সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০


মাতৃত্ব : সঙ্গীতা সোম


প্রকাশিত:
৩১ অক্টোবর ২০২০ ২১:৪৫

আপডেট:
৩১ অক্টোবর ২০২০ ২২:৩১

 

একঃ

তিনবাড়ি রান্নার কাজ সেরে এসে মিনতি পাশের বাড়ী বৌদিমনির দরজাটা কড়া নাড়তে গিয়ে একটু থমকালো। জানালাটার একচিলতে ফাঁক দিয়ে চোখে পড়লো ভিতরের দৃশ্যটা। ছোট্ট নীলু বৌদিমনির কোলের কাছে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। মিনতি না ডেকে চলে এসে তার দু কুঠরী ঘরের চাবিটা খুললো। তারপর গামছা আর সাবানটা নিয়ে চললো বোসপুকুরের জলে স্নানটা সেরে আসতে।

পুকুরের কুচকুচে কালো ঠান্ডা জলে গলা পর্যন্ত ডুবে মিনতির শুধু শরীরটা নয়, পিঠের কালশিটে দাগগুলোও যেন ঠান্ডা হয়ে আসছিলো। কতই বা বয়েস হলো ওর, তিরিশ বছর । এই বয়সেই শরীর মন সব যেন কালশিটের দাগে ভরে গেছে। সংসারের বোঝা বইতে বইতে এই বয়সেই বড্ড ক্লান্ত লাগে নিজের। সেই কোন তেরো বছর বয়সে বউ হয়ে এসে থেকে সংসার ঠেলছে। মনে হয় যেন তিরিশ নয় ষাট বছরের বুড়ি হয়ে গেল ও।

পড়াশোনা করার বড্ড ইচ্ছে ছিল ওর। কিন্তু গরিবের সংসার। মিনতির পরে আরও দুটো ভাই। বাপের সম্বল বলতে ছিল কাঠা দুয়েক জমি আর কয়েকটা ঘর যজমানী। তাই বিয়ের সম্বন্ধ আসা মাত্রই আর দেরী না করে বাবা তার বিয়ে দিয়ে বেড়াল পার করেছিল। শ্বশুর বাড়ি বলতে ছিল বর তারক আর এক বিধবা পিসী শাশুড়ি।


দুইঃ

সমীর মানুষটা বেশ ভালো। সাদামাটা ধরনের। মুদির দোকানটা বেশ ভালোই চলে। পৈত্রিক জমিও আছে অনেক খানি। সবে মিলে বেশ স্বচ্ছল অবস্থায় বলা যায়। বউটিও ভারী লক্ষীমন্ত। কিন্তু সমীর আর আরতির একটাই মনোকষ্ট। সন্তান নেই। ডাক্তার বদ্যি ঠাকুর দেবতা কিছুই বাদ যায়নি। কিন্তু লাভও কিছু হয়নি।

বিয়ে হয়ে আসার থেকেই মিনুর ভারী ভালো লাগে আরতি বৌদিকে। কখন যে আরতি তার বৌদিমনি হয়ে গেছে মিনু বোধহয় নিজেও টের পায়নি। আসলে একলাকার সংসারে পাশের বাড়ির বৌদিমনিকে তার বড্ড আপন মনে হয়।

মিনুর থেকে তারক বয়েসে বেশ খানিকটা বড়ই ছিল। মনের মিল ছিলনা বললেই চলে। তারউপর ছিল মাতাল। বিয়ের পর একটু আধটু খেলেও যা হয়, বদ সঙ্গে পরে দিনে দিনে মাতলামি বেড়েই যাচ্ছিল। সঙ্গে মিনুর বাড়তি পাওনা ছিল বাড়ি ফিরে তারকের মার। তারমধ্যেই এলো নীলু। নীলুর পিছুটান আর। বৌদিমনির ভালোবাসা টুকুই যেন মিনুকে আগলে রেখেছিল।

ভগবান যে কি করেন তা বোঝা সবসময় সাধারণ মানুষের ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে কুলোয় না। যে কটা ঘরে তারক যজমানি করতো মাতলামির চক্করে পরে তাও গেল। কিন্তু পেট যে বড়ো বালাই । সঙ্গে ওই টুকু শিশুর খাওয়ার দুধ টুকুও নাই। মিনুর দিশাহারা দশা। বৌদিমনি সাধ্যমতো সাহায্য করলেও দিনের দিন হাত পাততে মিনুর মাথাটা নেমে যেত।



বামুনের মেয়ে, তাই রান্নার কাজটা পেতে খুব একটা অসুবিধা হয় নি। কিন্তু ছোট্ট নীলুকে দেখবে কে। দুশ্চিন্তা গ্রাস করছিল মিনুকে।

"কিছু না মনে করলে নীলুকে আমায় দিয়ে যাস। ওর কোনো অসুবিধা আমি হতে দেব না, দেখিস। বুক দিয়ে আগলে রাখবো। "

বৌদিমনির কোলে নীলুকে দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকে মিনু। নীলুকে কোলে নিয়ে আরতি বৌদির চোখ গুলো জলে টলটল করে। নিঃসন্তান কোলটা ভরে ওঠে। বৌদিমনির চোখের জলটা মিনুর চোখ এড়ায় না। বৌদির কষ্টটা মিনু টের পায়।


তিনঃ

আজ সপ্তাহ তিনেক হলো মিনু বিধবা হয়েছে। বেলাগাম মদ্যপ জীবন তারককে রেহাই দেয় নি। মিনুর বাপের বাড়ি থেকে দুভাই এলেও নিয়ম রক্ষা কর্তব্যটুকু সেরেই ফিরে গেছে। বাপ মা বুড়ো হয়েছে। ভাইদের নিজেদেরই সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরোয় দশা। তাদের মা ছেলের বোঝা বইবে কে।

মিনু অবশ্য রোজ রাতে মারের হাত থেকে রেহাই পেয়েছে।

কাজ সেরে এসে নীলুকে আনতে গিয়ে দেখে বৌদিমনি র কোল ঘেঁষে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। আর বৌদিমনি একদৃষ্টে নীলুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

মিনু চুপচাপ সরে এলো। বৌদিমনি তাকে অগাধ ভালোবাসা দিয়েছে। তার বিনিময়ে নীলুর দেওয়া এইটুকু মাতৃত্বের আস্বাদ যদি আর একজনের জীবন কে ভালো রাখে তাতে ক্ষতি কি। নিজের অজান্তেই মিনুর চোখ দিয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল।

 


সঙ্গীতা সোম
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top