সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০


পুরনো বন্ধুত্বের নবায়ন : শায়লা সুলতানা


প্রকাশিত:
৩১ অক্টোবর ২০২০ ২১:৪১

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ১৭:৫৮

 

অফিসের বার্ষিক ডায়েরি ছাপানোর দায়িত্বটা পড়েছে আমার কাঁধেই। প্রেসে বসে কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছিলাম মিলন ভাইকে। তিনি চায়ের অর্ডার দিলেন। পয়তাল্লিশোর্ধ আজম ভাই এলেন দুই কাপ আদা চা নিয়ে। মিলন ভাইয়ের সম্বোধন থেকেই নামটা জানতে পারলাম। চা টা খেয়ে অন্যরকম একটা স্বাদ পেলাম । যেন অনেক চেনা এমন ভঙ্গিতে বললাম, ‘ধন্যবাদ আজম ভাই।’

কাজ শেষ করে হাঁটতে হাঁটতে আগাচ্ছিলাম। পাশ থেকে কেউ একজন আমার নাম ধরে ডাকলো।

প্রথমে বুঝতে পারিনি এখানে আমার নাম ধরে কে ডাকবে। দ্বিতীয় বার ডাক শুনে তাকিয়ে দেখি চায়ের দোকানদার আজম ভাই ডাকছে। তার দিকে এগিয়ে যেতেই অনুরোধের সুরে বলল, ‘আরেক কাপ চা খান।’

বললাম, ‘চা তো খেলাম, আবার কেন?’

বলল, ‘আমি আপনেরে এক কাপ চা খাওয়াই।’

বোধকরি একটু বিরক্তই হলাম। কিন্তু উপেক্ষাও করতে পারলাম না। বসে পড়লাম তার চা স্টলের বেঞ্চিটাতে।

চা এগিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘আপনে আমারে চেনেন নাই কিন্তু আমি আপনেরে ঠিকই চিনছি। স্কুল জীবনে আপনের ক্লাসমেট ছিলাম।’

এবার ভালো করে তাকিয়ে লম্বা দাড়ির ভেতরে স্কুল জীবনের শুধু ক্লাসমেট বললে ভুল হবে, আমার খুব কাছের একজন বন্ধু আজমকে আবিষ্কার করলাম।

বললাম, ‘তা তখন কিছু বললা না যে?’

‘বললাম না লজ্জায়। মিলন ভাইয়ের সামনে নিজেরে আপনের বন্ধু বইলা পরিচয় দিতে লজ্জা পাইলাম।’

‘কিন্তু তুমি আমাকে চিনেও এভাবে আপনি আপনি করছ কেন?’

‘আপনে বড় অফিসার আর আমি সামান্য চায়ের দোকানদার। মানুষে শুনলে আপনে লজ্জা পাইবেন। আপনেরে ছোট করতে চাই না মানুষের সামনে।’

‘না, আজম তুমি এখন থেকে আমার নাম ধরেই ডাকবা আর তুমি সম্বোধন করবা।’

‘আইচ্ছা চ্যাষ্টা করব।’

এতক্ষণ স্টলে অন্য কোনো লোক ছিল না। সেজন্য আমরা স্বচ্ছন্দে কথা বলছিলাম। হঠাৎই ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া ছেলেমেয়ের এক জুটি এসে বলল, ‘মামা, চা দাও।’

আমাদের গল্পে ছেদ পড়ল। ইচ্ছে হচ্ছিল আরো অনেক কিছু শুনতে, অনেক কিছু বলতে। কিন্তু আজমের চায়ের এত চাহিদা যে জায়গাটা ফাঁকা থাকেনা বললেই চলে।

‘আজম, আজ তাহলে যাই। আরেকদিন আসব।’

‘যাইবেন?’ বলেই আমার দিকে তাকিয়েই আবার সসংকোচে ও সলজ্জে আস্তে করে বলল, ‘যাইবা? আইচ্ছা। আবার কবে আসবা?’

বললাম, ‘খুব তাড়াতাড়িই আসব।’

এরই মধ্যে স্টলে আরো লোকজন চলে এসেছে। তাদের সকলের চোখে বিস্ময়ের দৃষ্টি মেখে সেদিন আজমের কাছ থেকে বিদায় নিলাম।

বাসায় ফিরে আজমকে মাথা থেকে সরাতে পারছিলাম না। নানা প্রশ্ন ভিড় করছিল মনের ভেতর। ও তো মোটামুটি ভাল ছাত্রই ছিল। তবে কেন ওর অবস্থান এখানে? ম্যাট্রিকটা কী পাশ করেছিল? সত্যি ওকে এই জায়গায় মানতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল।

-

 

মিলা আমার আগেই অফিস থেকে ফিরেছে। অন্যদিনের মত ওর সাথে খুনসুটি হলো না। তবে খাবার টেবিলে বসে আজমের ব্যাপারটা শেয়ার করলাম। আমাকে অস্থির দেখে ও বলল, ‘আরেকদিন গিয়ে গল্প করে এসো।’

পরের দু' তিন দিন আর সময় হয়ে উঠল না। ডায়েরির ব্যাপারে ফোনেই কথা হয়েছে মিলন ভাইয়ের সাথে। একদিন হাতে সময় নিয়ে বের হলাম। প্রেসে খোঁজ নিয়ে যাবো আজমের ওখানে। গিয়ে দেখি দোকানে বেশ ভিড়। আমাকে দেখেই ওর মুখটা চকচক করে উঠল। আমাকে বসতে দেবার জায়গা খুঁজছিল। ওর ইতস্তততা দেখে বেঞ্চির এক কোণায় বসে পড়লাম। দ্রুত সবাইকে চা দিয়ে তাদের বিদায় করার চেষ্টা করছে কিন্তু একদিক থেকে বিদায় হচ্ছে আরেকদিক থেকে নতুন নতুন লোক এসে হাজির হচ্ছে।

প্রায় ঘন্টাখানেক পরে আর কাউকে সুযোগ না দিয়ে দোকান বন্ধ করে দিয়ে বলল, ‘তুমি যদি কিছু মনে না কর, একটু দূরে কোথাও বইসা তোমার সাথে কথা কইতাম।’

আমি বললাম, ‘এত কাস্টমার ঠেলে দোকান বন্ধ করে দিলে, তোমারতো অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে।’

ও বলল, ‘জীবনের সব দিন এক রকম হওয়া লাগবো এমন তো কোনো কথা নাই।’

‘বুজছ মামুন, সেই যে ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর তোমার আব্বার বদলির কারণে তোমরা চইলা গেলা তারপরে তোমারে অনেক মনে করছি কিন্তু আর কুনোদিন দেখা হয় নাই।’

‘তোমার ম্যাট্রিকের রেজাল্ট কী ছিল আজম?’

‘সেকেন্ড ডিভিশন পাইছিলাম। তুমিতো ফার্স্ট ডিভিশন পাইছিলা।’

‘তুমি কলেজে ভর্তি হইছিলানা?’

‘না রে ভাই। পরীক্ষার পরপর একদিন কী হইলো জানো? আমি নদীতে গোসল করার জন্যে গামছা কান্দে নিয়া কেবলই বাড়ির বাইর বাড়ি থেকে নামছি, দেখি আব্বা কপাল থাপড়াইতে থাপড়াইতে পুকুর পাড় দিয়া আসতাছে আর বিলাপ বিলাপ করতে করতে কইতাছে, ‘আমার এতবড় সর্বনাশ ক্যারায় করলো। কেমনে করলো । আমিতো কেরোর ক্ষতি করি নাই।’ পনেরো/বিশ দিন পরে নদীর পাড়ের ওই বড় খ্যাতের দান কাটনের সময় অইয়া যাইবো। হেই খ্যাতে ক্যারা জানি মই দিয়া দানেরে মাটির সাতে মিশাইয়া থুইছে। আমি তাড়াতাড়ি আব্বারে ধরতে ধরতেই অজ্ঞান হইয়া মাটিতে পইড়া গেল। সেই যে অজ্ঞান হইলো । ওই অবস্থায় নয় দিন থাকার পর সবাইরে ছাইড়া দুনিয়া থিকা চইলা গেল।’

আজমের কাছে সেই স্মৃতি এত জীবন্ত যে ওর বলার ভঙ্গিতে ঘটনা শুনে মনে হচ্ছিল কয়েকদিন আগের ঘটনা শুনছি ওর মুখে অথচ এর মধ্যে কেটে গিয়েছে দীর্ঘ পঁচিশ বছর। ওকে চুপচাপ দেখে বললাম,

‘পড়াশুনাটা কেন চালিয়ে গেলেনা?’

‘খাতা কলমের বদলে কান্দে তুইলা নিলাম লাঙ্গল সাথে মা আর ছোট চাইর বোইনের সব দায়িত্ব।’

‘তো তোমাদের জমিতে কারা মই দিছিল তা আর জানতে পার নাই?’

‘ওই চির শত্রুরা কী আর ওইখানেই থামছিল? অরা আছিল আমার আব্বার জন্মের শত্রু। আব্বার তো কোনো ভাই আছিল না। দাদা মারা যাওয়ার পর থিকা চাচতো ভাইয়েরা তার পিছনে লাইগাই আছিল। শেষ পর্যন্ত লোকটারে অরা বাঁচতেই দিলো না।’

‘তুমি পরে কোনো মামলা টামলাও কর নাই?’

‘না, আমি আসলে এত কিছু বুঝতামই না। আর কয়েক বছরের মধ্যে বেশির ভাগ জমি নদী ভাঙ্গনে হারাইলাম। বাকি যা ছিল অগো কাছ থিকা রক্ষা করতে পারলামনা। দুইটা জমি বিক্রি করতে পারছিলাম। সেই টাকা সম্বল কইরা এক চিলতা জমি কিনা মা-বোইনগো নিয়া এই শহর থিকা আধা ঘন্টার পথ হইব জিগাপাড়া। সেইখানে আইসা ছাপড়া তুইলা থাকতে শুরু করলাম। আর এই চায়ের দোকানডা দিলাম।’

বুঝতে পারছিলাম, আজমের পঁচিশ বছরের সংগ্রামের ইতিহাস এমন করে কারো কাছে বলার সুযোগ পায়নি। সেজন্যই হয়তো আমাকে পেয়ে এতটা প্রগলভ হয়ে উঠেছে। আমিও কৌতূহলভরে একমনে শুনছিলাম ওর কথাগুলো।

বললাম, ‘তোমার ছেলেমেয়ে কয়জন? কী করে তারা?’

ও আবার বলতে শুরু করলো, ‘বোইনেগো বিয়া দিয়া নিজে বিয়াশাদি করতেও অনেক দেরি হইয়া গেল। তাও একটা শান্তি কী জান, তোমাগো দোয়ায় খুব ভালো একটা বউ পাইছি। ভালো ভালো শাড়ি গয়না, ভালো ভালো খাওন দিবার পারি না এইজন্য কোনো নালিশ নাই। যা আছে তাই নিয়াই খুশি। আর কিছু না থাক শান্তিডা তাই আছে। দিনশেষে যহন বাড়ি যাই মাইয়া দুইডা আব্বু আব্বু কইরা আইসা জড়াইয়া ধরে, পিছে পিছে অগো মা আইগিয়া আসে, বিশ্বাস কর আমি সব কষ্ট ভুইলা যাই।’

অর্থহীন, বিত্তহীন একটি ছাপড়া ঘরে আধঘোমটার ফাঁকে সুখী সহাস্য গৃহবধূ আর খলখলে চঞ্চল দু'টি মেয়ের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ আজমের প্রশান্ত চেহারার একটি শৈল্পিক রঙিন ছবি ভেসে উঠে আমার চোখের সামনে।

পাশাপাশি সৌখিন আসবাব, রুচিশীল শোপিসে সজ্জিত টিপটপ ঘর, দু'জনের পছন্দের নানারকম গাছে শোভিত বারান্দা। শেষ বিকেলে বারান্দার গাছপালাগুলোর মাঝে বসে আমাদের দু'জনে মিলে চা খাওয়ার সুখসময়ের দৃশ্যগুলোও চোখে ভাসে। কিন্তু সেখানে চৈত্রের খাঁ খাঁ রোদ্দুরে জনমানবহীন বিরানভূমির বিশাল শূন্যতায় আমরা দু'জনই বড্ড নিঃসঙ্গ বোধ করি।

আজমের জীবনে অর্থ আসেনি তবে স্থিতি ও শান্তি এসেছে। কিন্তু জন্মখোঁড়া সবার আদরের  ছোট বোনটিকে তেমন স্বচ্ছল ছেলের কাছে বিয়ে দিতে পারেনি, সেই কষ্ট তাকে যেন বারবার অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করায়।

‘মায় যদি আমার শান্তিডা দেইখা যাইতো আর ছোট বোইনডার অবস্থা একটু ভালো দেখতাম আমার আর কোনো দুঃখ থাকতো না। জান, এক মাস হইলো অর একটা ফুটফুটা মাইয়া হইছে। ও খালি আমারে কয়, ভাইজান তোমার দোকানে কতরকম মানুষ আহে, একজন ভালো মানুষ পাইলে আমার মাইয়াডারে দত্তক দিয়া দিও। তারা যত্ন কইরা পাইলা লেখাপড়া শিখাইয়া মাইয়াডারে অনেক বড় বানাইবো। মাইয়া আমার বড় চাকরি করবো, সুখে থাকবো।’

বলতে বলতে আজম হঠাৎ একটু লজ্জিত ও সচকিত হয়ে উঠে, ‘আইচ্ছা আমি যে নিজেরে নিয়া এত কথা বইলা ফালাইলাম, তোমার কথাতো কিছুই জানা হইল না। তোমার বউও নিশ্চয় বড় চাকরি করে?তোমার ছেলেমেয়ে কয়জন?’

বললাম, ‘হ্যাঁ, আমার স্ত্রী মিলা। ওর সাথে আমার খুব ভালো সমঝোতা। কিন্তু সন্তানের অভাবে আমাদের ঘরটা ফাঁকা। দুইজনেই চেষ্টা করি দুইজনকে সময় দিতে।’

আমার দীর্ঘশ্বাসের উষ্ণ বাতাসটা আজমের বুকের মধ্যে আগুনের হলকার মত গিয়ে লাগে। সকাতরে বলে উঠে, ‘আহহারে আমি তোমারে কষ্ট দিতে চাই নাই।’

শশব্যস্ত হয়ে বললাম, ‘না না কষ্ট কেন, বন্ধু হিসেবে তোমার সুখ-দুঃখের সাথে আমার কিছুটা অংশও না হয় যুক্ত হলো তোমার দিনপঞ্জির পাতায়।’

 

অন্য আরো অনেক দিনের মত একদিন পড়ন্ত বিকেলের সোনালি বেলায় মিলাকে নিয়ে রিক্সায় উঠেছি। শান্ত নিরিবিলি মেহগিনি গাছের সারি দেয়া পথ, সরিষা ফুলের হলুদে চোখ ভোলানো রূপ আর মন ভোলানো মিষ্টি গন্ধ গায়ে মাখতে মাখতে আমরা এগুতে থাকি। শুকনো কলাপাতায় ঘেরা একটি ছোট্ট বাড়ির সামনে রিক্সা থামে। আজম দাঁড়িয়ে আছে সেখানে।

রিক্সা থেকে নেমে বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই নিজের ভঙ্গিতে এগিয়ে আসে পঙ্গু আফজাল আর মেয়ে কোলে জন্মখোঁড়া মিতু।

আজমের কাছে সেদিন আমিই মিতুর মেয়েকে দত্তক নেবার প্রস্তাবটা দিয়েছিলাম। মিলাকে সারপ্রাইজ দেব বলে ওকে বলিনি কিছুই। কিন্তু সবকিছু শুনে মিলা বললো, ‘ছোট্ট সাজুকে আমরা মেয়ে হিসেবেই দেখবো। আজ থেকে ওর সব দায়িত্ব আমাদের। কিন্তু নিজের কোল পূর্ণ করার জন্য আরেকজন মায়ের কোল খালি করতে আমি পারব না। আমরা প্রতিদিন না হলেও দু'একদিন পরপর আসব ওর কাছে। কাটিয়ে যাবো সুন্দর কিছু সময়।’

মিতুর চোখ থেকে নেমে আসা অশ্রুর ফোয়ারায় তখন অস্তগামী সূর্যের চিকচিকে প্রতিফলন। মিলা তার কাঁধে হাত রাখতেই আবেগে আপ্লুত মিতু দীনতার সংকোচ কাটিয়ে মিলাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘আফা আপনের মত মানুষ দুনিয়াতে এহনো আছে দেইখাই দুনিয়াডা টিকা আছে। আল্লায় আপনের বালো করবো, আল্লায় আপনেরে শান্তি দিব।’

আমি মিতু আর মিলাকে দেখছিলাম। মাতৃত্বের কী অপূর্ব মায়া তাদের দু'জনের অবয়বে। প্রথম দেখার ক্ষণে মিলার যে পবিত্র স্নিগ্ধতায় মুগ্ধ হয়েছিলাম সেই মুগ্ধতার আবেশ নতুন করে জড়িয়ে দিল আমার জীবনকে, সেই আবেশ আলো ছড়িয়ে দিল আফজাল-মিতুর দীর্ণ আঙিনায়। আরেকবার শ্রদ্ধায় নত হলাম মিলার প্রতি।

পুরনো বন্ধুর সাথে তৈরি হল নতুন বন্ধন। আর এ বন্ধনকে অবিচ্ছেদ্য করে তুলল ছোট্ট সাজু। তার ডাগর চোখের মায়ায় আমাদের মন দু'টোকে বন্ধক রেখে সেদিন দু'জনে রিক্সায় উঠে বসলাম।

 

শায়লা সুলতানা
প্রভাষক, বাংলা বিভাগ
সরকারি শেখ ফজিলাতুন নেসা মুজিব মহিলা মহাবিদ্যালয়, টাঙ্গাইল।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top