সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১


ইসলামের দৃষ্টিতে বিজয় দিবসের ভাবনা : মোঃ শামছুল আলম


প্রকাশিত:
১৫ ডিসেম্বর ২০২০ ২১:৫৭

আপডেট:
১৯ এপ্রিল ২০২৪ ১৯:২৪

 

বাংলাদেশী জাতির সবচেয়ে বড় অর্জনের দিন হল বিজয়ের দিন বা ১৬ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রভাতী সূর্যের আলোয় ঝলমলিয়ে উঠেছিল বাংলার রক্তস্নাত শিশির ভেজা মাটি, অবসান হয়েছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সাড়ে তেইশ বছরের নির্বিচার শোষণ, বঞ্চনা আর নির্যাতনের কালো অধ্যায়। নয় মাসের জঠর-যন্ত্রণা শেষে এদিন জন্ম নেয় একটি নতুন দেশ স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। প্রায় ৯২ হাজার পাকিস্তানি বাহিনী ঐতিহাসিক রোসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) আত্মসমর্পণের মাধ্যমে সূচিত হয়েছিল এই মাহেন্দ্রক্ষণ।

হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াই করে এইদিনই বীর বাংলাদেশীরা ছিনিয়ে এনেছিল লাল-সবুজের পতাকা। তাই আজ আমরা মুক্ত ভাবে মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে পারছি।
পৃথিবীতে যখন যেখানে মানুষের ব্যক্তি অধিকার ক্ষুন্ন হয়েছে, মানুষ হারিয়েছে তার নিজস্ব স্বাধীনতা, সেখানেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মানবতার দাবি। মহান আল্লাহ সেখানেই প্রতিষ্ঠিত করেছেন মজলুম মানবতার আবেদনকে।

মিসরের ইতিহাসে হজরত মুসা (আ.) এর আগমনের পেছনে ফিরাউনের একনায়কতন্ত্র এবং তার ইচ্ছাস্বাধীন শাসনকে পরাজিত করানোই মূল উদ্দেশ্য ছিল। ব্যক্তি অধিকারবঞ্চিত পরাধীন মানুষের জন্য মানবতাবাদ আর স্বাধীনতার বাণী নিয়ে জাহেলিয়াতের যুগে আগমন ঘটেছিল সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর।
আরবের মানুষ যখন পরাধীনতার কালো যুগের অধিবাসী, আমাদের শেষ নবী তখন এসেছিলেন স্বাধীনতা আদায়ের বাণী নিয়ে। মানুষকে স্বাধীন করে প্রভুর সঙ্গে সম্পর্ক জুড়ে দিতে এসেছিলেন তিনি। সর্বোপরি মানবতার মুক্তির দাবিই ছিল প্রত্যেক নবী- রাসুলদের পৃথিবীতে আগমনের কারণ এবং তারা জানতেন-বুঝতেন একজন পরাধীন ব্যক্তি সবসময় প্রভুর সান্নিধ্য থেকে অনেক দূরে অবস্থান করে। পরাধীনতা প্রভুর সান্নিধ্য অর্জনের অন্তরায়, বড় বাধা। ইসলাম স্বাধীনতা অর্জন করা এবং পরাধীনতা মুক্ত থাকার ব্যাপারে বেশ গুরুত্বারোপ করেছে। 

এ দেশের মানুষ দৃঢ় প্রত্যয় বুকে ধারণ করে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করে, যে কারণে আল্লাহর রহমতে স্বাধীনতা আসে পলাশীতে লুট হয়ে যাওয়ার প্রায় ২১৪ বছর পর!
মানুষ সত্যের জন্য, ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা করলে, লড়াই করলে সেখানে আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয়।  কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে-

"নিশ্চয়ই আল্লাহ কোন জাতির অবস্থার পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজ অবস্থা নিজে পরিবর্তন করে।" (সূরা রাদ: -১১)

ইসলামে জন্মভূমিকে ভালোবাসা ঈমানের অংশ হিসেবে ভাবা হয়। হাদিসের বর্ণনায় আছে, রসুলুল্লাহ (সাঃ) মদিনা শরিফকে খুব ভালোবাসতেন। কোনো সফর থেকে প্রত্যাবর্তনকালে মদিনার সীমান্তে উহুদ পাহাড় চোখে পড়লে নবীজীর চেহারাতে আনন্দের আভা ফুটে উঠত এবং তিনি বলতেন, এই উহুদ পাহাড় আমাদের ভালোবাসে, আমরাও উহুদ পাহাড়কে ভালোবাসি (বুখারি : ১০২৮)।
প্রিয় নবী (সঃ) নিজে স্বদেশকে ভালোবেসে আমাদের জন্য দেশপ্রেমের অনুকরণীয় আদর্শ রেখে গেছেন। নবী (সঃ) তাঁর জন্মভূমি মক্কাকে ও মক্কার জনগণকে বিষণ ভালোবাসতেন। তাদের আল্লাহর পথে আনার জন্য তিনি অপরিসীম অত্যাচার সহ্য করেছেন। তার পরও কখনো স্বদেশ বাসীর অকল্যাণ কামনা করেননি! তায়েফে নির্যাতিত হওয়ার পরও কোনো বদ দোয়া করেননি!

স্বদেশ প্রেম প্রতিটি মানুষের স্বভাবজাত অভ্যাস, বিশেষত মুসলমানদের প্রতিটি রক্ত কণিকায়ই দেশপ্রেমের শিহরণ থাকা বাঞ্ছনীয়। কেননা মহানবী (সা.) ছিলেন দেশপ্রেমিকের সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত।
দেশপ্রেমের অন্যতম বহিঃপ্রকাশ হলো, দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করা। হাদিস শরিফে এসেছে-

‘আল্লাহর পথে এক দিন ও এক রাত সীমান্ত পাহারা দেওয়া এক মাস পর্যন্ত সিয়াম পালন ও এক মাস ধরে রাতে সালাত আদায়ের চেয়ে বেশি কল্যাণকর।
যদি এ অবস্থায় সে মৃত্যুবরণ করে, তাহলে যে কাজ সে করে যাচ্ছিল, মৃত্যুর পরও তা তার জন্য অব্যাহত থাকবে, তার রিজিক অব্যাহত থাকবে, কবর-হাশরের ফিতনা থেকে সে নিরাপদ থাকবে।' (মুসলিম, ১৯১৩)

ইসলাম ধর্মে বিজয় দিবস উদ্যাপনের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা আছে। এই দিনের অন্যতম করণীয় হলো—আট রাকাত নফল নামাজ পড়া। কেননা নবী (সা.) মক্কা বিজয়ের দিন শুকরিয়া স্বরূপ আট রাকাত নামাজ আদায় করেছিলেন। (জাদুল মা’আদ, আল্লামা ইবনুল কাইয়িম জাওজি)।

মহান বিজয় উপলক্ষে আমাদের কর্তব্য, শহীদদের জন্য দোয়া করা, আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা এবং অধিক পরিমানে তাসবীহ ও ইস্তিগফার পাঠ করা। কারণ এ বিজয় নিজেদের শক্তি-সামর্থ্য বলে নয় বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ সাহায্যেই সম্ভব হয়েছে।
বিজয় সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে-

‘যখন আসবে আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়, তুমি মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দ্বিনে প্রবেশ করতে দেখবে। তখন তুমি তোমার প্রতিপালকের পবিত্রতা বর্ণনা করো। আর তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল। (সুরা : নাসরঃ ১-৩)।

সর্বোপরি সব ধরণের অপসংস্কৃতি ও শিরকী কার্যক্রম, হিংসা-বিদ্বেষ ও রুট আচরণ পরিহার করে ক্ষমা, উদারতা এবং ন্যায়-ইনসাফ এর ভিত্তিতে সকলে মিলেমিশে দেশের উন্নয়ন ও মানুষের কল্যাণে কাজ করতে হবে, অশিক্ষা ও দরিদ্রতা দুরিকরণে অবদান রাখতে হবে এবং শত্রুর কবল থেকে দেশ রক্ষার জন্য একতাবদ্ধ থাকতে হবে। আর এতেই মানুষ প্রকৃত স্বাধীনতার ফল লাভ করতে সক্ষম হবে, ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদের সবাইকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে এবং দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় মুক্তিযুদ্ধের মতো সাহস প্রদর্শনের জন্য সদা প্রস্তুত থাকার তৌফিক দান করুন। আমিন।

 

মোঃ শামছুল আলম
লেখক ও প্রাবন্ধিক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top