সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

সাবলাইম পয়েন্ট ওয়াকিং ট্র্যাক: পাহাড় এবং সমুদ্রের যোগসূত্র : মোঃ ইয়াকুব আলী


প্রকাশিত:
৭ ডিসেম্বর ২০২০ ২৩:২৫

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ১১:২৮

ছবিঃ সাব্লাইম পয়েন্ট লুকআউট

 

সিডনি শহর গড়ে উঠেছে সমুদ্রের কোল ঘেঁষে। আর সমুদ্রের ঠিক পাড়েই রয়েছে সুউচ্চ পর্বতশ্রেণী। দেখলে মনেহবে এটা যেন অনেকটা প্রাকৃতিকভাবে তৈরি শহররক্ষা বাঁধ। সিডনির দক্ষিণের শহর 'ওলংগং' যেন সৌন্দর্যের লীলাভূমি। এখানেই সমুদ্রের পাড় ঘেঁষে রয়েছে সুউচ্চ সব পাহাড়। এইসব জায়গাগুলোতে পাহাড়ের উপর থেকে সমুদ্রের সৌন্দর্য দেখার জন্য রয়েছে একাধিক লুইকআউট। বুলাই এবং সাবলাইম পয়েন্ট ঠিক তেমনি দুটি লুকআউট। এই জায়গাগুলোতে দাঁড়ালে পুরো একশ আশি ডিগ্রিতে সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। আর মাঝে মাঝেই মেঘেরা এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায় মেঘেদের দেশে। মেঘ সরে গেলেই আবার সামনের সবুজের পরের অবারিত নীল জলরাশি শরীর এবং মনকে শান্ত করে দেয় মুহূর্তেই।  

ছবিঃ সাবলাইম পয়েন্ট যাওয়ার পথে

 

একদিন পরিকল্পনা করে আমি আর আমার দশ বছরের মেয়ে তাহিয়া এবং পাঁচ বছরের ছেলে রায়ান বেরিয়ে পড়লাম সাবলাইম পয়েন্টের উদ্দ্যেশে। আমাদের সবার্ব মিন্টো থেকে ঘন্টা খানেকের ড্রাইভ। সিডনি শহর থেকে যেতে চাইলেও ঘন্টা খানেকের ড্রাইভ। সাবলাইম লুআউটের পাশেই গাড়ি পার্কিং আছে তাই গাড়ি পার্ক করার ঝামেলা নেই। গাড়ি পার্ক করে আমরা নেমে হেটে লুকআউটের গ্রিলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। বাতাসের একেবারে আমাদেরকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো। সামনেই সমুদ্রের তটরেখা দেখা যাচ্ছে। দেখলে মনেহবে কোন এক শিল্পী তার নিপুণ তুলির আছড়ে আঁকাবাঁকা সমুদ্রের তটরেখাটি এঁকে দিয়েছেন।

সেখানে গ্রিলের বাইরে চেইন ঝুলিয়ে মানুষ তাঁদের ভালোবাসার তালা ঝুলিয়ে গেছেন। মোট চারটা স্প্যানের চেইনে অনেকগুলো বাহারি রঙের এবং আকৃতির তালা ঝুলানো। সেখান থেকে একটু ডান দিকে হাটার পর দেখলাম একটা কাঠের নামফলকে লেখা সাবলাইম পয়েন্ট ওয়াকিং ট্র্যাক। দূরত্ব সাতশ মিটার এবং এটা ওয়ান ওয়ে। আর এটা শিশুদের জন্য উপযোগী না। ওয়াকিং ট্র্যাকগুলো হাঁটার এবং পথের কাঠিণ্যের উপর ভিত্তি করে মোট পাঁচভাগে ভাগ করা হয়। গ্রেড এক থেকে শুরু করে বেশি কাঠিণ্যের ক্রোম অনুসারে পাঁচে যেয়ে শেষ। এই ওয়াকিং ট্র্যাকটার গ্রেড চার তাই বলা হয়েছে অভিজ্ঞ মানুষদের জন্য এটা উপযোগী। আমাদের সামনে দিয়ে দুজন ভদ্রলোক ট্র্যাকটির দিকে হেটে যাচ্ছিলেন দেখে গল্প জুড়ে দিলাম।  

বললামঃ আমরা প্রতি শনিবার হাটতে বের হয়। আজকে এখানে এসেছি। এখন আপনারা বুদ্ধি দেন বাচ্চাদের নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে কি না কারণ এখানে লেখা আছে বাচ্চাদের উপযোগী না। উনারা বললেনঃ হ্যাঁ এটা আসলেই বাচ্চাদের উপযোগী না। তোমার মেয়ে পারলেও ছেলেটার জন্য অনেক সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে কারণ ঢালগুলো একেবারে খাড়া। পা ফেলতে হয় খুবই সাবধানে। তোমরা এক কাজ করো। আমাদের পিছু পিছু মই পর্যন্ত চলো তারপর ফিরে এসো। এখানে ছোট বড় মিলিয়ে মোট সাতটা মই আছে। অগত্যা আমরা উনাদের পিছু পিছু মই পর্যন্ত গেলাম। এই রাস্তাটুকু মোটামুটি সহজ। পাথরের কোল ঘেঁষে আবার কখনওবা পাথরের নিচ দিয়ে হেটে গেলাম। 

ছবিঃ সাব্লাইম পয়েন্ট ওয়াকিং ট্র্যাক

মইয়ের কাছে যেয়ে উনারা মই বেয়ে নিচে নেমে গেলেন আর আমরা ফিরে আসতে শুরু করলাম। ফিরে আমরা সাবলাইম পয়েন্ট ক্যাফে এবং ফাংশন সেন্টারে নাশতা সেরে নিলাম। এখানে নাশতা এবং দুপুরের খাবার পাওয়া যায়। প্রত্যেকটা টেবিলে সাদা কাগজ বিছিয়ে দেয়া হয়। আর সাথে দেয়া হয় রং পেন্সিল যাতে বাচ্চারা খেতে খেতে আঁকিবুকি করতে পারে। আমরা জানালার ধারে একটা টেবিলে বসে পড়লাম। এখানে নাশতা করতে করতেও নিচের ভিউ দেখা যায়। এরপর থেকেই পৰিকল্পনা করছিলাম একদিন একা একা যেয়ে পুরো ওয়াকটা শেষ করবো। এবং সেটা শুরু করতে হবে নিচ থেকে তাহলে নামার সময় আর কষ্ট হবে না।

এরপর একদিন সকাল সকাল ছেলেমেয়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে একা একা বেরিয়ে পড়লাম। সাবলাইম পয়েন্ট ওয়াকের অন্য প্রান্ত শুরু হয়েছে ফুটহিল রোড থেকে। ফুটহিল রোডেই গাড়ি পার্কিং করা যায় তবে বেশি শব্দ না করাই ভালো কারণ পাহাড়ের কোলে সেটা একটা আবাসিক এলাকা। আমি যতবারই ওখানে গেছি ওখানকার মানুষগুলোকে মনেমনে ঈর্ষা করেছি। বেশিরভাগ বাড়ির পেছনের বারান্দা বনের মধ্যে প্রসারিত। সেখানে ইজি চেয়ারে বসে থাকার চেয়ে জীবনের শান্তির আর কাজ আছে। বনের নিজস্ব একটা গুঞ্জন আছে। তার বাইরে অবিরাম ঝিঁঝিপোকার ডেকে চলা, বিভিন্ন রকমের পাখপাখালির ডাক পুরো পরিবেশটাকে একটা অতিপ্রাকৃতিক রূপ দেয়। ঘরে ফিরতে আর ইচ্ছে করে না মোটেও।

ছবিঃ নরম সবুজের গালিচা

গাড়িটা পার্ক করেই হাটা শুরু করলাম। শুরুতে কিছুদূর সমতলে যাওয়ার পর রাস্তাটা উঁচু পাহাড় বেয়ে উপরে উঠে গেছে। প্রথম ধাপটা অতিক্রম করার পর রাস্তাটা দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে। একটা গেছে বাদীকে সমতল বরাবর যেটা আবার শেষ হয়েছে ফুটহিল রোডে এসেই। এই ট্র্যাকটার না 'গিবসন ট্র্যাক'। আর সোজা উপরে চলে গেছে সাবলাইম পয়েন্ট ট্র্যাক। আমি সমতল জায়গাটাতে পাতা কাঠের বেঞ্চে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে নিলাম। এভাবে কিছুদূর উঠার পরপর বিশ্রাম নেয়ার জন্য কাঠের বেঞ্চ পাতা আছে। খাড়া পাহাড়ে উঠার জন্য দমের দরকার হয়। আমি এই বেঞ্চগুলোতে জিরিয়ে নিয়ে আবার উঠা শুরু করতে পারেন। আমি প্রথমবার উঠছিলাম তাই বেশি ক্লান্তি বোধ হচ্ছিলো। 

বিশ্রাম নিয়ে আবারও হাটা শুরু করলাম। আসলে হাটা না বলে সিঁড়ি ভাঙা বলায় ভালো। পাহাড়ের উঁচু খাঁজে খাঁজে কাঠের ছোট ছোট পাত বসিয়ে সিড়ির আকার দেয়া হয়েছে। কিছুদূর উঠার পর দেখলাম চারজন বৃদ্ধা নেমে আসছেন। এইসব কঠিন কাজেও এখানে বৃদ্ধদের দেখা যায়। আসলে উন্নত দেশগুলোতে বয়স্ক মানুষদেরও যে একটা আলাদা জীবন আছে সেটা খুব পরিষ্কারভাবে চোখে পরে। আমি জিজ্ঞেস করলাম আর কতদূর আর কতটাই বা কঠিন। উনারা জানালেন তোমার উঠার সময় কোষ্ট হবে কিন্তু নামার সময় মনেহবে উঠার কষ্টটা সার্থক। আর শোন শরীরের উপর চাপ নিয়ো না। একবারে যতটুকু উঠতে পারো উঠবে তারপর দরকার হলে সে জায়গাতেই বসে বিশ্রাম নেবে। উনাদের একটা কথা আমার খুব পছন্দ হলো 'লিসেন টু ইউর বডি'।

আমি আবারও নব উদ্যমে উপরে ওঠা শুরু করলাম। চারপাশের পরিবেশ অনেক সুন্দর কিন্তু উঠার সময় সেদিকে দৃষ্টি দেয়ার ফুরসৎ মিলবে না কারণ সিঁড়িগুলো একেতো খাড়া আর বেশ সরু। আর সিঁড়ি ভাঙতে যেয়ে আপনি এতটাই ক্লান্ত হয়ে যাবেন যে আশেপাশে তাকানোর কথা মনেপড়বে না। এভাবে উঠতে উঠতে অনেকের সাথেই দেখা হলো। সবার সাথেই হালকা কুশল বিনিময় হচ্ছিলো। একজন আমার দুরবস্থা দেখে বললেনঃ তোমার সাথে এক বোতল পানি রাখা দরকার ছিলো, তুমি চাইলে আমরা বোতলটা নিয়ে যেতে পারো। আমি বল্লাম না আজকে আর পানি খাচ্ছি না, আসলে সকালে পেটভরে নাস্তা খেয়ে এসেই ভুল করেছি তা নাহলে এতো কষ্ট হতো না। আর অবশ্যই একটু ভালো মানের কেডস পরে নিতে হবে তাহলে সিঁড়ি ভাঙার কষ্টটা অনেকখানি লাঘব হয়ে যাবে।   

ছবিঃ সাবলাইম পয়েন্টের ওয়াকিং ট্র্যাকের মই

এভাবে উঠতে উঠতে একসময় মইগুলোর গোড়ায় চলে আসলাম। সেখানে যেয়ে দেখি এক বাবা তার ছয় বছর এবং চার বছর বয়সী দুই বাচ্চাকে নিয়ে নামছে। আমি ছোট বাচ্চাটাকে দেখে বললামঃ তোমার তো অনেক সাহস। উত্তরে সে আমাকে বললঃ কি যে বলো না তুমি, আমিতো এর চেয়ে আরও কঠিন কাজও করতে পারি। আমি তাকে বললাম তুমি সিঁড়িতে একটু দাড়াও তোমার ছবি তুলে নিই, আমার ছেলেকে দেখাবো তাহলে এরপর আমি তাকেও নিয়ে আসতে পারবো। তোমাকে দেখে অনেকটা উৎসাহ পাচ্ছি। এরপর ওরা আমাকে হাই ফাইভ দিয়ে এবং শুভ কামনা জানিয়ে নিচের দিকে যাওয়া শুরু করলো। আর আমি মইয়ের সিঁড়ি ভাঙা শুরু করলাম এবং একসময় উপরে পৌঁছে গেলাম। উপরের সৌন্দর্যের বর্ণনা তো আগেই দিয়েছি। উপরে এসে আমি পাবলিক টিপকল থেকে পানি নিয়ে চোখে মুখে দিয়ে এবং কিছুটা খেয়ে আবার নিচের দিকে নামা শুরু করলাম। 

নিচে নামার সময় বুঝতে পারলাম মানুষ এতো কষ্ট করে হলেও উপরে উঠে। শারীরিক ব্যায়াম ছাড়াও নিচে নামার সময় মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত প্রশান্তি কাজ করে। নিচে নামার প্রক্রিয়াটা আমার কাছে মনেহয়েছে আমি যেন পাখি হয়ে উড়ে উড়ে নামছি। মাঝে মাঝেই কোমল ঠান্ডা বাতাসে শরীরটা জুড়িয়ে যাচ্ছিলো। আর বন বনানীর ফাঁকা দিয়ে কাছেই সমুদ্রকে দেখা যাচ্ছিলো। নামার সময় আমিও অনেককে উৎসাহ দিলাম বিশেষকরে যারা সেদিনই প্রথম এসেছে। আপনিও চাইলে চলে যেতে পারেন সিডনির অদূরে সাবলাইম ওয়াকিং ট্র্যাকে যেখানে সাগর এবং পাহাড় মিতালি করে।

 

মোঃ ইয়াকুব আলী
মিন্টো, সিডনী, অস্ট্রেলিয়া

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top