সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০


শান্তির এক অনুপম শিক্ষা হচ্ছে সালাম : মোঃ শামছুল আলম


প্রকাশিত:
২ জুলাই ২০২০ ০০:১৩

আপডেট:
২ জুলাই ২০২০ ০০:১৪

 

সালাম আরবী শব্দ। এর অর্থ শান্তি, প্রশান্তি, কল্যাণ, দোআ, আরাম, আনন্দ ইত্যাদি। সালাম একটি সম্মানজনক অভ্যর্থনামূলক ইসলামী অভিবাদন। আল্লাহ তা’য়ালা সর্বপ্রথম আদম (আ.) কে সালামের শিক্ষা দেন। হজরত আদম (আ.) কে সৃষ্টি করার পর আল্লাহ তা’য়ালা তাকে ফেরেশতাদের সালাম দেওয়ার নির্দেশ দেন। তিনি সালাম দিলে ফেরেশতারাও এর উত্তর দেন। একজন মুসলিম আরেকজন মুসলিম ভাইয়ের সাথে সাক্ষাতের সময় যে বাক্য দ্বারা একে অপরের সাথে ভালবাসা-বন্ধুত্ব, শান্তি-নিরাপত্তা, কল্যাণ ও দো‘আ কামনা করে তারই নাম সালাম।
ইসলামী শরীয়তে পারস্পরিক সম্পর্ক ও ভ্রাতৃত্ববোধ সুদৃঢ় করার জন্য সালামকে করা হয়েছে সুন্নাত। ইসলামী ভ্রাতৃত্ব বোধের এই বিধান চালু হয়েছে হযরত আদম (আ.) হতে এবং তা আজ অবধি প্রচলিত আছে। হযরত মুহম্মদ (সা.) সালামকে এতটাই গুরুত্ব প্রদান করেছেন যে, পরস্পর পরস্পরের সাথে কথা বলার পূর্বেই সালাম প্রদানের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছেন। রাসুল (সা.) এরশাদ ফরমান-

"আস্সালামু কাবলাল কালাম"
অর্থাৎ কথার পূর্বেই সালাম। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, যত গুরুত্বপূর্ণ কথা বা আলোচনাই থাকুক না কেন তার পূর্বে সালাম বিনিময় করতে হবে।

প্রাক ইসলামী যুগে আরব সমাজে  "আন‘আমাল্লাহু বিকা আইনান" অর্থাৎ আপনার দ্বারা আল্লাহ আপনার প্রিয়জনদের চক্ষু শীতল করুন এবং "আনয়ামা ছবাহান" অর্থাৎ আপনার প্রত্যুষ সুন্দর-সমৃদ্ধ হোক বা শুপ্রভাত ইত্যাদি শব্দের প্রচলন ছিল। ইসলামের আবির্ভাবের পর বিশ্বনবী মুহাম্মাদ (সা.) প্রাক ইসলামী যুগে ব্যবহৃত শব্দগুলো পরিহার করে পরস্পরকে (আস-সালা-মু আলাইকুম) বলে অভিবাদন জানাতে নির্দেশ দেন। [আবুদাঊদ, মিশকাত ৪৪৪৯/২৭]

সালামের গুরুত্ব ও ফজিলত অনেক।  তার মধ্যে কয়েকটি দিক নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল-

সালামে অশেষ সওয়াবঃ
একদা এক ব্যক্তি নবী করিম (সা.)-এর পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল, তখন তিনি মজলিসে বসা ছিলেন। সে ব্যক্তি বলল, ‘আস্সালামু আলাইকুম’। নবীজি বললেন, ‘এ ব্যক্তির ১০টি নেকি বা সওয়াব হলো। অতঃপর অন্য এক ব্যক্তি এ পথ অতিক্রম করার সময় বলল, ‘আস্সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ্’ অর্থাৎ ওই ব্যক্তি শান্তির সঙ্গে আল্লাহর রহমত বর্ষণেরও দোয়া করল। নবীজি বললেন, ‘এ ব্যক্তির ২০টি নেকি হলো।’ এরপর আরেক ব্যক্তি এ পথ অতিক্রম করার সময় বললেন, ‘আস্সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ ওয়া বারাকাতুহু’ অর্থাৎ ওই ব্যক্তি আল্লাহর শান্তি, রহমত ও বরকত বর্ষণের দোয়া করল। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘এ ব্যক্তি ৩০টি নেকি পেল।’ এমন সময় এক ব্যক্তি মজলিস থেকে উঠে চলে গেল, কিন্তু সালাম দেয়নি, তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন-

‘তোমাদের সাথি কত তাড়াতাড়িই না সালামের মাহাত্ম্য ভুলে গেল।’ যখন কোনো ব্যক্তি মজলিসে আসে তখন তার উচিত সালাম দেওয়া। তারপর যদি সে মজলিসে বসার প্রয়োজন মনে করে, তবে সে বসবে। আবার যখন সে চলে যাবে তখনো তার সালাম দেওয়া উচিত। আগমন ও প্রস্থান এ উভয় সালামের মধ্যে কোনোটার চেয়ে কোনোটার গুরুত্ব কম-বেশি নয়।’ (আল-আদাবুল মুফরাদ)

সালামে ভ্রাতৃত্ববোধ সুদৃঢ় হয়ঃ
ইসলামি ভ্রাতৃত্ব বন্ধন সূদৃঢ় ও অটুট রাখার উত্তম মাধ্যম সালাম বিনিময়। এতে ব্যক্তির উন্নত আচার-আচরণ ও উত্তম স্বভাবেরও প্রতিফলন ঘটে। আর এটি ইসলামের উত্তম আমল। হযরত আবদুল্লাহ ইবন আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, জনৈক সাহাবী রাসূলুল্লাহ (স.) কে জিজ্ঞেস করেন, ইসলামে কোন আমলটি সবচেয়ে উত্তম? রাসূলুল্লাহ (স.) প্রত্যুত্তরে বলেন- অনাহারিকে খাওয়ানো এবং পরিচিত ও অপরিচিত সকলকে সালাম দেয়া (বুখারী ও মুসলিম)।

সালাম নির্বিঘ্নে জান্নাতে যাওয়ার মাধ্যমঃ
মহানবী (স.) বলেন- চারটি কাজ যে ব্যক্তি করবে সে নির্বিঘ্নে জান্নাতে যেতে পারবে। যেমন তিনি বলেছেন- অনাহারিকে খাদ্য দাও, সালাম দাও, আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখ এবং মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন নামায পড়, অত:পর নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশ কর (আহমদ ২/২৯৯)।

আল্লাহর বন্ধু হওয়ার মাধ্যমঃ
মহানবী (স.) হযরত জিব্রাঈল (আ.) কে জিজ্ঞেস করেন আল্লাহ তা’য়ালা হযরত ইব্রাহীম (আ.) কে কি গুণের কারণে খলীল হিসেবে গ্রহণ করেছেন? হযরত জিব্রাঈল (আ.) উত্তরে বলেন- তিনটি কারণে আল্লাহ তা’য়ালা হযরত ইবরাহীম (আ) কে খলীল হিসেবে গ্রহণ করেছেন ১. মানুষকে খাওয়ানো, ২. সালাম দেয়া, ৩. রাত্রে নামায পড়া (কুরতুবী- ৫ম খন্ড)।

সালাম জান্নাতী অভিবাদনঃ
হাশরের ময়দানে বিচার-ফায়ছালা হয়ে যাওয়ার পর ভাল কাজের জন্য একদল যাবে জান্নাতে আর মন্দ কাজের জন্য একদল যাবে জাহান্নামে (সূরা হাক্কাহ)। যারা অফুরন্ত নেয়ামত ভরা জান্নাতের অধিকারী হবে তাদেরকে ফেরেশতাগণ অভিবাদন জানিয়ে জান্নাতের দিকে নিতে নিতে বলবেন-

‘তোমাদের প্রতি শান্তি-শান্তি’।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ‘অনন্তর ফিরিশতাগণ তাদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য প্রত্যেক দরজা দিয়ে আসবেন, আর বলবেন, (সালা-মুন আলাইকুম) আপনারা যে ধৈর্যধারণ করেছেন তার বিনিময়ে শান্তি পরকালের ঘর কতই না উত্তম’ [রা‘দ ২৩-২৪]

স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা জান্নাতবাসীদেরকে
স্বাগত জানাবেনঃ
‘মহান দয়ালু রবের পক্ষ থেকে সালাম বলা হবে’ [ইয়াসীন ৫৮]
অন্যত্র বলা হয়েছে: ‘তোমাদের প্রতি সালাম বা শান্তি। তোমরা সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে থাক। অতঃপর তোমরা চিরস্থায়ী আবাস গ্রহণ করতঃ জান্নাতে প্রবেশ কর’ [যুমার ৭৩]

সামাজিক জীবনে নিরাপত্তার নিশ্চয়তায় সালামঃ
মা-বাবা, ভাই-বোনসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে গড়ে উঠে পরিবার। আর বহু পরিবার, হাট-বাজার, মসজিদ-মাদরাসা, স্কুল-কলেজ, রাস্তা-ঘাট ইত্যাদি নিয়ে গড়ে উঠে সমাজ। মানুষ সামাজিক জীব। মানুষ একে অপরের সহযোগিতা ছাড়া চলতে পারে না। ধনীর যেমন প্রয়োজন হয় গরীবের, গরীবেরও তেমন প্রয়োজন হয় ধনীর। প্রয়োজনের তাকীদে একে অপরের বাড়ি-ঘরে যেতে হয়। এ প্রয়োজনীয়তাকে সামনে রেখে অন্যের বাড়িতে প্রবেশ করার বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছে ইসলাম। তা হ’ল সালাম প্রদানের মাধ্যমে অনুমতি নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করা। অন্যথা বিনা বাক্য ব্যয়ে ফিরে আসবে। এতে করে সকলের সম্মান রক্ষা পাবে, মান-ইজ্জতের হিফাযত হবে এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-

‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের নিজেদের গৃহে ছাড়া অন্যের গৃহে প্রবেশ কর না, যতক্ষণ না গৃহবাসীর সম্মতি লাভ করবে এবং তাদেরকে সালাম দিবে। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম পদ্ধতি। যাতে তোমরা উপদেশ লাভ করতে পার’ [নূর ২৭]

বিনা অনুমতিতে ও বিনা সালামে অপরের বাড়িতে প্রবেশ করার কারণে মানুষের সম্ভ্রমের হানি ঘটে। সন্দেহ সৃষ্টি হয়। বাড়ীওয়ালা কি অবস্থায় আছে তা বুঝা যায় না। এতে তার ইজ্জত বিনষ্ট হওয়ার কারণে রুষ্ট হ’তে পারে। আর এভাবে সমাজে অশান্তি সৃষ্টি হয়।

সালামের মাধ্যমে শান্তির দোয়া করা হয়। এর চেয়ে ভালো দোয়া আর কী হতে পারে? শান্তির চেয়ে বড় কিছু মানুষের কাম্য নেই। আমরা সবকিছুতে শান্তি চাই, জীবনের সব ক্ষেত্রে চাই। দুনিয়াতেও চাই, আখেরাতেও চাই। প্রত্যেকটা পদে পদে শান্তি চাই। সালামের মধ্যে এরই দোয়া করা হয়। তাই এর চেয়ে উত্তম দোয়া আর হতে পারে না। কোনো মুসলমান যখন সালামের অর্থ বুঝে অন্তর থেকে সালাম দেবেন আর যিনি সালাম গ্রহণ করবেন, তিনি অর্থ বুঝে সালাম গ্রহণ করবেন। তখন উভয়ের মধ্যে মহব্বত সৃষ্টি হবে।

সালামের সঙ্গে সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পবিত্র মিরাজ রজনীর ঐতিহাসিক স্মৃতিময় ঘটনাটি বিজড়িত রয়েছে। এ মহিমান্বিত রজনীতে আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয়বন্ধুকে নিজের কাছে ডেকে নিয়ে-

"আস্সালামু আলাইকা আইয়্যুহান্নাবিয়্যু" বলে সম্ভাষণ জানিয়েছিলেন।

পবিত্র কোরআনে ‘সালাম’ শব্দটি নবীদের প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে সম্মান এবং সুসংবাদ হিসেবে ব্যবহূত হয়েছে।

তাই আসুন সালাম কায়েমের মাধ্যমে পরিবার, সমাজ ও জাতীয় জীবনে শান্তি-শৃংখলা, একতা, বরকত, রহমত ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠায় আমরা সচেষ্ট হই।

 

মোঃ শামছুল আলম
লেখক ও গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top