সিডনী মঙ্গলবার, ৭ই মে ২০২৪, ২৪শে বৈশাখ ১৪৩১

জয় হবেই একদিন : আফরোজা অদিতি


প্রকাশিত:
৯ মে ২০২০ ১৬:৫৩

আপডেট:
৯ মে ২০২০ ১৬:৫৫


আচমকা একদিন শোনা গেল সর্দি-জ্বর-শাসকষ্টে মারা যাচ্ছে মানুষ; প্রথমে অজ্ঞাত এই অসুখ শুরু হয়েছিল চীনের উহানে; তারপর দেশ থেকে দেশে; এই অসুখের নাম কোভিড-১৯ বা নভেল করোনা। আশ্চর্যের কথা হলো কেউ কারো কাছে যেতে পারছে না; গা ঘেঁষাঘেষি হলে, করমর্দন করলে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা ঐ রোগে! ভয়াবহ এক পরিস্থিতির মধ্যে চলছে দিনযাপন! এই মরণব্যাধি শুধু একটি দেশে নয় ছড়িয়ে গেছে বিশ্বজুড়ে!

নভেল করোনার কারণে আস্তে আস্তে বন্ধ হলো সব; বন্ধ হয়ে গেল আকাশপথ, সড়কপথ,পানিপথ। শোনা একটি শব্দ লকডাউন! একদেশের সঙ্গে অন্যদেশের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলো, বিচ্ছিন্ন হলো দেশের মধ্যে এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে; পথে বের হতে পারছে না মানুষ; পথে বের হলে গুলি, পথে বের হলে ফাইন, পথে বের হল ঝাড়– দিতে হবে পথ; এক এক দেশে এক এক নিয়ম বেঁধে দিয়েছে সরকার তবুও নিস্তার নেই, মৃত্যুর কোলে মাথা রাখছে মানুষ; মৃত্যু মিছিল! দুই লক্ষাধিক নিরবমানুষের
লম্বা মিছিল! শবদেহের কাছে যেতে দিচ্ছে না কাউকে, দেখতে তো নয়ই! এরপরে লকডাউন সকলের মুখে মুখে!
লকডাউন! লকডাউন! লকডাউন!

ছুটির পর ছুটি। ঘরবন্দী থাকতে থাকতে একদিকে অসহায় অন্যদিকে অসহ্য লাগছে মানুষের! কী করবে? কী-ই বা করার আছে! বিশ্বের সকল মানুষের চিন্তাতে একটি কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে, যুগযুগান্তরের সংক্রামক ব্যাধি জয় করার মতো এবারেও মৃত্যুকে জয় করে ঘুরে দাঁড়াবে পৃথিবী; সময় কাছে হোক বা দূরে হোক চেষ্টা সফল হবে বিজ্ঞানীদের, ঘুরে দাঁড়াবে পৃথিবী, বেঁচেবর্তে থেকে আবার নতুনভাবে জীবনযাপনে অভ্যস্ত হবে মানুষ! যুগেযুগে মহামারী এসেছে; এসেছে প্লেগ, পীত জ্বর, সার্স, কলেরা, স্মলপক্স, চিকনগুনিয়া, ডেঙ্গু, কয়েকপ্রকারের ফ্লু, এইচআইভি, ইবোলা; নানান রকমের মহামারীতে মৃত্যুমুখে পড়েছে মানুষ; আবার এই মানুষই ঘুরে দাঁড়িয়ে বিশ্ব কাঁপিয়ে রাজত্ব করেছে, করছে! মানুষ হারে না, হারতে জানে না; তারা মৃত্যুভয়ে ভীত হয় না। মৃত্যুভয়হীন মানুষের বিশ্বাস মৃত্যুকে জয় করে দাঁড়াবে তারা এই পৃথিবীতে; দাঁড়াবেই!

ওদিকে সভা বসেছে বিশ্বঅণুজীবকমিটির! অনেক মানব তো গিয়েছে, তছনছ করতে পেরেছে মানব জীবনসিস্টেম; এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে পরবর্তী করণীয় কী? সভাকমিটির প্রাণ, প্রশিক্ষক, যার কথায় ওঠেবসে সকলে তার কাছে প্রশ্ন রেখেছে এক প্রশিষ্য
অণুজীব, ‘এই মুহূর্তে কী এই পৃথিবী থেকে চলে যাওয়া উচিত নয় আমাদের?’ওর কথা শুনে চর্বিযুক্ত থলথলে শরীরের প্রশিক্ষক যেটির চোখের অস্তিত্ব আছে কি নেই সেই প্রশিক্ষক ঘুরে দেখলো সেই প্রশিষ্যকে; তারপর বললো, ‘এখনো সময় হয়নি এখান থেকে যাবার! পুরোবিশ্ব দখল করে রাজ চালাতে হবে, চালাতেই হবে; এই পৃথিবী হবে আমাদের, শুধুই আমাদের। এই মানবকুলের শাস্তি হওয়া প্রয়োজন; শাস্তি দিতেই হবে। ওরা নিজেদের খুব জ্ঞানী মনে করে; ওরা অহংকারের সীমা পার করে প্রকৃতির ওপরে অত্যাচার করেছে; ওদের ভেতরে বেড়েছে লোভ-লালসা, ওরা লালন করে ষড়রিপু! বিসর্জিত হয়েছে নৈতিকতা, মানবিক মূল্যবোধ! ওদের শাস্তি হওয়া প্রয়োজন!’ প্রশিক্ষক বয়ান শেষে অন্য দিকে ফিরে রইলো; যেন আর কোনো কথা বলার-শোনার নেই!

জগতে ঈশ্বরসৃষ্ট সব সৃষ্টির মধ্যেই ভালোমন্দের মিশেল থাকে, থাকে বাঁচার ইচ্ছা; অণুজীবদের মধ্যেও বিদ্যমান; তার প্রমান পাওয়া গেল তখন যখন বিশ্ব-অণুজীবকমিটির একেবারে পেছনের সারি থেকে উঠে দাঁড়ালো প্রষ্টা; প্রথমে দ্বিধাহীন প্রশ্ন করলেও এখন দ্বিধাহীন থাকতে পারলো না; প্রষ্টাটি কুন্ঠিতভাবে বললো, ‘অনেক তো হয়েছে কমিটিপ্রধান, প্রশিক্ষক মহাশয়, এখন থামলে ভালো হয়! এ তো শুধু মানবমৃত্যুমিছিল নয়, মৃত্যুমিছিলে তো সামিল হইতেছি আমরাও! এই মৃত্যুমিছিল ভালো লাগতেছে না! তাছাড়া মানবকুলের মধ্যে সকলেই তো খারাপ নয়! তাহলে সকলকে কেন মারবো?’ এই কথা শুনে রেগে গিয়ে একধাপ ওপরে উঠে গেল প্রশিক্ষক! বেশি ওপরে উঠতে না পেরে সেখানেই ভাসতে ভাসতে বললো, ‘তুমি ওদের চেনো না; ওরা আমাদের চেয়ে শক্তিশালী; একথা সত্য অতর্কিত আক্রমণে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে মানবসমাজ! কিন্তু আমদের মৃত্যুবাণ তৈরী করতে পিছপা হবে না ওরা; আমাদের মৃত্যুবাণ তৈরিতে মনোনিবেশ করেও ফেলেছে! ওরা মানব; মানবেরা সবসময় শক্তিধর- এই কথাটা মনে রাখবে! তাছাড়া, বিশ্বপ্রধানদের রাজনীতি; কেউ ছাড়তে চায় না তাঁদের একচিলতে জমি; তাঁদের একবিন্দু ক্ষমতা! একটু শিক্ষা তো পেতেই হবে ওদের! চুপ করে বসে থাক! যে শিক্ষা দিয়েছি, পেয়েছ যে শিক্ষা তাই হবে, তাই করতে হবে! তোমরা, আমার শিষ্য-প্রশিষ্য সাহসী সৈনিক; তোমরা মৃত্যুভয়ে ভীত হলে চলবে কেন?’

কিন্তু চিকনা-চাকনা প্রশিষ্যটি খুব আস্তে অথচ কঠিন কণ্ঠে বললো, আমাদের সঙ্গীরা মানবশরীর সংক্রমণের পরে আর
বের হতে পারছে না; মারা যাচ্ছে! এটা ঠিক যে সঙ্গী ঢুকেছিল মৃতমানবটির নাক-মুখ-চোখ কিংবা অন্যপ্রবেশপথ দিয়ে ঐ শরীরে তাঁর ছোঁয়ায়, তাঁদের ছোঁয়ায় সংক্রমিত হচ্ছে অনেকেই; কিন্তু কথা এটা নয়, কথা হলো তারা তো ঐ মানব বা মানবদের মহাযাত্রার পর শরীরের মধ্যেই থেকে তাঁরই দাফনকার্য বা দাহক্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুবরণ করছে; ওরা আমাদের সঙ্গী, আত্মীয় কমিটিপ্রধান! আমি...আমি..আমি মরতে চাই না, সঙ্গীদের মৃত্যু হোক সেটিও চাই না! আমরা, মশককুলের মতো বেঁচে থেকে আমাদের কাজগুলো এগিয়ে নিতে চাই!’ চিকনা-চাকনার কথা শুনে প্রশিক্ষক কমিটিপ্রধান খুব রেগে গিয়ে বললো, ‘খুব কথা শিখেছো তুমি; উত্তর দাও, তুমি মশক হতে পারবে? তুমি তো মানবশরীরে ঢুকলেও মরবে না ঢুকলেও মরবে! যখন মানবদেহে ঢুকতে পারবে না তখন তো না খেয়ে মরবে? তাহলে!’ হঠাৎ কথা বলার একপর্যায়ে রেগে গিয়ে ধমকে উঠলো নেতা, ‘মানবের এখানে এসে দেখেশুনে বিপ্লবী হয়েছ, মহাবিপ্লবী! বের হয়ে যাও!’

চিকনা-চাকনা বললো,‘যাচ্ছি! কিন্তু যাবার আগে বলে যাই, আপনিও তো মানবকুলের মোড়লদের মতো আমাদের ওপর অর্ডার করতেছেন, আমাদের কথা বিবেচনায় আনতেছেন না! আপনার-আমাদের ভবিতব্য ভাবার সময় হইয়ে গেছে; ভাবুন! ভাবুন! ইউরোপ-আমেরিকাতে যে রাজত্ব করছেন, করতেছেন তা শেষের দিকে আর গ্রীষ্মপ্রধানদেশে গরম আর বৈশাখের ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়েছে; আমরা কোথায় যাবো? তাছাড়া ওষুধ আবিষ্কারের পথে; ওষুধ আবিষ্কার হলে কোথায় যাবো আমরা? এর মধ্যেই কী সঞ্চরণে থাকবো নাকি ক্ষ্যামা দিয়ে পরে আবার শুরু করবো? ভাবুন, ভাবুন; ভাবতে থাকুন! খুব ভালো করে ভাবুন!’ চিকনা-চাকনা দুড়দাড় বের হয়ে চলে গেল। সভাতে মৃদু শোরগেল শুরু হলো। ধমকে থামিয়ে দিল প্রধান!

ওদিকে ওষুধের পরীক্ষা শুরু হয়েছে ল্যাবগুলোতে! গবেষকগণ প্রাণপন চেষ্টা চালাচ্ছে এই মারণবিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার! খবরের কাগজে বড়ো বড়ো হরফে লেখা হয়েছে “করোনার প্রথম ওষুধ পেল বিশ্ব”.... তাঁদের বিশ্বাস এই মৃত্যু রোধ হবেই; কোভিড - ১৯ জয় করে মাথা তুলে দাঁড়াবে মানুষ, দাঁড়াবেই।

আফরোজা অদিতি
কবি ও কথা সাহিত্যিক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top