সিডনী মঙ্গলবার, ২৩শে এপ্রিল ২০২৪, ১০ই বৈশাখ ১৪৩১

অপরূপা- রূপসী সাতক্ষীরাতে ক'দিনঃ ঐতিহ্য ও ইতিহাসের খোঁজে : ডঃ সুবীর মণ্ডল


প্রকাশিত:
৩১ আগস্ট ২০২০ ২০:৪৪

আপডেট:
২৩ এপ্রিল ২০২৪ ১৪:২৪

 

বসিরহাটের ইছামতি নদীর তীরে, চায়ের আসরে আড্ডা দিতে দিতে কলেজের পুরানো বন্ধুরা হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিল, এবার পুজোয় কয়েক দিনের জন্য ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি সাতক্ষীরায় বেড়াতে যাব। যেমন ভাবা, তেমনি প্রস্তুতি শুরু করলাম। দ্রুততার সঙ্গে  যাওয়ার আয়োজন করা হলো। এর আগে আমি বেশ কয়েকবার বাংলাদেশ ভ্রমণে গেছি। মনে একটা কিন্তু কিন্তু হচ্ছিল।সবার আবেদন ফেলতে পারলাম না।

অবশেষে মহাসপ্তমীর দিন খুব সকালে, প্রয়োজনীয় শীতের পোশাক সহ একটা লাগেজ নিয়ে ৬ জন বন্ধু রওনা দিলাম ঘোজাডাঙ্গা-ভোমরা  সীমান্তের উদ্দেশ্যে। বসিরহাট মহকুমার শহর থেকে ভোমরা সীমান্তের দূরত্ব মাত্র ১০কি, মিঃ। একটি টোটো ভাড়া করে যাত্রা শুরু করলাম। আনন্দে মন ভরে উঠছে, এত কম খরচে বিদেশ ভ্রমণ ভাবা যায়না। আসলে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা, খুলনা, যশোর জেলার শহরগুলো ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার খুব  কাছাকাছি। হাত বাড়ালেই বিদেশ। আট থেকে আশির, স্বপ্নপূরণের  এক আদর্শ ঠিকানা রূপসী বাংলাদেশ। 

উত্তর ২৪পরগণার সীমান্ত শহর বসিরহাট-ইটিণ্ডা রোডের হৃদয় ছুঁয়ে, নানান বর্ণময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতেই মিনিট কুড়ির মধ্যে পৌঁছলাম ঘোজাডাঙ্গা বর্ডারে। ওপারে বাংলাদেশের ভোমরা স্থলবন্দর ও শহর। সীমান্তের দু'ই চেকপোস্টে  সরকারি সমস্ত কাজ শেষ করে,জিরো পয়েন্টে গিয়ে সবাই দাঁড়ালাম। সময় সকাল ৭টা। কয়েক মিনিট বাদেই বিদেশের মাটিতে পা রাখব। এ-এক  অন্য অনুভূতি। বেশ ভালো লাগছে নিজেকে। মন জুড়ে একটা ভাবনার স্রোত বয়ে গেল। সীমান্ত রেখার দু'পাশে দাঁড়িয়ে আছে, দু'টো দেশ। এপার বাংলা ও ওপার বাংলা, অর্থাৎ ভারত ও বাংলাদেশ। দুটি প্রতিবেশী দেশ। দীর্ঘদিনের অমলিন মধুর সম্পর্ক। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন ভারতের অবদান দু'দেশের মানুষ অস্বীকার করে না । এটা আমাদের এক আকাশ অহংকার । এক ভাষা, সংস্কৃতি ও প্রকৃতি। সেই সঙ্গে জলবায়ু-আবহাওয়া এক । অথচ সীমান্ত বিভাজনে শুধু কাঁটা তারের একটা  অলীক বেড়া।

সীমান্তে দাঁড়িয়ে আলাপচারিতায়  দু'দেশের মানুষের মনে ও হৃদয়ে লেশমাত্র কোন বেড়াজাল পরিলক্ষিত হলো না। সকাল ৭-৩০ মিনিটে পা রাখলাম বাংলাদেশের মাটিতে। হৃদয়ে জাগলো অনির্বচনীয় অনুভূতি । বাংলাদেশের ভোমরা স্থলবন্দরে আমদানি-রপ্তানি হয় নানা ধরনের  জিনিসপত্র, বিশেষ করে পেঁয়াজ, আলু, ইট, পাথর, বালি, সিমেন্ট, মাছ, সবজি, আঙুর, আপেল, বিভিন্ন মশলা, সয়াবিন বড়িসহ ৫১টি পন্য। এগুলো আমদানি করে বাংলাদেশ এবং রপ্তানি করে ১২ টি পন্য। প্রতিদিন রাজস্ব আদায় হয় ৮০/১০০ কোটি টাকা। সেই কারণেই একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র ও স্হল বন্দর। দু'দেশের অর্থনীতির মেরুদন্ড ভোমরা ও ঘোজাডাঙ্গা সীমান্ত বন্দর।

এখান থেকেই দু'টো স্বপ্নের  মহাসড়ক চলে গেছে বাংলাদেশের ভিতরে।  (১) সাতক্ষীরা-খুলনা মহাসড়ক (২) কালিগঞ্জ-সাতক্ষীরা মহাসড়ক। আমরা ৬জন একটা শেয়ার টাটাসুমোতে চাপলাম। সকাল সাড়ে ৮টায় আমাদের পথ চলা শুরু। গাড়িতে পরিচয় হলো সাতক্ষীরার সরকারি কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক ড: মনিরুল ইসলাম সাহেবের সঙ্গে। খুব সুন্দর ব্যবহার। তাড়াতাড়ি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হলো। আমাদের ভ্রমণের উদ্দেশ্য জানলেন। যে কোন সহযোগিতার আশ্বাস দেন এবং ফোন নং দেন। সেই সঙ্গে বিনামূল্যে সরকারি কলেজের একটি সরকারি গেস্ট হাউসে থাকার সুযোগ করে দেন। আমাদের পেশা শিক্ষকতা। ফলে সুযোগটা পেতে সুবিধা হলো। আমরা এই অযাচিত আপ্যায়নে খুব খুশি হলাম। গাড়ি চলছে, হৃদয় জুড়ে একটা আনন্দের ঝলক। আপন মনে গেয়ে উঠলাম, কবিগুরুর বিখ্যাত গান, "আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি"। পথের দু-পাশের দৃশ্য অতুলনীয়। শুধুই সবুজ আর সবুজের বন্যা। মাঝে মাঝে প্রকৃতি পালটে যাচ্ছে। আমরা চলেছি কালীগঞ্জ-সাতক্ষীরা মহাসড়ক ধরে। দূরত্ব ৫২ কি, মি। প্রকৃতি দু'হাত ভরে এই জেলাকে অকৃপণ ভাবে সাজিয়েছেন।

১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের নীরব সাক্ষী এই মহাসড়ক ও শহর। মসৃণ রাস্তার দুপাশে সবুজ প্রকৃতি দু'বাহু জড়িয়ে আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে। সাতক্ষীরা জেলার গ্রামীণ প্রকৃতির রূপ এক কথায় মনোমুগ্ধকর ও অনুপম। শীতের সকালে প্রকৃতি যেন রূপের খেলায় মেতে উঠেছে। শীতের প্রকৃতিও অনবদ্য। এ -যেন রূপসী বাংলার পথে চলেছি। সত্যিই রপসী বাংলার দেশ সাতক্ষীরা। অধ্যাপক ড: মনিরুল ইসলাম সাহেবের কাছ থেকে সাতক্ষীরার ইতিহাস অন্বষণে অগ্রসর হলাম। তাছাড়া জেলার গৌরবময় ঐতিহ্য, ভূগোল, সংস্কৃতি ও প্রশাসনিক বিষয়ে অনেক কিছু জানলাম। নামকরণ সম্পর্কে কিছু তথ্য দিয়ে সমৃদ্ধ করলেন। আমরা সাতক্ষীরা শহরের কাছাকাছি চলে এসেছি। ইতিহাস ও কিংবদন্তির মেলবন্ধনে উঠে এসেছে এক বর্ণময় অধ্যায়। ঐতিহাসিকগনের  নানা অভিমত আছে, সাতক্ষীরা জেলার নামকরণ সম্পর্কে- (১) প্রাচীন কালে সাতক্ষীরা,বাগড়ী, ব্র্যাঘ্যতট, সমতট, যশোর, চূড়ন নামে  পরিচিত ছিল। মান্যতাপ্রাপ্ত মতামত টি হলো এই রকম,  চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের  এক কর্মচারী বিষ্ণুরাম চক্রবর্তী নিলামে চূড়ন পরগনা ক্রয় করেন এবং তার অন্তর্গত সাতঘড়িয়া নামক গ্রামে বাড়ি তৈরি করেন। পরবর্তীতে তার পুত্র প্রাণনাথ চক্রবর্তী সাতঘড়িয়া  এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন মূলক কাজ শুরু করেন। ব্রিটিশ সরকার ১৮৬১ সালে মহকুমা স্হাপনের সিদ্ধান্ত নেয় ও সাতঘড়িয়াতে প্রধান প্রশাসনিক কার্যালয় স্হাপন করেন। ইতিমধ্যেই সাতঘড়িয়া, ইংরেজ কর্মচারীদের মুখে মুখে সাতক্ষীরা হয়ে যায়। (২) আর একটি মত গুরুত্বপূর্ণ বলে কেউ কেউ মনে করেন--একসময়ে ৭জন জনৈক মনীষী সাগর ভ্রমণে  এসে নিজদের  ইচ্ছায়  এক সঙ্গে ক্ষীর রান্না করে খেয়ে ছিলেন। পরবর্তীতে ক্ষীর-এর সঙ্গে 'আ' প্রত্যয় যুক্ত হয়ে ক্ষীরা হয় এবং লোকমুখে প্রচলিত হয়ে যায় সাতক্ষীরা। (৩) আধুনিক গবেষকদের মতে। এই অঞ্চলে উৎপাদিত ৭টি বিখ্যাত জিনিসের নাম নিয়েই এই জেলার নামকরণ। জিনিসগুলো - ওল, মধু, কুল, দুধ, সন্দেশ, মাছ, আম।

প্রাচীন   ইতিহাস - সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অপার লীলাভূমি সাতক্ষীরা। সাতক্ষীরার ইতিহাস-ঐতিহ্য, রূপ-লাবণ্য-বাংলাদেশের অন্য জেলার চেয়ে কম নয়। বাংলাদেশের সমৃদ্ধশালী একটি জেলা। খুব আত্মপ্রত্যয়ী কন্ঠে বললেন সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক ড: মনিরুল ইসলাম বাবু । গৌতম  ঘোষ  পরিচালিত ও  প্রসেনজিৎ অভিনীত 'শঙ্খচিল' চলচ্চিত্রের অনেকাংশে সাতক্ষীরায় তোলা।৭টি উপজেলা ও ৮টি থানা এবং ৭টি পুরসভায় বিভক্ত। সর্ব বৃহৎ উপজেলা শ্যামনগর আর সব চেয়ে ছোট উপজেলা কলারোয়া। উপজেলাগুলো- সদর সাতক্ষীরা, তালা, কলারোয়া, দেবহাটা, কালিগঞ্জ, শ্যামনগর, আশাশুনিয়া। বর্তমানেএই জেলার লোকসংখ্যা ২৫ লক্ষাধিক। বাংলাদেশের ৭তম বৃহৎ জেলা সাতক্ষীরা। মোট গ্রামের  সংখ্যা- ১৪৪০টি। জেলা হিসাবে  সরকারি   স্বীকৃতি ১৯৮৪, সালের ২৫  শে, ফেব্রুয়ারি। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় শত্রুমুক্ত জেলা।

সুন্দরবনের প্রবেশ দ্বার ও বাংলাদেশের সর্ব প্রথম রেন্টাল মোটর  সাইকেল চালু  হয় এই জেলায়। কেউ কেউ সাদা সোনার (বাগদা চিংড়ির জন্য)  রাজ্য  বলে। বাংলাদেশের ৭৫ ভাগ বাগদা -গলদা চিংড়ি সাতক্ষীরায় উৎপাদিত হয়।   জেলার অন্যতম গর্বের প্রত্নভূমি তেঁতুলিয়া জামে মসজিদ, কপোতাক্ষ নদ, ইছামতিনদী, রাজা  প্রতাপাদিত্যের রাজধানী ধূমঘাট, ডা: বিধানচন্দ্র রায়ের, ভারতের প্রাক্তন জেনারেল শঙ্কর রায়চৌধুরী, নাট্যকার মনোজ মিত্র,  লেখক অমর মিত্রের বসত বাড়ি । এছাড়াও  সাবিনা ইয়াসমিন, জমিদার হরিচরণ রায় চৌধুরী এবং সাতক্ষীরা শহরের রূপকার প্রাণনাথ রায় চৌধুরীর স্মৃতি বিজড়িত, সাতক্ষীরা, শ্যামনগর, মুকুন্দপুর, ধূমঘাট, দেবহাটা ও শ্রীপুর গ্রাম এবং সাতক্ষীরার রূপসী সুন্দরবন এই জেলার  অন্যতম গর্বেব বিষয়।

বহু কৃতি মানুষের  জন্ম এই জেলায়।  জাতীয় ক্রিকেটার  সৌম্য সরকারর, মুস্তাফিজুর রহমান, চিত্রনায়িকা পরীমনি, মৌসুমী হামিদ, রানী সরকার, চিত্রনায়ক আমিন খান ,জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রসঙ্গীতের ও আধুনিক গানের জনপ্রিয় গায়িকা নিলুফার ইয়াসমিন ও সাবিনা ইয়াসমিন, লেখক ওয়়াজেদ আলি,  বিশ্বখ্যাত বাঘ শিকারী পচাব্দী  গাজি, শিক্ষাবিদ খানবাহাদুর আহুসান উল্লাহ, মুক্তিযুদ্ধের সৈনিক ফজলুল হক।   কালিগঞ্জ উপজেলা ছুঁয়ে সাতক্ষীরা শহরের কাছাকাছি এসে পড়লাম। কথা প্রসঙ্গে জানলাম, সাতক্ষীরার কলারোয়া ও তালা  উপজেলার টালি ইটালী সহ বেশ কিছু দেশে  যায়। ভাসমান বিজিবি ক্যাম্প চালু  করার বর্ণময় গৌরব এই জেলার মুকুটে। শুনে অবাক হয়েছিলাম, মাটির উপর দিয়ে হেলিকপ্টার চালু এই জেলার একটি বিশেষত্ব। আসলে হেলিকপ্টার হলো এক বিশেষ ধরনের সাইকেল, তার সাহায্যে চারজন মানুষকে নিয়ে অনায়াসে যাতায়াত সম্ভব। পরে দেখলাম বেশ ভালো লাগলো। একটা বিশেষ ভাবনা থেকেই এর উদ্ভব হয়েছে। গ্রামীণ এলাকায় গন পরিবহন হিসাবে ব্যবহার করা হতো। এখনও কিছু জায়গায় চালু আছে।

হঠাৎ দৃশ্যপট বদলে যেতে  লাগলো। চোখ ফেরানো যায় না। অতুলনীয় পথের সৌন্দর্য। দু'চোখ যতদূর পর্যন্ত যায়, শুধু জল আর জল। বাগদা, গলদা চিংড়ির ভেড়ি। এই জেলার চারটি উপজেলায় আনুমানিক ১লক্ষ  হেক্টর জমিতে মূলত চিংড়ি চাষ করা হয়, এই মাছ বিদেশে রফতানি করে আয় হয় প্রচুর। সাতক্ষীরা কে বলা হয় বাংলাদেশের 'kingdom of Fish’  অর্থাৎ মাছের রাজ্য। শুধু অপার মুগ্ধতা। বিদেশে এখানকার বাগদা চিংড়ি White gold নামে বিশেষ ভাবে খ্যাত। কয়েক হাজার মাছের ঘেরি আছে, কালিগঞ্জ, দেবহাটা, শ্যামনগর, সদর সাতক্ষীরা, কলারোয়া উপজেলায়। সাতক্ষীরাকে  দেখে   মনে হলো মাছের রাজ্য।

এই সব দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা  শহরের   সরকারি কলেজের গেস্টহাউসে  পৌঁছলাম। অতিথি আপ্যায়ন অসাধারণ।

কলেজ অধ্যক্ষ মতিউর রহমান আসলেন।  খোঁজ খবর নিলেন। ফোন নং দিলেন । আমরা ফ্রেস হয়ে দ্রুত সাতক্ষীরা শহরের কাছাকাছি একটি নান্দনিক সৌন্দর্যের আধুনিক হোটেলে দুপুরের খাওয়া পর্ব সারলাম। ঘড়িতে সময় সকাল ১১টা। সময় লাগলো ১-৩০মিনিট। এলাহি মেনু দেখে সবাই অবাক হলাম। ডাল, বেগুন ভাজা, সবজি, বাগদা চিংড়ির কালিয়া, সর্ষে ইলিশ, পাঁঠার মাংস, চাটনি, আইসক্রিম, স্বাদে -গন্ধে এক কথায় অসাধারণ।

ভোজন পর্ব শেষ করে গেস্টহাউসে গিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে পড়বো, তালা উপজেলার উদ্দেশ্যে। ফিরে এসে সাতক্ষীরা শহরের প্রধান প্রধান জায়গা গুলো ভালো করে দেখবো। দুপুর ১২টায় সরকারি বাসে করে, ১ ঘন্টায়   পৌঁছলাম তেঁতুলিয়া  জামে মসজিদ। জেলার অন্যতম গর্বের প্রত্নভূমি। অসাধারণ স্হাপত্যের নিদর্শন। বিশাল জমির উপর অবস্থিত। ঐতিহ্যবাহী স্হাপত্য। নান্দনিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হলাম সবাই, কপোতাক্ষ নদের তীরে সাজানো বিনোদন কেন্দ্রে কফি পান করলাম, আপন মনেই তির তির করে বয়ে চলেছে, অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলাম শান্ত ঢেউগুলো যেন আলপনা এঁকে এঁকে চলেছে, মধু কবির কবিতার কথা মনে পড়ে গেল  "সতত হে নদ পড় মনে, সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে"। মোহাবিষ্ট হয়ে পরলাম। এরপর চললাম  দুধের গ্রাম দেখতে। দুধের জন্য বিখ্যাত জিয়ালা। অবশেষে জিয়ালাতে গেলাম, মুগ্ধ হলাম কারণ এই ধরনের দুধের গ্রাম আমি কখনও দেখিনি। বহু মানুষের জীবন ধারণের উৎসভূমি  দুধ উৎপাদন। আধুনিক সুযোগ-সুবিধা ছিল গ্রাম গুলোতে।  দুগ্ধ উৎপাদনে সাতক্ষীরা বাংলাদেশে দ্বিতীয় জেলা । কিছু বাদে মাগুরার পীরের মাজার, লোকনাথ ব্রহ্মচারীর শান্তিনিকেতন, রেওয়াজ খানের জমিদার বাড়ি দেখে, মাধবখাল ও মথুরা খাল পরিদর্শন করে তাড়াতাড়ি সাতক্ষীরা শহরের ফেরার বাস ধরলাম।  ফেরার পথে অফুরান সুন্দরের হাতছানি। সব জায়গাতেই লেখা, 'হৃদয়ে তালা উপজেলা।' 

বিকেল  ৪টায় জেলা শহরে ফিরেই, একটি বেবি ট্যাক্সি নিয়ে  বেরিয়ে পড়লাম। এক এক করে দেখলাম (১) শপিংমল (২) পৌরসভার বিশালাকৃতি দিঘী ও বাহারী ফুলের সাজানো গোছানো পার্ক (৩) একটু দূরে বিখ্যাত জোড়াশিব মন্দির (৪) লেক ভিউ ক্যাফে, একটি নান্দনিক বিনোদন কেন্দ্র (৫) লাবসা (৬) প্রাণনাথ রায় চৌধুরীর জমিদার বাড়ি (৭) মোজাফ্ফর গার্ডেন (১২০ বিঘা জমি, মন্টুমিঞার বাগান নামে পরিচিত) (৮) মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত সৌধ (৯) বধ্যভূমি, গনকবর, ইতিহাসের নীরব সাক্ষী (১০) পৌরসভা ও সিটি সেন্টার এবং সার্কিট হাউস (১১) মেডিকেল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামিক হসপিটাল,ফিস প্রসেসিং সেন্টার  (১২) ছয় গম্বুজ মসজিদ, অসাধারণ স্হাপত্যের নিদর্শন (১৩) আধুনিক বাস টার্মিনাল, চাই চম্পার দরগা, সুন্দরবন টেক্সটাইল (৩০০ একর জমির উপর)। সারা দিন ঘোরাঘুরির  পর  উপস্থিত হলাম  প্রাণসায়র খালের পাশে একটি অসাধারণ বিনোদন কেন্দ্রে। শহরের কাছাকাছি কোন নদী নেই। দীর্ঘ সাড়ে আট কিলোমিটার ও ৫মিটার  চওড়ার  প্রাণসায়র  খালকে স়ংস্কার করে সৌন্দর্য সৃষ্টি করা  হয়েছে সাতক্ষীরা শহরে। বেতনি নদীর সঙ্গে যুক্ত খালটি। সাজানো গোছানো অভিজাত ও ঐতিহাসিক শহর সাতক্ষীরা। পরতে পরতে বনেদিয়ানার ছাপ।

সূর্য ডুবতে চলেছে প্রাণসায়র খালের বুকে। চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে খালের বুক। শুভ্র জ্যোৎস্নায় মায়াবী লাগছিল। চাঁদের আলো যেন আপন মনে খালের বুকে আলাপনা এঁকে এঁকে  চলেছে। নির্জন প্রকৃতি আর পাখপাখালির সিম্ফনি। রঙতুলি দিয়ে কেউ যেন ক্যানভাসে ছবি এঁকে চলেছে। রাতের সাতক্ষীরা যেন রূপকথার স্বপ্নপুরী। গোটা শহর আলোর বন্যায় ভাসছে। সারাদিন ঘুরে একবার ও মনে হয়নি, আমরা শুধু কয়েকটি দিনের ক্ষণিকের অতিথি। মনে হলো, এ-যেন নিজের দেশ । এখানকার মানুষ সহজ-সরল। অত্যন্ত অতিথিপরায়ণ। আমরা মুগ্ধ ও আপ্লুত হলাম। শুনেছিলাম সাতক্ষীরা ধর্মীয় সম্প্রীতির অনন্য শহর। বাস্তবে সেটাই মনে হয়েছে। আমার কাছে প্রাণের, ভালোবাসা ও অনুভবের  শহর। পরতে পরতে আভিজাত্যের ছাপ পরিলক্ষিত। মানুষের আলাপচারিতায় আন্তরিকতার ছোঁয়া পেলাম।

ক্লান্ত শরীরে রাত দশটায় বাইরের হোটেলে সারলাম সাধারন ভাবে খাওয়া পর্ব। ফিরে আসলাম গেস্টহাউসে। এইভাবে প্রথম দিনের স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লাম, নতুন সকালের প্রতীক্ষায়, এক আকাশ স্বপ্ন বুকে নিয়ে। পরেরদিন শীতের ভোরে পাঁচটায় বেরিয়ে পড়লাম নতুন পথে, নতুনভাবে পথ চলা শুরু। সরকারি বাসে, গন্তব্য স্হল বহু স্মৃতি বিজড়িত সাতক্ষীরার উপজেলা দেবহাটা। দেবহাটার শ্রীপুরে এক সময়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের ও ভারতের প্রাক্তন জেনারেল শঙ্কর রায়চৌধুরীর পৈতৃক বাড়ি ছিল। সেই কারণে দেবহাটার প্রতি গভীর টান ও ভালোবাসা অনুভব করতাম। পশ্চিমবঙ্গের বসিরহাট মহকুমার খুব কাছে দু'দেশের প্রিয়নদী ইছামতির তীরে অবস্থিত। দু'বাংলার প্রাণের নদী ইছামতি। হাসনাবাদ ও  টাকি সীমান্ত শহর থেকে দেবহাটার শ্রীপুর  শহরকে দেখা যায়। সাতক্ষীরা জেলা শহর থেকে দূরত্ব ৩৪কিমি। গল্প করতে করতে  রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলামের ও জীবনানন্দ দাশের  রূপসী বাংলাদেশের মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে সকাল সাড়ে ৬টায় দেবহাটা পৌঁছলাম। একটু টিফিন সেরে পথচলা।

দেবহাটার শ্রীপুর শহরকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলাম। এই শহরের সমৃদ্ধি ও বর্ণময় ইতিহাস অন্বষণে অগ্রসর হলাম। বহু ইতিহাসের নীরব সাক্ষী এই জায়গা। ১৮জন জমিদার এক সময়ে রাজত্ব করেছেন এখানে। বহু মন্দির দর্শন করলাম। জমিদারগন বিভিন্ন দেব-দেবীর পুজা করতেন। ঐ সকল  দেবদেবীর নাম থেকে দেবহাটার নাম। দেখে তাই মনে হল। এ-এক শিল্প রূপময় মন্দির নগরী। একটুখানি দূরে বাংলাদেশের অপার বিস্ময় সুন্দরবনের সুন্দরী ম্যানগ্রোভ অরণ্যের হাতছানি। খুব পুলকিত হলাম। একে একে দেখলাম ( ১) জমিদার বাড়ি ( ২) ঐতিহাসিক বনবিবিতলা, এটি একটি প্রত্নভূমি, একটি বটগাছ দাঁড়িয়ে আছে অতীত  ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে (৩) নীলকুঠি ( ৪) বিধান চন্দ্র রায় ও জেনারেল শঙ্কর রায়চৌধুরীর পৈতৃক বাড়ি। এক অমলিন চিরকালীন স্মৃতি বিজড়িত বাড়ি। সংস্কার করে রক্ষার চেষ্টা হচ্ছে। (৫) রূপসী দেবহাটা ম্যানগ্রোভ পর্যটনকেন্দ্র (৬) কেয়াপাতার জঙ্গল। শ্রীপুর শহরকে খুব ভালো লাগলো।

সকাল ১১টায় দেবহাটাকে বিদায় জানিয়ে চললাম সাদা সোনার রাজ্য কালীগঞ্জের দিকে। সাদা সোনা হলো, এখানকার সুস্বাদু, লোভনীয়  বাগদা চিংড়ি। বাংলাদেশের বেশি ভাগ চি়ংড়ি মাছ  উৎপন্ন হয় সাতক্ষীরার দেবহাটা, কালিগঞ্জ ও শ্যামনগরের বিস্তীর্ণ এলাকায়। এখানকার বাগদা চিংড়ি বিদেশে white gold  নামে খ্যাত। গাড়ি এগিয়ে চলেছে কালিগঞ্জ উপজেলার মধ্যে দিয়ে, চোখে পড়ছে শুধু মাছের ঘেরি ও বাংলাদেশের রূপসী প্রকৃতি। মন জুড়িয়ে গেল। দেবহাটা থেকে কালিগঞ্জ ১২কিমি এবং সাতক্ষীরা জেলা শহর থেকে দূরত্ব মাত্র ৪০ কিমি। মূহুর্তের মধ্যে আমরা টোটোয় পৌঁছলাম কালিগঞ্জ শহরে। সময় লাগলো মিনিট ২০। নেমে আবার পথচলা শুরু। কালিগঞ্জ উপজেলা শহর। সাজানো গোছানো।পরতে পরতে বনেদিয়ানার ছাপ পরিলক্ষিত হলো। মুক্তিযুদ্ধের নীরব সাক্ষী কালিগঞ্জ। নানান স্মৃতি সৌধ নির্মাণ দেখলাম। মুগ্ধ হলাম। ১৯৭১ সালের ২০ই নভেম্বর কালিগঞ্জ শত্রুমুক্ত হয়। বসন্ত পুর, নাজিমগঞ্জ, কান্দিয়া, দুর্দাল জুড়ে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ছড়িয়ে আছে। এখানকার নলতা শরীফ একটি সুপ্রাচীন প্রত্নস্হল। ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। সামনে যেতেই শ্রদ্ধায় মাথা নত হলো। অসাধারণ পরিবেশ। স্হাপত্যশৈলী দেখে মুগ্ধ হলাম সবাই। একে একে দেখলাম (১) দুই সতীনের দিঘি (২) বিক্রম আদিত্যের দুর্গ, রাজা প্রতাপাদিত্যের বাগান, কালিগঞ্জ মুক্তিযুদ্ধের যাদুঘর, কালিগঞ্জ ব্রিজ, ভ্যাসরাইল নবরত্ন মন্দির, মদিনা পীরের দরগা, (৩ )সাত্তার মণ্ডলের  স্বপ্নের খামারবাড়ি। জায়গাটা অসাধারণ লাগলো। জানলাম, এই শহরের বিখ্যাত ব্যক্তিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের ক্রিকেটার মুস্তাফিজুর রহমান, জনপ্রিয় রবীন্দ্রসংগীত- লোকসংগীতের কন্ঠশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন, চিত্রনায়ক আমিন খান ও চিত্রনায়িকা বানী সরকার। শিক্ষাবিদ খানবাহাদুর আহুছান উল্লার বাড়ি।

ভালো করে শহর ঘুরে একটি হোটেলে মাছ-ভাত দিয়ে দুপুরের খাওয়া পর্ব সারলাম এবং দুপুর ২টো নাগাদ চললাম শ্যামনগর উপজেলার দিকে। অসাধারণ যাত্রাপথের শোভা। শুধু সবুজের সমারোহ আর মাছের ঘেরির অনন্ত জলরাশি। মনে হচ্ছে  মাছের রাজ্যে এলাম । দূরত্ব ২৫কিমি কালিগঞ্জ থেকে, সাতক্ষীরা থেকে দূরত্ব ৭০/৭৫ কিমি। একটা অতীত ইতিহাস ছুঁয়ে আছে শ্যামনগরে। ঐতিহ্যবাহী, সংস্কৃতি ও আভিজাত্যের শহর শ্যামনগর। বাংলাদেশের শেষ সীমানায় ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে সুপ্রাচীন  শ্যামনগর শহর। এক সময়ের  রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজধানী ধূমঘাট এখানেই  অবস্থিত। সামান্য কিছু দূরে বাংলাদেশের অপার বিস্ময় সুন্দরবন। শ্যামনগর -মুন্সিগঞ্জ দিয়ে সড়কপথে সুন্দরবন যাওয়া  সহজ। বাংলাদেশের সুন্দরবনের প্রবেশ দ্বার সাতক্ষীরার শ্যামনগর। ৯০কিমি দূরে মান্দারবাড়িয়া সমুদ্র সৈকত।এক ভালোবাসার স্বর্গভূমি, অপার মোহনীয় রূপ নিয়ে অপেক্ষা করছে। সেই সঙ্গে সুন্দরবনের কলাগাছির রহস্য-রোমাঞ্চকর হাতছানি। আপনাকে মুগ্ধ করবেই।

৪০মিনিটে পৌঁছে গেলাম শ্যমনগর ডাকবাংলো চত্বরে জেলা পরিষদ ভবনের সামনে। সময় তখন ২-৩০মিনিট। পরিকল্পনা রাতে শ্যামনগরে থেকে পরেন দিন মান্দারবাড়িয়া সমুদ্র সৈকতে যাওয়া। সুতরাং হাতে সময় নিয়ে সব কিছুই দেখব। শ্যামনগর নামকরণ কি করে হলো, এব্যাপারে একটা কৌতূহল জাগল মনের মধ্যে। দেখা হলো এক ইতিহাসের অধ্যাপকের সঙ্গে,শ্যামনগর সরকারি কলেজের। সংক্ষেপে যা বললেন ,তা শুনে বিস্মিত হলাম। এক সময় মুঘল বাদশার সঙ্গে রাজাপ্রতাপাদিত্যের সংঘাত অনিবার্য হয়ে পড়ে, বিশাল সৈন্য বাহিনী আক্রমণ করতে আসে। সামনের সৈন্যরা দেখতে পায়, বিশালাকৃতির খাল দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে প্রতাপাদিত্যের সৈন্যরা। সামনের সৈন্যরা বিপদের মুখে চিৎকার করে পিছনের সৈন্যদের সাবধান করে দেওয়ার সময় চিৎকার করে বলে উঠলো 'শ্যামনি গর' বলে। পরবর্তী সময়ে 'শ্যামনি' ও  গর' সংযোগে শ্যামনগর নামের উৎপত্তি বলে অনেকেই ধারণা। এছাড়াও আর একটি মত আমার বিশ্বাস যোগ্যবলে মনে হয়েছে, কথিত আছে যে  সম্ভবত এখানকার আদি মানুষজনের প্রিয় দেবতা শ্রীকৃষ্ণের' শ্যাম'।

 নামানুসারে তাঁদের বসবাসের এলাকাটির নাম 'শ্যামনগর' রেখেছিলেন। বাংলাদেশের শেষ সীমানায় ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষে সাগর কূলে দাঁড়িয়ে আছে শ্যামনগর উপজেলা নামক জনপদটি। ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক দিক দিয়ে এই জনপদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা উপলব্ধি করলাম। মনে মনে ভাবছি,  মহারাজা প্রতাপাদিত্যের স্মৃতিবিজড়িত শ্যামনগরের নামকরণের ইতিহাস অতি বৈচিত্র্যময়। একে একে দেখলাম (১) শ্যামনগর রাজবাড়ি, রাজা হরিচরণ রায় চৌধুরীর জমিদার বাড়ি। বর্তমানে ধ্বংসের মুখে। (২) কিছু দূরে জাগ্রত যশোরেশ্বরী মন্দির, ভৈরবমন্দির, ছয়গম্বুজ বিশিষ্ট হাম্মারখানা, জাহাজঘাটা নৌদুর্গ । (৩) মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত গোপালপুর স্মৃতি সৌধ, অসাধারণ লাগলো। ১৯৭১এর স্মৃতি নিয়ে ইতিহাসের নীরব সাক্ষী। স্হাপত্য শৈলী অনবদ্য। একটা আবেগ ও শপথের সাক্ষর বহন করে চলেছে। (৪) যীশুর গির্জা দেখে মুগ্ধ হয়ে, চললাম ধুমঘাটের দিকে। রাজাপ্রতাপাদিত্যের রাজধানীতে বেশ কিছু সময় থাকলাম। 

সময় ঘড়িতে বিকাল ৪টা। এবার গন্তব্য আকাশনীল  ইকোপার্ক। শ্যামনগরের অন্যতম গর্বের জায়গা ও আকর্ষণীয় জায়গা। ৫টা নাগাদ পৌঁছলাম। ঘুরতে ঘুরতেই সময় কখন পেরিয়ে গেছে বুঝতে পারিনি। শীতের নরম রোদ মেখে গোটা দিন আনন্দে কাটিয়ে দিলাম। আকাশনীল  ইকোপার্ক খুব ভালো লাগলো। সূর্য ডোবার অবস্থায়, পূব থেকে হেলে পশ্চিমে। জানান দিচ্ছে ফিরতেই হবে, মন না চাইলেও। পুরো দিনের স্মৃতি রোমন্থন করতে করতেই চললাম মুন্সীগঞ্জে, ওখানকার সুন্দরবন হোটেলে  পৌঁছলাম রাত ৮টার সময়। রাতের খাবার পর্ব সারলাম এবং আলোচনা করলাম তৃতীয় দিনের গন্তব্যস্হল  সাগর সৈকত মান্দারবাড়িয়া ও সুন্দরবনের কলাগাছিয়া যাওয়া নিয়ে। শ্যামনগরের কৃতি মানুষের খবর নিলাম হোটেলের মালিক আনিসুর রহমানের কাছ থেকেই। এই শহরের বর্ণময় ব্যক্তিরা হলেন ,প্রখ্যাত শিকারী পচাব্দী গাজি, মুক্তিযুদ্ধের নায়ক ফজলুল হক, সমাজ সেবী রাজা হরিচরণ রায় চৌধুরী, চিত্রনায়ক জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, লেখক, প্রাবন্ধিক অনিলরাজ।

রাত দশটায় হোটেলের বাইরের দিকের ব্যালকোনিতে এসে বাংলাদেশের মুন্সীগঞ্জের রাতের রূপ  দেখছি মুগ্ধ দৃষ্টিতে। এই কয়দিনে  সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের যে আন্তরিকতা ও ভালোবাসা পেলাম, তার ভোলা যাবেনা। আমরা তিন দিনের অতিথি। মনে হয়নি এ-দেশ বিদেশ। যেন নিজের দেশে আছি। এ এক আত্ম উপলব্ধি। বাংলাদেশের আতিথেয়তার  গৌরবময়  দিক আছে। যারা এখানে আসেন, তাদেরকে আপনজন করে নেয় এই দেশের মানুষ। এই সব বর্ণিল কথা ভাবতে - ভাবতেই আমরা সবাই ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দিলাম।

তৃতীয় দিনের সকালে উঠে সমুদ্র সৈকত মান্দারবাড়িয়ার  দিকে পা বাড়ালাম। আমাদের পরিকল্পনা ছিল, সারা দিন কাটিয়ে রাতে ফিরবো বসিরহাটের ইছামতি ছুঁয়ে নিজ স্বপ্নের নীড়ে। তৃতীয় দিন ভোর ৫টায় যাত্রা শুরু করলাম, এ বারের গন্তব্য স্হল  অপরূপা সমুদ্র সৈকত মান্দারবাড়িয়া। সরকারি বাসে চড়ে পড়লাম। পথের দৃশ্য অতুলনীয়। দেড় ঘন্টায় পৌঁছলাম নীলডুমুর নৌকা ঘাটে। এইপর্যন্ত সড়ক পথ। এখান থেকে সুন্দর বনের ভিতর দিয়ে যেতে হবে সমুদ্র সৈকত মান্দারবাড়িয়াতে। ইঞ্জিন চালিত নৌকায় সময় লাগবে ৭ঘন্টা, সেই কারণে স্পিড বোটে পাড়ি দিলাম। সময় লাগলো ২-৩০ মিনিট। এই  যাত্রা পথের কথা চিরজীবন মনের মণিকোঠায় চিরজাগরূপ হয়ে থাকবে। রহস্য-- রোমাঞ্চকর যাত্রা। শুধু সবুজের সমারোহ। রূপসী ম্যানগ্রোভ অরণ্যের হাতছানি, ভয়ঙ্কর আরণ্যক পরিবেশ সব কিছুই মিলে আমরা তখন , এক অন্য জগতের বাসিন্দা। সাতক্ষীরার সুন্দরবন, প্রকৃতির এক অপার বিস্ময়। বঙ্গোপসাগরের তীরভূমি জুড়ে ৮/৯/ কিঃমিঃ জুড়ে এক নয়নাভিরাম সমুদ্র সৈকত মান্দারবাড়িয়া। দীঘা, বকখালি, পুরীর মতো নাগরিক কোলাহলে মুখর নয়। সমুদ্র সৈকতের এক দিকে বিশ্বের বিস্ময় সুন্দরবন, অপরদিকে বঙ্গোপসাগরের মায়াবী জলরাশি। আমাদের যাত্রাপথে  তিনখানা নদী অতিক্রম করতে হয়েছিল, কলাগাছিয়া, আড়পাঙ্গাশিয়া এবং মালঞ্চ। সৈকত ভূমিতে হরিণ ও বাঘের পায়ের চিহ্ন দেখলাম। এই সৈকতের নির্জনতা  মনকে মুগ্ধ করলো।

সাগরের ঢেউ, নীল আকাশের বুক চিরে পানকৌড়ির উড়ে যাওয়া, এক কথায় অসাধারণ। সাগরের বিশালতা  ও অস্তগামী সূর্যের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য আর  নিবিড় অরণ্যের নিস্তব্ধতা, এক মায়াবী জগৎ উন্মোচিত হলো আমাদের সামনে। ম্যানগ্রোভ অরণ্যের রকমারি গাছগাছালি  দেখলাম।  মান্দারবাড়িয়া সৈকতে প্রকৃতি যেন উজাড় করে দিয়েছে তার সমস্ত ঐশ্বর্য।   দুপাশের গভীর  বিস্তীর্ণ সবুজ বনভূমি অতিক্রম করে আরো গভীরে এগিয়ে চললাম। কিছুক্ষণ পরে এক নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমিতে পৌঁছলাম। সামনে শুধু অনন্ত জলরাশি। কখন কয়েক ঘণ্টা সময় কিভাবে কেটে গেল বুঝতে পারলাম না। হাতে সময় নেই, মন না চাইলেও আজ  ফিরতে হবেই।

বিকেল  ৪টেয়  ফেরার পথে পা বাড়ালাম। ফেরার পথে চারিদিকে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য ছড়ানো। চোখ ফেরানো যায় না। জঙ্গল চিরে ছন্দের ভঙ্গিতে এগিয়ে চলেছে কলাগাছিয়া আড়পাঙ্গাশিয়া এবং মালঞ্চ নদীবুকে আমাদের নৌযান । শীতের সময় বলে শান্ত প্রকৃতির রূপ দেখা গেল।অন্য সময় ভয়াল-ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা নামছে  মন্থর গতিতে। গরাণ- সুন্দরী- কেওড়া গাছের ফাঁক দিয়ে বিদায়ী সূর্যটা যেন  অনিন্দ্যসুন্দরী টিপ। সারা দিনের অফুরান সৌন্দর্য উপভোগ করে, প্রাপ্তির  স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে ফিরে আসলাম নীলডুমুর ফেরি ঘাটে।

তখন রাত ৭ টা। সাতক্ষীরার উদ্দেশ্যে  রওনা দিলাম। আকাশ জুড়ে চাঁদের আলো মায়াবী পরিবেশ রচনা করেছে। সারা দিনের ক্লান্তির থাকলেও রাতের সাতক্ষীরাকে অপরূপা লাগছিল। একটার পর একটা স্মৃতি ভীড় করছে। এই জেলাকে ভালো করে দেখতে ও বুঝতে এবং চিনতে গেলে হাতে ভালো সময় থাকা প্রয়োজন। এটা অনুভব করেছি। আবার এই জেলায় আসার একটা ইচ্ছা জাগলো মনে, কারণ সব জনপদে পৌঁছে তে পারেনি।

অধ্যাপক  অবিনাশ চন্দ্র মণ্ডল মহাশয়ের সঙ্গে ফোনে আলাপ হলো, বাড়ি সাতক্ষীরা জেলার অন্তর্গত আশাশুনিতে। থাকেন ঢাকায়। গুণী মানুষ, ভালো গান লেখেন। আঁকার হাত  চমৎকার। পরের বার ওনার সাহচর্য লাভ থেকে বঞ্চিত হবনা। সব কিছু দেখা হয়নি, বিশেষ করে ২টি উপজেলা কলোরোয়া ও আশাশুনি। মনে অতৃপ্ত বাসনা  নিয়ে ফেরার পথে চলেছি। নয়টায় পৌঁছলাম সাতক্ষীরা জেলা শহরে। ঘড়িতে তখন রাত ৯টা ১০মিনিট। একটি মারুতি ভ্যান নিয়ে ভোমরা স্থলবন্দরের দিকে যাত্রা করলাম। ৫২ কিমি রাস্তা অতিক্রম করে, ভোমরা-ঘোজাডাঙ্গা সীমান্তে পৌঁছলাম রাত সাড়ে দশটায়। সাতক্ষীরার মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা পাথেয় করে সীমান্ত পেরিয়ে, সাতক্ষীরাকে বিদায় জানিয়ে নিজেদের কেজো জীবনে প্রত্যাবর্তন করলাম। ফেলে আসা নানান বর্ণময় স্মৃতি মনকে ভারাক্রান্ত করে তুলেছে। রুপসী সাতক্ষীরার তিন দিনের বহু অমলিন স্মৃতি হৃদয়ে থেকে যাবে বহুদিন। মন আপন ছন্দে গেয়ে উঠলো, ''আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি'। তবু মন বলছে আবার আসিব ফিরে এই সাতক্ষীরার বুকে, হয়ত অন্য কোন ভাবে, অন্য কোন দিনে।  ফেরার সময় সঙ্গে নিলাম ঘোষ ডেয়ারীর বিখ্যাত সন্দেশ, একজোড়া মাদুর, কু  সাতক্ষীরার ওল এবং হরিণের শিং দিয়ে তৈরি লাঠি, একমাত্র বাংলাদেশের শ্যামনগরের কাছে আশাশুনির প্রতাপনগরে পাওয়া যায়।

 সীমান্ত শহর থেকে আমাদের বসিরহাট শহরের দূরত্ব ৮কিমি মাত্র। রাত সাড়ে ১১টায় নিজ নিজ বাড়িতে পৌঁছলাম। রূপসী সাতক্ষীরায় গিয়ে এক বিরল অভিজ্ঞতা লাভ।

পথনির্দেশ:

শিয়ালদহ (উত্তর) স্টেশন থেকে ট্রেনে বসিরহাট স্টেশন (৬০কিমি, সময় লাগবে ২ঘন্টা, ভাড়া--২৫টাকা, জনপ্রতি)। তারপর টোটোয় করে ৮কিমি গেলে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত। ঘোজাডাঙ্গা-ভোমরা চেক পোস্ট। সাতক্ষীরা-কালিগঞ্জ মহাসড়ক ধরে ৫২ কিমি দূরে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলা শহর। সব উপজেলায় থাকার জন্য ভালো হোটেল ও সরকারি গেস্টহাউস, জেলা পরিষদ ভবন পাওয়া যায়। ভালো মানের হোটেল ও গেস্ট হাউস (১) বর্ষারিসোর্ট, শ্যমনগর, দেশ-বিদেশের পর্যটকদের জন্য (২) সুন্দরবন হোটেল, ডাক্তার সাজাপান সাহেবের, (৩) গোপালনগর পিকনিক কর্নার, শ্যামনগর, (৪) টাইগার পয়েন্ট গেস্টহাউস ও সুশীলন রেস্টহাউস (বেসরকারি) (৫) হোটেল, জি, কে, আই, কলেজ মোড়, শ্যামনগর।

 অনলাইনে বুকিংয়ের সুযোগ আছে। সঙ্গে পরিচয় পত্র রাখা আবশ্যক এবং সেই সঙ্গে ভিসা-পাসপোর্ট সহ প্রয়োজনীয় তথ্য। প্রশাসনিক সহযোগিতা অসাধারণ। মনের আনন্দে ঘুরতে পারবেন রূপসী বাংলার সাতক্ষীরায়।

 

ডঃ সুবীর মণ্ডল
বাঁকুড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top