সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৫ই বৈশাখ ১৪৩১

হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা -- মনে মনে: সিকিম ভ্রমণ : ডা: মালিহা পারভীন


প্রকাশিত:
১৭ জুন ২০২০ ০০:১৫

আপডেট:
৬ আগস্ট ২০২০ ০৬:১৬

 

ভ্রমন প্রিয় মানুষরা এই করোনা মহামারিতে অনেকেই হয়তো কাটাচ্ছেন স্মৃতি রোমন্থন ক'রে। অনেকে আশায় আছেন ফিরে আসবে আবার শুভদিন। তেমনি ২০১৯ এ আমার সিকিম ভ্রমনের ছবিগুলি যখন ফেসবুক মেমোরিতে উঠে এলো তখন আমিও স্মৃতির আকাশে মেলে দিলাম আমার ' মনে মনে এই ডানা -'।

মোট দশ জনের আমাদের বন্ধু দল ৮ ই জুন ২০১৯ এ সড়ক পথে ঢাকা থেকে সন্ধ্যায় রওয়ানা হলাম সিকিমের উদ্দেশ্যে। ঈদের ছুটির ভীড়, সীমান্ত পার হবার নানা ঝক্কি পেরিয়ে পৌঁছাতে সময় লেগে গেল প্রায় আটাশ ঘন্টা।
আমরা গ্যাংটক যখন পৌঁছালাম রাত তখন তিনটা। জনমানব শুন্য সুনসান পাহাড়ি লোকালয়। একটানা ঝমঝম বৃস্টি পড়ছে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। দুর্গম আঁকাবাঁকা পথে ল্যাম্প পোস্টের টিমটিম আলোয় পরিবেশ হয়ে উঠেছে রহস্যময়। আমাদের বহনকারী মধ্যযুগীয় যানটি সুনসান পথ ধরে চলছে ধীর লয়ে। ক্ষুধা, ক্লান্তি সব ছাপিয়ে এই পরিবেশ মনকে জানান দিচ্ছিল এবারের সিকিম ভ্রমন বেশ জমে উঠবে নানা এডভেঞ্চারে!
ছোট্র একটি পাহাড়ি দেশ এই সিকিম। ভারতের উত্তর পুর্বে এর অবস্থান। আয়তন মাত্র ৭০৯৬ বর্গ কিমি, ভারতের দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম শহর। সিকিমের রাজধানী গ্যাংটক যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৬৫০ ফুট উঁচুতে। নানা ঘাত প্রতিঘাত ইতিহাস পিছনে ফেলে ১৯৭৫ সনে সিকিম ভারতের ২২ তম প্রদেশ হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

ভ্রমনের ক্লান্তিতে আমরা হোটেলে যেয়ে গভির ঘুম দিলাম। সকালে সময় মতন বের হলাম গ্যাংটক দেখতে। গ্যাংটক শহরের মধ্যে দিয়ে সিকিমের অন্যান্য জায়গায় যাওয়া আসা করতে হয় বলে শহরটি বেশ ব্যস্ত।
পাহাড় ঘেরা, পাহাড় নিয়ে, পাহাড়ের মধ্যেই এ শহরের বাস। উঁচুনীচু আঁকাবাঁকা পথ ধরে গাড়ি ছুটছে, মানুষ চলছে। চারিদিকে সবুজ আর সবুজ। উজ্জ্বল রঙ করা ছোট ছোট বাড়িগুলি পাহাড়ের ধাপে কি সুন্দর খোঁপায় তারা ফুল হয়ে যেন ফুটে আছে। প্রতিটি বাড়ির বারান্দায় নানারকম ফুলের বাহার। মাত্র ১ লক্ষ জনসংখ্যার এ শহর। পথে মানুষজন কম। নির্দিষ্ট জায়গা ছাড়া যত্রতত্র দোকানপাট নাই।


আমরা যখন বের হলাম তখন সকাল ৯ টা, মানে অফিস সময়। স্কুলগুলিও খোলা মনে হলো। তাই দেখলাম বেশ গাড়ির ভীড়। স্কুল ড্রেস পরা গোলগাল মুখের দেব শিশুরা দল বেঁধে স্কুলে যাচ্ছে। তাদের কলকাকলি মুখর করে তুলছেভ পাহাড়ি নির্জনতা।
স্কুলবাসগুলি পাহাড় ঢালে বাচ্চাদের নামিয়ে দিয়ে যায়। বেশির ভাগ স্কুলগুলি পাহাড়ের চুড়ায়। পিচ্চি পিচ্চি বাচ্চাগুলি পিঠে স্কুল ব্যাগ, হাতে ছাতা নিয়ে তরতর করে উঠে যাচ্ছে। ছোটবেলা থেকে এরা প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে বড় হয়।

সিকিমে শিক্ষার বর্তমান হার ৮২.৬%। প্রত্যন্ত দুর্গম এলাকায় এই সংখ্যা চমকে দেয়ার মতনই । শতভাগ বাচ্চা এখানে প্রাইমারি স্কুলে যাচ্ছে। এখানকার পড়াশুনার প্রায় সমস্ত খরচ বহন করে সরকার। দশ হাজার শয্যার বিশাল আধুনিক একটি শিশু হাসপাতাল দেখলাম।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সাথে দর্শনীয় নানা কিছু আছে এই গ্যাংটকে। আমরা প্রথমে টাশি ভিউ ( Tashi view) গিয়েছি । এটা একটা পাহাড় চূড়া। নানাভাবে সাজিয়েছে পর্যটকদের জন্য। এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার কিছু অংশ দেখা যায়।
তিব্বতীয়ান সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে ' নামগাল ইন্সটিটিউট অফ তিব্বেটোলজির ' জাদুঘরটি বেশ সমৃদ্ধ। হনুমানকে উৎসর্গ করা ' হনুমান টক মন্দির' সুন্দর কিন্তু বেশ উঁচুতে। আছে বান ঝাকরি ফলস, হিমালয় জুওলজিকাল পার্ক। পর্যটক গমগম করছে।
আমরা দুইদিনে রুমটেক মনাস্ট্রি, রিডজ ফ্লাওয়ার গার্ডেন, লহসা ফলস, গান্ধী মুর্তি ইত্যাদি দেখেও খুব একঘেঁয়ে বা ক্লান্তি বোধ করিনি। বরং ভাল লেগেছে। এ ছাড়া রোপওয়ে, রাফটিং, ট্র‍্যাকিং, হাইকিং ইত্যাদি পর্যটকদের দেয় আলাদা আনন্দ।
কেনাকাটার এম জি মার্কেট বিখ্যাত। এখানে সবই পাওয়া যায়। স্থানীয়দের বানানো ঐতিহ্যবাহি পোশাক, জুয়েলারি কিনতে পারেন। তবে বৃস্টির দেশ সিকিমে বিশেষ ধরনের ছাতা কিনতে ভুলবেন না।
এদের পাহাড়ি খাবারগুলিও বেশ মজাদার। বাঁশের চাঁটাইয়ের ভাপে তৈরী ' মমো ' না খেলে সিকিম ভ্রমন অপূর্ন থেকে যাবে।
একটা তথ্য না জানালেই নয়। কৃষিপ্রধান এই দেশটি পৃথিবীর সর্বপ্রথম জৈব রাস্ট্র ( Organic State) মানে যেখানে কোনোরকম কীটনাশক, কৃত্রিম সার ইত্যাদি ব্যবহার ছাড়া জমিতে ফসল ফলানো হয়।

লাচুং এর ইয়ানথাং ও জিরো পয়েন্ট ভ্রমন:

লাচুং : উত্তর সিকিমের ৮৬১০ ফুট উঁচুতে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে মায়াবি এক গ্রাম। গ্যাংটক থেকে এর দুরত্ব ১১৮ কিমি।

গ্যাংটক থেকে লাচুং যাওয়ার পথের দৃশ্য সত্যিই স্বর্গীয়। সবুজ ঘন অরন্য, উঁচুনিচু গভির খাদ, ছোট বড় পাথরের চাঁই। পথে যেতে কিছুক্ষন পরপর হাতির শুঁড়ের মতন বিশাল সব ঝর্না! আমাদের জীপ এগোচ্ছে এঁকেবেঁকে। মুগ্ধতা বাড়ছে আমাদের।
মাটিতে আছড়ে পরা ঝর্নার সমর্পন, খরস্রোতা পাহাড়ি নদীর ভয়ংকর শব্দ ভ্রমন সংগীদের বেসুরো গান থামিয়ে দিয়েছিল । দারুন উপভোগ করেছি এই বিপদ সংকুল পথের ৬ ঘন্টার চলা। হাসি গান আনন্দ উত্তেজনা মুগ্ধতা নিতে লাচুংএর পথে চলেছি।
পথের দু'ধারে গহিন অরন্য, পাহাড়ের পর পাহাড়! অসংখ্য ঝরনা চুলের সিঁথির মত, কখনো বালিকার লম্বা বেনির মতন, ফুঁসে উঠা সাপের মত গড়িয়ে নেমে আসছে মাটিতে। আমরা আর স্থির থাকতে পারলাম না। সময়ের কথা না ভেবে গাড়ি থামিয়ে ঝর্নার কাছে গেলাম। এর ঠান্ডা পানিতে পা ভেজালাম, ছবি তুললাম- ফিরে গেলাম কিশোর বেলায়।



লাচুং পৌছাতে রাত দশ বেজে গেল। পৌঁছে দারুন অভ্যর্থনা পেলাম হাড় কাঁপানো শীত মশাইয়ের। ওরেব্বাস! শীতে একদম জমে যাওয়ার অবস্থা !
সবাই ফ্রেশ হয়ে কাঁপতে কাঁপতে খাবার ঘরে গেলাম। ধোঁয়াওঠা গরম ভাত সাথে বন মোরগের ঝাল ঝাল পাতলা ঝোল তরকারি! কব্জি ডুবিয়ে খেলাম ।অমৃত সম লাগলো !
পরদিন ভোর ৫ টায় রওয়ানা দিতে হবে ইয়ানথাং ভ্যালি ( Yangthan Velly - means Valley of Flowers) র উদ্দেশ্যে । সবাই ওভারকোট, কান টুপি, দস্তানা, বুট জুতা পরে বস্তাবন্দি হয়ে জীপে উঠে বসলাম। গবতব্যব ইয়ানথাং ভ্যালী, পরে জিরো পয়েন্ট। লাচুং থেকে ইয়ানথাং ভ্যালির দুরত্ব ২৫ কিমি যা সমূদ্রপৃসঠ থেকে ১১,৮০০ ফুট উঁচুতে

ইয়ানথাং ভ্যালি : এই উপত্যকাটি হচ্ছে ফুলের স্বপ্নরাজ্য। এখানে মার্চ থেকে মে মাসে রডনডেনড্রন নামের ( Rhodondentron) বাহারি নানা রঙা ফুল ফোটে মাইলের পর মাইল জুড়ে। আমরা গিয়েছি জুনে, ফুল পাইনি। কিন্তু দেখেছি এর দিগন্ত বিস্তৃত অপরুপ শোভা।

জিরো পয়েন্ট : উত্তর সিকিমের শেষ প্রান্তে চীন সীমান্ত ঘেঁষে সমূদ্রপৃস্ঠ থেকে প্রায় ১৫০০০ ফুট উঁচু এর অবস্থান। এর পর আর পথ নেই বলে এর নাম জিরো পয়েন্ট। পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ এখানকার বরফ পাহাড়।
আমরা জিরো পয়েন্টের দিকে এগোচ্ছি সুর্যদোয়ের নবজাতক সুর্যোকে সাথে নিয়ে। হাড় কাঁপা ঠান্ডা বাতাস। । ভোরের আলোছায়া মাখা পাহাড়ি পথ বেয়ে আমাদের মতন পর্যটকবাহি অসংখ্য জীপ চলছে।
প্রায় ২ ঘন্টার পথ পেরিয়ে পৌছেঁ যাই জিরো পয়েন্টে । সাদা বরফে ঢাকা বিস্তীর্ণ প্রান্তর। ছোট বড় অসংখ্য শ্বেত শুভ্র বরফ পাহাড় গুচ্ছ। মাঝে মাঝেই কালো ঢেকে দিচ্ছে সব। আবার সূর্যের হঠাৎ সোনালি আলোয় রক্তিম হয়ে যাচ্ছে বরফ সমূদ্র। অপুর্ব!
শীত ও পিচ্ছিল পথ উপেক্ষা করে বরফ চূড়ায় দেখি বিন্দু বিন্দু অসংখ্য মানুষ। কেউ উঠছে, কেউ গড়িয়ে পরছে, কেউ পিছল খেয়ে খিলখিল হাসছে। বরফ ছুড়ে দিচ্ছে কেউ এ ওর দিকে, ঠান্ডায় জমে যেতে যেতে আবার দৌড়াচ্ছে।
আমাদের উৎসাহী দল বেশি উঁচুতে উঠার সাহস না পেলেও বরফের সাথে বন্ধুত্ব করতে সময় লাগলো না। বরফে গড়াগড়ি, শুয়ে থাকা, বসে থাকা, ফটো সেশন সবই হলো।
স্থানীয়রা দেখি ওর মধ্যেই চুলা ধরিয়ে দেখি নুডুলস, ছোলা, চা - কফি বানাচ্ছে। শীতে কাঁপতে কাঁপতে বীট লবন দিয়ে সেই ঝাল ছোলার স্বাদ কখনো ভুলবো বলে মনে হয়না!
এবার ফেরার পালা লাচুং এ। ওখানে লাঞ্চ সেরে গ্যাংটক। ফেরার পথে নেমে গেলাম নাম না জানা পাহাড়ি খরস্রোতা নদির ধারের বিশাল এক উপত্যকায়। বিশাল প্রান্তরে মাঠ জুড়ে ঘাসবন, নানা আকারের পাথর, পর্যটকদের বসার জন্য সুসজ্জিত বেঞ্চ। ইয়াকের দল যত্রতত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে । দল বেঁধে মেঘরা পাহাড় ছুঁয়ে খেলা করছে - কি মায়াময় দৃশ্য!
এ পরিবেশ আমাদেরকে আবেগ আক্রান্ত করলো মুহুর্তেই। কিছুক্ষন ঘুরে বেড়ালাম বিস্তির্ন এই মাঠে। নদির পাড়ের বেঞ্চে বসে স্তব্ধতায়। ছবি তুললাম। সামনে সৌম্য সবুজ পাহাড়। পায়ের কাছে স্রোতস্বিনী মুখর নদি, আকাশ ছাওয়া ধুসর এলো মেঘ !! সেই মুহুর্তটি স্মৃতি ফ্রেমে আটকে গেল !!

বৈরী আবহাওয়ার জন্য পরিকল্পনামত ৪০ কিমি দূরে সাংগু লেকে যাওয়া হয়নি। বরফ হ্রদের জায়গাটি পর্যটকদের জন্য শুনেছি অনেক আকর্ষনীয়।
সিকিমের আরেকটি দর্শনীয় শহর হচ্চ্ছে   পোলিং।  ব্রিজ দিয়ে মন্দিরে যাওয়া, রিম্বি অরেঞ্জ গার্ডেন, ট্রেকিং ইত্যাদি পোলিং ভ্রমনের আকর্ষন। একটু বেশি সময় নিয়ে গেলে পর্যটকরা সব কিছুই উপভোগ করতে পারবেন মনের মতন ক'রে।

সময়ের অভাবে আমাদের অনেক কিছুই দেখা হয়ে উঠেনি। তবু স্মৃতি ভান্ডার ঋদ্ধ করেই ফিরেছি। পাহাড়, নদি, ঝর্না, পাথরের মাঝে সরল মানুষ, তাদের সাধারন যাপিত জীবন ভাল লাগায় মন পুর্ন করেছে। আর লাচুং জিরো পয়েন্টের বরফ শীতল পাহাড় উষ্ণ আনন্দে সমৃদ্ধ করেছে জীবনের দিনপঞ্জি।

 

ডা: মালিহা পারভীন
কবি ও কথা সাহিত্যিক

সেগুনবাগিচা, ঢাকা

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top