সিডনী বুধবার, ১লা মে ২০২৪, ১৮ই বৈশাখ ১৪৩১

একজন আশাপূর্ণা দেবী ও তাঁর ট্রিলজি : আফরোজা পারভীন


প্রকাশিত:
৭ জুন ২০২০ ২০:৫০

আপডেট:
৭ জুন ২০২০ ২২:৩৯

আশাপূর্ণা দেবী

 

বাংলাসাহিত্যের খ্যাত্যিমান ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার ও শিশুসাহিত্যিক আশাপূর্ণা দেবী। অনেক পরিচয় তাঁর। সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি নারী অধিকার আর সমাজ পরিবর্তনের জন্য লড়েছেন আমৃত্যু। তিনি রাজনীতি করেননি, কোনো সংগঠনও করেননি। লড়েছেন নিজের কলম দিয়ে। নারীর জন্য এমন সদা সঞ্চারণশীল কলম বড় একটা দেখা যায়নি।

জন্মেছিলেন ১৯০৯ সালের ৮ জানুয়ারি উত্তর কলকাতার পটলডাঙায় মামার বাড়িতে।  পৈত্রিক নিবাস হুগলি জেলার বেগমপুর গ্রামে। পিতা হরেন্দ্রনাথ গুপ্ত, মাতা সরলাসুন্দরী দেবী। হরেন্দ্রনাথ গুপ্ত ছিলেন কমার্শিয়াল আর্টিস্ট। সে যুগের জনপ্রিয় বাংলা পত্রিকাগুলিতে ছবি আঁকতেন তিনি। এই পরিবারের আদি নিবাস ছিল হুগলি জেলার বেগমপুরে। অবশ্য আশাপূর্ণা দেবীর জীবনে  এই অঞ্চল কোনো প্রভাব ফেলেনি। কারণ তাঁর ছোটবেলা কেটেছে উত্তর কলকাতাতে। ঠাকুরমা নিস্তারিনী দেবীর পাঁচ পুত্রের একান্নবর্তী সংসার ছিল। সেই সংসারেই কেটেছে আশাপূর্ণার ছেলেবেলা। বাবা হরেন্দ্রনাথ একসময় আপার সার্কুলার রোডের (বর্তমান আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় রোড) নিজস্ব বাসভবনে উঠে আসেন। আশাপূর্ণার বয়স তখন সাড়ে পাঁচ বছর। কিন্তু  ছেলেবেলার ওই কয়েকটি বছর তাঁর মনে ছাপ ফেলেছিল  গভীরভাবে।

আশাপূর্ণা দেবী ছিলেন সৃজনশীল কথাশিল্পী। তার কলম থেকে বহতা নদীর মতো লেখারা কলকল করে বেরিয়ে আসত। বহুবিধ বিষয় নিয়ে তিনি লিখেছেন । তবে নারীর শোষণ-বঞ্চনা আর শৃঙ্খল মুক্তির স্বপ্নের কথা লিখেছেন সবচেয়ে বেশি। স্বপ্ন দেখেছেন সমাজ পরিবর্তনের। তাঁর রচনায় স্বদেশচিন্তা ও সমাজ ভাবনাও প্রবলভাবে উপস্থিত।  মননশীলতায় ঋদ্ধ তাঁর লেখনী।

বিংশ শতাব্দীর বাঙালি জীবন, বিশেষত সাধারণ মেয়েদের জীবনযাপন ও মনস্তত্ত্বের চিত্রই ছিল তাঁর রচনার মূল উপজীব্য। তিনি মধ্যবিত্ত জীবন দেখেছেন। চোখ ছিল খোলা। পাশ্চাত্য সাহিত্য ও দর্শন সম্পর্কে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ ছিলেন। বাংলা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো ভাষায় তাঁর জ্ঞান ছিল না। কিন্তু এজন্য তাঁর চিন্তা বা লেখা বিন্দুমাত্র বাধাগ্রস্ত হয়নি। বরং তার লেখা অনুদিত হয়েছে বিভিন্ন ভাষায়।

পরিবার ছিল রক্ষণশীল।  স্কুল-কলেজে পড়ার সুযোগ হয়নি তাঁর। পাননি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। ঠাকুরমা এ ব্যাপারে ভীষণ কঠোর  ছিলেন । মা সরলাসুন্দরী দেবী স্কুলে পড়া বিদুষী ছিলেন। তিনি  খুবই চেয়েছিলেন তাঁর মেয়ে স্কুলে পড়ুক।  চেষ্টার কোনো খামতি রাখেননি। কিন্তু শাশুড়ির অনমনীয় জেদের কাছে হার মেনে যান। শাশুড়ি কিছুতেই মত দেননি স্কুলে পড়ানোর। আশাপূর্ণা আজীবন আফসোস করেছেন স্কুলে  পড়েননি বলে।  মা সরলাসুন্দরী ছিলেন সাহিত্যের একনিষ্ঠ পাঠিক। তার সাহিত্যপ্রীতি কন্যার মধ্যে সঞ্চারিত করতে চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি। মা ছিলেন শিক্ষা দীক্ষা রুচি উদারতায় অনন্য। এসব গুণাবলীও তিনি মেয়েকে উজাড় করে দিয়েছিলেন । পিতা হরেন্দ্রনাথ গুপ্তর সংগীত ও চারুশল্পে প্রতিভা ছিল ।  বাড়িতে প্রচুর ভালো ভালো গ্রন্থ ছিল। স্কুলে না পড়লেও বাড়ির পরিবেশ পাঠের অনুকূল ছিল। সময় নষ্ট করেননি আশাপূর্ণা। মাত্র ছয় বছর বয়স থেকেই পাঠ্য ও অপাঠ্য সব ধরনের বই পড়তে শুরু করেন। আশাপূর্ণা ছিলেন স্বশিক্ষায় শিক্ষিত। ছিল অসাধারণ সূক্ষ্ম দৃষ্টি ও সংবেদনশীল মন। এটি তিনি পেয়েছিলেন মধ্যবিত্ত জীবনের সংস্পর্শ থেকে। গভীর দুচোখ আর মমতাভরা মন নিয়ে চারপাশের জগতকে প্রত্যক্ষ করেছেন তিনি।  প্রগাঢ় মেধা ছিল। অভিজ্ঞতা তাঁকে জ্ঞান দিয়েছিল। সে মেধা আর জ্ঞানের পুরোটাই ঢেলে দিয়েছিলেন লেখায়। লেখার পরতে পরতে রেখে গেছেন প্রতিভার স্বাক্ষর। তাঁর সৃষ্টি অমর হয়েছে গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার প্রসাদগুণে।

সাহিত্যের প্রতি তাঁর প্রগাঢ় অনুরাগ আর জীবনব্যাপী পরিশ্রমের ফসল  দেড় হাজার ছোটগল্প ও আড়াইশো-র বেশি উপন্যাস এবং শিশুতোষ রচনা। এসবের মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’, ‘সুবর্ণলতা’, এবং ‘বকুলকথা’। এই তিনটি উপন্যাস আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনার মর্যাদা পেয়েছে।

প্রথম প্রতিশ্রুতি-সুবর্ণলতাসহ তাঁর  অনেক  কাহিনি অবলম্বনে নিমিৃত হয়েছে জনপ্রিয় চলচ্চিত্র।

এছাড়াও আশাপূর্ণা  দেবীর রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাবলীর মধ্যে রয়েছে:

নিলয়-নিবাস, দিব্যহাসিনীর দিনলিপি, সিঁড়ি ভাঙা অঙ্ক, চিত্রকল্প, দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে, লীলা চিরন্তন, চাবি বন্ধ সিন্দুক, অগ্নিপরীক্ষা, আর এক আশাপূর্ণা, এই তো সেদিন, অলয় আদিত্যের ইচ্ছাপত্র রহস্য, গজ উকিলের হত্যা রহস্য, ভুতুড়ে কুকুর, রাজকুমারের পোশাকে, মনের মুখ, মধ্যে সমুদ্র, যাচাই, ভুল ট্রেনে উঠে, নিমিত্তমাত্রসহ আরো অনেক গ্রন্থ।

আশাপূর্ণা সম্মানিত হয়েছিলেন জ্ঞানপীঠ পুরস্কারসহ দেশের একাধিক সাহিত্য পুরস্কার, অসামরিক নাগরিক সম্মান ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রিতে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে প্রদান করেন পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ সম্মান রবীন্দ্র পুরস্কার। ভারত সরকার তাঁকে ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মান সাহিত্য অকাদেমি ফেলোশিপে ভূষিত করেন। আশাপূর্ণা দেবী সহজ, সরল ভাষায় লিখেছেন। কিন্তু সে লেখা গভীর তাৎপর্যময়। জীবন তাঁর কাছে নিত্য চলমান। অলসতা বা কর্মবিমূখতার অবকাশ সে জীবনে নেই। জীবনকে তিনি দেখেছেন কর্ম, সংগ্রাম, বিপর্যয়, বিপর্যয় কাটিয়ে উঠে দাঁড়াবার অদম্য শক্তির মধ্য দিয়ে। তাঁর কাছে জীবনের অর্থ নিরন্তর গতিশীলতা।

মাত্র ১৫ বছর বয়সে ১৯২৪ সালে কালিদাশ গুপ্তের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ের পর তাঁর অবরুদ্ধ জীবন  ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয়। বদলে যায় তাঁর জীবনের ধারা । স্বামীর উৎসাহে তিনি লিখতে শুরু করেন।  অল্প সময়ে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যান। তাঁর কলম সৃষ্টি করে একের পর একে কালজয়ী উপন্যাস।  মায়ের উৎসাহে পড়াশোনা শুরু হয়েছিল। মায়ের উৎসাহেই ‘শিশুসাথী’ পত্রিকায় প্রথম কবিতা পাঠান। লেখা এত ভালো হয় যে সম্পাদকদের উৎসাহমূলক চিঠি দিয়ে বলে, ‘আরো পাঠাও’। এই তাগাদা দেয়া, উৎসাহ দেয়াই ছিল তাঁর লেখার আসল অনুপ্রেরণা। তাঁর তখন মাত্র তেরো বছর বয়স। তাই সম্পাদকরা তুমি করেই সম্বোধন করতেন। প্রথমে তো প্রেমেন্দ্র মিত্র আর সজনীকান্ত দাস বলেছিলেন ‘এ পুরুষের কলম’। নতুন লেখক অথচ অত্যন্ত বলিষ্ঠ কলম। কিন্তু সব জল্পনা ভুল প্রমাণ করে জানা গেল, লেখক একজন গৃহবধূ, নাম আশাপূর্ণা গুপ্ত।

আশাপূর্ণার নারী সত্যবতী, সুবর্ণলতা,বকুল :

বাংলায় নারীবাদী সাহিত্য নিয়ে চিন্তা করলে আশাপূর্ণা দেবীর নাম প্রথমে মনে পড়বেই। মনে পড়বে তার  ত্রয়ী উপন্যাস,  প্রথম প্রতিশ্রুতি (১৯৬৪), সুবর্ণলতা (১৯৬৭), এবং বকুলকথা (১৯৭৪)। লক্ষ্যণীয় নারীবাদী আন্দোলন সূচনার বেশ কিছু আগেই এই ট্রিলজির আত্মপ্রকাশ। তিনটি উপন্যাসের কেন্দ্রে রয়েছে তিন প্রজন্মের নারী - যারা ঔপনিবেশিক সময় থেকে স্বাধীন ভারতে বাঙালি সমাজে নারীর অবস্থিতির সাক্ষ্য বহন করে। যেখানে তিনি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ঘরে বাইরে মেয়েদের কঠিন লড়াইয়ের ইতিহাস বলেছেন অত্যন্ত সহজ অন্তরঙ্গ ঝরঝরে ভাষায় । সত্যবতী, সুবর্ণলতা এবং বকুল, মা, মেয়ে ও নাতনি।  তিনটি বিশেষ সময় ও সমাজের প্রতিনিধি তারা। লেখায় ফুটে উঠেছে সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিত । তিনটি গ্রন্থকে একসাথে মিলালে নারীর অবস্থার বিবর্তনের একটা চিত্র পাওয়া যায়।

সত্যবতী:  তিন নারীর মধ্যে সত্যবতীই প্রথম লড়িয়ে।  নারী-জীবনের প্রাত্যহিক ছক ভেঙে বেরিয়ে এসেছে সে। নারীর প্রতি  নির্যাতন আর নারী শোষণের নগ্ন চেহারার মুখোমুখি সত্যবতীই আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয়। নারীর প্রতি যে সমাজে সংসারে অন্যায় হচ্ছে সত্যবতীর কারণে আমরা তা মানতে বাধ্য হই।  সত্যবতীর মধ্যেই আমরা পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী এক নারীকে পাই।  সেই  পেরেছে  পিতৃতন্ত্রকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে।

প্রথম প্রতিশ্রুতির গল্প দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন বাংলাদেশের । সময়টা ঐতিহাসিক। সত্যবতী মেধাবী, বুদ্ধিমতী, যুক্তিবাদী, প্রাণোচ্ছল একটা মেয়ে। বাড়ির সকলে তাকে ভালবাসে। সকলের খুব প্রিয় সে।  তার বাবা পন্ডিত, বিজ্ঞ মানুষ তিনি। বাবার প্রশ্রয়ে  বড় হতে থাকে সে। কিন্তু মা-বাবা তাকে যত স্নেহ করুক না কেন, যতই প্রশ্রয় দিক না কেন, মেয়েকে স্কুলে পড়াবার কথা ভাবতে পারেন না। সংস্কারের জাল ডিঙোতে পারেন না তারা। মেয়ে এই অপরাধে তার স্কুলে যাওয়া হয় না। হতাশ নিরুপায় সত্যবতীর জ্ঞানপিপাসা মেটানোর পথ কি? সে পথ সে নিজেই খুঁজে নেয়। ভাইদের পড়া শুনে শুনে বিদ্যাশিক্ষা করতে থাকে। একসময় তার বিয়ে হয়ে যায়।  ততদিনে সত্যবতী মনের দিক থেকে অনেক এগিয়ে গেছেন চারপাশের মানুষদের অনেক পেছনে ফেলে। গ্রামীণ সংস্কার আর শাসনের নাগপাশ এড়াতে তিনি শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে স্বামী নবকুমার, দুই ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে কলকাতায় এসে সংসার পাতলেন। তার এই মেয়েই সুবর্ণলতা।  যার জীবন নিয়ে লেখা হয়েছে দ্বিতীয় উপন্যাস  সুবর্ণলতা।

সত্যবতীর ইচ্ছে ছেলেদের পড়াশোনা করিয়ে সভ্য, সুশিক্ষিত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা । সুবর্ণলতাকে নিয়েও তার অপরিসীম আশা। নিজের জীবনে যা হয়নি তা পরিপূর্ণ করতে চান সুবর্ণলতার মধ্য দিয়ে। নিজে মেয়েদের স্কুল প্রতিষ্ঠা করে মেয়েকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান তিনি। চান স্বাধীন আর ক্ষমতাশীল করে তুলতে। এ ব্যাপারে তিনি বদ্ধপরিকর। কিন্তু বাধ সাধল শাশুড়ি আর স্বামী। তারা দুজন ছল করে মেয়েকে গ্রামের বাড়িতে এনে, সত্যবতীকে না জানিয়ে সুবর্ণলতার বিয়ে দিল। সত্যবতী যখন জানতে পারল,  তার  ছোট্ট মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেছে, বাধা দেওয়ার আর উপায় নেই তখন সে বিদ্রোহ করল। স্বামীর এই বিশ্বাসঘাতকতার প্রত্যুত্তর দিল চিরদিনের মতো সংসার ত্যাগ করে।

সুবর্ণলতার বিয়ের পর প্রথম প্রতিশ্রুতিতের  স্বামী নবকুমার ও সত্যবতীর কথোপকথন ছিল এমন।

‘‘গাড়ি প্রায় এগোতে শুরু করে, তবু নবকুমার সঙ্গে সঙ্গে এগোয়, তোমার বাবা এত বিচক্ষণ ব্যক্তি, তিনিও তোমাকে আট বছরে গৌরীদান করেছিলেন, সে কথা তো কই মনে করছো না?”

হঠাৎ সত্যর সেই পাথরের চোখে আগুন ঝলসে উঠেছিল। “মনে করছি না, এ কথা কে বলেছে তোমায়? জীবনভোর মনে করে আসছি। আর এবার বাবার কাছেই গিয়ে তার উত্তর চাইব।”

যে যুগে মেয়েদের শিক্ষা ছিল, “পুড়বে মেয়ে উড়বে ছাই / তবে মেয়ের গুণ গাই”। অর্থাৎ যে মেয়ে নিজেকে পুড়িয়ে ভস্ম করতে পারবে মুখ বুজে সেই গুণী। সত্যবতী সুবর্ণলতার বিয়ের শুধু মৌখিক প্রতিবাদ জানায়নি, কাজ করে দেখিয়েছে। স্বামীর বাড়িতে ফিরে যাওয়ার অনুনয়ে কর্ণপাত করেনি। শাস্ত্রমতে বিয়ের পবিত্রতা বা চিরস্থায়ীত্বে তার বিশ্বাস নেই। তাকে প্রবোধ দিতে স্বামী যখন মেয়ের বিয়ে ভেঙে দেওয়ার কথা তোলে, তখন সত্যবতী উদভ্রান্ত গলায় বলে ওঠে, “সত্যি বলছো? ফিরিয়ে এনে দেবে? এই পুতুল খেলার বিয়েটা মুছে ফিরিয়ে দেবে আমার সেই সুবর্ণকে?”

সদু গাড়ির ছইয়ের মধ্যে বসেছিল। এবারে আস্তে বলে, “মুছে ফেলব বললেই কি মুছে ফেলা যায় বৌ? এ কি মুছে ফেলার জিনিস? নারায়ণ সাক্ষীর বিয়ে --”

সত্য নবকুমারের হাতটা ছেড়ে দেয়। কেমন এক রকমের হাসি হেসে বলে, “সব বিয়েতেই নারায়ণ এসে দাঁড়ান কিনা, সব গাঁটছড়াই জন্ম-জন্মান্তরের বাঁধন কিনা, এই প্রশ্ন নিয়ে বাবার কাছে যাচ্ছি ঠাকুরঝি!”

সত্যবতীর ন্যায়ের দন্ড ঋজু, সমাজের অসম বিধানের প্রতি সে ক্রুদ্ধ, এবং পরম্পরাগত সংস্কারের প্রতি ধিক্কারে আপোসহীন। সমাজে নারীর গুণ বলতে আমরা যা বুঝি বাধ্যতা, ক্ষমা, তিতিক্ষা, স্বামীর আনুগত্য,  অপত্যস্নেহ, গুরুজনের প্রতি অন্ধ কর্তব্যবোধ সবই তুচ্ছ হয়ে গেছে সত্যবতীরর ন্যায়বোধের কাছে। ন্যায়ের জন্যে সে নিজের সন্তান-স্বামী-সংসার অবলীলায় পরিত্যাগ করেছে। সত্যবতীর বিরোধিতায়  দৈহিক হিংস্রতা  ছিল না, কিন্তু মানসিক ও আবেগের কঠোরতার কিছুমাত্র কমতি ছিল না। উপন্যাসের শেষে সত্যবতী প্রশ্ন তুলেছে মানুষের চিরাচরিত সম্পর্কের প্রতি। বিবাহ, সন্তান, স্বামী, পিতা নারীর জীবনে এই সম্পর্কগুলির অবস্থান ও প্রভাবের সে মূল্যায়ন করতে চায়।

প্রথম প্রতিশ্রুতি রচনার প্রেক্ষিতে সম্পর্কে আশাপূর্ণা দেবী বলেছেন,

‘ছেলেবেলা থেকেই আমার প্রশ্নমুখর মন তখনকার প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার অসঙ্গতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রখর হয়ে উঠেছে। মনে হয়েছে, মানুষে মানুষে এত পার্থক্য কেন? অবস্থার এমন অসাম্য কেন? এমন অনেক কেনই আমায় পীড়িত করেছে। বেশী পীড়িত করেছে মেয়েদের অবস্থা। কেন তাদের সকল বিষয়ে এই অধিকারহীনতা, কেন তাদের জীবন কাটে অন্ধকারে। (পৃ-২২, আমার সাহিত্য চিন্তা, আর এক আশাপূর্ণা)।

সুবর্ণলতা: আশাপূর্ণা দেবীর ট্রিলজির দ্বিতীয় উপন্যাস সুবর্ণলতা। সুবর্ণলতা সত্যবতীর মেয়ে। নয় বছরের সুবর্ণাকে বিয়ে দেয়ার প্রতিবাদে গৃহত্যাগ করল মা সত্যবতী।   দর্জিপাড়ার গলির বাড়িটার মেজবউ  সুবর্ণলতা।  নয় বছর বয়সে  এ বাড়িতে প্রবেশ করেছিল বউ হয়ে। আটকা পড়েছিল চার দেয়ালে। এক চিলতে রোদ বা এক ঝির বাতাসের জন্য সে হাহাকার করেছে। লাভ হয়নি কোনোই ।  মা সত্যবতীর গৃহত্যাগের সাথে সাথে কুলত্যাগ, স্বামীত্যাগের তকমাও জুটেছিল সত্যবতীর কপালে। এ দায় যেন সুবর্ণর। মায়ের উপর সমাজের চাপিয়ে দেয়া এই  অপরাধের দন্ড বয়ে বেড়াতে হয়েছে সুবর্ণকে আজীবন। মা যেমন তাকে স্কুলে পড়াতে পারেনি সেও  পারেনি তার বড় আদরের মেয়ে পারুলকে স্কুলে পাঠাতে। 

স্বামী প্রবোধচন্দ্রের কারণে অপমানিত সুবর্ণ আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে বারবার। না তাতেও মুক্তি মেলেনি। মরা হয়ে ওঠেনি।  যম তাকে বারবার হতাশ করেছে ।  বাড়িতে ছি ছি রব উঠেছে, "বস্তা বস্তা নাটক নভেল পড়ে এমনটি হয়েছে।" বস্তা বস্তা নাটক নভেল সুবর্ণ পড়েছে। ওটাই ছিল তার একমাত্র অবলমন্বন, লড়াই করার শক্তি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের রসদ। তাই জায়েরা যখন দুপুরে ভাতঘুম দিত বা পানের বাটা নিয়ে রাজ্যের কূটকাচালি করত, সুবর্ণ' ওই সময়টা জমিয়ে রাখত বই পড়ার জন্য।

অনেক ইচ্ছেকে নিজের হাতে মেরে ফেলা সুবর্ণ শেষ জীবনে তার আজীবনের চাওয়া লাল মেঝে চওড়া ঝুলবারান্দা পেয়েছিল।  কিন্তু জীবনের টুকরো টুকরো গল্পগুলেকে এক সুতোয় বাঁধতে পারেনি। পারেনি  জোড়া লাগাতে। পারেনি নিজের কবি সত্তার বিকাশ ঘটাতে। পারুলকে সুযোগ করে দিতে পারেনি তার কবিত্ব প্রতিভার বিকাশ ঘটানোর। পারেনি তার বিয়ে আটকাতে। অনেক ঝড় জল পেরিয়ে বকুলকে স্কুলে পাঠাতে পেরেছে, এতটুকুই।

সুবর্ণ গৃহকোণে অন্তরীণ থেকে দেশের স্বাধীনতার কথা ভাবতো। চেষ্টা করতো  পরিবারের মানুষগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি বদলানের। ভাবতো পরিবারে যেন আসে ইতিবাচক পরিবর্তন। সে জানতো খাওয়া, ঘুম, সংসারধর্ম পালন করার বাইরেও একটা বৃহত্তর জগত আছে। সে জগতের সাথে ঘরের জগতটাকে মেলাতে পারলে অন্ধত্ব ঘুচবে । সেই মেলবন্ধন ঘটাতে চাইতো সুবর্ণ।

সুবর্ণর অভিমান প্রচন্ড,  জেদি, সত্য বলে মুখের ওপর। এই স্পষ্টবাদিতা আর সততার জন্য  লাঞ্ছনার শেষ থাকে না তার। বিদ্রূপের শিকার হয় প্রতিপদে।  বিরক্তির কারণ হয় সংসারের অন্যদের। সুবর্ণকে কেউ বোঝে না। গতানুগতিক মানুষের পক্ষে তাকে বোঝা  কঠিনও। বোঝার চেষ্টাও কেউ করে না। সুবর্ণর সব কাজই সমাজের চোখে বাহুল্য, অতিরঞ্জিত মনে হয়। সুবর্ণরা জন্মায় কালকে অতিক্রম করার সহজাত স্বভাব নিয়ে। এরা যুগের তুলনায় অগ্রবর্তী থাকে সবসময়ই। কিন্তু প্রকৃতির বৈরিতা, সংসারের অসহযেগিতায় এরা মাঝে মাঝে ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ে।  কিন্তু না, থামে না এরা। শত লাঞ্ছনা, গঞ্জনা উপহাস পরিহাস তাচ্ছিল্যের মাঝেও এরা মাথা তুলে আবার দাঁড়ায় অদম্য শক্তিতে।

 সুবর্ণ মায়ের কথা শোনেনি। শুনেছিল ঠাকুমার কথা। সেকথা শুনে সারাজীবনের জন্য নিজের দুর্ভাগ্য বয়ে এনেছিল  সে। এই চিন্তা তাকে কুরে কুরে খেতো। মায়ের সাথে পার্থক্য ছিল সুবর্ণর। মা অদম্য ছিল, আপোসহীন ছিল, সমঝোতাপূর্ণ জোড়াতালির জীবন সে বইতে পারত না। তাই সংসার তাগ করেছিল। সুবর্ণ পারেনি তার মায়ের মতো সংসার ত্যাগ করতে। আবার পারেনি নিজের স্বপ্ন আর ইচ্ছেগুলো জলাঞ্জলি দিতে। তাই সংসারের মাঝেই আজীবন নিজের স্বপ্ন, নিজের ইচ্ছেগুলোকে হাতড়ে বেড়িয়েছে। সুবর্ণ'র মধ্যে মুক্তির যে আকুতি ছিল সে আকুতি কেউ বুঝতে চায়নি।

বকুল কথা: ট্রিলজির শেষ উপন্যাস বকুল কথা। বকুল সুবর্ণলতার কন্যা, সত্যবতীর নাতনি। বকুল  পেয়েছিল সুবর্ণলতার মতো একজন মা। মা পেয়েছিলেন পারুল বকুলকে লেখাপড়া শেখাতে। তাদের নিজের পায়ে দাড় করাতে। দুজনেরই সাকিত্যপ্রীতি ছিল। মা জানতেন সুযোগ পেলে তাদের সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটবে। কিন্তু পারলেন না। স্বামী মারা যাবার পর দুই ছেলে ভানু কানুই গার্জিয়ান। তাদের দৃষ্টিতে মেয়েদের লেখাপড়ার কোনোই প্রয়োজন নেই। তাই পারুলকে বিয়ে দেয়া হলো অমলের সাথে। বিয়ের পরও পারুল চেষ্টা করেছিল তার কবি সত্তাকে বাঁচিয়ে রাখতে। কিন্তু স্বামীর সন্দেহবাতিকে সেটা হলো না। বরং একসময় অমল মারা গিয়ে বাঁচিয়ে দিল পারুলকে। বকুলকে যদিও স্কুলে ভর্তি করতে পেরেছিলেন কিন্তু এগারো বছর বয়স থেকেই বকুলকে শুনতে হতো নানান টিপ্পনি:

‘ধাড়িমেয়ে, তোমার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকার কি দরকার। ধিঙ্গী অবতার! এবাড়ি ওবাড়ি বেড়িয়ে বেড়ানো হচ্ছে? যাও না সংসারের কাজ করোগে না..ছাদে ঘোরা হচ্ছিল? কেন? বড় হয়েছ। সে খেয়াল কবে হবে। ( পৃ-৪০, বকুলকথা)

বকুল পারুলদের সম্পর্কে আশাপূর্ণা দেবী নিজেই বলেছেন,

‘আজকের বাংলাদেশে অনেক বকুল পারুলদের পেছনে রয়েছে সংগ্রামের ইতিহাস। তারা সংখ্যায় অনেক ছিল না, তারা অনেকের মধ্যে একজন। তারা একলা এগিয়েছে। এগিয়েছে খানা ডোবা ডিঙ্গিয়ে, পাথর ভেঙে, কাটাঝোপ উপড়ে।’

বকুল ভালবাসতো পাশের বাড়ির পরিমল বাবুর ছেলে সুনির্মলকে। কিন্তু তাদের এই নির্মল ভালবাসা না পরিবার না সমাজ কেউই ভালো চোখে দেখেরি। তাদের ভালবাসা কোনো পরিণতি পায়ানি। চির কুমারী থেকে গেছে বকুল।

জীবনের শেষ বয়সে এসে লেখক স্বীকৃতি পেয়েছিল বকুল। তাও নিজ নামে নয়, অনামিকা দেবী নামে। নিজের নাম যশ খ্যাতি প্রতিপত্তি থাকার পরও নিজের পিতৃদত্ত নামে সে পরিচিত হতে পারেনি পরিবারের কারণে । পারেনি পিতার জরাজীর্ণ বাড়ি ছেড়ে যেতে। সেটাও পরিবারের কারণে। সে কুমারি, একা। শুধু তাই নয়, লেখা প্রকাশ নিয়েও ভাইদের অনেক বিদ্রুপ শুনতে হয়েছে তাকে। মেয়ের নামে লেখা বলে নাকি সম্পাদকরা ছাপায়। এই লেখা কোন পুরুষ পাঠালে ছাপতো না। সেই পুরুষ নারী বিভাজন. সেই  শ্রেণিবৈষম্য, নারীকে হ্রষ্র করে দেখা।

বকুলের জীবনের শেষাংশে আধুনিকতার বিকাশ ঘটে কলকাতার জীবনে। ভাইঝি শম্পাা সত্যবান দাস নামে এক কুলিকে বিয়ে করে। সংসারের অনুশাসন ভেঙে সে প্রেমের ডাকে সাড়া  দেয়। এমনকি সত্যবানের পা কেটে বাদ দেয়ার পরও তাকে নিয়ে থাকে।  সে ভালবাসার জয়ঘাট বাজায় সব বিপত্তি উপেক্ষা করে। অন্যদিক নাতনি সত্যভামা, ভ্রাতষ্পুত্রী আধুনিকতাকে স্বেচ্ছাচারিতা হিসেবে নিয়ে নিজেদের ধ্বংস করে ফেলে। আরাধ্য তো স্বাধীনতা । স্বাধীনভাবে নিঃশ্বাস নেয়া, চলাফেরার অধিকার, সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার। স্বেচ্ছাচারিতা নয়।

শেষ কথা: আশাপূর্ণা জন্মেছিলেন ব্রিটিশ শাসিত পরাধীন বাংলায়। সেখানে তিনি পেয়েছিলেন সত্যবতী সুবর্ণলতাদের। তিনি নিজেও তো এক সত্যবতী, এক সুবর্ণলতা। তিনি নিজেই বলেছেন সত্যবতীর জীবনের সাথে সামান্য কিছু অমিল বাদে অনেকটাই মেলে তার জীবন। বৃটিশ চলে গেছে। সময় গড়িয়েছে। নারীর পরাধীনতা ঘোচেনি।  আজও সংসারের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সত্যবতী, সুবর্ণলতা, বকুলরা। যাদের খবর কেউ নিতে চায় না। যারা কিছু বললেই সমাজ চেঁচিয়ে ওঠে, ভ্রুকুটি করে বলে, " মেয়েমানুষের অত দেমাগ থাকতে নেই"। তাদের  সামান্য ইচ্ছেগুলো মার খায়।  এ কথার নিচে চাপা পড়ে যায়, গুমরে মরে। 

এ যুগের সত্যবতী সুবর্ণলতাদের হয়তো সেকালের সুবর্ণলতাদের মত এত বাধা বিঘœ সহ্য করতে হয় না, পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে কিছুটা। তবে সেকাল আর একালের মধ্যে নারীর প্রতি বৈষম্যের বিষয়ে  মিলটা এখনও রয়ে গেছে। এখনো অনেক পরিবারে নারীর মতামতের কোনো মূল্য নেই। মানুষ আগের চেয়ে আধুনিক হয়েছে। তাদের ধারণা চেতনা, ধ্যার ধারণা -ভাবনা, জীবনাচারে পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু সব জায়গায় সমানভাবে পরিবর্তন আসেনি।  নারীর প্রতি সমাজের মানসিকতার পরবর্তন আজও সেভাবে দৃশ্যমান নয়। নারীর সামাজিক ও মানসিক অবস্থানের জায়গাটা পোক্ত নয়। তাই সংসারে আজও একটা পুরুষ সন্তানের মূল্য কন্যা সন্তানের চেয়ে অনেক বেশি। যদিও বা কর্মে নারী অনেক এগিয়ে থাকে, দাম কিন্তু পুরুষেরই। এটা সমাজের মানসিকতা। তাই বাহ্যিক দিক থেকে নারীর অবস্থান পরিবর্তিত হয়েছে, কিন্তু স্বীকৃতি মেলেনি তার কাজের, চাওয়া পাওয়ার। তার নিজস্ব আইডেনটিটি স্বতন্ত্র পরিচয় আছে, কিন্তু  ইচ্ছে অনিচ্ছে আজও অনেকটাই উপেক্ষিত। কটা পরিবারের ক’জন খবর রাখে নারীর মনের অন্ধি সন্ধির। রাখে না, এটাই বাস্তবতা।

তাছাড়া মানসিক দাসত্ব তো রয়েই গেছে, যে নারী কাজ করে না তারা আজও অর্থনৈতিক বা সামাজিক দিক থেকে পুরুষের উপর নির্ভরশীল। এর থেকেও বড় সমস্যা নারীরাই নারীর উন্নতিতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কখনও কখনও শত্রুও হয়ে ওঠে। সেকালে ঠাকুমা'র ইচ্ছেতে সুবর্ণ'র বিয়ে হয়েছিল। " মেয়ে মানুষ অত লেখাপড়া শিখে কী করবে?"-এ ধারণা পুরুষের  যতটা আছে, নারীর কিছু কম নেই তার চেয়ে। তাছাড়া আরো একটা প্রবণতা আছে। আমার যা হয়নি, আমি যা পাইনি অন্যে তা পাবে কেন!  আশাপূর্ণা দেবী ঠিক এই জায়গাটাই ধরেছেন। কোনো নারী যদি নিজের পায়ে দাঁড়ায়, অন্যদের থেকে একটু অন্যরকম ভাবে বা একটু ভালো থাকে, তখন আশেপাশের নারীরাই তার পেছনে লেগে যায়। ' কেচ্ছা' রটায়। আর নারীর বিরুদ্ধে কেচ্ছা রটানোর প্রধান হাতিয়ার তার চরিত্র। সেখানেই হাত দেয়।  এভাবে নারীর জীবনে অদৃশ্য শেকল নারীদের দ্বারাই  তৈরি হয়। যেমন সুবর্ণলতার জীবনে তার ঠাকুমা, তার শ্বাশুড়ি  তৈরি করেছে। তারা পরিবর্তনের বিরোধী, সমাজপতি আর শাস্ত্রজ্ঞদের বানানো অর্থহীন নিয়মকানুনের কাছে নত। সে নিয়মের বিরুদ্ধে কেবল সত্যবতী, সুবর্ণলতারাই প্রশ্ন তোলে।  ভেঙে দিতে চায়  সে নিয়ম । যে নিয়ম নারীদের মানুষ ভাবতে শেখায় না, নারী-পুরুষে  বৈষম্য সৃষ্টি করে, সংকীর্ণ মনোভাব গড়ে তোলে, সেসব নিয়ম সুবর্ণলতারা মানে না।

আশাপূর্ণা দেবী'র ত্রয়ী উপন্যাসের কোনোটিই কোনোটির চেয়ে কম নয়। সত্যবতীর মুখে লেখক মেয়েদের স্বনির্ভরতার গুণগান গেয়েছেন। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা যে নারীমুক্তির কেন্দ্রবিন্দু, তার স্পষ্ট ইঙ্গিত পাই প্রথম প্রতিশ্রুতির পাতায়। গল্পের শেষে, স্বামী ও সংসার পরিত্যাগের পর, নায়িকা সত্যবতী ইঙ্গিত দেয় সে স্কুলের শিক্ষয়িত্রী হয়ে পেট চালাবে। কারোর কাছে হাত না পেতে তার নিজের পায়ে দাঁড়াবে।

স্বামী নবকুমারের সঙ্গে সত্যবতীর সংঘাত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু আশাপূর্ণা দেবী এই ব্যক্তিগত টানাপোড়েন শুধু স্ত্রী-পুরুষের সংঘর্ষে আবদ্ধ রাখেননি। তাঁর এবং সত্যবতীর বিদ্রোহের লক্ষ্য পুরুষতন্ত্র, যা পুরুষের প্রতি পক্ষপাত ও সুযোগ সুবিধের উৎস। এই সিস্টেমের মন্ত্রে শুধু পুরুষ নয়, মহিলারাও দীক্ষিত। সেই জন্যেই সত্যবতীর শাশুড়ি তার বিরুদ্ধাচরণ করে, তাকে ঝাঁকের  কৈ করে তুলতে এত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সত্যবতীকে সে বুঝিয়ে দেয়, পুরুষশাসন মানলেই মহিলাদের ক্ষমতা থাকে। বিদ্রোহীরা হয় সমাজ-পরিত্যক্তা। কিন্তু এদেরই মধ্যে রয়েছে সদু, সত্যবতীর ননদ, যার সাহস কম, কিন্তু যে সুবর্ণলতার স্বাধীন চিন্তাধারার সমর্থক, তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল।

সত্যবতী নারীমুক্তির পথিকৃৎ। নারীবাদের মৌলিক শর্ত, তত্ত্ব ও প্রয়োগ, দুই-ই তার চরিত্রে প্রখরভাবে বর্তমান। পিতৃতন্ত্রের ফাঁদে পড়ে সত্যবতী অত্যাচারিত অবশ্যই, কিন্তু সেই নিগ্রহ তার জীবনকে ধ্বংস করতে পারেনি; বরং অনুপ্রাণিত করেছে জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার। সেই ঔপনিবেশিক সময়কে উত্তরণ করে সত্যবতী হয়ে উঠেছে বাংলায় নারীমুক্তির প্রতীক। বাংলা সাহিত্যের ভান্ডারে সত্যবতী এক অমর চরিত্র।

সুবর্ণলতা এক বন্ধন জর্জরিতকালের মুক্তিকামী আত্মার ব্যাকুল যন্ত্রণার প্রতীক। গভীর জীবনবোধ সংবলিত নির্ভীক এক নারীর  শৈশব থেকে মৃত্যু পর্যন্ত উত্থান-পতনের সাক্ষী এই এই উপন্যাস। সুবর্ণলতারা ভালো থাকে কিনা, জানি না। তবে সুবর্ণ'র মতো দুর্লভ মেয়েদের মূল্য এই সমাজ, সংসার একদিন বুঝতে পারবে, এই আশা রাখি।

সুবর্ণতার মধ্য দিয়ে লেখিক নিয়ে এসেছেন পরবর্তীকালের নারীবাদের বহু বিতর্ক, নারীশিক্ষা, বাল্যবিবাহ, অর্থনৈতিক উত্তরাধিকার, যৌথ পরিবারের সমস্যা, মেয়েদের স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতায়নের বিষয়গুলি। মেয়েদের  দৈনন্দিন জীবনের বঞ্চনা, উপেক্ষা, অবহেলা, এবং অত্যাচারের বিবরণ এতে রয়েছে। রয়েছে আবারো সেই পুরুষতন্ত্রেও কথা যার বিরুদ্ধে সত্যবতী সুবর্ণলতারে  শর্তহীন বিদ্রোহ।

বকুলের জীবন যন্ত্রণাও শতধা বিস্তৃত। যদিও সময় এগিয়েছে। নিজের পরিচয়ে পরিচিত না হবার যন্ত্রণার চেয়ে বড় যন্ত্রণা মানবজীবনে আর কি হতে পারে!

সত্যবতী সুবর্ণলতা বকুলের অমর স্রষ্টা আশাপূর্ণা দেবী। তিনি বলেছেন “আমি মনের জানলা খোলা রেখেছিলাম যে..। মনের জানালা খোলা রেখেছিলেন বলেই তিনি সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন  অমর কিছু নারী চরিত্র। যার প্রতিটিই স্বতন্ত্র, স্বকীয়তায় উজ্জ্বল।

১৯৯৫ সালের ১৩ জুলাই গড়িয়ার কানুনগো পার্কে এই লেখকের জীবনাবসান হয়। অশেষ শ্রদ্ধা জানাই ।


আফরোজা পারভীন
কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, কলামলেখক



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top