সিডনী শনিবার, ৪ঠা মে ২০২৪, ২১শে বৈশাখ ১৪৩১


জান্নাতে প্রথম সৌভাগ্যবান প্রবেশকারী


প্রকাশিত:
২৪ এপ্রিল ২০২০ ২৩:২৩

আপডেট:
৪ মে ২০২৪ ১৩:১৯

 

প্রভাত ফেরী: জান্নাত হবে অসীম ঐশ্বর্য ও অফুরন্ত নেয়ামতে ভরপুর অনাবিল এক জগত। মানুষ ও জিন জাতি পার্থিব জীবনের পুণ্যকর্মের পুরষ্কার হিসেবে প্রবেশ করবে পরম সুখ-শান্তি এবং ভোগ-বিলাসের অকল্পনীয় জগত জান্নাতে। প্রত্যাশিত নয়নাভিরাম জান্নাতে সর্বপ্রথম কে ও কারা প্রবেশ করবেন- এ কৌতূহল সব মুমিনের। অপার্থিব সে অবস্থার কিছু বর্ণনা নিম্নে করা হলো।

জান্নাতে প্রথম প্রবেশকারী : হাশরের মাঠ থেকে পুরসিরাতের ভয়ংকর পুল পার হয়ে জান্নাতের প্রবেশদ্বারে সর্বপ্রথম প্রিয়নবী (সা.) উপস্থিত হবেন এবং তিনিই জান্নাতের কড়ায় টোকা দিবেন। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কেয়ামতের দিন আমি জান্নাতের দরজায় দিয়ে দরজা খোলার অনুমতি চাইলে জান্নাতের রক্ষক বলবে, কে আপনি? আমি বলব, মুহাম্মদ! তিনি বলবেন, হ্যাঁ, আপনার ব্যাপারে আমাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যেন আপনার আগে কারো জন্য জান্নাতের দরজা না খুলি।’ (মুসলিম, হাদিস : ১৯৮)

উম্মতের মধ্যে প্রথম প্রবেশকারী : প্রিয়নবীর মাধ্যমে জান্নাতের প্রধান ফটক খোলার পর সর্বপ্রথম উম্মতে মুহাম্মদি প্রবেশ করবে। হজরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘আমরা সর্বশেষ উম্মত, কিন্তু কেয়ামতের দিন জান্নাতে প্রবেশের ক্ষেত্রে থাকবো সবার অগ্রবর্তী দলে। যদিও তাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে আমাদের আগে এবং আমাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তাদের পরে।’ (মুসলিম, হাদিস : ৮৫৫)। উম্মতে মুহাম্মদির মধ্যে সর্বপ্রথম জান্নাতে প্রবেশের সৌভাগ্য লাভ করবেন আবু বকর (রা.)। তার পর আমল ও মর্যাদার পরিমাণ অনুযায়ী অন্যান্যরা প্রবেশ করবেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘জিবরাইল এসে আমার হাত ধরে জান্নাতের দরজা দেখালেন, যে দরজা দিয়ে আমার উম্মত জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ তখন আবু বকর (রা.) বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল, আমিও আপনার সঙ্গে থাকব, যেন জান্নাতের দরজা দেখতে পারি।’ তখন রাসুল (সা.) বলেন, ‘হে আবু বকর, শুনে রাখো, আমার উম্মতের মধ্যে সর্বপ্রথম তুমি জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৬৫২)

সর্বপ্রথম প্রবেশকারী দল : সর্বপ্রথম যে দলটি জান্নাতে প্রবেশ করবে দুনিয়ায় তাদের অবস্থা সম্পর্কে রাসুল (সা.) জানিয়ে দিয়েছেন। হজরত আবদুল্লাহ বিন আমর বিন আস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা কি জানো, আল্লাহর সৃষ্টিকুলের মধ্যে সর্বপ্রথম জান্নাতে কারা প্রবেশ করবে?’ তখন সাহাবায়ে কেরাম বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল ভালো জানেন। তখন নবীজি (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর সৃষ্টিকুলের মধ্যে সর্বপ্রথম জান্নাতে প্রবেশ করবে দরিদ্র মুহাজিররা। যাদের মাধ্যমে সীমান্তের প্রহরা নিশ্চিত করা হয়। তাদের মাধ্যমে যেকোনো বিপদ-আপদ দূর করা হয়। এমনভাবে তাদের মৃত্যু হয় যে আশা-আকাঙ্খাগুলো তাদের অন্তরের ভেতরেই রয়ে যায়। তারা তা পূরণ করতে পারে না। আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদের বলবেন, তাদের কাছে যাও, তাদের সালাম প্রদান করো। ফেরেশতারা বলবে, ‘হে আমাদের রব, আমরা তো আপনার আসমানের বাসিন্দা, আপনার সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীবন। আপনি আমাদের বলছেন, তাদের কাছে গিয়ে সালাম প্রদান করি?’ আল্লাহ বলবেন, ‘তারা আমার বান্দা, আমার ইবাদত করেছে, আমার সঙ্গে কাউকে শরিক করেনি। তাদের এমন অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে যে তাদের প্রয়োজনের কথা তার মনে রয়ে গেছে। তা আর পূরণের সামর্থ্য হয়নি।’ অতঃপর ফেরেশতারা তাদের কাছে যাবে। সব দরজা দিয়ে প্রবেশ করে তাদের সালাম জানাবে। বলবে, ‘ধৈর্য ধারণের ফল হিসেবে তোমাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক, তোমাদের শেষ নিবাস কতই না উত্তম!’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ৬৫৭০)

ধনীদের আগে দরিদ্রদের জান্নাতে প্রবেশ : বিভিন্ন হাদিসে দরিদ্র মুহাজিরদের ধনীদের ৪০ বছর আগে জান্নাতে প্রবেশের কথাও বর্ণিত হয়েছে। হজরত আবদুল্লাহ বিন আমর (রা.) বলেন, একদিন আমি মসজিদে বসা ছিলাম। দরিদ্র মুহাজিরদের একটি দলও মসজিদে বসা ছিলেন। এমন সময় রাসুল (সা.) এসে তাঁদের কাছে বসে বললেন, ‘দরিদ্র মুহাজিররা সুসংবাদ গ্রহণ করুন! তাঁদের চেহারা উজ্জ্বল হোক। কারণ তাঁরা ধনীদের ৪০ বছর আগে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আমি দেখলাম, তাঁদের রং পরিবর্তন হয়ে উজ্জ্বল হয়ে গেল। আমারও আশা জাগল, আমি যদি তাঁদের মাঝে হতাম!’ (দারেমি, হাদিস : ২৭২১)।

অন্য হাদিসে পাঁচশো বছর আগে জান্নাতে প্রবেশের কথা এসেছে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘দরিদ্রগণ ধনীদের পাঁচশ বছর পূর্বেই জান্নাতে প্রবেশ করবে। এই পাঁচশ বছর হচ্ছে আখেরাতের এক দিনের অর্ধেক।’ সুনানে তিরমিজির অন্য একটি বর্ণনায় আছে, ‘দরিদ্র মুসলমানগণ ধনী মুসলমানদের অর্ধেক দিন পূর্বেই জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর এই অর্ধেকদিন হচ্ছে দুনিয়ার পাঁচশ বছরের সমান।’ (তিরিমিজি, হাদিস : ২৩৫৩-২৩৫৪)।

এসব হাদিসের মাঝে সমন্বয় করে হাদিস বিশারদগণ  বলেছেন, ‘আসলে আখেরাতের এক দিন হবে দুনিয়ার এক হাজার দিনের সমান। তাই কোনো হাদিসে ‘অর্ধ দিন’ ও কোনো হাদিসে ‘পাঁচশ বছর’ বলা হয়েছে। আখেরাতের বিবেচনায় যা অর্ধদিন, আমাদের পৃথিবীর হিসেবে সেটাই পাঁচশো বছর। আসলে আমলের তারতম্যের কারণে কেউ আগে ও কেউ পরে জান্নাতে প্রবেশ করবে। যেমন মুমিন গুনাহগার বান্দারা তাদের পাপের পরিমাণ অনুযায়ী কিছুকাল জাহান্নামে থাকবে। পুলসিরাত অতিক্রম করতেও আমলের তারতম্য অনুযায়ী সময় আগপিছ হবে। দরিদ্রগণ যারা আগে জান্নাতে যাবেন। তাদের মর্যাদা পরে জান্নাতে প্রবেশকারীদের চেয়ে বেশি হওয়া অত্যাবশ্যকীয় নয়। বরং অনেক ক্ষেত্রে যারা পরে জান্নাতে যাবে তাদের মর্যাদা আগে প্রবেশকারীদের চেয়ে বেশি হতে পারে। ধনীদের সম্পদের হিসাব দেয়ার পরে যখন দেখা যাবে যে, তারা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেছে, বিভিন্ন সৎকর্ম, কল্যাণকর কাজ, দান সদকা ও ভালো কাজের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করেছে; তারা আগে জান্নাতে প্রবেশকারী দরিদ্র লোক, যাদের এসব আমল নেই, তাদের চেয়ে বেশি মর্যাদা লাভ করবে। বিশেষ করে ধনী যখন দরিদ্র লোকের মতো অন্যান্য আমলও করেছে ও সম্পদের দ্বারা আরো  বেশি আমল করেছে, তখন তাদের মর্যাদা অনেক বেশি হবে; যদিও তারা অনেক পরে জান্নাতে প্রবেশ করেছেন। আল্লাহ তো কারো আমল নষ্ট করবেন না! অতঃএব, এখানে দুটি বৈশিষ্ট্য, একটা হলো আগে জান্নাতে প্রবেশ, অন্যটি হলো উঁচু মর্যাদা লাভ। কখনও কখনও এ দুটি গুণ এক সাথে পাওয়া যেতে পারে আবার কখনও কখনও আলাদাভাবেও পাওয়া যেতে পারে। ফলে কেউ আগেভাগেই উচ্চ মর্যাদা নিয়ে জান্নাতে যেতে পারে। আবার কারও অগ্রভাগে জান্নাতে প্রবেশ করার সৌভাগ্য হতে পারে তবে উচ্চ মর্যাদা নাও হতে পারে। আবার কেউ উপরোক্ত দুটি গুণের কারণে পরে জান্নাতে গিয়েও উঁচু মর্যাদাবান হতে পারেন। আল্লাহ আমাদেরকে জান্নাতে যাওয়ার তাওফিক দান করুন।’ (হাদিউল আরওয়াহ, পৃষ্ঠা : ১৩৪)

সর্বপ্রথম প্রবেশকারীদের অবস্থা : সর্বপ্রথম জান্নাতে প্রবেশকারীদের অবস্থা কেমন হবে তারও বর্ণনা রাসুল (সা.) আমাদের জানিয়েছেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘সর্বপ্রথম যে দল জান্নাতে প্রবেশ করবে তারা পূর্ণিমার চাঁদের মতো উজ্জ্বল বর্ণের হবে। তার পরের দলটি হবে আকাশের সবচেয়ে বেশি আলোসম্পন্ন তারকার মতো। তাদের মুখে থুথু হবে না। প্রস্রাব-পায়খানা হবে না। সেখানে তাদের পাত্রগুলো হবে স্বর্ণের। চিরুনি হবে স্বর্ণ ও রুপার তৈরি। তাদের ঘাম হবে মেশকের মতো সুঘ্রাণময়। তাদের সবার সঙ্গে দুজন করে স্ত্রী থাকবে। অতিশয় লাবণ্যময় হওয়ায় মাংসের ওপর থেকে তাদের হাড়ের মগজ দেখা যাবে। তাদের মধ্যে কোনো বিরোধ ও বিদ্বেষ থাকবে না। সবার অন্তর একজন ব্যক্তির অন্তরের মতো হবে। সবাই সকাল-সন্ধ্যা আল্লাহর তাসবিহ পাঠ করতে থাকবে।’ (মুসলিম, হাদিস : ২৮৩৪)

জান্নাতে প্রবেশের দৃশ্য অভ্যর্থনা : আমাদের প্রিয় নবীজি জান্নাতের ফটক খোলার পর আমলের তারতম্য ও মর্যাদা অনুপাতে কেউ আগে ও কেউ পরে দলে দলে বিভক্ত হয়ে চিরসুখের নিবাস জান্নাতে প্রবেশ করতে থাকবেন। যারা যে আমল বেশি করেছেন তারা সে আমলের দরজা দিয়ে প্রবেশ করবেন। কারো জন্য সব দরজা উন্মুক্ত থাকবে; যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা প্রবেশ করতে পারবে। এভাবে কয়েক হাজার বছর পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ অব্যহত থাকবে। প্রবেশের সময় ফেরেশতারা সালাম ও শান্তি-সুখের বাক্য দিয়ে স্বাগত জানাতে থাকবেন। পবিত্র কোরআনে এই দৃশ্যের বর্ণনা রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করতো তাদেরকে দলে দলে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। যখন তারা জান্নাতের কাছে গিয়ে উপস্থিত হবে এবং জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হবে, তখন জান্নাতের রক্ষী ফেরেশতারা তাদেরকে স্বাগত জানিয়ে বলতে থাকবে- ‘তোমাদের প্রতি সালাম! চিরসুখী হও তোমরা; প্রবেশ করো এই জান্নাতে অনন্তকালের জন্য!’ তারা প্রবেশ করে বলবে- ‘প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাদেরকে তার দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করেছেন এবং আমাদেরকে এই জান্নাতের ভূখণ্ডের অধিকারী বানিয়েছেন; আমরা যেখানে ইচ্ছা বিচরণের সৌভাগ্য লাভ করেছি!’ উত্তম আমলকারীদের পুরষ্কার কতই না উত্তম!’ (সুরা জুমার : ৭৩-৭৪)


বিষয়: জান্নাত


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top