সিডনী মঙ্গলবার, ১৬ই এপ্রিল ২০২৪, ৩রা বৈশাখ ১৪৩১

গঙ্গাসাগর থেকে ফিরে : সিদ্ধার্থ সিংহ


প্রকাশিত:
৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৮:৪৬

আপডেট:
১৬ এপ্রিল ২০২৪ ১৫:০৫

 

এই অতিমারি অবস্থায় গোটা পৃথিবী স্তব্ধ হয়ে গেলেও বঙ্গোপসাগরের গঙ্গাসাগর মেলায় কিন্তু তার বিন্দুমাত্র আঁচ পড়েনি।

আর গঙ্গাসাগর মেলা মানেই কপিলমুনির মন্দির। এই মন্দিরের বিশ্বজোড়া খ্যাতির পিছনে রয়েছে মকর সংক্রান্তির দিনে এখানে পুন্যস্নান ও মেলা। সে সময় লক্ষ লক্ষ মানুষের পায়ের ধুলোয় এই জায়গাটা হয়ে ওঠে একেবারে মিলনতীর্থ।

এ বারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তাই আরও বেশি করে সতর্ক হতে হয়েছে এই মেলা কমিটিকে। পূর্ণ উদ্যামে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়েছে সরকারকে। তার সঙ্গে সঙ্গে নানান স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকেও।

ভেসেলে ওঠার আগেই সবার হাতে হাতে দিয়ে দেওয়া হয়েছে সেনিটাইজার। যাঁদের মাস্ক নেই, তাঁদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে মাস্ক। কোনও তীর্থযাত্রীই যাতে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে জমায়েত করতে না পারে, সদা সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হয়েছে তার দিকে।

যে সব স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন প্রত্যেক বার লাইন দিয়ে খিচুড়ি ভোগ খাওয়ায়, প্রসাদ বিতরণ করে, চা-বিস্কুট দেয়, এ বার তারাও স্থগিত রেখেছে তাদের সেই সব উদ্যোগ। উদ্দেশ্য একটাই--- একজনের থেকে আরেক জনের দূরত্ব বজায় রাখা।

যদিও কপিলমুনির মন্দিরকে বাদ দিলেও গঙ্গাসাগরের এই বেলাভূমিটি কম আকর্ষণীয় নয়। যে কোনও সময়ই গঙ্গাসাগরে যাওয়া যায়। মেলার ওই ক'টা দিন বাদ দিলে গঙ্গাসাগর বেশ নিরালা ও নির্জন। মন্দিরের সামনে থেকে নির্জন বালিয়াড়িটি সোজা গিয়ে মিশেছে সমুদ্রে। এখানে সমুদ্র খুব একটা ঢেউ ভাঙে না। তির তির করে এগিয়ে এসে পা ভিজিয়ে দিয়ে যায়। হাঁটতে হাঁটতে নেমে যাওয়া যায় সমুদ্রের অনেকটা ভিতরে। পায়ের পাতা ভেজানো জল থেকে হাঁটু জলে। ইচ্ছে থাকলে অনায়াসে স্নানও করা যায়।

এখানে এক সময় অবাধে খেলে বেড়াত লাল কাঁকড়া। কারও পা টিপে টিপে এগিয়ে আসা টের পেলেই সেঁধিয়ে যেত বালিয়াপির ছোট ছোট গর্তে। এখন তাদের দেখা যায়। তবে সংখ্যায় অনেক কম।

পাড়ে দাঁড়িয়ে সাগরের শেষপ্রান্তে তাকালে দেখা যায় আকাশ আর সমুদ্র মিলেমিশে কেমন একাকার হয়ে গেছে। চোখে পড়ে--- দূরে, দিগন্তরেখায়, একটা, দু’টো, তিনটে…. অনেক অনেক নৌকা এবং ট্রলার। মাছ ধরতে গেছে গভীর সমুদ্রে।

গঙ্গা নদী (হুগলি নদী) ও বঙ্গোপসাগরের মিলন স্থলে ছোট বড় মিলিয়ে মোট ৫১টি দ্বীপ নিয়ে ৫৮০ বর্গ কিমি জুড়ে গড়ে উঠেছে এই সাগরদ্বীপ। চড়া পড়ে আরও দু'-একটি নতুন গজিয়ে ওঠার অপেক্ষায়। আর গঙ্গাসাগর মেলা হল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণে সাগর দ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত কপিলমুনির আশ্রমে প্রতি বছর মক্রর সংক্রান্তিতে অনুষ্ঠিত একটি মেলা। যেটা ধর্মীও উৎসবও বটে।

কিংবদন্তি আছে, এখানে সাংখ্যদর্শনের আদি-প্রবক্তা কপিলমুনির আশ্রম ছিল। একদা কপিলমুনির ক্রোধাগ্নিতে সগর রাজার ষাট হাজার পুত্র ভস্মীভূত হন এবং তাঁদের আত্মা নরকে নিক্ষিপ্ত হয়। সগরের পৌত্র ভগীরথ স্বর্গ থেকে গঙ্গাকে নিয়ে মর্ত্যে নিয়ে এসে সগরপুত্রদের ভস্মাবশেষ ধুয়ে ফেলেন এবং তাঁদের আত্মাকে মুক্ত করে দেন।

(রামায়ণ, বালকাণ্ড, ৪৩ অধ্যায়)

মহাভারতের বনপর্বে তীর্থযাত্রা অংশে গঙ্গাসাগর তীর্থের কথা বলা হয়েছে। পালবংশের রাজা দেবপালের একটি লিপিতে তার গঙ্গাসাগর-সঙ্গমে ধর্মানুষ্ঠান করার কথা বলা হয়েছে। লোক-কাহিনি অনুযায়ী, এখানে কপিলমুনির একটি আশ্রম ছিল। কালের নিয়মে সেটা এক সময় সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। পরে আবার নতুন করে সেটা গড়ে তোলা হয়। আশ্রমটিকে কেন্দ্র করে ভক্তদের সমাগম বাড়তে থাকে। প্রত্যেক বছর জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি মকর সংক্রান্তি বা পৌষ-সংক্রান্তির পূণ্যতীথিতে লাখো লাখো মানুষের সমাগম ঘটে এই সঙ্গমে। এই সমাগমকে ঘিরে গড়ে ওঠে বিরাট মেলা। যার নাম গঙ্গাসাগর-মেলা।

কুম্ভমেলার পরেই এই মেলার স্থান। মানে, দ্বিতীয় বৃহত্তম হিন্দু মেলা এটি। এখানে ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তো বটেই, অন্যান্য দেশ থেকে লোক এলেও, মূলত বিহার আর উত্তরপ্রদেশ থেকেই অবাঙালি পুণ্যার্থীরা ভিড় করেন বেশি।

কলকাতা শহর থেকে মাত্র ১০০ কিলোমিটার দূরের এই দ্বীপে যাওয়ার সহজ উপায় হল--- প্রথমেই কলকাতায় পৌঁছে যাওয়া। শিয়ালদার দক্ষিণ শাখা থেকে কাকদ্বীপ কিংবা নামখানার ট্রেনে করে সোজা নামখানা। সেখান থেকে বাসে বা রিকশায় হারউড পয়েন্ট ৮ নম্বর লঞ্চ ঘাটে। কলকাতা থেকে অবশ্য বাসে করেও যাওয়া যায়। ঘণ্টা তিনেকের রাস্তা। হারউড পয়েন্ট ৮ নম্বর লঞ্চ ঘাটে। সেখান থেকে ফেরি ভেসেলে গঙ্গা পেরিয়ে কচুবেড়িয়া। মিনিট চল্লিশের পথ। কচুবেড়িয়া থেকে বাসে বা ট্রেকারে ৩০ কিমি দূরে বহু কাঙ্ক্ষিত--- সাগর। তবে আগে থেকে জোয়ার-ভাঁটার সময় জেনে নিলে ভাল। না হলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পাড়ে বসে থাকতে হতে পারে।

ভেসেলে ওঠার আগে বাদাম, ভুট্টা বা বিস্কুট নিয়ে নিতে পারেন। কারণ, যখন ভেসেল চলবে, তখন দেখবেন সেই ভেসেলের সঙ্গে সঙ্গে ডানা মেলে চলেছে অজস্র পরিযায়ী পাখি। অনেকেই তাদের দিকে খাবার ছুড়ে দিচ্ছে। ওরাও তা ছোঁ মেরে নিয়ে নিচ্ছে। এই অভাবনীয় দৃশ্য দেখে আপনারও ইচ্ছে করতে পারে, ওদের কিছু দিই।

না, ওখানে থাকার এখন আর কোনও সমস্যা নেই। প্রচুর ধর্মশালা ও পান্থনিবাস আছে। আছে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও বিভিন্ন মন্দির সংলগ্ন ছোট বড় নানা রকম থাকার জায়গা। বহু বাড়িতেও যৎসামান্য টাকায় ঘর ভাড়া পাওয়া যায়। বললে, আপনি যা খেতে চাইবেন, এনে দিলে কিংবা দাম ধরে দিলে ওরা তা রান্নাও করে দেবে। আছে ভারত সেবাশ্রম সংঘও।

এ ছাড়া পি ডব্লু ডি জেলা পরিষদ বাংলো, সেচ দফতরের ও পাবলিক হেলথ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বাংলো ও পঞ্চায়েতের যাত্রীনিবাসও আছে। আছে একটি পর্যটন লজ এবং একটি যুব হোস্টেল। ছুটি কাটানোর জন্য আছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের মিষ্টির ধর্মশালা। আছে সাগরদীপের গেস্ট হাউসও। আছে ভারত সংস্কৃতি সংঘের ধর্মশালা। কাপিলমুনি সংঘের ধর্মশালা। সাগরদ্বীপের টুরিস্ট লজ এবং ইয়ুথ হোস্টেল। আছে শঙ্করাচার্য আশ্রমের ধর্মশালা।

আগে থেকে ফোন করে বুক করা যেতে পারে---  স্টেট ইয়ুথ হোস্টেল,   +৯১ ৩৩ ২২৪৮ ০৬২6। সংযুক্ত স্নানের সঙ্গে একটি ডাবল বেড রুমের ভারা হল ১০০ টাকা প্রতিদিন। চেকিং টাইম হল দুপুর ১২টা। কলকাতার যুব পরিষেবা অধিদপ্তর, ৩২/১, বি.বি.ডি. থেকেও বুকিং করা যেতে পারে।

গঙ্গাসাগরে পৌঁছনোর পরেই সাগরে স্নান সেরে কপিলমুনির আশ্রমে পুজো সেরে নিতে পারেন। দর্শন করে নিতে পারেন মন্দির-লাগোয়া সাধুদের স্থায়ী ডেরা। মেলার সময় এই সব জায়গা একেবারে গমগম করে। হিমালয়ের সাধুসন্তরা তীব্র শীত উপেক্ষা করে কেবলমাত্র ছাইভস্ম গায়ে মেখে অনাবৃত অবস্থায় তাঁরা তাঁদের ধর্মীয় নিয়ম পালন করেন।

মেলার সময় সরকারের পাশাপাশি অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও প্রাথমিক চিকিৎসা থেকে আরম্ভ করে সেবামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে। থাকে অনেকগুলো অ্যাম্বুলেন্স। সদাসর্বদা তটস্থ থাকে সাগর গাসপাতাল। সে রকম বুঝলে হেলিকপ্টারে চাপিয়ে রোগীকে কলকাতায় উড়িয়ে আনা হয়। হারিয়ে যাওয়া বাচ্চা বা বৃদ্ধদের রাখা হয় নিরাপদ নানান শিবিরে। প্রতিদিন জলখাবার, চা-বিস্কুট এবং দিন-রাতের খাবার বিলি করে বহু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। খিদিরপুরের একটি সংস্থা যাত্রীদের সমস্ত মালপত্র নিজেদের হেফাজতে রাখে। আসলে এই মেলার সময় সবাই জাতপাত ভুলে, সমস্ত সঙ্কীর্ণতা দূরে ঠেলে ঐক্যের এক ভারতের সূচনা ঘটায়।

যেখানে এই সাগর, সেই বঙ্গোপসাগর হল বিশ্বের বৃহত্তম উপসাগর। এটা ভারত মহাসাগরের উত্তর অংশে অবস্থিত। প্রায় ত্রিভূজাকৃতি উপসাগর। এই উপসাগরের পশ্চিম দিকে রয়েছে ভারত ও শ্রীলঙ্কা, উত্তর দিকে ভারত ও বাংলাদেশ এবং পূর্ব দিকে রয়েছে মায়ানমার ও থাইল্যান্ড। বঙ্গোপসাগরের ঠিক মাঝখানে বিরাজ করছে ভারতবর্ষের আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ।

মেলার সময় ছাড়া অন্য যে কোনও সময়ও এখানে যাওয়া যায়। গেলে মন চাইলে ভ্যানরিকশায় চেপে বেরিয়ে পড়তে পারেন দ্বীপ দর্শনে। মঠ–মন্দির-আশ্রমের এই সাগরসঙ্গমে। ঘুরে আসা যায় মনসাদ্বীপে, রামকৃষ্ণ মিশনের আশ্রমে আর লাইটহাউসে। যাওয়া যায় ইসকনের মন্দিরেও। মেলার সময় এরা প্রায় এক লক্ষ লোককে বসিয়ে খাওয়ায়। কম্বল বিতরণ করে এবং অস্থায়ী ভাবে পুণ্যার্থিদের থাকার ব্যবস্থা করে।

বিকেলের দিকে একবার পায়ে পায়ে হেঁটে যেতে পারেন সাগর কিনারায়। যে পথ সেচবাংলো থেকে সোজা সমুদ্রে গেছে, সেই পথ ধরে। এই পথে ঝাউয়ের জঙ্গল পাবেন। এখনও প্রচুর ঝাউগাছ আছে। নতুন ভাবে আরও লাগানো হচ্ছে। সাজিয়ে-গুছিয়ে তোলা হচ্ছে। নতুন স্টুরিস্ট স্পট হিসেবে।

তবে মনে রাখবেন, ভুল করেও কোনও পলিপ্যাক সঙ্গে নেবেন না। কারণ, গঙ্গাসাগরকে এখন প্যাস্টিক মুক্ত করার জন্য সবাই উদ্যোগী হয়েছেন। আমরাও না হয় একটু উদ্যোগী হলাম, যাতে পরবর্তী প্রজন্মের কেউ এখানে বেড়াতে এলে শুধু প্রকৃতি দর্শন নয়, তার সঙ্গে সঙ্গে বুক ভরে একটু বিশুদ্ধ বাতাস নিতে পারেন এবং বলতে পারেন--- 'সব তীর্থ বারবার / গঙ্গাসাগর একবার' নয়, গঙ্গাসাগর বারবার / এবং আবার / এবং আবার...

 

সিদ্ধার্থ সিংহ
কলকাতা 

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top