সিডনী সোমবার, ৬ই মে ২০২৪, ২২শে বৈশাখ ১৪৩১


যুক্তির কষ্টিপাথরে ইসলাম ও মুহাম্মদ (দঃ): চৌধুরী শামস দেওয়ান


প্রকাশিত:
৪ এপ্রিল ২০১৯ ১৩:১১

আপডেট:
২২ এপ্রিল ২০২০ ০১:১৭

 

পূর্বকথা :
ইসলাম এবং ইসলামের নবী মুহাম্মদের (দঃ) বিরুদ্ধে সমালোচনা, কুৎসা রটনা এগুলো নতুন নয়। গত দেড় হাজার বছর ধরেই চলছে এর ধারাবাহকিতা। সেই আবু জেহেল, আবু লাহাব, উৎবা, শাইবা, আব্দুল্লাহ বিন উবাই থেকে শুরু করে এখনও পর্যন্ত তাদের উত্তরসূরী কেউ না কেউ সে কাজটি করেই যাচ্ছে। ইদানিং সোশাল মিডিয়াতে এ কাজটি বেশ জোরালোভাবে হচ্ছে। ইসলাম ধর্মকে, নবীকে যাচ্ছেতাই বলা হচ্ছে। আল্লাহর রাসূলকে(দঃ) ধর্ষক বলা হচ্ছে, শিশুগামীতার অভিযোগ আনা হচ্ছে, তাঁর বহুবিবাহের সমালোচনা হচ্ছে, ইসলামে দাসপ্রথা আছে এবং এটাকে অমানবিক বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। মোটকথা, অভিযোগের কোন শেষ নাই। এতে করে অনেক সাধারণ মানুষ ধোঁকায় পড়ে যাচ্ছেন, কেউ কেউ তো ঈমানহারাও হয়ে যাচ্ছেন। অনেক ভেবে দেখলাম আর বসে থাকার সূযোগ নাই। এগুলোর জবাব দেওয়া এখন ঈমানী দায়িত্ব হয়ে পড়েছে। এখানে লুকি-চুপির কিছু নেই। ইসলাম এবং ইসলামের নবীর বিরুদ্ধে যতগুলি অভিযোগ আজ পর্যন্ত এসেছে এর শতভাগই হচ্ছে ইসলামের প্রতি কিছুসংখ্যক হিংসুক টাইপের ক্ষ্যাপাটে মানসিকতার বুদ্ধিজীবির অনিরপেক্ষ বিবেচনার দ্বারা নির্বাচিত কুরআন-হাদিছের কিছু বিচ্ছিন্ন অংশের অপব্যাখ্যা। স্থূল দৃষ্টিতে এ অভিযোগগুলোকে প্রায়ই সত্য বলে মনে হয়। কিন্তু খুব সূক্ষ্মভাবে এবং একটি পরিস্কার মন নিয়ে চিন্তা ও অনুসন্ধান করলে এই সবগুলি অভিযোগই যে একেবারেই অন্তঃসারশুন্য সেটা পানির মত পরিস্কার হয়ে যায়। আমি যুক্তির ভিত্তিতে এর প্রতিটি অভিযোগের জবাব দেব ইনশা আল্লাহ। তবে পাঠকদেরকে একটু ধৈর্য ধরতে হবে। আমি আমার ধারাবাহিক লেখার এক একটি অধ্যায়ে এক একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করব।

দ্বিতীয় প্রসংগ:
ইসলাম এবং ইসলামের নবী মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহকে (দঃ) কাঠগড়ায় যারা দাঁড়া করাতে চান তারা প্রায়ই একটা জিনিষ ভুলে যান। সেটা হচ্ছে তখনকার পৃথিবীর পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিশেষত আরব ও আশেপাশের এলাকার নৈতিক অবস্থা, চাল-চলন, সংস্কৃতি, সভ্যতা, সামাজিক অবস্থা ইত্যাদি বিবেচনায় আনেন না। আমি আজ পর্যন্ত যতগুলি সীরাতগ্রন্থ পাঠ করেছি এর প্রতিটিতে দেখেছি প্রথম অধ্যায়টি তৎকালিন আরবের অবস্থার বিবরণ সংক্রান্ত। ইসলামের নবীকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়া করানোর আগে মাথায় একথাটি রাখতে পারলে যে তিনি কোন্ অবস্থার পৃথিবীতে এসেছিলেন এবং কোন্ অবস্থায় রেখে গিয়েছিলেন আমার মনে হয় তাঁর প্রতি শত্রুতার মানসিকতা সহজেই দূর হয়ে যাবে। দ্বিতীয়ত তারা আরেকটি জিনিষে এসে তালগোল পাকিয়ে ফেলেন- ব্যক্তি মুহাম্মদ, রাসূল মুহাম্মদ, সেনাপতি মুহাম্মদ, রাষ্ট্রনায়ক মুহাম্মদ এবং সর্বোপরি একজন মানুষ মুহাম্মদের মধ্যে যে ব্যবধানগুলি রয়েছে সেগুলি বেমালুম ভুলে যান। আরেকটি বিষয় জানা থাকা প্রয়োজন- মুহাম্মদকে(দঃ) বিচার করার ভিত্তি কি হবে, তাঁকে কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী বিচার করা হবে নাকি হাদিছের বর্ণনা অনুযায়ী নাকি সবকিছু বাদ দিয়ে শুধু ইতিহাস দিয়ে তাঁকে বিচার করা হবে এখানেও একটা বিবেচনার ব্যাপার রয়ে গেছে।

কুরআন-হাদিছকে বোঝার জন্য কিছু নিয়মনীতি অনুসরন করার প্রয়োজন আছে। এর সব বিষয়কে কেবল শাব্দিক ও পারিভাষিক অনুবাদ করে সেই ভিত্তিতে এর মূল্যায়ন করতে গেলেও ঘটে বিপত্তি। কুরআন এবং হাদিছের ব্যাখ্যা, পটভূমি, প্রয়োগনীতি ইত্যাদি না জেনে এগুলোকে সমালোচনা করার উদাহরণ অনেকটা এরকম- এক ব্যক্তি তার প্রিয়াকে বললো তোমার চেহারাটা হুবহু চাঁদের ন্যায়, এখন পার্শ্বে উপবিষ্ট এক বেরসিক বলে উঠলো আরে বোকারাম মানুষের মুখ আবার হুবহু চাঁদের ন্যায় হয় কেমনে, চাঁদের আয়তন কত আর তোমার প্রিয়ার মুখের আয়তন কত ভেবে দেখেছ? তুমি আসলে একটা ব্যাক্কেল! আরেকজন আবেগে বলে উঠলো আহা! বসন্ত এলো, ফুলও ফোটলো কিন্তু ভ্রমর তো এলো না! আরেকজন একথা শুনে তাকে ধমকের সুরে বলে উঠলো, তুমি কি পাগল? এসব আবোল-তাবোল বকছো কেন? তখন তৃতীয় একজন তাকে বুঝিয়ে দিলো, ভাই আপনি বুঝতে পারেননি, এখানে বসন্ত বলতে তার যৌবনকাল, ফুল সে নিজে আর ভ্রমর বলতে তার প্রেমিককে বুঝতে হবে, তাহলে আর আবোল-তাবোল মনে হবে না। ইসলাম ও নবী মুহাম্মদের বিরোধীতাকারীদের অবস্থা অনেকটা এরকমই। চাঁদের সাথে প্রিয়ার মুখের তুলনা করলে যে আয়তন মাপামাপির প্রয়োজন হয় না, বসন্ত শব্দটি উচ্চারণ করলেই যে কেবল বসন্ত কালকেই বোঝায় না এসব তারা বোঝেন না বলেই ঘটে যত বিপত্তি। 

আরেকটা বিষয়:
যেকোন বিষয়কে ইতিবাচক ও নেতিবাচক এই দুটি দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখা যায়, ব্যাখ্যা করা যায়। যেমন ধরুন ৫ সংখ্যাটিকে আপনি ৩ যোগ ২ বা ৪ যোগ ১ বলে বোঝাতে পারেন তেমনিভাবে ৬ বিয়োগ এক বা ৭ বিয়োগ ২ অথবা আরো অনেকভাবে বোঝাতে পারেন। আবার ধরুন কোন বিশেষ ব্যক্তির ব্যাপারে আপনি বলতে পারেন লোকটি অসুস্থ নন অথচ এই একই বিষয় আপনি অন্যভাবে ইতিবাচক করে বলতে পারেন লোকটি সুস্থ। এখানেই হচ্ছে দৃষ্টিভঙ্গির তফাৎ। আরেকটি উদাহরণ দিই- আপনি একটি নদীর তীরে বসে আছেন, চারিদিকে খুব খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছেন আর আনমনে ভাবছেন এই নদীটিকে নিয়ে। এখন আপনার মনে দুই ধরণের অনুভূতি আসতে পারে, একটা ইতিবাচক আর একটা নেতিবাচক। ইতিবাচক অনুভূতিতে আপনার মনে হবে- আহা! কি সুন্দর এই নদীটা! কেমন কলকল করে স্রোতের আওয়াজ আসছে! কি সুন্দর কতকগুলি বক উড়ে যাচ্ছে! ছলাৎ ছলাৎ শব্দ করে নৌকাগুলো একটার পর একটা আসছে, যাচ্ছে! এটা হচ্ছে ইতিবাচক অনুভূতি। কিন্তু আপনার মনে আরেক প্রকার অনুভূতিও আসতে পারে। যেমন- আচ্ছা, এই নদীর পাড়ে এত বিশ্রি জঙ্গল লেগে আছে কেন? পানির ভেতরে অনেক পঁচা শ্যাওলা জমে আছে। নৌকাগুলির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ বড্ড কানে বাজছে! ঐ যে দূরে পাখিগুলি উড়ে যাচ্ছে এরা নিশ্চয় মাঝে মাঝে মাঝে এই পানিতেই বিষ্ঠাত্যাগ করছে! ইস্ রে ভাবতেই কেমন ঘেন্না লাগছে!

দেখুন তো অনুভূতির কত পার্থক্য! এটাকেই বলে ভাবনা-চিন্তার ইতিবাচকতা আর নেতিবাচকতা। ইসলামকে বিবেচনার ক্ষেত্রে বা বোঝার ক্ষেত্রে চিন্তার ইতিবাচকতা এবং নেতিবাচকতা বিরাট ভূমিকা রাখে। 

 

যুক্তির কষ্টিপাথরে ইসলাম ও মুহাম্মদ (দঃ) পর্ব ২
এ পর্বে আমি আবারো সেই ইতিবাচক ও নেতিবাচক চিন্তা দিয়ে শুরু করছি। আগের পর্বে একটি উদাহরণ দিয়েছিলাম যে একজন মানুষ একটি নদীর তীরে বসে বসে যখন এই নদীটিকে নিয়ে চিন্তা করে তখন তার মনে দু ধরণের বিচারশক্তি কাজ করে, একধরণের বিচারশক্তির দ্বারা সে কেবল নদীটির খারাপ দিকগুলো দেখে এবং দেখতে দেখতে সে এই নদীটিকে একসময় ঘৃণা করতে শুরু করে। আবার দ্বিতীয় ধরণের বিচারশক্তির দ্বারা সে এই নদীটির সৌন্দর্য দেখে আভিভূত হয়ে যায়, তার চোখে তখন নদীটির খারাপ দিকগুলোও ভালো লাগে, কারণ সে তখন গভীর দৃষ্টিতে চিন্তা করে এই খারাপ দিকগুলোরও একটা ভালো ব্যাখ্যা খুঁজে পায়। যেমন ধরুন আগের পর্বে বলেছিলাম, নেতিবাচক বিচারশক্তি দিয়ে চিন্তা করার কারনে লোকটার কাছে বার বার মনে হচ্ছিল- এ নদীর পাড়ে এত বিশ্রি জঙ্গল লেগে আছে, পানিতে শ্যাওলা পড়েছে, নৌকা চলার ছলাৎ ছলাৎ শব্দে বিরক্ত লাগছে, পাখিগুলি নদীতে বিষ্ঠা ছাড়ছে ইত্যাদি। এখন তার কাছে কেবলই এই নদীর খারাপ দিকগুলো ধরা পড়ছে- মনে হচ্ছে পানিতে কেমন দূর্গন্ধ! কোথাও নিশ্চয় কোন প্রাণী মরে পঁচে আছে, মাটির কেমন একটা স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ! সে ধীরে ধীরে আতংকিত হয়ে ভাবতে থাকে এখানে বসে থাকা কি আদৌ স্বাস্থ্যকর? কলেরা হবে না তো? কিংবা বড় কোন অসুস্থতা? সে তখন এই নদী থেকে দূরে চলে যায়, ভাবে বেঁচে গেলাম। সত্যিই কি তাই? এখন যদি কেউ এসে তাকে বলে ভাই আপনি তো শুধু জঙ্গলটাকে জঙ্গলই দেখলেন কিন্তু ভেবে দেখেছেন কি এই জঙ্গলটিতে বসন্তকালে যখন চারিদিকে ফুল ফোটে তখন কত সুন্দর দেখায়, দূর থেকে এই ফুলেল জঙ্গলটিকে শুধু দেখতেই মন চায়! কেমন সুগন্ধ ছড়ায় পুরো এলাকায়! আরো চিন্তা করেছেন কি একসময় এই ফুলগুলি ঝরে গিয়ে নতুন করে ফল আসে জঙ্গলের গাছে গাছে। এলাকার ছোট ছোট বালক-বালিকারা এসব দিয়ে খেলা করে, কোন কোন ফল খেতেও পারে। এসব ভেবেছেন কি? এই শ্যাওলা, এই পাখির বিষ্ঠা এসবই হচ্ছে এ নদীর মাছগুলোর খাদ্য, আপনার দৃষ্টিতে যা খুব বাজে মনে হচ্ছে আসলে তা সেরকম বাজে নয়, অন্যকথায় এসব হচ্ছে প্রকৃতির ব্যালান্স কিন্তু বুঝতে পারছেন না। একইভাবে অন্য সবগুলি বিষয়ের ব্যাখ্যা খুঁজে পেয়ে লোকটির মনে হবে- তাই তো, আমি তো এভাবে চিন্তা করিনি! আমি তো বড় ভুলের উপরে ছিলাম! পাঠক আমার মনে হয় ইসলাম ধর্মটিকে আমরা এই নদীর সাথে তুলনা করতে পারি। 

বইয়ের শিরোনাম অনুযায়ী প্রথমে ইসলামের যৌক্তিকতা নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু ইসলাম বোঝার আগে মুহাম্মদকে (দঃ) বুঝে নিতে পারলে ইসলামকে বোঝা আরো সহজ হয়ে যাবে বলে আমার বিশ্বাস, যেকারনে আমি এ গ্রন্থটিতে প্রথম মুহাম্মদকে (দঃ) নিয়েই আলোচনা করবো। মুহাম্মদকে (দঃ) বিবেচনায় আনার জন্য আমাদেরকে তাঁর পুরো জীবনটাকেই সামনে এনে দেখতে হবে। তিনি দুনিয়াতে মোট তেষট্টি বছর ছিলেন। তন্মধ্যে ৪০ বছর নবুয়তপূর্ব এবং ২৩ বছর নবুয়তপরবর্তী। নবুয়তপরবর্তী জীবন আবার দুইভাগে বিভক্ত, ১৩ বছর মক্কার আর দশ বছর মদীনার জীবন। মুহাম্মদের (দঃ) নবুয়তপূর্ব ৪০ বছর এবং নবুয়তপরবর্তী মক্কার ১৩ বছরের জীবন নিয়ে তাঁর শত্রু-মিত্র কারোরই কোন আপত্তি নাই। অর্থাৎ তাঁর জীবনের মোট ৫৩ বছরই অবিতর্কিত। ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত মক্কার মানুষগুলোর কাছে তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রিয়ভাজন মানুষ। তাঁর ব্যক্তিত্ব, তাঁর পূত-পবিত্র চরিত্র, তাঁর আমানতদারি, তাঁর ব্যবহার সবই ছিল অতি উত্তম, চুড়ান্ত ব্যতিক্রমী। মক্কার লোকেরা তাঁকে আল-আমিন নামে অভিহিত করতো। যার অর্থ হচ্ছে বিশ্বাসী। সমাজের কারো সাথে কোন ব্যাপারেই তাঁর বিরোধ ছিল না, সবার কাছে তিনি ছিলেন সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য একজন মানুষ। আমরা দেখতে পাই, মক্কাবাসীদের সঙ্গে তাঁর চরম বিরোধের দিনগুলোতেও তাঁর শত্রুরা পর্যন্ত নিজেদের মালামাল তাঁর কাছে গচ্ছিত রাখতো আর তিনি কোনপ্রকার বিনিময় ছাড়াই এগুলো আমানত হিসাবে রেখে দিতেন। মুহাম্মদের (দঃ) চরিত্র বিবেচনায় আনার জন্য তাঁর এই আমানতদারির দিকটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মক্কার জীবনের শেষ দিনটিতেও যেদিন তাঁকে হত্যা করে ফেলার চুড়ান্ত ফয়সালা এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়ে গেছে, তিনি তাঁর শত্রুদের গচ্ছিত মালামালগুলো মেরে দেয়ার চিন্তা করেননি, জীবন হাতে নিয়ে, আপন প্রিয়ভাজন চাচাতো ভাই আলীকে (দঃ) নিহত হয়ে যাবার ঝুঁকিতে ফেলে রেখে গেছেন মালামালগুলো যথাযথভাবে মালিকদের হাতে পৌঁছায়ে দেওয়ার জন্য। 

মুহাম্মদের (দঃ) নবুয়তপরবর্তী মক্কার ১৩ বছরের ইতিহাস ছিল কেবলই তাঁর এবং তাঁর অনুসারীদের নিগৃহিত, নিপীড়িত, নিষ্পেষিত এবং নির্যাতিত হওয়ার ইতিহাস। অত্যাচারের হেন কোন পদ্ধতি নাই যা তাঁর এবং তাঁর অনুসারিদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়নি। মোটকথা, যে কেউ মুহাম্মদের (দঃ) জীবনের এই ৫৩ বছরের ইতিহাস পড়বে সে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় আভিভূত হয়ে পড়বে। বাকী রইলো তাঁর মাত্র দশবছরের হিজরত পরবর্তী মদীনার জীবন। এই জীবনের মাত্র কয়েকটি বিষয় নিয়ে তাঁর শত্রুদের যত বিতর্ক, যত ক্ষোভ। যেমন- আয়েশার (রাঃ) সঙ্গে তাঁর বিবাহ, পরবর্তীতে আরো অনেকগুলি বিবাহ, দাসপ্রথার অনুমোদন, দাসীদের সঙ্গে যৌনমিলনের অনুমতি, বানু নাজির, বানু কুরাইজা, বানু মুসতালিক, বানু কাইনুকা প্রভৃতি অভিযান, বন্দীদের সাথে আচরণ সহ আরো কতকগুলি বিষয় নিয়েই তাঁর ব্যাপারে যত অভিযোগ। আমার যথাসাধ্য চেষ্টা থাকবে এই বিষয়গুলোর উপর একটা একটা ঘটনাকে বা নিয়মকে সামনে এনে এর বিশ্লেষণ করা। 

আজকে আমি এ পর্বের আলোচনায় রাসূলের (দঃ) দুশমনদের দ্বারা অপপ্রচারকৃত ও অপব্যাখ্যাকৃত একটি হাদিছ বিবেচনায় আনবো। আজ থেকে বহু বছর পূর্বে খুব সম্ভব তসলিমা নাসরিনের নির্বাচিত কলামে এবং এরপরে আরো কয়েকস্থানে বিভিন্ন ইসলাম-বিদ্বেষী মিডিয়াতে এই হাদিছটির প্রচুর সমালোচনা হতে দেখেছি। হাদিছটির বাংলা অনুবাদ হচ্ছে- দুনিয়াতে যাকিছু রয়েছে সবই ভোগের সামগ্রী, আর এর মধ্যে সবচেয়ে ভালো ভোগের সামগ্রী হচ্ছে ভালো নারী। এই হাদিছটি প্রচার করতে গিয়ে মুহাম্মদের (দঃ) শত্রুরা খুব প্রচারণা চালাতে থাকে যে, দেখো সমগ্র নারীজাতিকে কেমন করে মুহাম্মদ (দঃ) ভোগের সামগ্রী বানিয়ে দিলো। এমনকি কোন কোন অবিবেচক একথাও বলতে দ্বিধা করেনি যে, একারণেই তো তাঁর উম্মতেরা মেয়েদেরকে ‘মাল’ ছাড়া কিছু ভাবতে পারে না (পাঠকদের জ্ঞাতার্থে বলছি, একথা ঠিক যে কিছু পশু প্রকৃতির লোক মেয়েদের প্রতি কু ইঙ্গিত করে এ শব্দটি ব্যবহার করে থাকে, কিন্তু যারা করে তারা কি ধর্মপ্রাণ মানুষদের অন্থর্ভুক্ত? মোটেই না, কিছুসংখ্যক বখাটে ছাড়া এধরণের শব্দ কেউ ব্যবহার করে না, ধর্মপ্রাণ তো দূরের কথা।) প্রথমত হাদিছটির অনুবাদ করার ক্ষেত্রে করা হয়েছে বড় জালিয়াতি। মূল হাদিছটির আরবী উচ্চারণ হবে কুল্লু শাইয়িন ফিল আরদ্বি মাতা’ ওয়া খাইরু মাতা’ইহা মারআতুন সালেহা (হাদিছটির উচ্চারণ, মূল বাক্যের হুবহু উপস্থাপনে আমার ভুল হতে পারে, কারন, অনেকদিন আগে দেখা, কোন ভাইয়ের জানা থাকলে ভুল ধরিয়ে দিলে খুশী হব। রেফারেন্সও উল্লেখ করলাম না, প্রশ্ন যদি উঠে, অবশ্যই দেব)। হাদিছটির অনুবাদ এভাবে করা যেত- ভূপৃষ্ঠে যাকিছু আছে সবই সম্পদ আর সর্বোত্তম সম্পদ হচ্ছে উত্তম চরিত্রের নারী। প্রকৃতপক্ষে অর্থের বিবেচনায় ভোগের সামগ্রী আর সম্পদের মধ্যে খুব বড় পার্থক্য নাই। কিন্তু প্রয়োগের ক্ষেত্রে আছে। আরবী মাতা’ শব্দটির অর্থ এখানে সম্পদ করলে উদ্দেশ্য সফল হয় না। কারণ সম্পদ শব্দটির প্রয়োগ ভোগের সামগ্রী প্রয়োগের মত সমান তুচ্ছার্থ বহন করে না। আমরা কথাপ্রসঙ্গে অনেক সময় নিজের মা-বাবাকে সম্পদ বলে থাকি। যেমন- ভাই আমার মা জীবিত আছেন, আমার আর কিছুর প্রয়োজন নাই, মা-ই আমার বড় সম্পদ! অনেক সময় নিজের সন্তানদের ব্যাপারে মানুষ বলে থাকে- এরাই আমার সবচেয়ে বড় সম্পদ! বরের বাপ কনের বাপকে বলে- আমার আর কিছু পাওয়ার দরকার নাই, আপনার বড় সম্পদই তো আমাকে দিয়ে দিলেন। কনের বাপ জবাবে বললেন- হ্যা ভাই আমার সবচেয়ে বড় সম্পদ ছিল এই মেয়েটি! একে আপনার কাছে গচ্ছিত রাখলাম, আপনি যতন করে রাখবেন। এভাবে সম্পদ শব্দটির বিভিন্ন অর্থের ব্যবহার বাংলা ভাষায় আছে। আসলে এখানে সম্পদ শব্দটি ঠিক সম্পদ অর্থে ব্যবহৃত হয়নি। কোনকিছুর প্রতি আবেগ প্রকাশার্থে বা গুরুত্ব দেখানোর প্রয়োজনে অনেক শব্দই আমরা ব্যবহার করে থাকি, যেগুলো আসলে তার শাব্দিক অর্থের চেয়ে আবেগকেই প্রকাশ করে বেশী। এই হাদিছটিতে একজন পূণ্যবতী নারীর কতটুকু মর্যাদা সেকথাটাই বোঝানো মুখ্য উদ্দেশ্য, তাদেরকে ভোগের সামগ্রী বানানো নয়। এখানে আরেকটা বিষয়ও লক্ষণিয়, বলা হয়েছে পৃথিবীতে যাকিছু আছে সবই সম্পদ, তাহলে তো পুরুষরাও সম্পদ, কারন পুরুষরা তো এ পৃথিবীর বাইরের কেউ নয়। এক্ষেত্রে বলা যায় যে, পৃথিবীতে যাকিছু আছে সবই সম্পদ (নারীও সম্পদ, পুরুষও সম্পদ) তন্মধ্যে সবচেয়ে উত্তম সম্পদ হচ্ছে পূণ্যবতী নারী। পাঠক, দেখুন তো সামান্য একটি শব্দের অপপ্রয়োগ এবং অপব্যাখ্যার কারনে কত সুন্দর একটি হাদিছকে কেমন বিশ্রিভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে! 

 


বিষয়: ইসলাম


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top