সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ১৮ই এপ্রিল ২০২৪, ৫ই বৈশাখ ১৪৩১


অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় অন্তঃসত্ত্বা: অসম্ভব হলেও সত্যি  : মু: মাহবুবুর রহমান  


প্রকাশিত:
১৫ এপ্রিল ২০২১ ২১:২০

আপডেট:
১৮ এপ্রিল ২০২৪ ১৬:০৩

 

একজন নারী একবার অন্তঃসত্ত্বা থাকা অবস্থায় কি আবারো অন্তঃসত্ত্বা হতে পারেন?" সাধারণত: এর উত্তর হলো - না, তবে ব্যাতিক্রমও আছে। যেমনটা ঘটেছে ইংল্যান্ডের উইল্টশায়ারে রেবেকা রবার্টসের ক্ষেত্রে। রেবেকার দুই সন্তান ছেলেশিশু নোয়াহ ও মেয়েশিশু রোজালির ক্ষেত্রে দুটি ভ্রূণের জন্মের পার্থক্য তিন সপ্তাহ যদিও তারা পৃথিবীতে আসে একই দিনে। 

ইংরেজিতে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় অন্তঃসত্ত্বা হবার ঘটনাকে বলা হয় সুপারফেটেশন (Superfetation)। বিশ্বে এমন ঘটনার প্রকৃত সংখ্যা অজানা। তবে ২০০৮ সালে ইউরোপিয়ান জার্নাল অব অবস্টেটরিক অ্যান্ড গাইনিকলজি অ্যান্ড রিপ্রোডাক্টিভ বায়োলজিতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই ধরনের ১০টির কম ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আর বিজ্ঞানীদের মতে যেসব নারীরা বন্ধ্যাত্বের জন্য চিকিৎসা নেন কেবল তাদের ক্ষেত্রেই অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় অন্তঃসত্ত্বা হবার ঘটনা ঘটে থাকে।  

সুপারফেটেশন ও যমজ এক নয়। যমজ সন্তান জন্মের ক্ষেত্রে একই গর্ভে দুটি ভ্রূণ একসঙ্গে জন্ম নেয় ও একসঙ্গে বেড়ে ওঠে। আর সুপারফেটেশনের ক্ষেত্রে দুটি ভ্রূণ সৃষ্টির পার্থক্য থাকে আর এর ফলে তারা বেড়েও ওঠে ভিন্নভাবে। প্রেক্ষিতে তাদের জন্মগ্রহণের তারিখও থাকে দুটি। সুপারফেটেশনের সর্বশেষ ঘটনার সাক্ষী হলেন রেবেকা রবার্টস ২০২০ সালে। এর আগে ২০১৬ সালে একজন অস্ট্রেলিয়ান নারীর ক্ষেত্রেও এটা ঘটেছিলো এবং তিনি ১০ দিনের মধ্যে দু'বার গর্ভবতী হন এবং ১০ দিনের ব্যবধানে যমজ মেয়েদের জন্ম দিয়েছিলেন।  

 

এবার আসি সর্বশেষ রেবেকা রবার্টস এর সুপারফেটেশন বিষয়ে। রেবেকা রবার্টস (৩৯) ও তাঁর সঙ্গী রিস ওয়েভার (৪৩) এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ্যাত্বের জন্য চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। যদিও রেবেকার ১৪ বছর বয়সী একটি কন্যা সন্তান আছে। আগে কন্যা সন্তান থাকার পর রেবেকা গর্ভধারণ করতে না পারায় ঐ জুটি ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়।  অবশেষে তাঁদের মুখে হাসি ফোটে। একপর্যায়ে ঘরে বসে পরীক্ষায় দেখা যায় রেবেকা অন্তঃসত্ত্বা। দীর্ঘ চেষ্টার পর ইতিবাচক ফল পেয়ে দারুণ খুশি হয় রেবেকা ও তাঁর স্বামী। 

পরে রেবেকা আল্ট্রাসনোগ্রাম করান এবং আল্ট্রাসনোগ্রামের স্ক্রিনে অনাগত সন্তানের অস্তিত্ব দেখতে পায় এই জুটি। এমনকি তার হৃৎস্পন্দন শুনতে পায় তারা। রেবেকার আল্ট্রাসনোগ্রামের প্রতিবেদনে তাঁর প্রসূতিবিদ একজন সন্তানের কথাও লিখে দেন। গর্ভধারণের বিষয়টি নিশ্চিত হতে প্রথম আল্ট্রাসনোগ্রামের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে রেবেকা বলেন, তাঁর মনে আছে, পরীক্ষার পর তিনি বেশ খুশি মনে সেখান থেকে বেড়িয়ে এসেছিলেন। 

এভাবেই চলছিলো কয়েক সপ্তাহ। ৫ সপ্তাহ পর ১২তম সপ্তাহে রেবেকা আবার যখন আল্ট্রাসনোগ্রাম করতে যান তখন ঘটে এক বিস্ময়কর ঘটনা। যিনি আল্ট্রাসনোগ্রাম করছিলেন, তিনি স্ক্রিনে দেখতে পান, রেবেকার গর্ভে দুটি সন্তান। রেবেকার প্রসূতিবিদ ডেভিড ওয়াকার বলেন, ‘‘আমার প্রতিক্রিয়া ছিল আমি কীভাবে প্রথম আল্ট্রাসনোগ্রাম করার সময় দ্বিতীয় ভ্রূণকে দেখতে পেলাম না। এবং পরে যখন আমি জানতে পারলাম এটি আমার ভুল নয়, একটি সুপারফেটেশন তখন আমি কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিলাম।’’ 

প্রসূতিবিদ ডেভিড ওয়াকার বলেন, এমনটা সাধারণত হয় না। তিনি ২৫ বছর ধরে এই পেশায় আছেন। এমন অভিজ্ঞতা তাঁর আগে কখনো হয়নি বলেও জানান তিনি। তাই কয়েকবার স্ক্যান করার পর তিনি নিশ্চিত হন যে রেবেকার গর্ভে দুটি সন্তান আছে। পরে রেবেকাকে জানানো হয় যে তিনি যমজ সন্তানের মা হতে চলছেন। তবে তাঁর গর্ভে থাকা দুই সন্তান সাধারণ যমজ নয় বরং সুপারফেটেশন।  

রেবেকার গর্ভে দুটি সন্তান শনাক্ত হওয়ার পর প্রসূতিবিদেরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন। কারণ, তাঁর গর্ভের দ্বিতীয় সন্তানের বিকাশ তুলনামূলকভাবে কম এবং এর আকার খুবই ছোট ছিল। প্রসূতিবিদ ডেভিড ওয়াকার বলেন, নানা পরীক্ষার পর তাঁরা দেখতে পান, গর্ভের দ্বিতীয় সন্তানটির বৃদ্ধির হার তিন সপ্তাহ কম। এ থেকে তাঁরা বুঝতে পারেন, রেবেকা অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় আবার অন্তঃসত্ত্বা হন। এবং এই দুই অন্তঃসত্ত্বা অবস্থার সময়ের পার্থক্য তিন সপ্তাহ।   

সাধারণত গর্ভাবস্থায় হরমোন ও শারীরিক পরিবর্তনের ফলে একজন নারীর আরেকটি গর্ভধারণের সুযোগ থাকে না। তবে সুপারফেটেশনের ক্ষেত্রে এমনটা ঘটে না। আর তাই অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় আবার অন্তঃসত্ত্বা হবার ঘটনাকে অনেকে অলৌকিক ঘটনা বলেও অভিহিত করে থাকেন। 

সুপারফেটেশনের ক্ষেত্রে দুটি ভ্রূণ সৃষ্টির যেহেতু পার্থক্য থাকে তাই তাদের সম্ভাব্য জন্মদানের তারিখও থাকে ভিন্ন। তবে রেবেকার ক্ষেত্রে নানা জটিলতা ছিল। চিকিৎসকেরা সতর্ক করে বলেছিলেন, তাঁর গর্ভের দ্বিতীয় সন্তানটি নাও বাঁচতে পারে। এইসব জটিলতার কারণে চিকিৎসকেরা একই সময় সিজার করে রেবেকার দুই সন্তানের জন্মদানের সিদ্ধান্ত নেন। 

২০২০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সিজারের মাধ্যমে একই সঙ্গে দুই সন্তানের জন্ম দেন রেবেকা। প্রথম জন্মগ্রহণ করে ছেলেশিশু নোয়াহ। তার দুই মিনিট পর পৃথিবীতে আসে মেয়েশিশু রোজালি। জন্মের সময় ছেলেশিশুটির ওজন ছিল ৪ পাউন্ড ১০ আউন্স। আর মেয়েশিশুর ওজন ছিল ২ পাউন্ড ৭ আউন্স। তবে জন্মের পরপর কোনো শিশুই হাসপাতাল থেকে ছাড়া পায়নি। 

জন্মের পর ছেলেশিশুটিকে তিন সপ্তাহের বেশি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়। আর মেয়েশিশুটিকে হাসপাতালে থাকতে হয় ৯৫ দিন। তবে বর্তমানে দুই ভাই বোন সুস্থ আছে। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় আবার অন্তঃসত্ত্বা কিংবা সুপারফেটেশনের মাধ্যমে জন্ম নেয়া শিশুর জন্মতারিখ ভিন্ন হলেও রেবেকার দুই শিশুর জন্মদিন একই। দুটি শিশুর বয়স এখন প্রায় ছয় মাস। তারা ঠিকভাবেই বেড়ে উঠছে বলে জানান রেবেকা। 

রেবেকা সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, যদিও আমার দুটি বাচ্চা একই দিন জন্ম নিয়েছে, তবে তাদের মধ্যে অবশ্যই বয়সের একটা ব্যবধান আছে। তাদের দেখেই তা বোঝা যায়। তিনি আরো বলেন, ‘অলৌকিক ঘটনা যে ঘটতে পারে, আমার সন্তানেরা তার প্রমাণ।’ রেবেকা আনন্দের সঙ্গে উল্লেখ করেন, ‘‘আমার সন্তানেরা আমার সুপার যমজ। আমি প্রতিদিন তাদের দিকে তাকিয়ে ভাবি, বাহ, আমি খুব ভাগ্যবান।’’ 

  

মু: মাহবুবুর রহমান  
ফার্মাসিস্ট, নিউজিল্যান্ডের মেসি ইউনিভার্সিটির পিএইচডি গবেষক 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top