সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০


সুখ্যাতির এক শীর্ষ শীরে আমার নবীর নাম : ড.শাহনাজ পারভীন


প্রকাশিত:
৪ নভেম্বর ২০২০ ২১:০৫

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ১৬:২৮

ছবিঃ ড.শাহনাজ পারভীন

 

“সুখ্যাতির এক শীর্ষ শীরে আমার নবীর নাম
মানবগুণের পূর্ণতা যার ছিলোই অবিরাম।”
চলছে রবিউল আওয়াল মাস। এই পবিত্র মাসের বার তারিখে ৫৭০ খৃস্টাব্দে ২৪ এপ্রিল, সোমবার, মক্কা, সৌদি আরবে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্ণ নাম মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আব্দুল মুত্তালিব ইবনে হাশিম। একই সাথে এই দিনটি হযরত মুহাম্মদ সা. এর জন্ম এবং মৃত্যুদিন। এই পৃথিবীতে তার আগমন তারিখেই তাঁর প্রস্থান দিবস। এটাও একটা বিরল ঘটনা। এই পৃথিবীতে শুধু তাঁর আগমন তারিখটাই আলোকিত থাকে, তাঁর প্রস্থান দিবস বা তারিখ নয়। কারণ পৃথিবীর জন্মের আগেই যেমন তাঁর নূর তৈরি হয়েছিল, তেমনি পৃথিবীর শেষদিন পর্যন্ত তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব বজায় থাকবে। তিনি আমাদের শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সা.। তাঁর পর এই পৃথিবীতে আর কোনো নবী বা রাসুল আসবেন না। তাঁর আদর্শের ভিত্তিতেই ইসলামিক সভ্যতা গড়ে ওঠে। মুসলিমরা তাঁকে নবী, রাসূল এবং মুহাম্মদ বলে সম্বোধন করে। তিনি সকল মানবীয় গুণের অধিকারী। মুসলিমরা তাঁর নামের শেষে সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অর্থ- তাঁর উপর শান্তি বর্ষিত হোক, সংক্ষেপে সা. উচ্চারণ করে। তিনি ছিলেন ইসলামী জীবন ব্যবস্থার প্রবর্তক। তিনি পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় নেতা ছিলেন। একই সাথে তিনি আধ্যাত্মিক ও জাগতিক উভয় জগতেই চ’ড়ান্ত সফলতা অর্জন করেন। ধর্মীয় জীবনে যেমন তিনি সফল ছিলেন, একইভাবে তিনি রাজনৈতিক জীবনেও সফল ছিলেন। সমগ্র আরব বিশ্বের তিনি নবজাগরণের পথিকৃত ছিলেন এবং বিবাদমান আরব জনতাকে একীভূতকরণ তাঁর জীবনের অন্যতম সফলতা। তাঁর উপর ঐশীগ্রন্থ আল কুরআন নাযিল হয়েছে। সে অর্থে তিনি বার্তাবাহক।


মুহাম্মদ সা. এর দৈনন্দিন কাজকর্মকে সুন্নাহ বলা হয়। তিনি যা যা করার আদেশ, উপদেশ ও নিষেধ করেছেন, তাকে হাদিস বলা হয়। ইসলাম ধর্মে পবিত্র কুরআনের পরই হাদিসের স্থান। এটি প্রত্যেক মুসলিমের জন্য অনুকরণীয়। কোন কোন বিষয় আছে তা অবশ্যই পালনীয়। তাকে ফরজ বলা হয়। তাঁর প্রতি নাযিলকৃত পবিত্র কুরআন ও পবিত্র হাদিসের অনুসরণই হবে একজন প্রকৃত মুমিনের বৈশিষ্ট্য।

এই মহান মানবের আগমনের সাথে সাথে পূর্ববর্তী যত ঐশী গ্রন্থ ছিল, তা রহিত করা হয়েছে। আমরা জানি, একশ চারখানা সহিফার মধ্যে চারখানা সহিফা বড় বা উল্লেখযোগ্য। তাওরাত, যাবুর, ইঞ্জিল ও পবিত্র কুরআন শরীফ। এর মধ্যে পবিত্র কুরআন হচ্ছে নিউ এডিশান। নিউ এডিশনটি নাযিল হওয়ার সাথে সাথেই পুরনো এডিশন গুলো রহিত হয়ে গেছে। আমি যদি একটি সাধারণ উদাহরণ দিয়ে তা বলি, তাহলে খুব সহজেই আমরা হৃদয়াঙ্গম করতে পারবো। একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেমন একটি ক্লাস রুটিন বা পরীক্ষার রুটিন দেওয়া থাকে। যদি কর্তৃপক্ষ সেই রুটিন পরিবর্তন করে নতুন কোন রুটিন চালু করেন, তখন পুরনো রুটিনগুলো বাতিল হয়ে যায়। তখন যদি কেউ পুরনো রুটিনে ক্লাস করতে চায়, তখন কি সেটা আদৌ সম্ভব? না, তা সম্ভব নয়। এটা তেমনি একটা বিষয়, হয়ত নতুন রুটিনে ম্যাজিকের মতো সপ্তাহের একটি, দুটি বিষয় ও শিক্ষক মিলে যেতে পারে, তবে কখনোই পরিপুর্ণ ক্লাস ও শিক্ষকের মিল পাওয়া যাবে না। তেমনি পূর্ববর্তী ঐশীগ্রন্থের মধ্যে হয়তো দুই একটি নিয়ম নীতি মিলে যেতে পারে, তবে সম্পুর্ণ মিল কখনো সম্ভব নয়।

বিদায় হজ্বের ভাষণে হযরত মুহাম্মদ সা. বলেছেন, আমি তোমাদের জন্য এমন সুস্পষ্ট দুটি বিষয় (বিধান) রেখে গেলাম, যা দৃঢ়ভাবে ধারণ করলে তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না; আল্লাহর কিতাব এবং তাঁর নবী সা. এর সুন্নাহ।
অথচ আমরা আজ এই নির্দেশ থেকে অনেক দূরে সরে গেছি। এ জন্যই আজ সমাজের আনাচে কানাচে নানান রকম দুর্নীতি, অত্যাচার, অবিচার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। আমাদের মধ্য থেকে আল্লাহ ভীতি অনেকটাই দূরীভূত হয়েছে। আমাদের উচিৎ পরিপূর্ণভাবে এই আদেশ মেনে চলা। বিদায় হজ্বের ভাষণে হযরত মুহাম্মদ সা. আরও বলেন:
“সাবধান! ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করবে না; কেননা, তোমাদের পূর্ববর্তী বহু জাতি ধর্মীয় বিষয়ে বাড়াবাড়ি করার কারণে ধ্বংস হয়েছে।’
ধমৃীয় ও পার্থিব জীবনে মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা. এর শিক্ষা সমগ্র মানব জাতির জন্য অনুসরণীয়। কিন্তু সেই শিক্ষা থেকে আজ আমরা অনেকটাই দূরে সরে গেছি। মুসলিম সভ্যতা এবং আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ সা. কে নিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করছে। এই পবিত্র মাসে, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়, ফ্রান্সে প্রকাশ্যে মহান আল্লাহর প্রেরিত প্রিয় হাবীব রাসুলুল্লাহ সা. এর ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন-- সত্যি, শতাব্দীর সর্ব নিকৃষ্ট অসভ্যতা। কোন সভ্য সমাজের মানুষ এভাবে ভিন্ন বিশ্বাসের মানুষদের সেন্টিমেন্টের প্রতি এরকম উগ্র আচরণ করতে পারে না। এটা সুস্পষ্ট উস্কানিমূলক। এর প্রতিক্রিয়ায়, অনাকাক্সিক্ষত যে কোন ঘটনা বা পরিস্থিতির জন্য ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট দায়ী থাকবে। কারণ সে বলেছে, ফ্রান্স ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন বন্ধ করবে না। এটা নাকি তাদের বাক-স্বাধীনতা। আমি আমার পক্ষ থেকে, সর্বোপরি মুসলিমের পক্ষ থেকে চরমভাবে ওই দেশের প্রতি, ওই হুমকির প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করছি। ঘৃণা প্রদর্শন করছি প্রশাসন এর প্রতিও।

হৃদয়ের সবটুকু ঘৃণা ও ক্ষোভ একত্রিত করে ধিক্কার জানাই এইসব মানুষ নামের অমানুষদের প্রতি যারা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি অসহনশীলতা প্রদর্শন ও অন্যের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করাকে “ফ্রিডম অফ স্পিচ” বলে আখ্যায়িত করছে। পৃথিবীর কোন ভদ্র ও সুস্থ বিবেকসম্পন্ন মানুষ এমন কাজকে সমর্থন করতে পারে না। তিনি সুস্থ আছেন বলে আমার সন্দেহ আছে। আমরা জানি, গরিব আফ্রিকান দেশগুলোকে শোষণ নিপীড়ন করেই লুটেরা ফ্রান্সের আজকের এই বাহাদুরি। দাম্ভিকদের পতন অনিবার্য। মহান আল্লাহ চাইলে মুহূর্তে এই দাম্ভিকদের দম্ভকে মাটির সাথে গুড়িয়ে দিতে পারেন। মনে রাখা দরকার যে “আল্লাহ ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না”। ইতিহাস আমাদেরকে এটাই মনে করিয়ে দেয়। ইতিহাস বড়ই নির্মম !

এই ফ্রান্সে আইন করে মুসলিম নারীদের হিজাব পড়া নিষিদ্ধ করা হলেও, করোনা সংক্রমিত হওয়ার পর, মুখে মাস্ক না দিয়ে, মুখ না ঢেকে চলাফেরা করলে ১৫০ ইউরো জরিমানার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ফ্রান্সে হঠাৎ গত একদিনে করোনায় ৪০ হাজার আক্রান্ত, মৃত্যু ২৯৮ জন। জানিনা এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন শিক্ষা!

শুধু এতটুকু জানি, প্রিয়নবীর প্রতি অসম্মান দেখিয়ে ওরা নিজেদেরকে কলঙ্কিত করেছে, সর্বোচ্চ অসভ্যতার পরিচয় দিয়েছে। আমার প্রিয় নবীর মর্যাদাকে ওরা কস্মিনকালেও কিঞ্চিৎ কমাতে পারবেনা। কিভাবে তারা সেটা করবে? স্বয়ং আরশের অধিপতি মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবিবের সম্মানকে দ্যুলোক-ভূলোক ছাড়িয়ে, সাত আকাশ মাড়িয়ে তাঁর আরশ অবধি সমুন্নত করেছেন। পবিত্র কুরআনে তিনি বর্ণনা করেছেন: “আর আমি আপনার স্মরণকে (গোটা জগৎময়) সমুন্নত করেছি”। [সূরা আল-ইনশিরাহ: ৪]
“আপনার প্রতি বিদ্বেষ ও শত্রুতাপোষণকারী হল শেকড়হীন, নির্বংশ” [সূরা আল-কাউসার: ৩]।
মহান আল্লাহই তাঁর হেফাজতকারী। তিনিই তাঁকে হেফাজত করবেন। এবং আশা করছি, দোয়া করছি, মহান আল্লাহ যেন আমাদেরকেও হেফাজত করেন। আমিন।

 

ড. শাহনাজ পারভীন
কবি, কথাসাহিত্যিক, উপাধ্যক্ষ, উপশহর মহিলা কলেজ, যশোর।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top