সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৮শে মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০


রমজানে গড়ে উঠা আমলগুলো ধরে রাখতে হবে : মোঃ শামছুল আলম


প্রকাশিত:
১০ মে ২০২১ ২৩:০৫

আপডেট:
২৮ মার্চ ২০২৪ ১৮:১০

ছবিঃ মোঃ শামছুল আলম

 

মুসলমানদের প্রবৃত্তিগুলোকে পরিশুদ্ধ করতে, মানুষকে ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীর মোহ থেকে আখিরাতমুখী করতে, মুসলমানের জীবনে সম্প্রীতি ও সহানুভূতির চেতনা জাগাতে আসে সিয়াম সাধনার মাস রমজান। সহসাই এ মাস আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্চে । এখন আমাদের জীবনে যদি রমজানের বিশেষ নেক আমলগুলো চালু রাখা যায়, তা হলে অনেক সুফল পাওয়া যাবে। আসুন রোজায় গড়ে উঠা কিছু ভাল আমল আমরা জেনে নেই।

রোজাঃ
প্রথমেই আসে শওয়াল মাসের রোজার কথা।
হজরত আবু আইয়ুব আনসারি (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি রমজান মাসে রোজা রাখল এবং শাওয়াল মাসে ছয়টি রোজা পালন করল; সে যেন পুরো এক বছর রোজা পালন করল।’ (মুসলিম)। এই রোজা একাধারে বা বিচ্ছিন্নভাবেও রাখা যায়।

‘জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিনের ইবাদত আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয়। এর প্রতি দিনের রোজা এক বছরের রোজার সমান এবং প্রতি রাতের ইবাদত শবে কদরের ইবাদতের সমান।’ (তিরমিজি)।
উল্লেখ্য যে জিলহজ মাসের ১ থেকে ৮ তারিখ সবাই রোজা পালন করতে পারবেন। ৯ তারিখে আরাফাতে অবস্থানকারীরা ছাড়া অন্যরা রোজা পালন করতে পারবেন। ১০ তারিখে অর্থাৎ কোরবানির ঈদের দিনে ভোর থেকে পশু জবাই করা পর্যন্ত পানাহার থেকে বিরত থাকলেই রোজা বলে গণ্য হবে এবং এই দিন কোরবানি করা পশুর মাংস দিয়ে প্রথম আহার করা মুস্তাহাব। এই দিন পূর্ণ দিবস রোজা রাখা বিধেয় নয়।

জামাতে নামাজঃ
রমজান মাসে জামাতে নামাজ পড়ার অভ্যাস আমাদেরকে ধরে রাখতে হবে, কারন জামাতে নামাজ পড়ার জন্য জোর তাগিদ দেয়া হয়েছে। মসজিদে জামাতে নামাজ আদায়ের অশেষ সওয়াব সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, জামাতে নামাজ পড়ার ফজিলত একা পড়ার চেয়ে ২৭ গুণ ঊর্ধ্বে। (বুখারি ও মুসলিম)
তিনি আরও বলেছেন, একজন লোক ঘরে নামাজ পড়লে একটি নেকি পান, তিনি ওয়াক্তিয়া মসজিদে পড়লে ২৫ গুণ, জুমা মসজিদে পড়লে ৫০০ গুণ, মসজিদে আকসায় পড়লে ৫০ হাজার গুণ, আমার মসজিদে অর্থাৎ মসজিদে নববীতে পড়লে ৫০ হাজার গুণ এবং মসজিদুল হারাম বা কাবার ঘরে পড়লে এক লাখ গুণ সওয়াব পাবেন। (ইবনে মাজা, মিশকাত)
মসজিদে নামাজ আদায়ে শুধু যে বান্দার আত্মিক উন্নতি হয় তা-ই নয়; সামাজিক ক্ষেত্রেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। জামাতে নামাজ আদায় করায় মুসলমানরা দৈনিক পাঁচবার একত্রে মিলিত হওয়ার সুযোগ পান। ফলে তাদের মধ্যে সম্প্রীতি গড়ে ওঠে। এভাবে একতাবদ্ধ হয়ে সৎ কাজ করার শিক্ষা জামাতে নামাজ আদায়ের মাধ্যমে অর্জন করা যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-

‘নামাজের প্রথম সারি হলো ফেরেশতাদের সারির মতো। তোমরা যদি প্রথম সারির মর্যাদা সম্পর্কে জানতে, তবে তা পাওয়ার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়তে। মনে রেখো, একা নামাজ পড়ার চেয়ে দুই ব্যক্তির একত্রে নামাজ পড়া উত্তম। আর দুই ব্যক্তির একত্রে নামাজ পড়ার চেয়ে তিন ব্যক্তির একত্রে নামাজ পড়া উত্তম। এভাবে যত বেশি লোকের জামাত হবে, তা আল্লাহর কাছে তত বেশি প্রিয় হবে।’

একবার এক অন্ধ ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমার এমন কেউ নেই, যে আমাকে হাত ধরে মসজিদে আনবে।’ অতঃপর লোকটি মসজিদে উপস্থিত হওয়া থেকে অব্যাহতি চান এবং ঘরে নামাজ পড়ার অনুমতি চান। রাসুলুল্লাহ তাঁকে ঘরে নামাজ পড়ার অনুমতি দিয়ে দেন। লোকটি রওনা করলে রাসুলুল্লাহ তাঁকে পুনরায় ডেকে পাঠান। লোকটি ফিরে আসেন। রাসুলুল্লাহ তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন-

‘তুমি কি আজান শুনতে পাও?’ লোকটি বললেন, ‘হ্যাঁ, শুনতে পাই।’ রাসুলুল্লাহ বললেন, ‘তাহলে তুমি মসজিদে উপস্থিত হবে।’ বললেন, ‘ফজর ও এশার নামাজ মুনাফিকদের জন্য অন্যান্য নামাজের তুলনায় অধিকতর ভারী। তোমরা যদি জানতে এ দুটি নামাজের মধ্যে কী পরিমাণ সওয়াব নিহিত আছে, তবে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও নামাজে উপস্থিত হতে।’
অন্য হাদিসে বর্ণিত আছে, ‘এশা ও ফজরের নামাজ মুনাফিকদের জন্য অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। যদি তাদের জানা থাকত যে এই জামাতের সওয়াব কত বেশি, তাহলে জমিনে হেঁচড়িয়ে হলেও এসে তারা শরিক হতো। (তারগিব)।

উত্তম ব্যবহারঃ
রমজান মাস সংযমের মাস, এমাসে মুমিনের চারিত্রিক গুনাবলির বিকাশ ঘটে। মানুষের কথা-কাজ ও ব্যবহারে সৌন্দর্যতা ফুটে উঠে, আর এই সৌন্দর্যতা সারা জীবন ধরে রাখতে হবে। মানুষ তার উত্তম ব্যবহার ও চরিত্র দ্বারা পরিবারসহ সমাজকে অলোকিত করে থাকে।

চারিত্রিক সৌন্দর্য দ্বারা মানুষের ভালোবাসা ও সম্মান হাসিল করা যায়। গোমরামুখী হওয়া কোনো তাকওয়ার পরিচয় বহন করে না। ব্যক্তিগত জীবনে দেখা যায় অনেক সৎ চরিত্রের অধিকারীদের চরিত্রে কোমলতা কম থাকে, মেজাজ থাকে কিছুটা কর্কশ। মুমিনের এমন চরিত্র হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। কিয়ামতের দিন এমন লোককেও আল্লাহর সামনে হাজির করা হবে- যার আমলনামার মধ্যে নামাজ, রোজা, জাকাত প্রভৃতি নেক আমল থাকবে। কিন্তু বিভিন্ন ব্যক্তি তার মন্দ আচরণের জন্য আল্লাহর কাছে নালিশ করবে। তাই মিষ্টি হাসি, মধুর আচরণ ও কোমল চিত্তের অধিকারী হওয়া পরিবার প্রধান ও সমাজ সংস্কারকদের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ছিলেন এমন সব বৈশিষ্ট্যের অধিকারী।
মধুর চরিত্রের অধিকারী ও মিষ্টভাষীদের জন্য জান্নাতের সুখবর রয়েছে পবিত্র হাদিসে। এ বিষয়ে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে কথাটি প্রকৃতই মিথ্যা এবং অসঙ্গত, যে ব্যক্তি তা বলা এবং আলোচনা করা পরিত্যাগ করে- তার জন্য জান্নাতের কিনারায় স্থাপনা নির্মিত হয়। যে ব্যক্তি সঙ্গত কারণ থাকা সত্ত্বেও ঝগড়া-বিবাদ পরিত্যাগ করে, তার জন্য জান্নাতের মধ্যে বাসস্থান নির্মিত হয়। যে ব্যক্তি বাক সংযম, মিষ্টভাষণ এবং সত্য কথা প্রভৃতি গুণ দ্বারা নিজের চরিত্র সৌন্দর্যমন্ডিত করে, তার জন্য জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থানে বাসস্থান নির্মিত হয়।’ –মিশকাত

দান-খয়রাতঃ
রমজান মাসে মুমিন- মুসলমানদের মধ্যে ছোট ছোট দান-খয়রাতের অভ্যাস গড়ে উঠে। এই অভ্যাস যদি আমরা সারা জীবন ধরে রাখতে পারি তাহলে ইনশাআল্লাহ আমরা কামিয়াবি অর্জন করতে সক্কম হব।

“দান-ছাদকা গুনাহ মিটিয়ে ফেলে যেমন পানি আগুনকে নিভিয়ে ফেলে।” (সহীহুল জামে/৫১৩৬)
ধন-সম্পদের প্রকৃত মালিক আল্লাহ তা’আলা।
অধিকাংশ মানুষ দান-খয়রাত করতে চায় না। মনে করে এতে সম্পদ কমে যাবে। তাই সম্পদ সঞ্চিত করে রাখতেই সর্বদা সচেষ্ট থাকে, এমনকি নিজের প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রেও খরচ করতে কৃপণতা করে। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেন-

“মানুষ বলে আমার সম্পদ আমার সম্পদ অথচ তিনটি ক্ষেত্রে ব্যবহৃত সম্পদই শুধু তার। যা খেয়ে শেষ করেছে, যা পরিধান করে নষ্ট করেছে এবং যা দান করে জমা করেছে- তাই শুধু তার। আর অবশিষ্ট সম্পদ সে ছেড়ে যাবে, মানুষ তা নিয়ে যাবে।” (মুসলিম)

সিয়াম সাধনার মধ্য দিয়ে একজন রোজাদার আরো যেসব উন্নত গুনাবলি গড়ে তোলার সুযোগ লাভ করেন। যেমন-একই সময় সাহরি গ্রহণ, একই সময় ইফতার করা, একসঙ্গে ঈদ আনন্দ করা, একে অন্যকে সাহায্য-সহযোগিতা করা, প্রচণ্ড পেটের ক্ষুধা ও জৈবিক চাহিদা পূরণের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও একমাত্র আল্লাহর ভয়ে এগুলো থেকে বিরত থাকা, মিথ্যা কথা না বলা, সুদ না খাওয়া, ঘুষ না নেয়া ও না দেয়া, মদ-জুয়াবাজি না করা, হত্যা-রাহাজানি না করা, যেনা-ব্যাভিচার না করা। সেই রোজাদার রোজার পরও যদি এ ভাল কাজগুলা করতে পারেন, তবে ইনশাআল্লাহ শান্তির জান্নাত হবে আমাদের এই জনপদ।

তাই আসুন রমজানের এ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আমাদের বাকি জীবনকে পরিচালিত করি সত্য ও সুন্দরের পথে। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দিন। আমিন।

 

মোঃ শামছুল আলম
লেখক ও গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top