সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

জননী ও জন্মভূমি : শাহানারা পারভীন শিখা


প্রকাশিত:
৬ এপ্রিল ২০২১ ১৯:৪০

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ১৮:০১

 

আম্মার চলে যাওয়ার সাত মাস পার হয়ে গেছে। সেই যে রেখে এসেছি। এতদিনেও দেখতে যাওয়া হয়নি। এবার আব্বাকে সাথে নিয়ে যাবো ঠিক হলো।
কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা আমার মায়ের বাড়ি। সেখানেই আম্মা চিরনিদ্রায় চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে।
বাসের দুটো সিট আগেই কাটা ছিল। নির্দিষ্ট সময়ে কাউন্টারে পৌঁছে শুনি বাস আসতে দেরি হবে। কারণ মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট সাভারে যাবেন এ পথে। সেকারণে রাস্তা বন্ধ।গাড়ি কখন আসবে তার ঠিক নেই।
আমার মনে সবসময় একটা প্রশ্ন ঘোরে, এই ধরনের বিশেষ মানুষদের জন্য হেলিকপ্টার ব্যবহার করলে তো সাধারণের এমন দুর্ভোগে পরতে হয় না। প্রায় দু'ঘন্টা পর বাস আসে। এরপর আমাদের যাত্রা শুরু হয়।
পথে তেমন একটা জ্যাম নেই।
ফোর লেন ধরে গাড়ি ছুটে চলেছে।
ঝকঝকে তকতকে রাস্তা। রাস্তার দুপাশে সবুজের সমারোহ। বিস্তৃত মাঠ জুড়ে সবুজ ধানক্ষেত আর সবুজ গাছপালায় ছাওয়া। চতুর্দিকে সবুজ ভালোবাসা ছড়িয়ে আছে। আমি দুচোখ মেলে দেখতে থাকি।
গাড়ি বঙ্গবন্ধু সেতুর উপর উঠতেই সতৃষ্ণ নয়নে যমুনা নদী দেখি। খুঁজে পাইনি স্রোতস্বিনী যমুনাকে। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে কেবলই বালির আস্তর। পানির প্রবাহ নেই বললেই চলে। চর পরে ভরাট হয়ে গেছে নদীর নানা জায়গা। ছোটটো একটা দীর্ঘশ্বাস বুকে আছড়ে পড়ে।
গাড়ি ছুটে চলেছে চলনবিলের রাস্তা ধরে। এখন আর বিলে পানি নেই। সবুজ ধানক্ষেতে ছাওয়া।

হঠাৎই বদলে যায় চারপাশের পরিবেশ
রাস্তার একপাশে সারি সারি সুউচ্চ অট্টালিকা। আর অন্য পাশে রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র। এটাকে ঘিরে চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। এটাকে কেন্দ্র করেই আশেপাশের এলাকা বদলে যাওয়া চেহারা চোখে পরে।


সন্ধ্যা নামার কাছাকাছি। দূর থেকে দেখি লালন শাহ সেতু। আলোয় ঝলমল করছে।
পাশেই হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। পলকে দেখে নিলাম আমাদের পদ্মা নদী। মনে মনে গাইলাম ' 'পদ্মার ঢেউ উড়ে এ এ..। চৈত্রের খরায় নদীর সে ঢেউ এই শূণ্য মনকে আর নিয়ে যাবেনা নদীর বুকে।

দুপাশে সবুজের মাঝে হারিয়ে যেতে যেতে মায়ের সুঘ্রাণ পাই। ভেড়ামারা। আমার জন্মস্থান। এখানেই আমার মা ঘুমিয়ে আছে।
বাসার সামনেই নেমে পড়ি বাস থেকে। গেটের নেমপ্লেটে ' সুশীলা ' নামটি দেখলাম। আমার মায়ের নাম। দুতলা বাড়িটা কেমন নিশ্চুপ। আগে বাস থেকে নেমেই আম্মাকে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতাম।আম্মার হাজারো স্মৃতি ছুঁয়ে আছে বাড়ির প্রতিটিতে।


খুব সকালে হাটঁতে বের হই।
বাড়ির পাশের ক্যানাল পাড়ের ব্রীজে এসে দাঁড়াই। অসাধারণ রূপ চারপাশে। ভীষণ মনোরম।
পদ্মা নদী থেকে আসা এই ক্যানেলটা। জি কে প্রজেক্টের এটা। গাঢ় সবুজ রঙের পানি।ভীষণ স্বচ্ছ। পানিতে গাছের ছায়াগুলোকে আসল ভেবে ভ্রম হতে পারে যে কারো।
আগের চেয়ে বেশ চিকন হয়ে গেছে মনে হলো। কারণ টা জেনেছি পরে।
মূল পদ্মার পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় ড্রেজিং করে নদী থেকে মাটি ক্যানেলের দুপাশে ফেলে ভরাট করছে। শুনলাম পাড় বাঁধিয়ে দুপাশে সৌন্দর্যে ভরিয়ে তুলবে। ভালো লাগলো শুনতে। এমনিতেই সৌন্দর্যের কোন কমতি নেই।
ব্রীজের ওপাশে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ। মাঠের ওপারে পদ্মা নদী। নদীটা দেখা যায় না এখান থেকে। তবে নির্মল বাতাস বয়ে আনে পদ্মার সুর।
দিন দশেক ছিলাম এখানে। প্রতিদিন সকালে বেরিয়ে পড়েছি একা। এক একদিন হেঁটেছি এক এক রাস্তায় ক্যানালের পাশ দিয়ে। সাঁতার কেটে গোসল করেছি এখানে।

জরুরি একটা কাজে আব্বাকে সাথে নিয়ে কুষ্টিয়া যেতে হলো।যাওয়ার সময়ই চোখে পড়লো বালির পাহাড়। বিস্তৃত জায়গা জুড়ে এর বিস্তার। প্রায় শহরের দোরগোড়ায় চলে এসেছে।
পথের দুধারে মাঠের পর মাঠ তামাকের খেত। বিশাল সাইজের সবুজ পাতা। তামাক গাছের চমৎকার ফুল দেখে মুগ্ধ হতে হয়। প্রায় প্রতিটি ঘরের সাথেই আছে তামাক পাতা পোড়ানোর জন্য বিশেষ ভাবে তৈরি দুতলা মাটির ঘর।

আব্বাকে নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কলোনিতে গেলাম। একসময়ের জমজমাট সেই কলোনির মলিন দশা।
কলোনির পেছনের দেয়ালের ওপারে গড়াই নদী। পদ্মা নদীর শাখা নদী।
পেছনের গেটটা তালাবদ্ধ। দারোয়ানকে বলতেই খুলে দিল।
ভাবলাম গেইট থেকে বেরুলেই নদী। কিন্তু কোথায় নদী!
আব্বা বললো আগে এখানেই ছিল। বালির আস্তর জমে জমে নদী সরে গেছে বেশ দূরে।
চারিদিকে শুধু বালির পাহাড়।
নদীর উপর সুবিশাল ব্রীজ দেখলাম। কুষ্টিয়ার হরিপুর এলাকার সাথে সংযোগ।
যতদূর চোখ যায় নদীর পানি আর চোখে পড়ে না। ব্রিজের নিচের টং দোকানে দাঁড়িয়ে চা খেতে খেতে দোকানদারের কাছ থেকে এই নদীর অনেক গল্প শুনলাম।
নদীর কান্না এখানের মানুষের বুকেও আছে বুঝলাম।
বিশাল নদীটাকে বাঁধ দিয়ে ছোট করার কথা জানলাম।
আমি নদীটাকে কাছ থেকে দেখতে চাই।
জানাতেই বললো, ব্রীজের নীচ দিয়ে হেঁটে যান।

বালির উপর দিয়ে হেঁটে পৌঁছে গেলাম নদীর কাছে। শহর ঘেষা নদীর জীর্ণ শীর্ণ রূপ।
এমনিতেই এসময়টা প্রচন্ড খরায় নদী নালা শুকিয়ে যায়। তারপরও! এতটা কম থাকার কথা নয়।
বাঁধের উপর দাঁড়িয়ে দেখছিলাম আমাদের একসময়ের সুবিশাল এই নদীর ভগ্নদশা। বিশাল ব্রীজের পায়ের পাতা পর্যন্ত পানি আছে কিনা সন্দেহ। গরু চড়ে বেড়াচ্ছে।
এ নদীর একদম কাছে যেতে হলে আমাকে উঁচু এই বাঁধ থেকে অনেক নীচে যেতে হবে। গনগনে রোদের মধ্যে এতটা দুরে আর যাইনি। ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম বহতা গড়াইয়ের হারানো রূপ ফিরে পাবে আবারও।
সৌন্দর্য বর্ধনের কথা আছে শুনলাম। বিকেল হলেই একটু শান্তি খুঁজতে অনেকেই ঘুরতে আসে এখানে। নৌকায় চড়ে ঘুরে বেড়ানোর আয়োজন আছে। পদ্মা আর গড়াই নদীর মিলন স্থলে যাওয়ার ইচ্ছে নিয়ে ফিরে এলাম।

শৈশব ছুঁয়ে থাকা আমার জন্মভূমি।
চারপাশের সবুজ ভালোবাসায় খুঁজে নিয়েছি মায়ের শ্নেহ। জননী ও জন্মভূমি আজ মিলেমিশে একাকার। আমি প্রাণ ভরে শ্বাস নিই। এটাই আমার বেঁচে থাকার অক্সিজেন। এই অক্সিজেন বুকে নিয়ে আবারও ফিরে আসি এই কাঠখোট্টা শহুরে জীবনে।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top