সিডনী রবিবার, ১৯শে মে ২০২৪, ৪ঠা জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১


করোনাকালীন সময়ে এক প্রবাসীর সংগ্রামের গল্প

শিশিরের জল : নেহাল অর্ক 


প্রকাশিত:
১৯ আগস্ট ২০২০ ২৩:১০

আপডেট:
৩০ আগস্ট ২০২০ ২৩:২৬

 

সকাল হতেই স্কটল্যান্ডের আকাশ খানিকটা মেঘলা।ভারী বৃষ্টির কথা উড়িয়ে দেওয়া যায়না। প্রতিদিন বৃষ্টি এখানকার একটি বৈশিষ্ট্য।  এমনই এক মন খারাপের সকালে পাশে থাকা অয়নের মুঠোফোনে একটা কল এলো। অয়ন পাশের জানালায় প্যাজলি শহরের উঠোনকে দেখে নিজের দেশের ছড়িয়ে থাকা মায়ায় ডুব দিয়েছে কিছু সময়ের জন্য। মোবাইলটা হাতে নেওয়ার সাথে সাথেই অয়নের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ তাকিয়ে তাকিয়ে কী যেনো ভাবলো আর বললো, সব কিছুই সময়ের দাবির কাছে হার মানে।

সুবীর পিছন হতে কাঁধে হাত রেখে অয়নকে বলে, তোর মন কি খুব খারাপ,অয়ন? তুই সবসময় এতো হতাশায় থাকিস কেনো? অয়ন কোনো জবাব দেয়না। সুবীর আবার বলে,কী হবে এতো বেদনা আঁকড়ে রাখার প্রবণতা মনে পোষণ করে?

অয়ন কিছু সময় পর সুবীরের দিকে ফিরে তাকিয়ে বলে, ব্যথা বহন করার ক্ষমতা সবসময় একরকম হয়না। যেমন দ্যাখ্, মায়ের ব্যাথা বহন করার ক্ষমতা যতটা থাকে, স্ত্রী হিসেবে একই মেয়ের এই ক্ষমতাটুকু থাকেনা। সময়ের আবর্তনই একটি মেয়েকে দুইরকম করে দেয়। থাক্, ওসব কথা। চল্, এবার ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে যাবো। 

অয়ন আর সুবীর খুব ভালো বন্ধু। একই বাসায় দুজন মেস করে থাকে। ৩৭, আর্গাইল ষ্ট্রীট তাদর বাসা। প্যাজলি শহরে অল্প ভাড়ায় এর থেকে আর ভালো বাসা পাওয়া যায়না। একজন পাকিস্তানী ভদ্রলোক এই বাসার মালিক। অনেক কষ্টে তারা এই বাসাটি জোগাড় করতে পেরেছে। অয়নের মুখে সুবীর প্রায়ই শাম্মীর নাম শুনছে। শাম্মী অয়নের মামাতো বোন যদিও একজন ভালো বন্ধুও বটে। সকল সুখ - দুঃখ অয়ন তার সাথেই শেয়ার করে। শাম্মীর এখানে আসার কথা থাকলেও ভিসা জটিলতার কারণে আর হয়ে উঠেনি।

দুজনেই রাস্তায় হাটতে থাকে। শহরের উঠোন ঘিরে যে শৃংখলা বিরাজমান তার কথা বলতে বলতে এগিয়ে যাচ্ছে ক্যাম্পাসের দিকে। সুবীর ঠিক বুঝতে পারছেনা অয়নের কী হয়েছে! সুবীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

উঁচুনিচু ঢেউয়ের মতো রাস্তাগুলো;যেনো মনকে দুলিয়ে নিয়ে যায়। খানিকটা পথ হাঁটতেই অয়ন থমকে দাড়ায়। সামনে একটা ইন্ডিয়ান টেক ওয়ে দেখে চোখ আটকে যায় অয়নের।

--চল্ না সুবীর, এই টেক ওয়েতে একটু খোঁজ নিয়ে দেখি কোনো একটা কাজ যদি পাওয়া যায়।

অয়নের মলিন মুখের ওপর যেনো খানিকটা লাল সূর্যের আভা এসে ভীড় করে। এক চিলতে আশা যেনো নাড়িয়ে দিয়ে যায়।

টেক ওয়েতে গিয়ে খোঁজ নিতেই কর্মচারী একজন বললো মালিক নেই, আপনার মোবাইল নম্বর দিয়ে যান। মোবাইল নম্বর দিয়ে বের হয়ে দুজন হাঁটতে থাকে হাই ষ্ট্রীটের দিকে। প্যাজলি সেন্টারের কাছে এসে হাসির ছলে সুবীর অয়নকে বলে,

আজকাল শাম্মীর কথা একেবারেই তোর মুখে শোনা যায় না! তোদের মাঝে কোনো ঝামেলা হয়েছে নাকি?

অয়ন কিছুসময় নিরব থেকে বলে, না-এমন কিছু নয়! সবাই যেনো নিজের প্রয়োজন টাকে বড় করে দেখে। কেউ আসলে কাউকে বুঝতে গেলেই বিপত্তি বাঁধে। অয়নের কথা ঠিক মতো বুঝতে  পারে না সুবীর। তবে, কিছুটা ঝড়ে বিপর্যস্ত মনের বাগানে পানির ভাপ দরকার সেটা বোঝার বাকি নেই সুবীরের।

--আচছা সুবীর, খুব জানতে ইচ্ছে করে আমার নিকট আমি কতটা আপন! টাকার প্রয়োজন এতো মূখ্য হয়ে উঠলো কেনো ?  

সুবীর কোনো উত্তর দেয়না ; কেবলই ভাবে। আসলে টাকার জন্য নিজের  স্বপ্ন চুরমার করেছে কতোজন। নিগৃহীত জীবন বেঁচে নিয়ে দিনের পর দিন পরে থাকি আমরা প্রবাসে। এই বেদনা কেবল আমরাই বুঝতে পারি; যারা প্রিয়জনের মুখে হাসি ফুটিয়ে নিজের কান্নাকে ভুলিয়ে রাখে অবিরত।

কদিন যাবত অয়ন কাজে যায়না। সাব ওয়ের যে কাজটা ছিলো সেটাও চলে গেছে কিছুদিন হয়। ম্যানেজারের সাথে একটা মনঃস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব ক্রমেই নিরাসক্ত করছিলো অয়নকে। তাই হয়তো শাম্মীর ফোনালাপ নিয়ে এতো আর ব্যস্ত নয় অয়ন।

শাম্মী সুবীরের কাছে ফোন দিয়ে খোঁজ নেয় অয়নের। এসাইনমেন্ট ও লেখা শেষ হলোনা অয়নের। কেবল আহত পাখির মতো বসে থাকে। অয়ন প্রায়ই বলে, নিজের আদরের মানুষগুলোকে ছেড়ে বিদেশে থাকার কী যে যন্ত্রণা সেটা যদি দেশের আপনজনরা বোঝতো তাহলে হয়তো বিদেশে প্রিয়জনকে পাঠিয়ে কেউ এতো শান্তি পেতোনা।

আজ সন্ধ্যায় সুবীর একটি কাজ ঠিক করে দেয় অয়নকে। অয়ন যেনো হাতে আকাশ পায়। নিজের অজান্তেই মনের জানালায় খানিকটা সুখ উঁকি মারে। শাম্মীকে ফোনে নতুন কাজের কথা জানায়। খোশগল্পে মেতে উঠে দুজন, কেটে যায় অনেক সময়।

সুবীর ঘরে ফিরে এসে অয়নের হাসিমাখা মুখটা দেখে খুব আনন্দিত হয়। কতোদিন পরে রুমে এসে সুখের ঠিকানা খোঁজে পায় !  খেতে খেতে আগামীকাল কিভাবে নতুন কাজে যোগদান করবে এসব নিয়ে সুবীর ও অয়ন কথা বলতে বলতে কখন রাত গভীর হয় টেরই পায়নি কেউ ! 

পরদিন সকালে সুবীর অয়নকে কাজে পৌঁছে দিয়ে চলে যায় গ্লাসগো রোডে। একটি বাঙালি দোকানে সুবীর সপ্তাহে দুদিন কাজ করে। বেশিরভাগ এশিয়ার মানুষগুলো খাবারের দোকানে কাজ করে। সুবীর কাজ শেষে ঘরে ফিরে এসে দেখে রুম তালাবদ্ধ।

যথারীতি রুমে ঢুকে একটু ফ্রেশ হয়ে নেয়। অয়ন তখনো ঘরে ফিরে আসেনি। সুবীর অপেক্ষা করতে থাকে। মনের মাঝে খানিকটা বিচলিত বোধ করে। শত সহস্র প্রশ্ন তাকে ঘিরে রাখে পাহারাদারের মতো। কোনো উত্তর পায়না। 

বেশ কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর সুবীর বাসা থেকে বের হয়ে সোজা ইউনিভার্সিটির হাবে আসে। বাইরে তুষারপাত হচ্ছে। এইসময়ে প্যাজলির রাস্তাগুলো যেনো লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকে। ভীষণ চমৎকার লাগে দেখতে। ভারী তুষারপাত গাড়ির চাকাগুলো আটকে দেয় মাঝপথে। এখানকার লোকজন আগেই আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানতে পারে, যার ফলে তারাও বেশ সতর্ক অবস্থানে থাকে। 

সুবীর দেখে অয়ন হাবের একটি চেয়ারে বসে আছে। অন্ধকার  যেনো হাবের সমস্ত আলোর কোলাহল কে বন্দী করে বেঁধে রেখেছে এই একটি টেবিলে। ধীরে ধীরে সুবীর অয়নের নিকট এসে মুখোমুখি বসে। কী বলবে কিছু বুঝে উঠতে পারছে না সুবীর! 

কেমন কাটলো আজ প্রথম দিন ? কথাটা সুবীর অয়নের নিকট জানতে চায়। 

অয়ন বলে, আমাকে আর  কাজে না যাওয়ার জন্য বলেছে। সুবীরের মনটাও বেশ খারাপ হয়ে যায়। বিদেশে এভাবেই কাজের জন্য প্রতিদিন সংগ্রাম করতে হয়। হায়রে টাকা!  সুবীর মনে মনে বলে যদি আপনজনেরা এই কষ্ট দেখতো তাহলে দেশে  তাদের এতো বিলাসিতা প্রতিদিনের জীবনে স্থান পেতো না। সুবীরের কাছে আর কোনো মায়া নেই যা দিয়ে অয়নকে সান্ত্বনা দেওয়া যায়। কিছু সময় একান্তে কাটাতে দুজন ম্যাকগিল বাসে চড়ে বসে। বাস চলতে থাকে গ্লাসগোর দিকে। রাস্তার দুপাশে সারি সারি ঘরবাড়ি, সামনে বাগান বিলাসী গাছ দ্বারা পরিবেষ্টিত। বাসের জানালার কালচে কাঁচে ভেসে উঠে শাম্মীর মুখ।

অয়ন মনে মনে ভাবে,এভাবে অচেনা মানুষের ভিড়ে একটা মুখের প্রতিচ্ছবি খোঁজে দেখার জন্যই বোধহয় ছুটে চলা। 

বাসটি চলতে থাকে গ্লাসগোর উদ্দেশ্যে। অয়ন আর সুবীর বাহিরের দিকে চেয়ে থাকে অপেক্ষাকে আঁকড়ে ধরে। হয়তো সুদিন আবার আসবে। হয়তো সময়ের সাথে হাটতেই টাকার প্রয়োজন এতোটা প্রকট মনে হয় মানুষের কাছে।। তাইতো  জীবন এভাবেই গতির আবর্তে সময়ের প্রয়োজন মেটাতে ব্যস্ত হয়ে উঠে। গাড়ি থেকে নামতে নামতে অয়ন ভাবে,আমার জীবনেও বোধহয়  এভাবেই  শিশিরের জলের  মতো করে সুখ - দুঃখ নেমে আসে রাতের পথ বেয়ে।

 

নেহাল অর্ক
কবি, হবিগঞ্জ

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top