সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০


প্রতিবেশী আমাদের জীবনের আবশ্যকীয় অংশ : মোঃ শামসুল আলম


প্রকাশিত:
১৭ জুন ২০২১ ১৯:১৮

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ২১:০০

 

প্রতিবেশীদের সাথে আমাদের আচরণ কেমন হবে। আমরা আজ যে সমাজ ব্যবস্থায় অভ্যস্ত তাতে আমাদের অনুভূতিগুলোও দিন দিন যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে। মানুষকে অবিশ্বাস আর সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখাই যেন এই যুগের সবার চিন্তাধারার একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে! ইট পাথরের দালানে থাকা আমরাও যেন অনুভূতিহীন কলের পুতুল! পাশের দরজার প্রতিবেশীর বিপদে আপদে, তাদের সুখ দুঃখের সঙ্গী হওয়া তো আজকাল দুরের কথা, কেউ কাউকে চিনিই না অনেক সময়! এরপরও কি আমরা দাবী করতে পারি আমরা সত্যিকারের মুসলমান?
আসুন দেখি প্রতিবেশীদের অধিকার সম্পর্কে আল্লাহ তা’য়ালা ও তাঁর রাসুল সা. আমাদেরকে কি বলেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-

“তোমরা আল্লাহর উপাসনা কর ও কোন কিছুকে তাঁর অংশী করো না, এবং পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, পিতৃহীন, অভাবগ্রস্ত, আত্মীয় ও অনাত্মীয় প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথী, পথচারী এবং তোমাদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসীদের প্রতি সদ্ব্যবহার কর।” [সূরা নিসা: ৩৬]

প্রতিবেশী কারাঃ
প্রতিবেশী হচ্ছে আশেপাশের মুসলিম, অমুসলিম যে কোন ধর্মাবলীর অনুসারী, নেক বান্দা, ফাসেক, বন্ধু, শত্রু, ভিনদেশি, স্বদেশী, উপকারী, অনিষ্ঠকারী, আত্মীয়, অনাত্মীয়, কাছের বা দূরের সবাই প্রতিবেশীর অন্তর্ভুক্ত। শুধু মাত্র পাশের ঘরের লোকেরাই প্রতিবেশী তা নয়। প্রতিবেশী বিভিন্নভাবে হতে পারে। একজনের জমির পাশে আরেকজনের জমি থাকলে তারা একে অপরের প্রতিবেশী। একজনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পাশে আরেকজনের প্রতিষ্ঠান থাকলে তারাও পরস্পর প্রতিবেশী। কোন বাহনে কোথায় যাওয়ার সময়ে যাত্রীরাও কিছু সময়ের জন্য একে অপরের প্রতিবেশী।

প্রতিবেশী হওয়ার জন্য ধর্ম প্রতিবন্ধক নয়:
জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবার ওপরই প্রতিবেশীর হুকুম আরোপিত। হজরত মুজাহিদ (রহ.) থেকে বর্ণিত, একদা আবদুল্লাহ ইবনে অমরের জন্য একটি বকরী জবাই করা হলো। তিনি ঘরে এসে বলতে লাগলেন, ‘তোমরা কি আমাদের ইহুদী প্রতিবেশীর জন্য গোশত হাদিয়া পাঠিয়েছো’?

প্রিয়নবী সা. বলেন, জিবরাঈল আ. আমাকে প্রতিবেশীর হক সম্পর্কে এত বেশি তাগিদ করতেন যে এক পর্যায়ে আমার মনে হয়েছে হয়তো অচিরেই প্রতিবেশীকে উত্তরাধিকারী সাব্যস্ত করা হবে। [বোখারী : ২/৮৮৯]

মানুষের ভালোমন্দ, শত্রু-মিত্র, উপকার-অপকার এসব কিছু নির্ভর করে প্রতিবেশীর ওপর। প্রতিবেশীর সঙ্গে উত্তম ব্যবহার সম্পর্কে বলতে গিয়ে তাওরাতে বর্ণিত হয়েছে যে, তোমরা প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষী, অন্যায়-অত্যাচার, শোষণ, নিপীড়ন, নির্যাতন করো না। তাদের ধন-ঐশর্যের প্রতি লোভাতুর-লোলুপ দৃষ্টি নিক্ষেপ করো না। হজরত ঈসা আ. প্রতিবেশী সম্বন্ধে বলেন, তোমরা তোমাদের প্রতিবেশীকে নিজের মতো ভালোবাসো।

ইসলামে প্রতিবেশীর ব্যাপারে যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে মহান রাব্বুল আলামিন বলেন-

মা-বাবার সঙ্গে সৌহার্দ পূর্ণ আচরণ করো। আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতিম এবং মিসকিনদের সঙ্গে সদাচার করো। সদ্ব্যবহার করো পরিচিত অপরিচিত প্রতিবেশী ও সাময়িক প্রতিবেশী এবং মুসাফিরদের সঙ্গে। [সুরা নীসা: ৩৬]

উক্ত আয়াত থেকে প্রতিবেশীকে আমরা তিনভাগে বিভক্ত করতে পারি। ১. নিকটতর আত্মীয় প্রতিবেশী। ২. অনাত্মীয় প্রতিবেশী। এবং ৩. সাময়িক প্রতিবেশী।

প্রতিবেশী কেবল তারাই নয়, যারা নিজ বাড়ির একান্ত আশেপাশে বসবাস করে। এর সীমারেখা আরও বিস্তৃত। হজরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত রাসুল সা. বলেন-
তোমাদের ডানে-বামে, সামনে-পেছনে চল্লিশটি বাড়ি পর্যন্ত প্রতিবেশীর আওতার অন্তর্ভুক্ত। [বোখারি: /২৯০১]

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. এবং হযরত আয়েশা রা. উভয়েই এই হাদীসটি বর্ণনা করেন; রাসূল (সা.) বলেছেন-
“জিবরাইল আমাকে প্রতিবেশীদের সাথে ভদ্র ও নমনীয় আচরণ বজায় রাখার জন্য এত অধিক সুপারিশ করেছেন যে, আমার মনে হচ্ছিল তাদেরকে উত্তরাধিকারী হিসেবে নির্ধারন করে দেওয়া হয় কিনা।” [বুখারী]

এ হাদীস থেকে প্রতিবেশীর অধিকারের বিষয় আমরা অনুধাবণ করতে পারি।
শরীয়তে প্রতিবেশীর সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে এবং একে ঈমানের একটি অংশ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।

হযরত আবু শুরয়াহ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল  সা. বলেছেন-
“আল্লাহর কসম! সে মুমিন হতে পারেনা।! আল্লাহর কসম! সে মুমিন হতে পারেনা! আল্লাহর কসম! সে মুমিন হতে পারেনা!”
উপস্থিত সাহাবীরা জিজ্ঞেস করলেন, “হে আল্লাহর রাসূল! কে সেই ব্যক্তি?” রাসূল সা. বলেন-
“ঐ ব্যক্তি যার ক্ষতি থেকে তার প্রতিবেশীরা নিরাপত্তাবোধ করে না।” [বুখারী]
ইসলামে একজন প্রতিবেশীর অনেক ধরনের অধিকার আছে। তার মধ্যে কিছু নিম্নরূপ-

এক. সালাম-কুশলের আদান প্রদান এবং প্রতিবেশীর নিমন্ত্রণ রক্ষা করা।
দুই. প্রতিবেশীর ক্ষতি করা থেকে দূরে থাকা।
তিন. প্রতিবেশীর বিপদে সাহায্য করা।
চার. তার ন্যায্য অধিকার আদায়ে তাকে সাহায্য করা।
পাচ. তার গোপনীয়তা রক্ষা এবং তার সম্মানের সংরক্ষণ করা।

এছাড়া একজন পরিপূর্ণ মুসলমান প্রতিবেশীর সাথে সৌহার্দ রক্ষার জন্য যেসকল কাজ করবে-
★অসুস্থ হলে সেবা করা
★মৃত্যু হলে জানাজায় অংশগ্রহণ করা
★অত্যাচারিত হলে সাহায্য করা
★ভুল করলে তার ভুল সংশোধন করে দেওয়া
★সহযোগিতা ও সহমর্মিতার সাথে পাশে দাঁড়ানো
★বিপদ-বিপর্যয়ে পাশে দাঁড়ানো
★দুর্দশায় সান্তনা দেওয়া
★আনন্দের সময় স্বাগত জানানো
★জীবনের প্রয়োজনে সৎ উপদেশ দান করা
★কোন বিষয়ে তার অজ্ঞতা থাকলে সহমর্মিতার সাথে তাকে তা জানানো
★তার অনুপস্থিতিতে তার সম্পত্তি রক্ষা করা
★তার ব্যক্তিগত গোপনীয়তাকে সম্মান ও সংরক্ষণ করা।

আবু হানিফা রহ.-এর একটি  ঘটনাঃ
ইমাম আবু হানিফা রহ. সম্পর্কে একটি ঘটনা বর্ণিত, তার একজন প্রতিবেশী ছিল, যে তাকে প্রতিদিন তার চলার পথে কষ্ট দিত। ইমাম আবু হানিফা রহ. প্রতিদিন কষ্টদায়ক বস্তু পথ থেকে দূর করতেন এবং তার কষ্টের উপর ধৈর্য ধারণ করতেন। একদিন তিনি ঘর থেকে বের হলেন, কিন্তু নির্ধারিত কোনো কষ্টদায়ক বস্তু পথের মধ্যে দেখতে পেলেন না! তিনি লোক জনের নিকট তার প্রতিবেশীর খোঁজ খবর নিলেন। তখন সবাই তাকে জানালো যে লোকটি একটি ঘটনা ঘটিয়েছে, যার কারণে তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে জেল খানায় প্রেরণ করেছে। এ কথা শোনে আবু হানিফা রহ. থানায় গিয়ে সুপারিশ করে, তাকে জেল খানা থেকে মুক্ত করে নিয়ে আসেন। কিন্তু লোকটি জানতো না যে, কে তার জন্য সুপারিশ করল?। জেল খানা থেকে বের হয়ে সে মানুষের কাছে জিজ্ঞাসা করল, কে আমার জন্য সুপারিশ করল। মানুষ তাকে বলল, তোমার প্রতিবেশী তোমার জন্য থানায় গিয়ে সুপারিশ করেছে। লোকটি বলল, কোন প্রতিবেশী? সবাই বলল, আবু হানিফা! তারপর সে তাকে কষ্ট দেয়ার কারণে লজ্জিত হল এবং কষ্ট দেওয়া হতে বিরত থাকল।

একজন মন্দ প্রতিবেশীর ঘটনাঃ
প্রতিবেশীর সাথে মানুষের সম্পর্ক সামান্য সময়ের নয়; বরং সকাল-সন্ধ্যা, রাত-দিন, মাস ও বছরের বা সারা জীবনের। এ প্রতিবেশী যদি মন্দ হয় তাহলে ভোগান্তির আর শেষ থাকে না। তেমনি এক মন্দ প্রতিবেশীর ঘটনা হাদিস শরীফে এসেছে-

“আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসূল সা. এর কাছে এসে তার প্রতিবেশীর ব্যাপারে অভিযোগ করল। রাসূল সা. তাকে বললেন-
তুমি যাও, ছবর কর। এভাবে সে দুই বার অথবা তিনবার আসার পর পরের বারে নবীজী তাকে বললেন, তোমার বাড়ির আসবাবপত্র রাস্তায় নিয়ে রাখ। সাহাবী তাই করলেন। মানুষ সেখান দিয়ে যাচ্ছিল এবং এর কারণ জিজ্ঞেস করছিল আর লোকটি প্রতিবেশীর অত্যাচারের ঘটনা তাদেরকে জানাচ্ছিল। লোকেরা ঐ লোকটিকে অভিশাপ দিচ্ছিল, আর বলছিল আল্লাহ তার সাথে এমন এমন করুন, কারণ সে এমন এমন কাজ করেছে। এটা দেখে ঐ লোকের প্রতিবেশী লোকটির কাছে এসে বলল, আমি আর এমনটি করব না (প্রতিবেশীকে কষ্ট দিব না।)!”

আখেরাতের প্রথম বাদী-বিবাদীঃ
প্রতিবেশীর হক নষ্ট করা বা তাকে কষ্ট দেওয়া অনেক বড় অন্যায়, কখনো দুনিয়াতেই এর সাজা পেতে হয় আর আখেরাতের পাকড়াও তো আছেই। আমার অর্থবল বা জনবল আছে বলে আমি প্রতিবেশীর হক নষ্ট করে পার পেয়ে যাব এমনটি নয়। হ্যাঁ, দুনিয়ার আদালত থেকে হয়ত পার পেয়ে যাব, কিন্তু আখেরাতের আদালত থেকে আমাকে কে বাঁচাবে? হযরত উকবা ইবনে আমের রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলু সা. বলেছেন, কিয়ামতের দিন প্রথম বাদী-বিবাদী হবে দুই প্রতিবেশী। [আহমাদ- ১৭৩৭২]

ইসলামে সচ্চরিত্র, সৎ, আদর্শ, ন্যায়পরায়ণ প্রতিবেশীকে জীবনের জন্য সৌভাগ্যের নিদর্শন হিসেবে ধরা হয়। রাসুল সা. তিনটি জিনিসকে সৌভাগ্যের প্রতীক বলেছেন, তা হলো প্রশস্ত বাসস্থান, সৎ প্রতিবেশী ও রুচিসম্মস্ত বাহন।

একজন প্রতিবেশীর সম্পর্কে তার প্রতিবেশীই সবচেয়ে ভালো জানেন। হযরত ইবন মাসঊদ রা. বলেন, এক ব্যক্তি মহানবীকে বললো, হে আল্লাহর রাসূল সা.! কিভাবে জানবো, ভালো কাজ করছি নাকি মন্দ কাজ করছি? মহানবী বললেন-

“যখন প্রতিবেশীদের বলতে শুনবে যে, ভালো কাজ করছো তখন মূলতই ভালোকাজ করছো। আর যখন তাদের বলতে শুনবে, খারাপ কাজ করছো তখন মূলতই খারাপ কাজ করছো।”

দয়া, নম্রতা, নরম মেজাজ ও ব্যবহারের মাধ্যমে পরিবার, প্রতিবেশী ও সমাজের মানুষের সাথে হাসি মুখে, হাস্যোজ্জ্বল চেহারা নিয়ে মিশতে হবে। তাদের সঙ্গে কোমল আচরণ করতে হবে। আর এসব যেন লোক দেখানোর না হয়- সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে প্রতিবেশীর সাথে সুন্দর আচরণ করা ঈমানের অন্যতম শিক্ষা। তাই সর্বাবস্থায় সর্ব স্তরের মানুষের সাথে ভদ্র আচরণ করা ঈমানদার ব্যক্তির কর্তব্য। সেই মানুষটি যে পর্যায়েরই হোক না কেন।

আসুন, করোনাকালীন এই সময়ে আমরা সবাই আমাদের প্রতিবেশীদের সাথে সুন্দর ব্যবহার এবং সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে সমাজ, সংসার এবং জাতীয় জীবনে শান্তির পরশ ফিরিয়ে আনার জন্য চেষ্টা করি। আল্লাহ পাক আমারদের সহায় হোন। আমিন।

 

মোঃ শামছুল আলম
লেখক ও গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top