সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

ভালো আছো, ম্যাকলাস্কিগঞ্জ! : (পর্ব তিন) : ড. গৌতম সরকার


প্রকাশিত:
১১ নভেম্বর ২০২১ ০০:২২

আপডেট:
১৯ এপ্রিল ২০২৪ ২০:৫৫

ছবিঃ কয়লা খাদান

 

পরের দিন বেশ ভোর ভোর ঘুম ভাঙলো, শরীরটা চনমনে লাগছে অর্থাৎ ঘুমটা ভালোই হয়েছে৷ যদিও সারারাতই লোডশেডিং ছিল কিন্তু আবহাওয়া ঠান্ডা থাকার কারণে ঘুমের ব্যাঘাত হয়নি৷ বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম, সোয়া পাঁচটা বাজে৷ বেড়াতে এসে আমার অভ্যাস হল সকালবেলা একবার একা একা এক চক্কর হেঁটে আসা, তৈরী হয়ে বেরোতে বেরোতে দেখি সন্দীপ আর পাশের ঘরের প্রবীরও তৈরি, তিনজনে মিলে প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে পড়লাম৷ একটা জিনিস আমি বিশ্বাস করি (আপনারা অনেকেই সহমত পোষণ করবেন) বেড়াতে গিয়ে সেই জায়গাটা একটু পায়ে হেঁটে না ঘুরলে জায়গাটাকে সঠিক ভাবে চেনা যায়না, জায়গাটার হৃদস্পন্দন অনুধাবন করা যায় না৷ হোটেল থেকে বেরিয়ে বাঁ দিকের রাস্তাটা ধরে এগিয়ে গেলাম, এটা ম্যাকলাস্কির উল্টো দিক, এদিকটা আগে আসা হয়নি৷ এদিকে বাড়ি ঘর অনেক বেশি, বেশ ঘন ঘন আর একটু বেশি সম্পন্ন পরিবারের বাস৷ আস্তে আস্তে এগিয়ে যাই, ম্যাকলাস্কির ঘুম ভাঙ্গছে, সূর্য এখনও ওঠেনি তবে পাকা কামরাঙা রঙের পূব আকাশ তাঁর আশু আগমন বার্তা ঘোষণা করছে৷ এদিকটা দেখে মনে হছে সমস্ত সম্প্রদায়ের বাস, ইতস্ততঃ মন্দির, মসজিদ একটা গির্জাও চোখে পড়ল৷ আমরা এদিক ওদিক ঘুরতে থাকি, এপথ ওপথ করতে করতে অবশেষে বুঝলাম জায়গাটায় আমরা গোল গোল হয়ে ঘুরে যাচ্ছি, শেষে ট্রেনের আওয়াজ শুনে সাব্যস্ত হল রেললাইনের দিকেই যাওয়া হবে কারণ সকলেরই মনটা একটু চা চা করছে৷ আবার কিছুটা আন্দাজে পথ চলা শুরু, দেখতে দেখতে চলে এলাম ম্যাকলাস্কিগঞ্জের থানা, থানার সামনের মাঠে আগামীকাল স্বাধীনতাদিবসের প্রস্তুতি চলছে, পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় চোখে পড়ল থানার দোতলা থেকে বন্দুকের নল তাক করে নির্নিমেষে আমাদের লক্ষ্য করছে এক উর্দিধারী পুলিশ৷ তড়িঘড়ি করে জায়গাটা পেরিয়ে যাই, ভয় হল কি জানি আমাদের উগ্রপন্থী-টন্থী ভাবছে কিনা ! প্রবীর আশ্বাস দিল, "আরে ওসব কিছুনা, এসব স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে অতিরিক্ত সতর্কতা৷ " যাই হোক হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌছলাম রেলওয়ে ক্রসিংয়ে, বাঁদিকে স্টেশন দেখা যাচ্ছে, আমাদের ইচ্ছা রেললাইন টপকে ওপাশটা একটু ঘুরে পিছন দিক দিয়ে স্টেশনে ঢোকা৷ সেইমতো লাইন টপকে এদিকে চলে এলাম, তারপর সামনে এগোতে থাকি, কিছুটা যাবার পর একটা রাস্তা বাঁদিকে ঘুরে গেছে৷ আমরা ভাবলাম এটাই নিশ্চয় পিছন দিক দিয়ে স্টেশনে গিয়ে মিলেছে, সামনে বসে থাকা একজনকে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল এই রাস্তা স্টেশনে যাবেনা তখন সেই ভদ্রলোক আমাদের বললেন, "আপনারা এদিকে এসেছেন কেন, স্টেশনতো ওই রেলওয়ে ক্রসিং থেকে ডানদিকে গেলেই পাওয়া যাবে৷" আমরা যত বলি, এদিক দিয়ে কোনো রাস্তা আছে কিনা- কারন ভূগোল বলছে এদিক দিয়ে রাস্তা থাকতেই হবে, হয়ত আর একটু এগিয়ে বাঁ দিকে ঢুকেছে, ভদ্রলোক অবাক হয়ে আমাদের মুখের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন, উনি ভাবতেই পারেননি সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে এরকম কতকগুলো বুরবাকের মুখোমুখি হতে হবে - যে রাস্তা দিয়ে পাঁচ মিনিটে গন্তব্যে পৌঁছান যায় সেদিকে না গিয়ে এরা কেন সামনের রাস্তা ধরে যেতে চাইছে সেটা ওনার মাথায় কিছুতেই ঢুকছিল না৷

অবশেষে আমরা তাকে বোঝালাম যে আমরা সকালবেলা একটু হাঁটতে বেরিয়েছি, ওনার নির্দেশিত রাস্তাটা আমাদের জানা, কিন্তু আমরা একটু ঘুরতে ঘুরতে, দেখতে দেখতে যেতে চাই তখন তিনি সামনের দিকে দেখিয়ে বললেন, ‘তাহলে যান ওদিকে, রাস্তা পেয়ে যাবেন’৷
এগিয়ে চলি, এগিয়ে চলি - বেশ অনেকটা যাবার পর দেখতে পেলাম বাঁ দিকে একটা রাস্তা ঢুকে গেছে, কেউ কোথাও নেই যে জিজ্ঞাসা করব, অনেকক্ষন আগেই আগেই বাড়িঘর শেষ হয়ে গেছে, সুতরাং আন্দাজের ওপর নির্ভর করে চলতে থাকি৷ এবার চলছি তো চলছি, না মিলছে কোনও লোকের দেখা, না পাচ্ছি কোনও গ্রামের হদিশ৷ এতক্ষণ মালগাড়ির আওয়াজ শুনতে শুনতে পথ চলছিলাম এখন তাও ক্ষীন হতে হতে আর কিছুই শুনতে পাচ্ছি না, তবে কি স্টেশন থেকে আমরা ক্রমশঃ দূরে সরে এসেছি ! এবার একটু চিন্তা শুরু হল, অনেকক্ষন বেরিয়েছি, হোটেলে ফিরতে ফিরতে কত দেরি হবে কে জানে, ওদিকে সাড়ে নটায় টোটো আসবে৷ এখন পিছনে ফেরার আর কোনো উপায় নেই অগত্যা সামনেই এগোতে লাগলাম৷ বেশ কিছুক্ষন পর অবশেষে একটা আদিবাসী গ্রামে এসে পৌৎছলাম, জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, হ্যাঁ, এই রাস্তাই স্টেশনে গেছে৷ আমি আবার জিজ্ঞাসা করি, “কোন স্টেশন, ভাই?” উত্তর পাই , 'ম্যাকলুস্কিগঞ্জ'৷ ধড়ে প্রাণ এলো কারণ আমার তখন দুর্ভাবনা হচ্ছিল আমরা বোধ হয় হাঁটতে হাঁটতে পরের স্টেশন ‘টোরি’ পৌছে গেছি৷ তাই নতুন উদ্দমে পথ চলা শুরু হল, চলতে চলতে টের পেলাম কেন আগের ওই ভদ্রলোক আমাদের কথা শুনে মুখের দিকে ওরকম অবাক চোখে তাকিয়ে ছিলেন, আর কেনইবা আমাদের বেওকুব সমঝেছিলেন৷ পথ পথের মতো চলতে থাকল, আর আমরা আমাদের মতো হাঁফাতে হাঁফাতে, হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে এগিয়ে চললাম৷ ঘাম হয়ে শরীরের সব নুন বের হয়ে গেল, আর টানা যাচ্ছেনা, মাথার ওপর সূর্যদেবের ক্রোধ আমাদের আহাম্মকি দেখে ক্রমশঃ যেন বেড়ে চলেছে৷ বেশ কিছুটা চলার পর দূরের দিকে তাকিয়ে আমার মুখে স্বস্তির হাঁসি ফুটে উঠল - একটু চেনা চেনা লাগছে না ! ওদের কিছু বললাম না, আরেকটু এগিয়ে গেলাম - হ্যাঁ, এবার নিশ্চিত - সামনে গিয়ে রাস্তাটা যে দ্বিধাবিভক্ত হয়েছে তার বাঁ দিকেরটা স্টেশন গেছে, এ তো আমার চেনা রাস্তা, কাল স্টেশন থেকে এই অবধি এসে আমি ফিরে গেছি৷ এবার বাকিদের আশ্বস্ত করলাম৷ সেই চেনা গ্রামের পথ ধরে স্টেশনে আসতে বেশি সময় লাগলোনা৷ চেনা বলেই কী ! নাকি গন্তব্যে পৌছনোর নিশ্চয়তা বাড়তি অক্সিজেন জোগালো? স্টেশনে পৌছে আগে আমাদের চেনা চায়ের দোকানে বসলাম, একটু ঠান্ডা হয়ে জলপিপাসা মেটালাম, তারপর চা-বিস্কিট খেতে খেতে বুঝলাম বেশ ক্ষিদে পেয়েছে৷ তবে আর একদম দেরি নয়, সাড়ে পাঁচটায় বেরিয়েছিলাম আর এখন বাজে পৌনে নটা, চা খেয়ে চটপট গর্ডন হাউস ফিরতে হবে৷

ব্রেকফাস্ট সেরে বেরোতে বেরোতে দশটা বেজে গেল৷ প্রথমে যাবো কয়লাখনি, কিছুটা যাওয়ার পর টোটোটা হঠাৎ মেইন রাস্তা থেকে গোঁত্তা মেরে ঢুকে পড়ল পাশের অপরিসর রাস্তায়৷ জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, এটা শর্টকাট এবং এটাই অপেক্ষাকৃত ভালো রাস্তা, যেতে যেতে টের পেলাম ভালো রাস্তার যন্ত্রণা৷ এই যদি ভালোর নমুনা হয় তাহলে খারাপটা না জানি কি হতো! রাস্তা বলে কিছু নেই, সিম্পল খোয়া ছড়ানো, কখনও গ্রামের মধ্য দিয়ে, কখনও মাঠের ওপর দিয়ে আবার কখনওবা পুকুরের পাশের সরু রাস্তা দিয়ে বিপজ্জনক ভাবে টাল খেতে খেতে চলেছে৷ আমাদের অবস্থা টিনের কৌটোর মধ্যে থাকা মুড়ির মতো, গাড়ি যেদিকে হেলে সেইমতো গড়িয়ে পড়ছি, আমি আবার বসেছিলাম ছিলাম ড্রাইভারের পাশে সামনের সিটে, আমার অবস্থা আরও শোচনীয় , রড ধরে বসে অনবরত টাল সামলানো একটা চ্যালেঞ্জের পর্যায়ে পৌছে গেল৷ ডানদিকে হেললে আমি পড়ি ড্রাইভারের ঘাড়ে আর বাঁ দিকে হেললে ড্রাইভার পড়ে আমার ঘাড়ে৷ এ যেন উদ্দাম পাহাড়ি কোনো নদীতে রাফ্টিং প্রতিযোগিতা চলছে৷ এভাবে নাচতে নাচতে এগিয়ে চললাম৷ কিছুটা যাবার পর টোটো মেইন রাস্তায় উঠল; সকলের স্বস্তির নিশ্বাস পড়ল, কিন্তু তৃপ্তির উদ্গার মিলিয়ে যেতে না যেতেই গাড়ি আবার গাঁক করে টার্ন নিয়ে আবার ঢুকে পড়ল সেই ভয়ংকরের আবর্তে৷ কিচ্ছু করার নেই...এভাবেই ছেলে-বুড়ো মিলে নাচতে নাচতে চলতে থাকলাম আর গভীর আতঙ্ক মনে জাগলো - নামার পর শরীরের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোকে নিজের নিজের জায়গায় দেখতে পাবো কিনা!
অবশেষে আট-দশ কিলোমিটার রাস্তা এভাবেই চলে এলাম, এসে পৌছলাম ম্যাকলাস্কির আগের স্টেশন খলাড়ি৷ এখানে এসে নরক গুলজার সম্পূর্ণ হল, এতক্ষণ কেবলমাত্র রাস্তাই খারাপ ছিল এখন তার সাথে যুক্ত হল নোংরা পুতিগন্ধময় রাস্তার জমা কালো জল, ধোঁয়া, ধুলো, লোকজনের চিত্কার, চেঁচামেচি, ট্রেনের আওয়াজ, আর তার সাথে নিয়মশৃঙ্খলাহীন ট্রাফিক৷ মনে হল কোথাকার কি এক খাদান দেখার জন্য এত কষ্ট কেন করছি! যাই হোক আরও আধ ঘন্টা পর দুঃস্বপ্ন রাত্রির শেষ হওয়ার মতো (আপাতভাবে ) গন্তব্যে পৌছলাম৷ কয়লাখাদান ব্যাপারটা আমার কাছে নতুন, বইপত্র বা ছবিতে দেখলেও, সামনাসামনি দর্শন এই প্রথম৷ দেখলাম বেশ বিশাল আয়োজন চলছে চারদিকে, যতদূর চোখ যায় দিগন্তজোড়া বিশাল এক কালো গহ্বর জুড়ে চলছে কয়লা খননের কাজ, যদিও আমরা একদম ওপরে, নিচে কী চলছে কিছুই বুঝতে পারছিনা কিন্তু চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি পরতের পর পরত কয়লার স্তর, কোথাও ঘন কালো কোথাও হালকা কালো৷ একটা কথা খনি এলাকার মাটি খুব ভঙ্গুর হয় তাই পা ফেলতে হয় খুব সাবধানে৷ বিশেষতঃ আপনি যখন খাদের কিনারার কাছাকাছি চলাফেরা করছেন৷ খাদানে অনেকক্ষণ সময় কাটালাম, প্রাণটা চা চা করতে লাগলো, ফিরে ড্রাইভার ছেলেটির কাছে আবদার পেশ করলাম এবং তুরন্ত আশ্বাস পেলাম৷ এবার ওরা আমাদের নিয়ে গেল খাদানের অন্য এক দিকে, এদিকেও দৃশ্যপট একই তবে একটা জিনিস দেখে খুব ভালো লাগলো - অনেক নিচে খাদানের গায়ে সৃষ্টি হয়েছে এক কৃত্রিম ঝরনা, সেখান থেকে তির তির করে জল বয়ে চলেছে৷ খুব সুন্দর দেখতে লাগছে ওপর থেকে৷ তবে রোদের যা তেজ বেশিক্ষণ দাঁড়ানো গেলনা, পাশে একটা মেকশিফ্ট চায়ের দোকান, মাথায় প্লাস্টিক টাঙানো৷ সবাই মিলে ঢুকলাম কিছুটা চায়ের আশায় আর কিছুটা খরতাপ থেকে বাঁচতে৷ হাত-পাটাও একটু খেলিয়ে নিলাম, ফেরার জন্য মনের সাথে সাথে একটু শারীরিক প্রস্তুতিও খুব জরুরি৷
শুরু হল প্রতিঅভিযান, গল্প একই, তবে এবার শরীর প্রতি মুহূর্তে জানান দিচ্ছে, পিছন থেকে অনবরত ভেসে আসছে 'আঃ! উঃ! ওরে বাবা, গেলাম রে! ওঃ মাগো! ওঃ ভগবান! ও ভাই একটু দেখে চালাও!'৷ আমি সামনে বসে মনে মনে ভাবছি -এই পথ যদি তাড়াতাড়ি শেষ হয়, তবে কত ভালো হয় বল তো? কিন্তু পথের কোনো শেষ নেই, সে তার আপন গরিমায় চলতেই থাকে, চলতেই থাকে, এবং আমাদের নিয়ে এক বিভত্স মজার খেলায় মত্ত হয়ে ওঠে৷ আমরা এখন যাচ্ছি দুগাদুগি নদী দেখতে৷ সেই একই রাস্তা ধরে ফিরতে হবে তারপর স্টেশনে পৌছে উল্টোরাস্তায় কতদূর যেতে হবে কে জানে ! যতটা সম্ভব মুখ বুজে চলার চেষ্টা করি, কিন্তু অবচেতনে মুখ দিয়ে এমন সব শব্দাংশ বেরোতে লাগলো যেগুলো বোধহয় শৈশবে ভাষাশিক্ষার আগে মুখনিঃসৃত হত৷ মা সঙ্গে থাকলে হয়ত অর্থ উদ্ধার করতে পারতেন, কিন্তু তাঁকে এখন কোথায় পাবো, তিনি তো আমাকে ছেড়ে চিরকালের মতো চলে গেছেন৷ তাই যাচ্ছি তো যাচ্ছি, ভাবছি কষ্টের পথ কি দীর্ঘ হয় ?


ছবিঃ দুগাদুগির বিস্তার

হয়তোবা৷ অবশেষে সকালের দেখা সেই রেলওয়ে ক্রসিংয়ে পৌছলাম৷ দেখলাম আমাদের পায়ে হাঁটা পথ ধরেই টোটো এগিয়ে চলল৷ সেই রাস্তা, রাস্তার বাঁক, বহুদূরের সেই গ্রাম, আস্তে আস্তে পৌছে যাই সেই জায়গায় যেখানে রাস্তা দুভাগে ভাগ হয়েছে, বাঁ দিকের রাস্তা স্টেশনে গেছে আমরা ডানদিকের রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলাম৷ রাস্তা অপেক্ষাকৃত ভালো হলেও শরীর এবার সরবে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে শুরু করেছে৷ জঙ্গল ক্রমশ ঘন হচ্ছে, চারপাশের মাটি গাঢ় রক্ত বর্ণ ধারণ করছে, গাড়ি এবার বাঁদিকে ঘুরে জঙ্গলের সংকীর্ণ রাস্তা ধরল, আবার শুরু হল যাত্রার যন্ত্রনা৷ কিছুটা গিয়ে চোখে পড়ল একটা ছোট নদী, ভাবলাম - আহা, এটাই যদি দুগাদুগি হত কি ভালোই না হত! একবার ভাবলাম এখানেই নেমে পড়ি, কিন্তু ওই যে মধ্যবিত্ত মানসিকতা - পয়সা দিয়েছি, সবটা তো যেতেই হবে৷ তাই শত কষ্ট বুকে চেপে নিয়ে এগোই, দলে অধিকাংশ সদস্যের বয়স চল্লিশের ওপরে, আর খুব স্বাভাবিকভাবেই স্পন্ডেলাইসিসে আক্রান্ত৷ তাই রাস্তা যত দীর্ঘ হয় কষ্ট তত চেপে বসে৷ শেষে টোটো ড্রাইভারের ওপরই রাগ হয় - ব্যাটা এত কম পয়সায় কিভাবে আমাদের হিল্লিদিল্লি ঘোরাচ্ছে৷ অবশেষে আরো কিছুক্ষণ নরক ভোগের পর অপেক্ষাকৃত একটা বড় নদীর পারে উপস্থিত হলাম৷ মনে হল এটাই সেই কাঙ্ক্ষিত জায়গা, কিন্তু আমি মনস্থ করে ফেলেছি, আর নয় অনেক হয়েছে - গাড়ি সম্পূর্ণ থামার আগেই আমি নেমে পড়েছি, নেমেই ড্রাইভারকে বিশুদ্ধ বাংলায় বলতে লাগলাম, "দেখ ভাই, এটা দুগাদুগি হোক বা নাই হোক, এটাই দুগাদুগি৷" ড্রাইভার তো কিছুই বুঝতে পারছে না, হাঁ করে মুখের দিকে চেয়ে বোঝার চেষ্টা করছে, হয়তো ভাবছে রোদের তাপে স্যারের মাথা বোধহয় খারাপ হয়ে গেছে৷ আমি কিন্তু একই ডায়ালগ বার বার আউরে যাচ্ছি, ‘এটা দুগাদুগি হোক বা না হোক..........’৷ পিছনের গাড়িটাও এসে পৌঁছল, আমি একই ডায়ালগ দিতে দিতে দৌড়ে গিয়ে শর্মিলাকে গাড়ি থেকে হাত ধরে নামাই (জনান্তিকে বলে রাখি আমাদের ঘরণীদের সমস্ত রোগের সম্যক অভিজ্ঞতা আছে, তাই নিজের সাথে সাথে শর্মিলার শরীর নিয়ে চিন্তা ছিল)৷ হঠাৎ দেখলাম দলের সকল সদস্য, ছেলে থেকে বুড়ো, কোরাসে বলতে শুরু করেছে, "দুগাদুগি হোক বা না হোক এটাই দুগাদুগি৷" কথাগুলো এবং তার সাথে আমাদের সম্মিলিত হাঁসি সারা পাহাড়, নদী, জঙ্গল জুড়ে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো৷

চলবে

 

ড. গৌতম সরকার 
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top