সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১


ভাস্কর্য বিরোধী আন্দোলনে সরকারের দূর্বল অবস্থান : মোহাম্মদ অংকন


প্রকাশিত:
২ ডিসেম্বর ২০২০ ২০:৩৭

আপডেট:
২৫ এপ্রিল ২০২৪ ০৬:০৮


বেশ কিছু দিন ধরে দেশে ভাস্কর্য বিরোধী আন্দোলনের নানান খবর রটছে। রটছে না শুধু, রীতিমত তুঘলকি কান্ড। ভাস্কর্যীনিয়ে কতিপয় ইসলামপন্থি নেতাদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্যের নজির মিলেছে। বিশেষ করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্যের প্রতি তাদের রাগ-ক্ষোভ তীব্রতর। চট্টগ্রামের হাটহাজারীর এক সম্মেলনে হেফাজতে ইসলামী বাংলাদেশের আমীর তাঁর বক্তব্যে এভাবেই বলেছেন- যেকোনো ভাস্কর্য তৈরি করা হলে তা টেনে-হিঁচড়ে নামিয়ে ফেলা হবে [সূত্র : বিবিসি]। মাওলানা মামুনুল হক নামের এক বক্তা প্রকাশ্যে বলেছেন- দেশের কোথাও বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ করতে দেওয়া হবে না [সূত্র : ইউটিউব]। তাদের এই ধরনের বক্তব্য হতে সুস্পষ্ট হয় যে তাদের রাগ-ক্ষোভ শুধু ভাস্কর্যের প্রতি নয়, বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিই প্রবল এবং নিশ্চয়ই কারণ আছে। শুধু ভাস্কর্য নিয়ে কথা বললে যে এদেশে কাজ হবে না তা তাদের জানা আছে। বাঙালির স্পর্শকাতর ইস্যুতে হাত না লাগালে কি আর চলে!

দেশের কতিপয় ইসলামপন্থি নেতাদের ভাস্কর্যবিরোধি নানান কর্মসূচি, আন্দোলন কিংবা এ নিয়ে হট্টগোল-গন্ডগোল প্রতিহতকরণে ক্ষমতাসীন সরকারের কোনো ভূমিকা আদৌ চোখে পড়েনি। একের পর এক ভাস্কর্য ইস্যুকে কেন্দ্র করে ইসলামের অপব্যাখ্যা দিয়ে ধর্মপ্রিয় মানুষের মাঝে বিদ্বেষ তৈরির চেষ্টা করছে তারা। শুধু তাই নয়- তাদের বক্তব্যে প্রতীয়মান হচ্ছে- মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, এদেশের আবহমানকালের শিল্প-সংস্কৃতি এবং ইতিহাস-ঐতিহ্যেরও বিরোধি তারা। নচেত এই একবিংশ শতাব্দিতে এসে, একটি আধুনিক সভ্যতায় এসে এমন প্রশ্নের উদয় হয় কিভাবে যে ভাস্কর্য নির্মাণ ও প্রর্দশন মূর্তিপূজার সমতূল্য? তারা কি জানে না- ভাস্কর্য আর মূর্তি এক জিনিস নয়।

ধর্ম হচ্ছে বিশ্বাসের বিষয়। সবাই বিশ্বাস করে ইহকালের পরে পরকাল আছে। আবার কেউ এর ব্যতিক্রম হতেই পারে। যার বিশ্বাসের জায়গা যেখানে, তার চিন্তাচেতনা সেখানে। এ নিয়ে বাড়াবাড়ির কোনো সুযোগ নেই। ইসলাম ধর্মে মূর্তিপূজার কোনো অস্তিস্ত্ব নেই, থাকতেও পারে না বলে আমি মুসলিম হয়ে বিশ্বাস করি। সনাচন ধর্মসহ বেশ কয়েকটি ধর্মে মূর্তিপূজাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এটি তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা। একজন মুসলমান হয়ে তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতাকে হরণ করার অধিকার কারও নেই। যেখানে এই রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক ভূখন্ড বলা হচ্ছে, সেখানে কে কোন ধর্ম কিভাবে পালন করল, তার বাছবিচার করার এখতিয়ার কারও নেই। কিন্তু অন্য ধর্মের বিষয়বস্তুকে ইস্যু করে মানে মূর্তিকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় অপব্যাখা দিয়ে ভাস্কর্যকে মূর্তি প্রমাণকরণস্বরূপ কীর্তমানদের ভাস্কর্য অপসারণের যে দাবি তোলা হয়েছে, তা ইচ্ছে প্রণোদিত ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত। এদের বিরুদ্ধে সরকারের আইনগত ব্যবস্থা নিতে না পারাটা চরম দূর্বলতার বহিঃপ্রকাশ।

সৌদি আরব, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, পাকিস্তানসহ বিশ্বের অনেক মুসলিম দেশেই ভাস্কর্য রয়েছে। সেসব দেখতে শত শত পর্যটকও আসছে। ইতিহাস-ঐতিহ্য ও প্রাচীন সভ্যতা সম্পর্কে জানছে। সেখানে বাংলাদেশে ভাস্কর্য হতে পারবে না কেন? এমন প্রশ্ন এখন সহজাত হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ব্যাখ্যায় কেউ কেউ হয়ত বলবে- সে সব দেশ ধর্মীয় অনুশাসন মানছে না। যদি তাই না মানে তবে এত দিন ধরে ভাস্কর্য চর্চার যে রীতিনীতি চলে আসছে তাতে কোনো সংঘাত, মতনৈক্য কিংবা বিরোধিতা দেখা গেল না কেন? প্রায় সব দেশেই বাকস্বাধীনতা রয়েছে। কোনো রাষ্ট্র যদি জনগণের হিতকর নয় এমন কিছু করে তবে তার বিরুদ্ধে বলার এবং করার স্বাধীনতা রয়েছে। ভাস্কর্য নিমার্ণ যদি ইসলাম ধর্মবিরোধি হত, তবে বিশ্বের কোথাও না কোথাও এ নিয়ে হট্টগোল লেগেই থাকত। অথচ এমন কোনো নজির নেই। দেশে দেশে ভাস্কর্য নির্মাণ ও প্রদর্শন হচ্ছে দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি চর্চায় ও রক্ষায়। প্রজন্মের পর প্রজন্মকে শেখাতে ও জানাতে; দেশের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, কীর্তমান, বীরদের আর্দশকে তুলে ধরতে ভাস্কর্য একটি উল্লেখযোগ্য মাধ্যম বলে মনে করি। এর বিরোধিতা করার মত দৃশ্যঃত কোনো বিষয় আছে বলে মনে করি না।

ভাস্কর্যকে কেন্দ্র করে কোথাও পূজা কিংবা উপাসনা হয়েছে বলে এমন কোনো তথ্য কেউ দিতে পারবে কি না আমার জানা নেই। এই ইস্যুকে জনগণের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে চাঙ্গা করছে কতিপয় ব্যক্তিবর্গ। ইসলাম যেখানে শান্তি ও সহাবস্থানের ধর্ম, সেখানে জাতিগত বিদ্বেষকে উস্কে দিচ্ছে তারা। এই বিদ্বেষকে বেগবান করতে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙ্গা ও নির্মাণে বাধা দেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। তারা এটি পরখ করতে চায় যে বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার এ নিয়ে কী ভাবছেন? সরকার যদি তাদের দাবি-দাওয়া মেনে নিয়ে দেশের সকল ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলেন এবং আর কোনো ভাস্কর্য নির্মাণ করা হবে না মর্মে ঘোষণা জারি করেন তবে কতিপয় বিপদগামি ইসলামপন্থিদের জয় হবে। এবং সরকার যে তাদের সিদ্ধান্তকে মেনে নিয়েছে এটি সরকারের চরম ব্যর্থতা বলে জাহির করবে এবং তাদের ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে ধর্মের নামে ব্যবসাকে সুপ্রসারিত করবে বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে। দেশে যখন মাদ্রাসায় শিশু বলাৎকারের শিকার হয়, নারীদের ধর্ষণ করা হয়, তখন তারা আন্দোলনে নামে না এই বলে যে ইসলাম ধর্মে কোনো ধর্ষক থাকতে পারে না। ধর্মীয় পোশাক পরে কত শত মানুষ সুদ নিচ্ছে-দিচ্ছে, অপকর্ম করছে, সেসব বন্ধে কোনো উদ্যোগ দেখি না।

ভাস্কর্য ইস্যুতে হাতেগোনা কিছু মন্ত্রী, নেতানেত্রী (যারা জাতীয় ইস্যুতে কথা বলে থাকেন নিয়মিত) ব্যতিত তেমন কোনো গ্রহণযোগ্য সূত্র থেকে জোরালো কোনো বক্তব্যের আভাস মেলেনি। এটি অবশ্যই অনাকাক্সিক্ষত। ভাস্কর্য নিয়ে সরকার কী ভাবছে না ভাবছে তা সুস্পষ্ট করা জরুরি এই কারণে যে ইতোমধ্যে সাধারণ জনগণের মধ্যে মিশ্রপ্রতিক্রিয়া লক্ষণীয়। সাধারণ জনগণ যতটা না ধর্ম পালন করে, ততটা তারা ধর্মভীরু। ধর্মীয় রাজনীতির স্বার্থে ভাস্কর্য নিয়ে জনগণকে যে ব্যাখা বোঝানো হচ্ছে, তা সহজে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে সাধারণ জনগণ। তাই সাধারণ জনগণকে বিভ্রান্তিমুক্ত করতে হলেও সরকারের অবস্থান সুস্পষ্টকরণ জরুরি বলে মনে করি। ধর্মকে হাতিয়ার করে তারা বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন কিংবা ইতিহাস-ঐতিহ্যকে ‘যাচ্ছেতাই’ করছে; এর প্রতিকার করার কি কোনো সক্ষমতা সরকারের নেই? না কি তাদের দাবিকে মেনে নিতে সরকার প্রস্তুত?

দেশে আর কোনো ভাস্কর্য নিমার্ণ হতে পারবে না কিংবা সকল ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলতে হবে- এমন দাবি কার্যকর হলে দেশের অবস্থা রাতারাতি রণক্ষেত্রে পরিণত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা যাচ্ছে। সকল ভাস্কর্য ভাঙ্গা হবে তো বটেই যারা এই ভাস্কর্যশিল্পকে লালন করে, এটি নিয়ে জীবন-জীবিকা করে তারা গণহত্যার শিকার হতে পারে যাতে পরবর্তীতে আর ভাস্কর্য নির্মাণের সুযোগ তৈরি না হয়। প্রতিটি ধর্মেই মানুষ হত্যাকে নিষিদ্ধ বলা হলেও যেকোনো ধর্মের ধর্মীয় উগ্রপন্থিরা মানুষ হত্যা করতে একটুও দ্বিধা করে না, ভেবেও দেখে না। ধর্মীয় অপব্যাখা যে কতটা মারাত্মক ও ভয়ানক তা বিভিন্ন সময় সংঘটিত ধর্মজনিত সংঘাত থেকে উপলব্ধি করা যায়। এ দেশে প্রায়ই এ জাতীয় ঘটনা ঘটছে। শুধু তাই নয়, প্রকাশ্যে মানুষ হত্যা করে ট্যাগ লাগানো হচ্ছে যে মৃতমানুষটি ধর্ম নিয়ে অবমাননা করেছিল বলেই এই শাস্তি তাকে পেতে হল এবং এটি সৃষ্টিকর্তার হুকুম।

বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আমার উদাত্ত আহ্বান, দ্রুত সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করুন। ভাস্কর্য নিয়ে সরকারের কী চিন্তা-চেতনা তা দ্রুত প্রকাশ করুন। নচেত ভাস্কর্য ইস্যুকে কেন্দ্র করে দেশে ধর্মীয় সংঘাত ক্রমশ বেড়ে যাবে। দেশে অপ্রীতিকর ঘটনা যেকোনো মুহূর্তে বেড়ে যেতে পারে। এসব নির্মূলে সরকারের অবস্থানকে কঠোরকরণপূর্বক ভাস্কর্য নিয়ে ধর্মীয় অপব্যাখাকারীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। আমি আশ্চর্য হই- মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সরকার ক্ষমতায় থাকতেও  ধর্মীয় লেবাসধারী একদল ধর্মব্যবসায়ী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ভাঙ্গার হুমকি দেয়, স্থাপনে বাধা দেওয়ার জন্য আন্দোলনে নামে, তাকে নিয়ে কটাক্ষ করে, তবুও তাদের গ্রেপ্তার করা হয় না। এই ধরনের নিরবতা, কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ার অভিপ্রায় থেকে বার বার মনে হচ্ছে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের কাছে সরকারের অবস্থান ক্রমশ দূর্বল হচ্ছে। আজ যারা ভাস্কর্যকে ধর্মের কাটা বানিয়ে মাঠে নেমেছে, কাল তারা দেশকে একক ধর্ম তথা সাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে অন্যদের ধর্ম পালনে বাধা সৃষ্টি করবে না বা দেশ থেকে বিতারিত করবে না, তার কি কোনো গ্যারান্টি আছে? সরকারের এ বিষয়ে আগাম সাবধানতা অবলম্বন করা জরুরি।



মোহাম্মদ অংকন
তরুণ লেখক, ঢাকা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top