যতীনবাবুর চাকর : শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
প্রকাশিত:
২০ মে ২০২০ ১০:২৬
আপডেট:
১ মে ২০২৩ ২০:৫৯
যতীনবাবু পানুকে খুব ভালো করে চেনেন না, একথা ঠিক। যতীনবাবুর দোষ নেই, তার মেলা লোকলশকর, মেলাই মুনিষ, দারোয়ান, চাকরবাকর। এর মধ্যে পানু কোনজন তা তাঁর না জানার হক আছে। তবে কিনা যতিনবাবুর দুটো কুকুর, সাতটা গাই, গোটা সাতেক ছাগল, পঞ্চান্নটা হাঁস, সত্তরটা মুরগি, সতেরোটা খরগোশ, সাতটা পোষা পাখি আর যতীনবাবুর প্রায় একশো বছর বয়েসি দিদিমা কুসুম দাসী পানুকে ভালোই চেনে। তবে তারা আরও অনেককে চেনে, আবার পানুকেও চেনে।
পানু যদি বলে, ‘আমি যতীনবাবুর চাকর’ তাহলে কথাটা মিথ্যেও হয় না, আবার সত্যিও হয় না। মাস গেলে পানু যে আশিটা টাকা মাইনে পায় তা যতীনবাবুর তহবিল থেকেই আসে। দু-বেলা পানু যে পাহাড়প্রমাণ ভাত পেটের মধ্যে সাঁদ করায় তাও বটে যতীনবাবুরই ভাত, তবু সত্যি কথা বলতে গেলে বলতে হয়, পানু হল গে চাকরের চাকর। যতীনবাবু তাকে চেনেন না, তার মাথার উপর ছড়িও ঘোরান না। তাকে হুকুম তামিল করতে হয় সত্যরামের। সত্যরাম এ বাড়ির যত চাকরবাকর আর কাজের লোকের ছড়িদার। সত্যরামের যা দাপট তা কহতব্য নয়। সত্যরামও বটে যতীনবাবুর এক চাকরই, কিন্তু সে কথা মনে আনাও পাপ। সে এখন যতীনবাবুর মেলা মেলা টাকা রোজ ছানাঘাঁটা করে, কাকে রাখবে, কাকে ফেলবে তাও সে-ই ঠিক করে, সে-ই বাজার সরকার, খাজাঞ্চি, আরও কত কী। পানু শুধু জানে, যতীনবাবু নন, তার মাথার উপর সত্যরাম। তার মরা-বাঁচা সত্যরামের হাতে, সুতরাং সে হল গে যতীনবাবুর চাকরের চাকর।
এ বাড়িতে পানু ঢুকেছিল ছুঁচ হয়ে। তবে ছুঁচেই রয়ে গেছে, ফাল আর হওয়া হয়নি। সেই ছুঁচ হয়ে ঢোকাটাও এক বৃত্তান্ত। পানু তখনও তো চাকর হয়নি। বাপ বেঁচে। গরিব বটে, তবে বাপ খাটত-পিটত, পানু আলায়-বালায় ঘুরে দিব্যি হেসেখেলে ছিল। পানুর তখন বয়সের জোয়ারে চেহারাখানাও এমন পাকিয়ে দরকচা মেরে যায়নি। ভারি মিঠে করে বাঁশি বাজাতে পারত। ইচ্ছে ছিল যাত্রাপার্টিতে ভিড়ে যাবে। গুণীর খুব কদর যাত্রার দলে। সেই সময়ে সে পড়ল গন্ধবাবুর খপ্পরে। সে আর এক বৃত্তান্ত। গন্ধবাবুর মেয়ে হল পারুল। গেছো মেয়েছেলে যাকে বলে। জামা ছেড়ে শাড়ি ধরার বয়সের ফাঁকেই দু-দু-বার দুটো ছোঁড়ার সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে ফের ফেরত আসে। কোনো মেয়ে থাকে এরকম, যাকে শেষ অবধি সামলে উঠা যায় না। স্বজাত স্বঘরের একটি যেমন-তেমন পাত্র তখন গন্ধবাবুর খুব দরকার। নইলে মানসম্মান থাকে না।
তা গন্ধবাবুর মানইজ্জত বড়ো কমও তো নয়। উনি ছিলেন যতীনবাবুর তেলকলের ম্যানেজার। গোঁসাইগঞ্জের হাটে গন্ধবাবু পাকড়াও করলেন পানুকে। দু-চার কথার পরই ধাঁ করে কাজের কথা পেড়ে ফেললেন। বেশ হেঁকেই বললেন, পারুলকে যদি বিয়ে করো তবে আখের গুছিয়ে দেব। চাই কী আজই কাজে লেগে যেতে পারো।
গায়ে খুব গন্ধ মাখতেন বলে লোকটার ওই নাম। আসল নাম রাখাল-টাখাল কিছু হবে। তবে গন্ধবাবু বললে দশখানা গাঁয়ের লোক চেনে। বাড়ি এসে যখন পানু তার বাপকে কথাটা বলল তখন বাবা লাফিয়ে উঠে বলল,
আরিব্বাস, এ তো লটারি জিতেছিস। কালই গিয়ে কাজে লেগে যা। মেয়েটার একটু বদনাম আছে বটে, তা বিয়ের পর দু-চার ঘা দিলেই সারবেখন।
পানু অগত্যা কাজে লেগে পড়ল। তেলকলের কাজ গতরের খাটুনি। তবে হবু শ্বশুর মাথার ওপর ছিল বলে ভরসাও ছিল। দিন ফিরবে।
কিন্তু ফ্যাসাদটা বাঁধাল পারুলই। চোত মাসে কাজে লেগেছিল পানু আর জ্যৈষ্ঠে পারুল ফের পালাল। এবার গেল এক ঠিকাদারের সঙ্গে। গিয়ে যে কোন গাড্ডায় পড়ল কে জানে, আর ফিরল না।
গন্ধবাবু তারপর থেকেই পানুর ওপর বিগড়ে গেলেন। না, তা বলে তাড়িয়ে দিলেন না। তবে আগের মতো ‘এসো, বোসো’-ও আর করলেন না। পানু চাকরী করে, গন্ধবাবু ম্যানেজারি করেন, কারও সঙ্গে কারও অন্য কোন সম্পর্ক থাকল না।
সেই সময়ে যতীনবাবুর বাড়িতে কাজের লোকের টান পড়ায় সত্যরাম এসে তেলকল থেকে কয়েকজনকে ধরে নিয়ে গেল। সেই কয়েকজনের মধ্যে পানু একজন। গন্ধবাবু ফিরেও তাকালেন না।
পানুর একটু দুঃখ হয়েছিল বই কী। পারুলের জন্য তাকে দেগে রাখা হয়েছিল বটে কিন্তু গন্ধবাবুর আরও মেয়ে ছিল। পারুলের ছোট বকুল, তার ছোট টগর। কিন্তু তাদের কোন গন্ডগোল নেই। কই তাদের একজনের সঙ্গেও তো বিয়েটা লাগাতে পারত পানুর। গন্ধবাবু সেদিক দিয়ে গেলেন না।
গন্ধবাবু আর বেঁচে নেই। তার পরিবার কোথায় কীরকম আছে-টাছে তাও জানে না পানু। তার সে-সময় নেই। যতীনবাবুর বাড়িতে পাহাড়প্রমাণ কাজ। সত্যরাম আবার কারও বসে থাকা পছন্দ করে না।
যতীনবাবুর দুটো মহল। একটা অন্দর আর একটা বার। অন্দরমহল যারা যাতায়াত করে তারা সত্যরামের পেয়ারের লোক। পানুর কপালে সত্যরামের নেক-নজর জোটেনি। সে বাইরের লোক। বাইরে থেকে ভিতরটা কিছুই দেখা যায় না, তবে আন্দাজ করা যায়। মোটা মোটা দেয়াল, চিক-ফেলা বারান্দা, পর্দা-ফেলা জানলার ওই যে বিশাল তিনতলা অন্দরমহল ওটা হল রাজার পুরী। ওখানে নরম বিছানা, আতরের সুবাস, পায়েস, রসগোল্লার ছড়াছড়ি। আর সোনাদানা টাকাপয়সার পাহাড়।
এই বাইরের মহল আর অন্দরমহলের মাঝামাঝি একখানা একটেরে দালান আছে। আগে ঠাকুরদালানই ছিল, এখন নতুন ঠাকুরদালান হয়েছে দক্ষিণদিকে। এই দালনের একখানা ঘরে যতীনবাবুর দিদিমা থাকে। তিন কুলে কেউ আর নেই বলে বুড়ি যতীনবাবুর কাছে এসে পড়েছিল কোনোকালে। যতীনবাবু ফেলেননি, আবার তেমন মাথায় করেও রাখেননি। গরিব আত্মীয় বড়ো বালাই। তার ওপর বুড়ি কার আপন দিদিমাও নয়, মায়ের মাসি।
খুনখুনে বুড়ি কসুম দাসী একদিন পানুকে হাতছানি দিয়ে ডেকে বলল, দিবি দাদা একখান ডাব পেডে? পানু তখন নতুন। কিছু জানে না। কোথা থেকে ডাব পেড়ে দেবে তাও বুঝতে পারছে না। হাঁ করে চেয়ে রইল।
বুড়ি বলল, আমি যতীনের দিদিমা, যা ওই পুবের ঘরের পিছনে যে গাছগুলো আছে সেখান থেকে একটা পেড়ে আন। আজ একাদশী।
যতীনবাবুর দিদিমা! পানুর চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেল। তক্ষুনি গিয়ে তরতরিয়ে গাছে উঠে একটার জায়গায় চারটে পেড়ে আনল। কুমুস দাসী খুব খুশি। কত আশীর্বাদ করল। ফলে আজ পানুর রাজাগজা হওয়ার কথা। সে তো হয়ই নি সে, তার ওপর ডাব পাড়ার জন্য সত্যরাম এই মারে কী সেই মারে। তবে সে যাে-ই হোক, সেই থেকে বুড়ির সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গেল পানুর। যতীনবাবুর দিদিমার অবস্থা যে তার চেয়ে খুব বেশি ভাল নয়, তা বুঝতে পানুর বেশি দেরি হয়নি। তবে বুড়ি মানুষ ভাল। দায়ে পড়লে মানুষের স্বভাব ভাল হয়ে পড়ে, তারা ভারি নরম নরম হয় আর লোকদের ভক্তিমান্য করতে শুরু করে, এ পানু অনেক দেখেছে। যতীনবাবুর দিদিমাও সেই হিসেবেই ভাল। পানুকে খুব ডাকখোঁজ করে, এটা-সেটা জোগাড় করে দিতে বলে, আর লোভও দেখায়, ‘তোর বে হোক, আমার এক ছাড়া তিন ভরির মটরদানা হার আছে, তোর বউকে দেব।’
পানু হাসে। মটরদানা হারখানা আর দিদিমাকে হাতছাড়া করতে হবে না ইহজন্মে। পারুল সটকে পড়ার পর থেকেই পানু জানে, এই ঢনঢনে কপালে বে আর নেই।
খড় কুচোতে বসে, কিংবা চুন আর বালি দিয়ে ঝামায় ঘসে কুয়োপাড়ার শ্যাওলা তুলতে তুলতে কিংবা পুকুরধারে পাটায় বাবুদের পেল্লায় পেল্লায় মশারি কাচতে কাচতে জীবনটার ওপর যেমন ঘেন্না আসে, তেমনই আবার শিউলি ফুটলে, নলেনগুড় জ্বালের গন্ধ বেরোলে বা কোকিল আচমকা ডেকে উঠলে মনটা ভারি খুশি খুশি হয়ে ওঠে। জীবনটায় আর একটা খুশির তুফান লাগতে পারত যদি সত্যরাম তার ওপর খুশি থাকত। কিন্তু সেটা কিছুতেই হয়ে উঠল না। এক-একজন থাকে, বেশ আছে, দোষঘাট কিছু করেনি, তবু তার ওপরে কেউই যেন খুশি হয় না। তাকে দেখলেই মুখ ব্যাজার করে ফেলে। পানুরও হয়েছে তাই। পানুর বাপ মারা গেল এই তো সেদিন। খবর পেয়ে পানুর তেমন কিছু বুক-তোলপাড় হল না। গরিবদের তেমন আঠা থাকে না কিনা। বাপের সঙ্গে পানুরও বহুকাল ছাড়কাট হয়ে গেছে। তবু খবর পেলে যেতে হয়, তাই গেল। গিয়ে দেখল, দেড় বিঘে জমি আর খোড়ো ঘর সমেত বাস্তুটা জুড়ে থাবা গেড়ে আছে তার ছোট ভাই কানু। রাগি কুকুর যেমন লোক দেখলেই গরগর করতে থাকে, তেমনই তাকে দেখেও কানু কেমন যেন গরগর করতে থাকল। বুঝি ভেবেছিল পানু বাপের সম্পত্তির ভাগ চাইবে। চাওয়ার কথা মনেই হয়নি পানুর। সে বড়লোকের চাকর, নজর একটু উঁচু হয়েছে। দেড় বিঘে জমি আর নড়বড়ে খোড়ো ঘরের ভাগ চাইবার মতো ছোট নজর তার আর নেই। সেকথা কানুকে বুঝিয়েও বলল সে, তবুও কানুর গরগরানিটা থামল না। বউ ছেলে-মেয়ে নিয়ে তার বেশ ফাঁদানো সংসার। এখানে ভাগিদার জুটলে তার বিপদ। সে তো আর সুখে নেই। তবে ছোঁড়াটা বরাবরই খারাপ ছিল। মদ-টদ খায়। জুয়া খেলে, বউকে ধরে পেটায়, বাপকে ঝাড় দিত মাঝে মাঝে।
পানু ফিরে আসার পর সত্যরাম একদিন তাকে পা দাবাতে ডেকে পাঠাল। সত্যরামের পা দাবানো এক মস্ত সম্মানের কাজ। যে-সে সত্যরামের পায়ে হাত ছোঁয়াতে পারে না। যারা পারে তাদের নির্ঘাত দশ-বিশ টাকা বেতন বেড়ে যায়। আর তারা নেক-নজরেও থাকে।
পানুর ভারি আহ্লাদ হয়েছিল সত্যরামের ডাক পেয়ে। কিন্তু পা দাবাবে কী, হাত ছোঁয়াতে না ছোঁয়াতে সত্যরাম কঁকিয়ে উঠে বলল, ওরে থাম থাম, কী লোহার হাতরে বাবা। কড়া পড়ে যে এক্কেবারে শিরিস কাগজ বানিয়েছিস। আমার নরম শরীর, ওই কেঠো হাত চলবে না।
তা কথাটা সত্যি বটে। পানুর হাত আর হাত নেই। থাবা হয়ে গেছে। মনের দুঃখে সে সত্যরামের ঘর থেকে বেরিয়ে এল। কপালটা খুলি খুলি করেও খুলল না। সত্যরামও চাকর বটে, কিন্তু বড় চাকর! সর, ননি, দুধ, ঘি খেয়ে আর ঘতর না খাটিয়ে সে ইদানীং নাদুসনুদুস হয়েছে। মুখখানায় আহ্লাদী ভাব। তিন আঙুলে তিনখানা সোনার আংটি। এমন এটে বসে গেছে যে, স্যাকরা ডেকে না খোলালে আর খুলবে না। তার পা দাবাতে গেলে পানুকে সাতদিন হাত দুখানা তেলে ভিজিয়ে নরম করে নিতে হবে।
এইসব নানা কথা নিয়ে ভাবে পানু! আর কাজ করে। আর খায়। আর ঘুমোয়। আর ভাবে।
ওদিকে যতীনবাবুর কারবার বাড়ছে, টাকা বাড়ছে, লোক বাড়ছে। ক্রমে ক্রমে চারদিকটা বেশ ফলাও হয়ে উঠেছে। দুখানা গাড়ি কিনলেন যতীনবাবু। বারবাড়ির উঠোনে একখানা দোতলা তুলে ফেললেন।পাঞ্জাব থেকে দুটো বিশাল গাই এল। কিন্তু পানু যে কে সে-ই! তবে একথাও ঠিক, যতীনবাবুর উন্নতি যত হয় ততই পানু খুশি হতে থাকে। শত হলেও মনিব তো। যতীনবাবুর রংখানা দিনদিন ফর্সা হয়েছে, চোখ দু’খানা থেকে দু-বাটি মধুর মতো সুখ থিকথিক করছে। মুখখানায় সর্বদা যেন হাসি-হাসি ভাব। আগে একজন পাইক সর্বদা ঘুরত। আজকার দুজন। দু-নম্বর পাইকটার চেহারা কাবলিওয়ালাদের হার মানায়। যেমন লম্বা, তেমনই চওড়া, তেমনি বিশাল বুকখানা। আর চোখ দুখানায় দোফলা ছুরির ধার। যত টাকা বাড়ছে যতীনবাবুর ততই শত্রু বাড়ছে। তাই বাড়ছে পাইক। নতুন পাইকটার হাতে একটা দোনলা বন্দুকও থাকে। দেখে ভারি ভক্তি শ্রদ্ধা হল পানুর।
দুপুরবেলা বারবাড়ির বারান্দায় তারা ছ-জন বাইরের চাকর খেতে আসে। সত্যরামের পেয়ারের লোকদের ভিতরে দরদালানে ভিন্ন ব্যবস্থা। তা হোক, পানুর কোন দুঃখ নেই। যতীনবাবুর বাড়িতে ভাতটা নিয়ে হিসেব করা হয় না। যত পার খাও। ভাতটা বেশ চেপেই নেয় সকলে। ভাতের মাথায় একটা গর্ত করতে হয়, তাতে বড় হাত দিয়ে হড়হড় করে ডাল ঢেলে দিয়ে যায় হরিহর। একটু ঘ্যাট মতো থাকে সঙ্গে। পরে চুনো বা ছোট মাছের একখানা ঝোল। বাড়িতে ভোজ হলে অবশ্য তাদের কপাল ফেরে। আর যতীনবাবুর বাড়িতে ভোজ লেগেই আছে।
খেতে বসে আজ নলিনীকান্ত পানুর কানে কানে বলল, নতুন পাইকটার বৃত্তান্ত শুনছ! সাতখানা খুন করে এয়েছে।
পানু শুনে ভিরমি খাওয়ার জোগাড়, বলিস কী?
নোনাপুকুরের বটকেষ্ট কাপালিকের কাছে গিয়ে গা-ঢাকা দিয়েছিল। পুলিশ গিয়ে ধরে। বটকেষ্টর বড়ো ভক্ত হল যতীনবাবু। তার কথায় উঠে-বসে। বটকেষ্ট যতীনবাবুকে হুকুম দিলে পুলিশের সঙ্গে বন্দোবস্ত করে ছাড়িয়ে এনে পাইকের চাকরিতে বহাল করতে। যতীনবাবুও কাঁচাখোকা খুনিটাকে এনে রেখেছে। রোজ দুটো করে মুরগি, ডজন ডজন ডিম ওড়াচ্ছে আর বন্দুকি নিয়ে গোঁফ মুচড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভগবান বলে কিছু নেই বুঝলে? পানু মাথা নেড়ে বলল, সে আমি অনেক আগেই বুঝেছি।
বলাই দাঁতের ফাঁক থেকে একটা মাছের কাঁটা টেনে বের করার চেষ্টা করতে করতে বলল, তবে দীনু পাইক আসায় সত্যরামের বাজারে বাজার খারাপ। কর্তাবাবু দীনুকে চোখে হারাচ্ছেন আজকাল।
একথা সকলের মনে ধরল। তারা কেউ সত্যরামের পেয়ারের লোক নয়। সত্যরামকে তারা কখনো ঘাটায় না এবং মুখে যথেষ্ট খাতির দেখায়। নইলে সত্যরাম যেদিন খুশি ঘাড় ধরে যে কাউকে চাকরি থেকে তাড়িয়ে দিতে পারে। দিয়েছেও কতককে। তবে তার ছ-জন যে ঠিক আছে তার কারণ, তারা কাজের লোক, প্রাণপনে খাটে।
পানু মাথা নেড়ে বলল, কথাটা বড় ভয়ের হল।
বলাই বলল, কেন ভয়ের কী? দিক না বন্দুকটা সত্যরামের ইয়েতে ঢুকিয়ে। আমি তো হরির লুট দেব।
পানু লেবুপাতা ডলে শেষ কয়েকটা গরাস গপাগপ মুখে চালান দেওয়ার ফাঁকে বলল, সত্যরামের কিছু হলে দীনু পাইক যদি আমাদের ওপর বসে তাহলে তো দিনেদুপুরে হাতে মাথা কাটবে। ফটিক গতকালেই সত্যরামের হাতে জুতোপেটা খেয়েছে হাট থেকে তামাক আনেনি বলে। সে বলল, আগে তো সত্যরামের ব্যবস্থা হোক, পরে দীনুকে নিয়ে ভাবা যাবে।
কেষ্ট এতক্ষণ কিছু বলেনি। একটা মস্ত লঙ্কা নুনে মেখে একটু একটু করে খেয়ে শিসোচ্ছিল। লঙ্কায় আর একখানা চাটন দিয়ে বলল, খবর তো রাখো না। দীনু পাইক এমনি আসেনি। খবর হয়েছে এ বাড়িতে ডাকাত পড়বে। এত টাকা, ডাকাত না পড়ে পারে!
পাঁচুর সঙ্গে শ্রীপতি এতক্ষণ নিচু গলায় দাক্ষী নামে একটা নতুন ঝিকে নিয়ে রসের কথা বলছিল। দাক্ষীর বয়স কাঁচা, দেখতেও ভালো। পাঁচু আর শ্রীপতিরও বয়স কম। দাক্ষী অন্দরমহলের ঝি। বাইরে বড়ো একটা আসে না। তবে দোতলার জানালা বা বারান্দায় দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝে বেপর্দা হাঁ করে বাইরের দিকে চেয়ে থাকে। পাঁচুর সঙ্গে কয়েকবার কথা হয়েছে। মেয়েটার ভাইয়ের বড়ো অসুখ। টিবি। সারাক্ষণ ভাইটার কথা ভাবে।পাঁচু বলল কিছু টাকা জমলে ভাবছি ওকে দেব।
শ্রীপতি মুখখানা উদাস করে বলল, ওটাকায় কী হবে? ক-টাকাই বা তুই পাস? ওটাকা তো সাগরে শিশির। অত মজে যাস না বাপ। সত্যরাম টের পেলে ছাল ছাড়িয়ে নেবে। সবাই যে-যার থালা নিয়ে ঘিরে পুকুরধারে মাজতে বসল।
খেয়ে উঠে পানু একটু চিন্তিতভাবে ঘরে এল। দীনু পাইককে নিয়ে তার যেন খুব চিন্তা হচ্ছে।
যদিও কোনদিন কথাবার্তা হয়নি, এমনকী চোখাচোখিও ভাল করে নয় এবং তার নামও যদিও ভাল করে জানেন না তবু যতীনবাবুর প্রতি একটা দুর্বলতা আছে পানুর। শত হলেও মনিব। খুব ইচ্ছে হয় পানুর, একদিন গিয়ে যতীনবাবুকে বলে, আজ্ঞে আমি আপনার চাকর, আমার নাম পানু। যতীনবাবু হয়তো ভারি অবাক হয়ে বলবেন, ও তাই নাকি? বা! বেশ, বেশ।
ওইটুকুই যথেষ্ট। পানু আর বেশি কিছু চায় না। যতীনবাবু কেমন লোক তা জানে না পানু। কেমন আর হবেন, ভালোই হবেন বোধ হয়। ভগবান যাঁকে এমন ঢেলে দেন, লক্ষ্মী যাঁর ঘরে এমন উথালপাতাল তিনি কি আর খারাপ লোক? তা এই যতীনবাবুর জন্য পানুর এখন একটু চিন্তা হচ্ছে। দীনু পাইকের মতো খুনে লোককে নিয়ে ঘোরাফেরা কি ঠিক হচ্ছে কর্তাবাবুর!
বটকেষ্ট কাপলিকের নাম হল গে কালিকান্দ। তার সাধন-নামে কেউ অবশ্য তাকে ডাকে না। সবাই তার পুরোনো নামই বজায় রেখেছে। লোকে বলে, সে তার একটা বউকে কুয়োয় ফেলে মেরেছে, আর একটাকে গলায় ফাঁস দিয়ে। দু-বারই আত্মহত্যা বলে পার পেয়ে যায় বটকেষ্ট। নোনাপুকুরে শ্মশানে এখন তার সাধনপীঠ। খুব রবরবা। লোক যে সুবিধের নয় ঠিকই, কিন্তু পানু এও জানে, লোক ভালো হলে কাপলিকের চলে না। দুনিয়ার আর সব লোকের প্রতি পানুর যে মনোভাব, বটকেষ্টের প্রতিও তাই। মনোভাবটা ভয়ের। এ বাড়িতে যখন আসে তখন তার জন্য খাশি কাটা হয়, দিশি মদের বোতল আসে আর বাড়িটা কেমন ছমছম করতে থাকে। করবেই। বটকেষ্টর সঙ্গে দেড়শো ভূত সবসময়ে ঘুরে বেড়ায়। ভূতের গায়ের বোঁটকা গন্ধে বাড়ি একেবারে ‘ম ম’ করতে থাকে। যতীনবাবু বিশ্বাস করেন, তাঁর যে অবস্থার এত উন্নতি তা ওই বটকেষ্টর জন্য।
তা হবে। পানু অতশত জানে না। কী থেকে কী হয় তা সে কী জানে। বটকেষ্টর ভূতেদেরও সে খুব ভক্তিমান্য করে এবং ভয় খায়।
খাওয়ার পর তবু উবু হয়ে বসে কুয়োতলায় শ্যাওলা ঘষে তুলছিল পানু। শীতকাল। রোদ পশ্চিমে হেলেছে। সেই রোদে একটা ছায়া পড়ল তার গায়ে।
পানু মুখ তুলে যা দেখল তাতে ফের ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। সামনে দীনু পাইক দাঁড়িয়ে। বুকের মধ্যে কেমন একটা গুড়গুড় শব্দ উঠল। হাত-পা সব ঠাণ্ডা মেরে যেতে লাগল।
দীনু খুব ঠাণ্ডা গলায় বলল, অ্যাই, তুই গোবরার কানু মন্ডলের ভাই না?
পানু ভারি চমকে গেল। সে গোবরা গাঁয়ের কানু মন্ডলের ভাই বটে, কিন্তু সে কথা বেশি লোকে জানে না। জানার কথাও নয়। দীনু পাইকের মত মস্ত লোকের কানে যে কথাটা গেছে এইতেই সে অবাক। পানু ভারি বিগলিত হয়ে বলল, আজ্ঞে।
তোর নাম পানু?
যে আজ্ঞে।
পানু লক্ষ করল, দীনু পাইকের পরনে একটা ফর্সা পায়জামা, গায়ে খয়েরি রঙের পাঞ্জাবি, তার ওপর জহর-কোট। আড়েদিঘে আলিসান লোকটা বোধ হয় খালি হাতে মোষের ঘাড় ভেঙে দিতে পারে। দীনু পাইক তার বাঘা গলায় শব্দ তুলে বলল, সেদিন গোবরায় গিয়ে কানু মন্ডলকে ভয় দেখিয়ে এসেছিস?
পানুর এক গাল মাছি। কানুকে কেন, সে তো মশা-মাছিকেও ভয় দেখানোর এলেম রাখে না। সবেগে মাথা নেড়ে বলল, আজ্ঞে না। লোকটা কিছুক্ষণ খুনিয়া চোখে তার দিকে চেয়ে থেকে বলল, কানু মন্ডল আমার ইয়ার। বুঝেছিস কথাটা?
যে আজ্ঞে।
ওর জমিবাড়ির ওপর তোর কোন হক নেই। আছে?
পানু সভয়ে মাথা নেড়ে বলল, ভাগ তো চাইনি।
আলবত চেয়েছিস।
আজ্ঞে না।
লোকটা আবার কিছুক্ষণ রক্ত-জল-করা চোখে তাকে ঠাণ্ডা করে দিয়ে বলল, তা ভালো কথা। সাতদিনের মধ্যে গোবরায় গিয়ে কাগজে সইসাবুদ টিপছাপ দিয়ে আসবি।
খুব ভয়ে ভয়ে পানু জিজ্ঞেস করল, কিসের কাগজপত্র আজ্ঞে?
তোর অত খতেনের কি দরকার? যা বলছি তাই করবি। বেশি ট্যাঁ-ফোঁ করলে বিপদ আছে।
লম্বা লম্বা পা ফেলে চোখের পলকে দীনু পাইক হাওয়া হয়ে গেল।
পানু তার ভেজা হাতে কপালটা মুছল। দোতলার জানালা থেকে দাক্ষী নামের ঝিটা তাকে হাঁ করে দেখছে। দেখছে আরো অনেকেই। দীনু পাইক চলে যাওয়ার পরই পাঁচু, শ্রীপতি, বলাই এসে জুটল।
কী ব্যাপার গো পানুদাদা, দীনু পাইক তোমার ওপর তম্বি করে গেল কেন?
পানু কী আর বলবে, ঘন ঘন মাথা নেড়ে বলল, আমি কিছু করিনি, ভাগ-টাগও চাইনি।
কীসের ভাগ, কী করোনি?
পানু মাথা নেড়ে বলল, সে অনেক কথারে ভাই। তবে আমিও ব্যাপারটা ভালো বুঝছি না।
সাবাই মিলে ব্যাপারটা কিছুক্ষণ তুমুল কথাবার্তা হল। পাঁচু বলল, ও যা বলছে তাই করো গো পানুদা।
পৈতৃক প্রাণটার দাম অনেক বেশি।
পানু শুধু বলল, হুঁ।
রাত্রিবেলা পানু ভালো করে খেতে পারল না। এত তেষ্টা পাচ্ছিলো যে ঘটি-ঘটি জল খেয়ে খিদের বারোটা বেজে গেল। রাত্রিবলো ঘুমও হল না ভালো। ঘন ঘন পেচ্ছাপ চেপে যেতে লাগল। দীনু পাইক যে কানুর বন্ধু তা কে জানত। আর কানুই বা কেন দীনুকে তার পেছনে লাগাল তাও বুঝে ওঠা ভার।
শুয়ে শুয়ে অনেকক্ষণ ভাবল পানু। মাথাটা গরম হয়ে গেল।
সকালবেলা যতীনবাবু তার পাইক বরকন্দাজ নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। পানু সে-সময়ে পুকুরধারে চাদর কাচছে। এমন সময় সত্যরামের পেয়ারের লোক মুকুন্দ এসে বলল, ওরে তোর তলব হয়েছে।
সত্যরাম তার ঘরে নরম সাদা বিছানায় বসা। দেয়ালে হরেক ক্যালেণ্ডার। একখানা পেল্লায় লোহার আলমারি। ইস্ত টেবিল চেয়ার। কে বলবে চাকরের ঘর! তা সে যত বড়ো চাকরই হোক।
তবে কিনা পরিষ্কার ঘরখানা যেমন হাসছে, সত্যরামের মুখে কিন্তু তেমন হাসি হাসি ভাব নেই। ভারি ব্যাজার মুখ। তাকে দেখে ভ্রু কুঁচকে বলল, কী রে, ওই ডাকাতটার সঙ্গে কি কথা হচ্ছিল? ষড় করছিস নাকি?
পানু আগাপাশতলা হয়ে বলল, ষড়? ভন্ডটা যে আমাকে শাসাচ্ছিল।
শাসাচ্ছিল? কেন রে আহাম্মক, করেছিসটা কী?
সেইটেই তো ভাবছি। ভেবে ভেবে কিছু ঠিক পাচ্ছি না।
খোলসা করে বল।
খোলসা করেই বা বলি কী। কপালটাই আজ্ঞে আমার খারাপ।
দীনু পাইক তো আর যাকে-তাকে শাসায় না। তার কাছে তুই তো পিঁপড়ে। কিছু গুরুচরণ করে থাকলে ঝেড়ে কেশে ফ্যাল।
পানু উবু হয়ে বসল। তারপর খানিক ভাবল। পারুল না সটকালে আজ তার তেলকলটার ম্যানেজার হওয়ার কথা। গন্ধবাবু সেরকমই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। সত্যরাম বা দীনু পাইক কেউই তাকে পেত না। স্বয়ং যতীনবাবুর সঙ্গে সে রোজ মুখোমুখি কথা বলতে পারত। কত বড়ো সম্মান।
চোখে জল আসছিল পানুর। মায়ের পেটের ভাই হয়ে কানু কিনা বিনা দোষে পেছনে গুণ্ডা লাগাল!
সত্যরাম তার দিকে চোখা নজরে চেয়ে থেকে বলল, দ্যাখ, তোদের কিন্তু আমি এরকম বাঁচিয়ে-বর্তিয়ে রেখেছি। দুবেলা খেতে জুটছে, ট্যাক গরম-করা পয়সা জুটছে। এমন আরামে সাতটা গাঁয়ে ঘুরে দেখে আয় আর কেউ আছে কিনা। তোদের মতো মনিষ্যির পক্ষে কি এটা কম হল?
তা আজ্ঞে ঠিক।
তাই বলছি, ওই ডাকাতটার সঙ্গে ষড় করে আমার পিছনে লাগার মতলব যদি থেকে থাকে তাহলে কিন্তু আখেরে ভাল হবে না। বেশি কথা কী, কালকেই বাবুকে বলে ঘাড় ধাক্কা দেব।
পানু মাথা নেড়ে বলল, আমি যথার্থই পিঁপড়ে। দীনু পাইক আমার সঙ্গে ষড় করার লোক নয়। তবে আমার ভাই কানুর সঙ্গে ওর ভাব আছে। বোধ হয় মদ বা জুয়ার আড্ডায় ভাব হয়েছিল। তাই আমাকে শাসাচ্ছিল বাপের সম্পত্তি যা আছে সব যেন লেখাপড়া কানুকে ছেড়ে দিয়ে আসি।
তোরও আবার বাপের সম্পত্তি আছে নাকি? এ যে গোরুর গাড়ির হেডলাইটের বৃত্তান্ত। তা কত কী আছে?
শুনলে হাসবেন। দেড় বিঘে জমি আর দুটো খোড়োঘর।
শুনে কিন্তু সত্যরাম হাসল না। বলল, তা তুই কী বললি ডাকাতটাকে?
কী আর বলব। রাজি হতে হল।
সত্যরাম কথাটা বোধ হয় মনে মনে ওজন করে দেখল। তারপর বলল, তোর বাড়ি তো গোবরায়।
আজ্ঞে মাইল তিনেক হবে উত্তর দিকে।
চিনি।
আজ্ঞে সবাই চেনে। গোবরার বেগুন খুব নামকরা।
সত্যরাম খিঁচিয়ে উঠে বলল, বেগুনটাই চিনলে। আর কিছু দেখলে না?
কি দেখব আজ্ঞে?
দেখোনি খেত-খামারের ওপর দিয়ে আমিন বাবু শেকল টেনে মাপজোক করছে?
তা দেখেছি বটে।
আহাম্মক কোথাকার। ওখানে বিরাট কারখানা হবে। জমির দাম হু হু করে বাড়ছে। চাষের জমি সব গাপ করে বড়ো বড়ো বাড়ি হবে।
পানুর গালে হাত, আজ্ঞে তা তো জানতাম না। কানু বলেওনি।
দেড় বিঘেতে কত টাকা হয় জানিস?
তা জানি।
এক-এক কাঠার দাম যদি ঠেলে দশ হাজার ওঠে তবে কানুর ট্যাকে কত আসবে তার আন্দাজ আছে?
পানুর চোখ কপালে, উরে বাবা!
সাধে কি আর দেড় বিঘের জন্য দীনু পাইক তোকে শাসায়?
গুহ্য কথা আছে না! যতীনবাবু থলিভর্তি টাকা নিয়ে রোজ গোবরায় আনাগোনা করছেন। আজও গেলেন একটু আগে। গোবরার জমি এখন সোনা।
পানুর মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছিল। কথা সরছিল না মুখে।
সত্যরাম করুনার সুরে বলল, যা, কাজ করগে যা। ভেবে চিন্তে একটা কিছু মাথায় এলে বলবখন তোকে।
দীনু পাইক যে মোটে সাতদিন সময় দিয়েছে। কাগজপত্র সব তৈরি গিয়ে ছিপছাপটা দিলেই হয়।
সত্যরাম উদার গলায় বলল, জাতসাপে ধরলে তো আর বাঁচন নেই রে। ছিপছাপ দিতে হলে দিবি। তবে একেবারে ফাঁকিতে পড়তি যাবি কেন? দু-চার হাজার চেয়ে বসবি।
যদি মারে?
মরবি তো বটেই। তোর আবার ওয়ারিশও নেই যে তুই মরলে কেউ দাবিদার দাঁড়াবে না। না, তোর কপালটাই খারাপ দেখছি।
পানু উঠল। সত্যরামের মুখ-চোখে দুশ্চিন্তার ছাপটা তার ভালো লাগছে না।
সত্যরাম যেমনই হোক, পানুর মতো পুঁটি মাছের পরান তো ওরই হাতের তেলোয় দাপাচ্ছে। মারলে ওই মারবে, রাখলে ওই রাখবে। কিন্তু ওরও যদি বাঁচন-মরনের সমস্যা দেখা দেয় তো ঘোর বিপদের কথা।
পানু পুকুর পাড়ে গিয়ে আজ খুব গতর নেড়ে কাপড় কাচল। কাজে মন থাকলে, শরীর ব্যস্ত থাকলে দুশ্চিন্ত একটু কম হয়।
বিকেলের দিকটায় সত্যরামের একটু ছুটি হয়। ঘণ্টাটাক একটু নিজের মনে থাকতে পারে সাঁঝবেলাটায়। সত্যরাম এ সময় সিদ্ধি খায় আর শাকরেদদের নিয়ে ঘরে বসে কুটকচালি করে।
পানু চাদরটা জড়িয়ে বাঁশবন পার হয়ে কালীবাড়ির দিকে যাচ্ছিল। আরতিটা দেখে আসবে। আর ওই সঙ্গে মায়ের কাছে একটু মানসিকও করে আসবে। সাতে নেই পাঁচ নেই মা, তবে কেন আজ আমার এমন বিপদ।
আনমনা ছিল তাই লোকটাকে দেখতে পায়নি পানু।
দাদা!
পানু পিলে কেঁপে গেল। দু-বার আঁ আঁ করল মুখ দিয়ে। পথ আটকে কানু দাঁড়িয়ে।
দাদা, ভয় পেলে নাকি? আরে আমি কানু।
পানুর শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। বলল ক্কী? ক্কী? ক্কী চাস তুই?
তোমার সঙ্গে কথা আছে। আড়ালে চলো।
পানু মাথা নেড়ে বলল, ও বাবা, আড়ালে আমি যাচ্ছি না।
কানু অবাক হয়ে বলল, অত ভয় পাচ্ছ কেন? আমি কি বাঘ না ভাল্লুক?
পানু দু-পা পিছিয়ে বলল, আমি চললুম। যা বলার চিঠি লিখে জানাস।
কানু বেকুবের মতো দাদার দিকে চেয়ে বলল, কী হয়েছে তোমার বলো তো! আমি যে ভীষণ বিপদে পড়ে তোমার কাছে এলুম।
কী বিপদ?
দীনু গুণ্ডা যে আমাকে ভিটেছাড়া করতে চাইছে।
অ্যাঁ। তা সে তোর পেয়ারের লোক, তা-
কী যে বলো দাদা, তার ঠিক নেই। কে, কার পেয়ারের লোক? গোবরায় বরে কী সব কলকারখানা হবে টবে, সেই শুনে সবাই জমির দাম চড়িয়ে বসে আছে। সেই কবে জুয়া খেলতে গিয়ে পঞ্চাশটা টাকা ধার নিয়েছিলুম সেই সুবাদে দীনু শালা গিয়ে নানা রকম গাইতে লাগল। তোমার মনিবেরও সাট আছে এর মধ্যে।
দীনু কী বলছে?
বলছে, হাজারটা টাকা নগদ দিচ্ছি ভিটেমাটি ছেড়ে চলে যা। নইলে ঘরে আগুন দিয়ে বেগুনপোড়া করে ছাড়ব। সব তোমাকে বলা যায় না, শালা দীনু আমার কিছু গুপ্ত কথাও জানে। আমার বড়ো খারাপ সময় পড়েছে।
পানু আতঙ্কিত হয়ে বলল, তা আমার কাছে কেন? আমি কী করব?
বলছিলুম কী এ সময়টায় তুমি যদি তোমার ভাগেরটা না ছাড়ো তাহলে দীনু শালা মুশকিলে পড়বে!
ও বাবা, সাতদিন সময় দিয়েছে। তার মধ্যে লেখাপড়া না করে দিলে ঘাড় নামিয়ে দিবে।
বলো কী তোমাকেও ধরেছিলো এর মধ্যে? তুমি যে আমার দাদা তা তো জানার কথা নয়।
পানু বলল, জেনেছে। তাছাড়া আমাকে তো বলল, আমি গিয়ে নাকি তোকে ভাগের জন্য ভয় দেখিয়েছি।
কানু মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। বলল, সব্বনাশ। আমার ভরসা তো ছিলে তুমি। এখন তুমিও যদি লিখে দাও তাহলে তো দীনু শালা আমার ঘাড় ধরে আদায় করে নেবে। তোমার কথা গেয়ে একটু ভজঘট পাকানোর তালে ছিলুম যে।
পানু একটু ভাবল। তারপর হালছাড়া গলায় বলল, তা আর কী করা যাবে! প্রাণটা তো আগে! শুনেছি গুণ্ডোটা মেলা খুনখারাবি করেছে।
তা করেছে।
ওরকম লোকের সঙ্গে কি লাগা ভালো?
কানু একথাটার জবাব দিল না। উবু হয়ে বসে চাদরের খুঁটে মুখ মুছল। বেশ কাহিল দেখাচ্ছিল তাকে। গরগরানিটাও আর নেই। দায় পড়লে মানুষের স্বভাব ভালো হয়ে পড়ে। কানুকেও কেন যেন ভাল মানুষের মতো দেখাচ্ছে। কেঁদেকেটে চোখ লাল করে ফেলল কানু। তারপর মুখ তুলে ধরা গলায় বলল, মায়ের দিব্যি কেটে বলছি দাদা, যদি দীনু গুণ্ডাকে ঠেকাতে পারো তবে জমি বেচে যা পাব অর্ধেক তোমার। এখনই সাত হাজার করে কাঠার দর উঠেছে। আমাদের জমির পাশ দিয়ে রাস্তা হচ্ছে বলে জমির দাম আরো বেশি।
সত্যরাম বলছিল কাঠার দাম নাকি দশ হাজার।
আর ছ-মাস পরে তাই হবে। যদি ততদিন ধরে রাখা যায়।
পানু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে গেল।
বাঁশবনের ভিতরে কুয়াশা আর অন্ধকারে একটু শব্দ উঠল। কে যেন সাবধানি পায়ে আসছে বা যাচ্ছে।
বাঁশপাতায় খড়মড় শব্দ উঠছে।
কানু সপাৎ করে উঠে দাঁড়াল।
পানু বলল, কে?
কে যেন দৌড়ে পালাচ্ছে ওধারে।
কানু সভয়ে বলল, কে গো দাদা?
পানু মাথা নেড়ে বলল, বুঝতে পারছি না। আবছা মনে হল একটা মেয়েছেলে। দাঁড়া দেখছি।
আমি আর দাঁড়াব না। ফিরতে দেরি হয়ে যাবে তার ওপর দীনু শালা দেখতে পেলে বিপদ ঘটবে। কাল-পারশু একবার আসবখন।
কানু চলে গেল।
পানু বাঁশবনের ভিতরে একটু চেয়ে রইল। মরা আলোর ঝুঁঝকো মায়ার ভিতর সে একটা খয়েরি ডুরে শাড়ির আভাস দেখেছে। মেয়েছেলেটা দৌড়ে বেশি দূর যায়নি। কথা শুনছিল আড়ি পেতে। কথা যে শেষ হয়েছে তা জানে না। ফের আসবে।
পানু সন্তর্পণে এগোল। মস্ত একটা শিমুল গাছ আছে ভিতরবাগে। আর যতদূর ধারণা, ওখানে গা-ঢাকা দিয়েছে।
পানু তাড়াহুড়ো করল না। বরং বেশ গুনগুন করে রামপ্রসাদি ভাঁজতে ভাঁজতে শুঁড়িপথ ধরে দুলকি চাল এগোল। শিমুলগাছটার ডানধার বরাবর হয়ে আচমকা গোঁত্তা মেরে ঢুকে গেল বাঁশবনে। তারপর একদম মুখোমুখি।
মেয়েটা নড়ারও সময় পেল না। একটু হাফাচ্ছিল।
তুমি! অ্যাঁ! তুমি তো দাক্ষী!
বছর সতেরো-আঠেরোর মেয়েটা সভয়ে চেয়ে রইল পানুর দিকে।
এখানে কি করছিলে শুনি?
দাক্ষী হাঁফসানো গলায় বলে, কী করব? নিজের ইচ্ছায় এসেছি নাকি?
তবে?
তোমরা সবাই যাকে ভয় পাও সেই দুনুই তো ধরে এনেছে আমাকে।
ধার এনছে মানে?
মানে চুলের মুঠি ধরেই একরকম টেনে বার করে এনেছে। আমার বাবার পেটে লাথি মেরেছিল। কী জানি কেমন আছে বাপটা। ভােইয়ের টিবি বলে বাবা টাকা নিয়েছিল। ধার শোধ হয়নি।
বটে তা এখানে কি করছিলে?
রাক্ষসটা যে আমাকে এবাড়িতে রেখেছে চারদিকে নজর রাখবার জন্য। কোথায় টাকাপয়সা গয়নাগাটি, কে কেমন, এসব খবর নিতে। আজ সকালে ডেকে পাঠিয়ে তোমার ওপর নজর রাখতে বলল।
ক্কেন ক্কেন?
তোমার কাছে কেউ আসে কিনা, কি কথা হয় সব খবর দিতে বলেছে। নইলে তো বুজতেই পারছ।
পানু ভয়ে এবং শীতে কাঁপছিল। রীতিমতো হি-হি কাঁপুনি। কাঁপা গলাতেই বলল, বডড শীত করছে।
আমারও।
তা তোমাকে ধরে এনে ও কী করতে চায়?
মেয়েটা করুন গলায় বলল, এখনও খারাপ কিছু করেনি। তবে কপালে যা আছে তা হবে। খারাপই হবে। হয়তো নিজে কিছুদিন কাছে রাখবে, তারপর গোহাটার গরুর মতো বেচে দেবে। বাজারের মেয়ে হওয়া ছাড়া ভগবান আর আমার কপালে কী লিখেছেন?
ও বাবা!
শোনো। সাঁপুই গাঁ চেনো?
চিনি। কাছেই।
সেখানে গোপাল দাসের বাড়ি। আমার বাবা। কেমন আছে আমার বাপটা একটু খবর এনে দেবে? পেটে লাথিটা লেগে বড়ো কাতরাচ্ছিল।
তা দেখবখন চেষ্টা করে।
যদি এনে দাও খবরটা তাহলে আজকের কথা আমি গুণ্ডাটাকে বলব না বুঝলে?
বুঝেছি।
কানুর মতো এ মেয়েটাও কাঁদল। বড়ো বড়ো চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল পড়ছিল। কাঁদতে কাঁদতে ধরা গলায় বলল, আমি তো গেছিই, নিজের জন্য আর ভাবছি না। বাপটা ভাইটার কী যে হবে।
পানু মৃদু স্বরে বলল, হিম পড়ছে। ঘরে যাও। বেশিক্ষণ বাইরে থাকলে লোকে নানারকম সন্দেহ করতে পারে। যাও।
যাচ্ছি।
মেয়েটা চলে গেলে বাঁশবাগানে স্তব্দ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল পানু। হাত-পায়ের কাঁপুনি কমেছে, কিন্তু ভয়টা তার শরীরকে কাঠ করে রেখেছে। কিছুক্ষণ পানু নড়তে পারল না। বাঁশবনের ভিতর দিয়ে কারা আসছে। টর্চ জ্বলছে মাঝে মাঝে। কথা কইছে। যতীনবাবু হবে না। যতীনবাবু তো গেছেন হাওয়াগাড়ি চেপে। তাতেই ফিরবেন।
পানু কয়েক পা এগোল।তারপর দাঁড়িয়ে গেল। যতীনবাবুই। সঙ্গে বিভীষণ দীনু পাইক এবং আরও ক-জন। জমিজমা বিষয়-আশয়ের কথাই হচ্ছে।
পানু আর এগোল না। দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগল। অনেক্ষণ ভাবল। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফিরে এল ঘরে।
ঘটনাটা ঘটল একটু বেশি রাতে। খেতে যাবে বলে ছয় চাকর তৈরি হচ্ছে। পাঁচু গাড়ু নিয়ে মাঠে গেছে। শ্রীপতি রান্নাঘর সেরে এসে হাত-মুখ দুচ্ছে। কেষ্ট টেমির আলোয় গোপালভাঁড় পড়ে শোনাচ্ছে সবাইকে! বেশ একটা ফুর্তির ভাব।
হঠাৎ দীনু এসে ঘরে ঢুকল। বিশাল চেহারাখানা যেন ঘর ভরে দাঁড়াল।
পানুর দিকে রক্তজল করা চোখে একটুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, কে এসেছিল তোর কাছে?
পানু থতোমতো খেয়ে বলল, কই!
জিব টেনে বের কের দেব। কে এসছিল?
পানুর মাথাটা টাল খেল। দাক্ষীই কি বলে দিল শেষে? কথা দিয়েছিল বলব না।
পানু মাটির দিকে চেয়ে বলল কানু।
বটে! পরামর্শ হল ভাইয়ের সঙ্গে?
হঠাৎ পানু একটু হাসল, বলল, দু-ভাইয়ে ঠিক করলুম জমিটা আমরা হাতছাড়া করছি না।
বটে! বলে একটা বাঘা গর্জন ছাড়ল দীনু।
পানু চমকাল না। উঠে দাঁড়াল। দাক্ষী কথা রাখেনি। সেইটে তার মনে বড়ো বাজেছে। খিদেটা পেট থেকে খাঁ খাঁ করে পেট থেকে উঠে আসছে বুকে। মনে পড়ছে পারুল তাকে বিয়ে করবে না বলে সটকে পড়েছিল কার সঙ্গে। সব মিলেমিশে আজ পানুর মাথাটা গোলমাল।
সে একেবারে সমানে সমানে দীনুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল, তুমি বড়ো বেচাল লোক হে। বড়ো পাপী। খুন করো, মেয়েমানুষকে ধরে আনো, লোকের জমিজমা কেড়ে নাও....
কথাটা শেষ হল না। দীনু একখান থাপ্পড় তুলল। একেবারে আকাশসমান উঁচু।
পানু যতীনবাবুর বাড়ির বড়ো বড়ো মশারি আর কাপড় কাচে, খড় কুচোয়, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কলপাড়ের শ্যাওলা তোলে, জন্মের শোধ ভাতের পাহাড় সাঁদ করায় ভিতরে। তার হাত-পা পাকিয়ে দড়ির মতো হেয়ে গেছে ঠিকই। কিন্তু ভারি পোক্ত শরীর। শীতে গ্রীষ্মে রোদে জলে একেবারে সই। কোদাল কুড়ুলে তার চমৎকার হাত। মাঝারি মাপের পাটের দড়ি কতবার দায়ের অভাবে টেনে ছিঁড়েছে।
দীনুর চড়টা নামবার আগেই থাবড়াটা পানু কষাল।
সে এমন থাবড়া যা আর কহতবা নয়।
দীনু পাইক চড়টা নিরীহভাবে নামিয়ে নিজের গালে হাত বোলাতে লাগল অবাক হয়ে। মুখে কথা নেই, এত অবাক।
পানু সামনে দাঁড়িয়েই রইল। বলল, আমরা বাবুর পেয়ারের চাকর নই, বুঝলে? খেটে খাই। আমাদের প্রাণের ভয় থাকলে চলে না।
দীনু দাঁতে দাঁত ঘষটাল। তারপর পটাং করে গায়ের গরম চাদরখানা খুলে ফেলে দিয়ে দুটো মুগুরের মতো হাত বাড়িয়ে চেপে ধরল পানুকে।
তারপর কী থেকে যে কী হল পানু বলতে পারবে না। কিন্তু লড়াইটা বেশিক্ষণ চলেনি। একসময় সে দেখল, দেখে খুবই অবাক হল যে, সে অর্থাৎ পানু, দীনু পাইককে উপুড় করে ফেলে তার চুলে ঝুঁটি ধরে মাথাটা চৌকাঠে ঠুকছে আর বলছে, মর, মর, মরে যা।
শ্রীপতি পাঁচুরা এসে না ছাড়ালে দীনুকে মরতেই হত।
তবে মরার চেয়ে কম হল না। দীনুকে গো-গাড়িতে তিন মাইল দূরে হাসপাতালে পাঠাতে হল রাত্রেই। চাকরি যাবে। জেলও খাটতে হবে। সবই জানে পানু। ঘরে বসে সে বুটের শব্দের জন্য অপেক্ষা করছিল। তার চারদিকে পাঁচজন বাইরের চাকর। মুখ গম্ভীর, কথা নেই।
ঠিক এই সময়ে সত্যরামকে সঙ্গে নিয়ে যতীনবাবু ঘরে এসে ঢুকলেন।
তটস্থ হয়ে সকলে উঠে দাঁড়াল।
যতীনবাবুর মুখখানা গম্ভীর। সকলের দিকে একে একে চেয়ে দেখে সত্যরামকে জিজ্ঞেস করলেন, এদের মধ্যে কোনজন?
আজ্ঞে এই যে। বলে সত্যরাম তাড়াতাড়ি পানুকে দেখিয়ে দিল।
যতীনবাবু কাশ্মীর শালের ভিতর থেকে তার ডান হাতখানা বের করলেন। ঘরে হ্যারিকেনের আলো, তা সে আলোতেই হিরের আংটি ঝিকিয়ে উঠল। আর কী ফর্সা হাত।
সেই হাতে নিজের থুতনিটা খামোখা একটু চুলকালেন যতীনবাবু। তারপর বললেন, ও। তারপর চারদিকটা একটু ঘুম-ঘুম চোখে একটু তাকিয়ে নিয়ে চেয়ে সত্যরামের দিকে তাকিয়ে বললেন, এ ঘরটায় একটা বিশ্রী গন্ধ, তাই না?
সত্যরাম বিনয়ের গলায় বলল, আজ্ঞে। ছোটলোকদের ঘর তো-
যতীনবাবু তাঁর হিরের ঝরকানি তুলে গলা চুলকালেন। তারপর বললেন, আজ বড়ো ঠাণ্ডা, তাই না সত্যরাম?
আজ্ঞে, বেজায়।
যতীনবাবু যেন কথা খুঁজে পাচ্ছে না এমনভাবে চারদিকে চাইতে লাগলেন। ঘরখানাই যেন দেখছেন। সামনে ছ-জন বশংবদ চাকর বাক্যহারা হয়ে দাঁড়িয়ে।
যতীনবাবু এবার জিজ্ঞেস করলেন, সত্যরাম, ওর নাম কী?
আজ্ঞে পানু। এমনিতে খারাপ নয়। কাজ ভালোই করে। বিশ্বাসী।
কতদিন আমার কাজ করছে?
তা বছর পাঁচেক হবে বোধ হয়।
যতীনবাবু একটু কাশলেন। এইসব হীন চাকরদের সঙ্গে তিনি কখনো কথা বলেননি।
কীভাবে বলবেন তা বোধ হয় ভেবে পাচ্ছিলেন না। তাই অসহায়ের মতো সত্যরামের দিকে চেয়ে বললেন, ওর কি আমাকে কিছু বলবার আছে সত্যরাম? ও কথা বলছে না কেন?
সত্যরাম শশব্যস্তে বলল, বলবে আবার কী আজ্ঞে? কথাটথা তো বিশেষ বলতে শেখেনি। ভদ্রলোকদের সঙ্গে কথা বলতে ভয় খায়। ওরে ও পানু বাবুকে কিছু বলবি?
পানু মাথা নাড়ল। তার কিছু বলার নেই।
ও কত মাইনে পায় সত্যরাম?
আজ্ঞে, আশি টাকা। এ বাজারে কম নয়। খায়ও মেলা। হরেদের পাঁচ সাতশোই পড়ে যায় আজ্ঞে।
যতীনবাবু গলা খাঁকারি দিয়ে ঘরের চালের দিকে চেয়ে বললেন, পুলিশ অবশ্য আসবে। ও পুলিশকে কী বলবে সত্যরাম?
সত্যরাম শশব্যস্ত পানুর দিকে চেয়ে বলল, ওরে ও ডাকাত, বাবুর কথাটা কানে গেছে নাকি?
পানু মাথা নাড়ল। গেছে।
একটা কিছু বলবি তো।
পানু মেঝের দিকে চেয়ে রইল। কথা বলল না।
যতীনবাবু একটা হাই তোলবার চেষ্টা করলেন। পারলেন না। বাতাসটা কান দিয়ে বেরিয়ে গেল। তিনি কানের ফুটোয় আঙুল দিয়ে একটু নাড়া দিলেন। তারপর পানুর দিকে চেয়ে বললেন, আমার বড়ো বিপদ হে।
পানুর সঙ্গে মনিবের এই প্রথম চোখাচোখি। পানুর অবশ্য ভয়ডর কেটে গেছে। ভক্তিমান্যর ভাবটাও আর নেই। তবে যতীনবাবুর ভয়টা কীসের তা সে ভালো বুঝতে পারল না।
যতীনবাবু তাঁর নাকের ডগায় চেপে ধরলেন একটু। তারপর বললেন, পুলিশ অনেক কথা জানতে চাইবে বাপু। দীনু যে আমার চাকর ছিল সেকথাটা ওদের বলা ঠিক হবে না। ওর নামে হুলিয়া আছে। তা, ইয়ে আমি বলছিলুম কি তোমাকে আমি পাইক করে নিচ্ছি। তিনশো টাকা-কী বলিস রে সত্যরাম, তিনশো কি কম হচ্ছে?
আজ্ঞে না।
আর অন্য সবাইকেও ত্রিশ টাকা করে বাড়িয়ে দিস।
যে আজ্ঞে।
যতীনবাবু পানুর দিকে চেয়ে বললেন, তোমাকে আমি দেখব। তুমি একটু আমাকে দেখো। পুলিশ জিজ্ঞেস করলে বোলো দীনুকে এ বাড়িতে কখনো দেখিনি। ও ডাকাতি করতে ঢুকেছিল, তুমি রুখেছ। মনে থাকবে কথাটা?
পানু জবাব দিল না। চেয়ে রইল।
যতীনবাবু আঙুলের হিরের ঝলকানি তুলে কপাল থেকে একটা মশা তাড়ালেন। কাহিল গলায় বললেন, বটকেষ্ট বলেছিলেন, দীনুর হাতে কবচ আছে, যমেও নাকি ওর সঙ্গে এঁটে ওঠে না। তা দেখছি তুমি যমের ওপর দিয়ে যাও। আমিও একটু শক্তপোক্ত লোক খুঁজছি। সঙ্গে সঙ্গে থাকবে। টাকাপয়সা নিয়ে চলাফেরার বড়ো বিপদ আজকাল।
জীবনে প্রথম মনিবের সঙ্গে কথা বলল পানু। কিন্তু যেমনটি বলার কথা তেমনটি তার মুখ দিয়ে বেরোল না। পেট থেকে যেন আপনা আপনিই বেরিয়ে এল, আজ্ঞে বাবুমশাই, চাকর হয়ে আর থাকা চলে না।
যতীনবাবু ভারি অবাক! কেন?
আজ্ঞে, চাকর হয়ে থাকলে নিজেকে ঠিকমতো চেনা যায় না কিনা।
যতীনবাবু একটু অপ্রস্তুত। হিরেসুদ্ধ হাতটা শালে চাপা দিয়ে বললেন, তোমার বোধ হয় খুব অযত্ন হয়েছে এ বাড়িতে?
আজ্ঞে তাতে ভালোই হয়েছে। ভগবান ভালোই করেন। তবে আমার আর চাকর হয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে না। আমি বাড়ি যাব।
যতীনবাবুর ফর্সা মুখটা একটু লাল হল। সত্যরামের দিকে চেয়ে বললেন, ওকে পাঁচশো করেই দিস রে সত্যরাম। আর চাকরের মতো নয়, বাড়ির ছেলে মতোই থাকবে।
যে আজ্ঞে।
পানু একটু হাসল, তারপর চাকরের পক্ষে বেমানান গলায় বলল, আজ্ঞে না বাবুমশাই।
আপনার অনেক নুন খেয়েছি। পুলিশকে যা বলার বলবখন। ও নিয়ে ভাববেন না। আমার কিছু টাকা জমেছে। দেশে গিয়ে ঘর তুলব। দু-ভাইয়ে থাকব।
যতীনবাবুর হিরে আবার চমকাল। উনি হাটু চুলকালেন।
পানু বলল, টাকাপয়সা না বাবুমশাই, তবে একটা জিনিস চাই। দাক্ষী যদি রাজি থাকে তবে ওকে নিয়ে যাব। বে করব।
যতীনবাবু অবাক হয়ে সত্যরামের দিকে তাকালেন, দাক্ষী কে?
নতুন একটা ঝি আজ্ঞে। ভারি কাঁদুনে। সারাদিন কাঁদে।
যতীনবাবু ভ্রু কুঁচকে বললেন, একে বিয়ে করতে রাজি হবে?
খুব হবে আজ্ঞে। ওর বাপ রাজি হবে।
ভোরবেলা কুয়াশায় মাখা খেতের ভিতর দিয়ে আগুপিছু দুটি প্রাণী এগিয়ে চলছে। দুজনেরই বগলে পুঁটুলি।
মাঝে মাঝে ফিরে চাইছিল পানু। ছুঁড়িটা পিছিয়ে পড়ছে বারবার।
দাক্ষী চোখ নামিয়ে নিচ্ছিল লজ্জায়। মরণ। গুণ্ডাটা তাকাচ্ছে দেখো, যেন গিলে খাবে।
দুজনেরই আজ মনে হচ্ছে, আকাশটা কত বড়ো। পৃথিবীটা কি বিশাল আর বেঁচে থাকাটা কত ভালো!
লেখক: শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
বিষয়: শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: