সিডনী শনিবার, ২৭শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১

সেলিনা হোসেন - প্রেক্ষিত কথাসাহিত্য : ড. শাহনাজ পারভীন


প্রকাশিত:
১৩ জুন ২০২০ ২২:৪৮

আপডেট:
১৩ জুন ২০২০ ২৩:৩৬

সেলিনা হোসেন

 

‘কত পথ হেঁটে হেঁটে সেলিনা হোসেন একজন-
মেঘে ঢাকা নীলাকাশ, পাখি ডাকা ভোর হওয়া মন।
সুখপাখি, বুনোপাখি,রাধাচূড়া, সোনালু সেগুন-
সবকিছু মেখে নিয়ে সাহসের সোনামাখা গুণ।’

আমরা জানি, সাহিত্যের আরশিতে প্রতিবিম্বিত হয় একটি জাতি তথা একটি রাষ্ট্রের জীবন প্রণালী। প্রতিফলিত হয় সেই দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পটভূমি। জীবন মানেই তো সাহিত্য আবার সাহিত্য মানেই তো জীবন। সাহিত্যের একনিষ্ঠ সংজ্ঞা প্রায় অপ্রতুল। দেশ কাল ভেদে এর সংজ্ঞা পাল্টায়। তবে সাহিত্য শব্দটি ‘সহিত’ শব্দ থেকে উদ্ভূত। সহিত অর্থ সংযুক্ত, সমন্বিত, হিতকর, সঙ্গে, সাথে। জীবনের সাথে ঘনিষ্টশিল্প সমন্বিত বাক-বিন্যাসই সাহিত্য। সাহিত্য শব্দটি ‘সম্মিলন’ অর্থেও ব্যবহৃত হয়। সম্মিলন হল মনে-মনে, আত্মায়-আত্মায়, হৃদয়ে-হৃদয়ে মিলন। সাহিত্য শব্দটির সাথে হিত, কল্যাণ, মঙ্গলও সম্পর্কযুক্ত। সাহিত্য মানব জীবনের দর্পণ স্বরূপ। মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, আস্থা-বিশ্বাস, চিন্তা-চেতনা, শিক্ষা-সংস্কৃতি এবং ইতিহাস-ঐতিহ্য সাহিত্যে প্রতিফলিত হয় শৈল্পিক সৌন্দর্যে। সাহিত্যের আর এক নাম জীব ন সমালোচনা (Criticism of life)। জীবন সত্যের বিশ্লেষণই এতে অঙ্গীকৃত। মানুষের আবেগ ও মননের (Emotion and Intellect) মাধ্যমে জীবনের সত্য, জীবনাতীতের সত্য ভাষার সৌন্দর্যে মন্ডিত হয়ে সাহিত্যে উদ্ভাসিত হয়। সত্য যখন শব্দ শিল্পের পরশে সুন্দর হয়ে প্রকাশিত হয় তখন তা যুগ যুগ ধরে সংবেদনশীল (Sensitive) হয়ে মানুষের মনে রসাবেদন সৃষ্টি করে। মানব মনের এ ধরনের পবিত্র আনন্দ সৃষ্টি করা সাহিত্যের কাজ। এজন্য মানব মনে সাহিত্যের প্রভাব খুব প্রবল, তার শক্তি বিপুল।

সাহিত্য যেখান থেকেই জন্মলাভ করুক না কেন, তার অবয়বে থাকে তার জন্মস্থান, যুগ এবং পারিপাশ্বিকতার ছোঁয়া। তাই সাহিত্যে যে কোন মুক্তিকামী জাতির কথা যেমন স্পষ্ট হয়, তেমনি স্পষ্ট হয় মুক্তিযুদ্ধের কথা। মুক্তিযুদ্ধের শৈল্পিক প্রভাব পড়ে সাহিত্যের উপর। সাহিত্য বহতা নদীর মত অস্থিতিশীল। নদীর মত সাহিত্যেরও রয়েছে অসংখ্য শাখা প্রশাখা। যদিও রবীন্দ্রনাথ বলেছেন: ‘সৃষ্টির ন্যায় সাহিত্যই সাহিত্যের উদ্দেশ্য। রবীন্দ্রনাথের এই উক্তিকে অস্বীকার করা যায় না। তবুও আমরা কোন কোন ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রমও লক্ষ্য করি। একটু লক্ষ্য করলেই আমাদের সামনে উদ্ভাসিত হয় উদ্দেশ্যও অনেক সময় মহৎ সাহিত্যের সৃষ্টি করে। তাই আমরা সাহিত্যের গবেষণায় দেখতে পাই সাহিত্যের অনেকটা অবয়ব জুড়ে আছে প্রকৃতি, রাজনীতি, সমাজ, ধর্ম এবং এর বড় একটা অংশ জুড়ে আছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। যদিও মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক সাহিত্যের যাত্রা সত্তর দশক থেকে তবুও আমাদের সাহিত্যে এর গতি স্বতন্ত্র।
কথাসাহিত্যে সেলিনা হোসেন আমাদের আলোচ্য বিষয়। কিন্তু কেন যেন মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ, ভাষা আন্দোলনের প্রসঙ্গ উত্থাপিত হলেই সেলিনা হোসেন সেখানে আবশ্যিক অনুসঙ্গের মাধ্যমে শত রঙে রঙিন হয়ে সাহিত্যের ক্যানভাসে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হন।

আমাদের উপন্যাসে বিভিন্নভাবে মুক্তিযুদ্ধ এসেছে। রামুরাইদের বাকা তরবারি এবং চন্দ্রমল্লিকা ফুল জাপানীদের কৃষ্টি। রাশানদের গর্ব তাদের বিপ্লব এবং আমাদের গর্ব হচ্ছে একুশ-মুক্তিযুদ্ধ। বিশ্ববিখ্যাত রাশান উপন্যাসিক টলস্টয়ের ওয়্যার এন্ড পিস এবং এরেন বুর্গের ফল অব প্যারী হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক উপন্যাস। দুটো উপন্যাসই মহৎ এবং কালজয়ী সৃষ্টি। প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে নিয়ে বিশ্ব সাহিত্যের অসংখ্য গল্প উপন্যাস লেখা হয়েছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রচ- সম্ভাবনার দুয়ারেও ঔপন্যাসিকগণ পদচারণার শ্বাশত পদক্ষেপ রেখেছেন। তাদের ছিল অসীম সাহস আর শক্তি। তাই তো সেদিন আমরা পেয়েছিলাম জহির রায়হানের হাজার বছর ধরে, আবু ইসহাকের সূর্যদীঘল বাড়ী, শওকত ওসমান এর জননী। এগুলো ছিল গ্রামীন জীবন ভিত্তিক রচনা। আমাদের সাহিত্য নাগরিক উপন্যাসে ঋদ্ধ হয় আবুল ফজলের জীবন পথের যাত্রী, আবু রুশদ এর সামনে নতুন দিন রশিদ করিমের উত্তম পুরুষ, প্রষন্ন পাষান, আমার যত গ্লানি, র মাধ্যমে।

পঞ্চাশ দশকে বাংলাদেশ উপন্যাসে সমুজ্জ্বল হয়ে ওঠে, যা নানা পরিবর্তন ও বিবর্তনের মধ্যে সৃষ্টিশীলতায় আজও প্রবাহমান। বাংলাদেশে উপন্যাসের পালাবদলের যে ধারা তা লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাই, আমাদের উপন্যাসের অধিকাংশই সময়ের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। এই সময়ের স্রোত বেয়ে আসে মুক্তিযুদ্ধ, সৃষ্টি হয় মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক উপন্যাস। মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক উপন্যাসসমূহের মধ্যে শহীদ আনোয়ার পাশার রাইফেল রোটি আওরাত, শওকত আলীর যাত্রা, শওকত ওসমানের নেকড়ে অরণ্য, জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলি, রশীদ হায়দারের খাঁচায়, সেলিনা হোসেনের হাঙ্গর নদী গ্রেনেড, গায়ত্রী সন্ধ্যা, ত্রয়ী, কাকতাড়–য়া, মাহবুবুল হক এর জীবন আমার বোন, রিজিয়া রহমান এর বং থেকে বাংলা, রাবেয়া খাতুনের মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী, শাহিদা খাতুনের যুদ্ধে যুদ্ধে নয় মাস, জোবাইদা গুলশান আরার সুবাস ফেরেনি, হাসনাত আব্দুল হাই এর নিখোঁজ, রফিকুন্নবীর পিস্তল, আন্দালিব রুশদীর সুসময়, মঈনুল আহসান সাবেরের সতের বছর পর, রশীদ হায়দারের নদী ও বাতাসের খেলা, হুমায়ুন আহমেদ এর নন্দিত নরকে, নির্বাসন, জ্যোৎনা ও জননীর গল্প এবং ইমদাদুল হক মিলন লিখেছেন কালো ঘোড়া, পরাধীনতা যা উল্লেখযোগ্য। বাংলা উপন্যাসের এই বিশেষ ধারাটি মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ ফলশ্রুতি। ১৯৪৭ থেকে ২০১৬ খ্রি. পর্যন্ত বাংলাদেশের উপন্যাসে যে ধারা প্রবাহমান তা নব দিগন্তে সৃষ্টিশীলতায় উৎসারিত।

মুক্তিযুদ্ধ উত্তর বাংলা কথাসাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ এবং অনন্য শিল্পঘনিষ্ট কর্ণধর সেলিনা হোসেন (১৪ জুন, ১৯৪৭ খ্রি.) রাজশাহীতে তাঁর পৈতিক নিবাস লক্ষীপুর জেলার হাজির পাড়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা এ. কে মোশারফ হোসেন, মাতা মরিয়ম-উন-নিসার নয় সন্তানের মধ্যে চতুর্থতম। শৈশব ও কৈশোর কেটেছে করতোয়া ও পদ্মা বিধৌত নদী অববাহিকা রাজশাহী শহরে। দুই নদীর মাতোয়ারা স্রােত তাঁকে উদার বানিয়েছে। জীবন শিখিয়েছে।

‘রাজশাহীর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন শেষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাকোত্বর ডিগ্রি অর্জন করেন। বিশ্ববিদ্যালের অধ্যয়নের সময় প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ততা যেমন ছিল, ততোধিক আগ্রহ ছিল সাহিত্যে। ১৯৬৯ সালে ছোটগল্প বিষয়ে প্রবন্ধ রচনার জন্য সেলিনা হোসেন ড. এনামুল হক স্বর্ণপদক লাভ করেন। জীবনের নানামাত্রিকতায় তিনি অনুধাবন করেছেন সমাজ, রাষ্ট্র ও পরিবেশকে।
সেলিনা হোসেন। এক বাংলাদেশের নাম। আপার সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল সম্ভবত ২০০৬ খ্রি. ১৩ ডিসেম্বর। ঢাকাতে একটি নারী নেতৃত্বের অনুষ্ঠানে আপা উদ্বোধক এবং প্রধান অতিথি ছিলেন। সেখানে আমি বিশেষ অতিথি ছিলাম। বলা যায় প্রধান অতিথি হিসাবে আপার নামটি দেখেই আমি সুদূর যশোর থেকে ঢাকার এই অনুষ্ঠানে ছুটে আসি। আপাকে খুব কাছ থেকে দেখব বলে। সেই অনুষ্ঠানে আমি আমার নির্ধারিত বক্তব্য শেষে আমার লেখা ‘নারী’ কবিতাটি আবৃত্তি করি। আপা আমার কবিতা শুনে আবেগে আপ্লুত হয়ে আদর করে বলেছিলেন- শাহনাজ, কবি, আমি তোমাকে ঈর্ষা করি। আমি লজ্জ্বায় আনত মুখে জিজ্ঞেস করি- কেন আপা? আপা বলেছিলেন- ‘তুমি উপন্যাস লেখো, গদ্য লেখো আবার চমৎকার কবিতা লেখো এবং ততোধিক সুন্দর আবৃত্তি করো। আমি কবিতা লিখতে পারি না।’ এটুকু বলে আপা স্বভাবসুলভ হাসিতে ভরিয়ে দিয়েছিলেন চারপাশ। তার হাসির রেশ এখনো আমার কানে চুঁয়ে চুঁয়ে পড়ে। আমি অনুপ্রাণিত হই। ঋদ্ধ হই। আপার সাথে আমার প্রথম সেই পরিচয়। আপার প্রতি আমার বিশেষ কৃতজ্ঞতা তৈরি হয়।
দীর্ঘ সময় শেষে এ বছর ২০১৭ খ্রি. আমার দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘পরিবার পাবলিকেশন্স’ থেকে প্রকাশিত বাইশটি ছোট গল্পের সমাহার একাত্তরের আগুন সময় আপাকে উৎসর্গ করি। সেটি আমার আনন্দ। আমার ভাললাগা। তাতে আপার কিছুই এসে যায় না। আমি তার পাঠক দীর্ঘ সময় থেকে। তাঁর প্রথম উপন্যাস জলোচ্ছ্বাস (১৯৭২ খ্রি.) থেকে শুরু করে হাঙর নদী গ্রেনেড (১৯৭৬ খ্রি.) মগ্ন চৈতন্যে শিস (১৯৭৯ খ্রি.) যাপিত জীবন (১৯৮১ খ্রি.) নীল ময়ুয়ের যৌবন (১৯৮২ খ্রি.), পদশব্দ (১৯৮২ খ্রি.), পোকা মাকড়ের ঘর বসতি (১৯৮৬ খ্রি.), নিরন্তর ঘন্টাধ্বনি (১৯৮৭ খ্রি.), ক্ষরণ ( ১৯৮৮ খ্রি.), কাঁটাতারে প্রজাপ্রতি (১৯৮৯ খ্রি.), গায়ত্রী সন্ধ্যা (১৯৯৪ খ্রি.), দীপান্বিতা (১৯৯৭ খ্রি.), যুদ্ধ (১৯৯৮ খ্রি.), একটি উপন্যাসের সন্ধানে (১৯৯৯ খ্রি.), যমুনা নদীর মুশায়রা (২০১১ খ্রি.)সহ অসংখ্য লেখা পড়বার সুযোগ হয়েছে। এছাড়াও কিছু গদ্য স্বদেশ পরবাসী (প্রথম প্রকাশ ১৯৮৫ খ্রি., দ্বিতীয় সংস্করণ ১৯৯৩ খ্রি.), একাত্তরের ঢাকা (১৯৮৯ খ্রি.) এবং নির্বাচিত গল্প মতিজানের মেয়েরা (১৯৯৫ খ্রি.)সহ প্রতিনিয়ত আপাকে পড়া হয়। পড়ছি দৈনিক পত্র পত্রিকায়। দেশ এবং দেশের বাইরের প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ায়।

প্রিয় পত্রিকা সমধারার ‘সেলিনা হোসেন মূল্যায়ন সংখ্যা’র জন্য সম্মানিত সম্পাদক প্রিয় কবি সালেক নাসিরউদ্দিন ভাই আমাকে একটি প্রবন্ধ লিখতে আমন্ত্রণ জানালে আমি আপাকে নিয়ে একটি গল্প লেখার কথা বলি। তিনি বিষয়টিকে ‘হাস্যকর’ বলে আমাকে প্রবন্ধ লিখতে বলেন। তবে ভবিষ্যতে আমার ইচ্ছে আছে আমি আপাকে নিয়ে একটি উপন্যাস লিখবো। কারণ একজন কবি বা সাহিত্যিক একটি বিশেষ সময়ের মানুষ মাত্র নন। তাঁরা সময়কে অতিক্রম করেন। ধারণ করেন সময়ের ঝিনুক মুঠোয়। তাঁদের জীবন ও সময় সাহিত্যেরই বিষয়। যে কারণেই, যেমন ভাবে তিনি কবি মির্জা গালিবকে নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন ‘যমুনা নদীর মুশায়রা’। এই উপন্যাসটি লিখবার জন্য তিনি ত্রিশ বছরের বেশি সময় ধরে তত্ব ও উপাত্ত্ব সংগ্রহ করেছেন। তিনি বহুবার দিল্লিতে গিয়েছেন। প্রথমে ১৯৯৬ খ্রি. তিনি কবি গালিবের জন্মস্থান আগ্রায় গিয়েছেন। ২০০০ খ্রি. এপ্রিল মাসে তিনি আবার দিল্লীতে গিয়েছেন। ফাউ-েশন অব সার্ক রাইটার্স অ্যা- লিটারেচার আয়োজিত সার্ক লেখক সম্মেলনে যেয়ে তিনি কবি গালিবের কবর দেখতে যান। সেখানে গালিবের কবরটি অযত্ন অবহেলায় দেখে তাঁর মন খারাপ হয়। কবরের পাশের লাইব্রেরী থেকে তিনি কিছু অনুল্লেখযোগ্য বই কিনে ফিরে আসেন। এবং তার পর থেকেই তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাবে কবি মির্জা গালিবকে নিয়ে রচিত বিভিন্ন ভাষার বিভিন্ন বই পুস্তক সংগ্রহ করেন এবং তা আত্মস্থ করেন। তিনি লিখেছেন, ‘অধ্যাপক আবু সায়ীদ আইয়ুব, লেখক গৌরী আইয়ুব, কবি গুলজার, গবেষক পবনকুমার ভার্মা, কবি শঙ্খ ঘোষ, কবি সৈয়দ শামসুল হক সকলের সঙ্গে এক হয়ে কবি গালিবকে বুঝতে চেয়েছি। এর দীর্ঘ উৎসর্গপত্র এবং নাতিদীর্ঘ ভ’মিকা দেখলেই বুঝতে পারি, তিনি কতটা ঋদ্ধ হয়েই তবে কবি মির্জা গালিবকে নিয়ে লিখেছেন।

তিনি নিজের জন্ম ও সাহিত্য সাধনা, জীবন পটভূমি সম্পর্কে সহজ স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। ‘১৪ জুন, ২০১৭। একাত্তর বছরে পা দিলাম। জন্মগ্রহণ করেছিলাম সাতচল্লিশ সালে। বড় হয়ে জেনেছি দেশভাগ হয়েছে। পাকিস্তান নামের একটি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। এই অর্থে আমি দেশভাগ দেখেছি। ভাষা আন্দোলন বুঝিনি। বাহান্নোর সেই সময়ে নিজের ভাষায় কথা বলেছি। কিন্তু মাতৃভাষার মর্যাদা বোঝার বয়স ছিল না। মহান মুক্তিযুদ্ধের একাত্তর আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। একাত্তর আমার জীবনের একটি সংখ্যা বা শব্দ মাত্র নয়। শব্দটি আমার অস্তিত্বের একটি অংশ। এ কারণে একাত্তর বয়সের সূচনার জন্মদিন আমি ভিন্নমাত্রায় দেখছি।
তার নিজের আত্মোপলব্ধি মূলক লেখা থেকেই বোঝা যায় তিনি একাত্তরকে-মুক্তিযুদ্ধকে এক অন্য উচ্চতায় নিজের জীবনের একটি অধ্যায় করে নিয়েছেন। তাঁর সর্বাধিক মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস রয়েছে।

সেলিনা হোসেনের প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে চল্লিশটি উপন্যাস, সাতটি গল্পগ্রন্থ এবং চারটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তার রচনা দুইবাংলার সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বের দরবারে উজ্জ্বল আলোক বিচ্ছুরণে বিভাসিত। তার গ্রন্থসমূহ ইংরেজি, ফরাসি, জাপানি, কোরিয়ান, ফিনিস, আরবি, মালয়ালাম, স্প্যানিশ, রুশ, মালেসহ বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়েছে। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় অবদানের স্বীকৃতিস্বরুপ তিনি বাংলা একাডেমি পুরষ্কার, একুশে পদক, রবীন্দ্র মেমোরিয়াল এ্যাওয়ার্ডসহ দেশি বিদেশি বিভিন্ন পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন। তিনি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডি.লিট প্রাপ্ত হয়েছেন। তার লেখা সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়র বিশিষ্ট অধ্যাপক ও সমালোচক বিশ্বেজিৎ ঘোষ লিখেছেন:

‘ইতিহাসের গভীরে সন্ধানী আলো ফেলে ঔপন্যাসিক প্রতিবেদন সৃষ্টিতে তাঁর সৃষ্টি কিংবদন্তিতুল্য। বস্তুত ইতিহাসের আধারেই তিনি সন্ধান করেন বর্তমানকে। শিল্পিত করার নানামাত্রিক শিল্প-উপকরণ। সমকালীন জীবন ও সংগ্রামকে সাহিত্যের শব্দস্রােতে ধারণ করাই সেলিনা হোসেনের শিল্প অভিযাত্রার মৌল অম্বিষ্ট। এক্ষেত্রে শ্রেণি অবস্থান এবং শ্রেণি সংগ্রাম চেতনা প্রায়শই শিল্পিতা পায় তাঁর ঔপন্যাসিক বয়ানে, তাঁর শিল্প আখ্যানে। কেবল শ্রেণি চেতনা নয়, ঐতিহ্যস্মরণও তাঁর কথাসাহিত্যের একটি সাধারণ লক্ষণ।

সেলিনা হোসেন আপাদমস্তক কথাসাহিত্যিক। উপন্যাসে তিনি ব্যবহার করেছেন ঐতিহাসিক উপাদান। এ সকল ঐতিহাসিক উপাদানকে তিনি সমকালীন বাস্তবতার নিরিখে সাহিত্যিক নির্মান করেছেন পারঙ্গমতায়। ইতিহাসকে ভেঙে নতুন সাহিত্য সৃষ্টির ধারায় তিনি রেখেছেন প্রাতিস্বিক প্রতিভার স্বাক্ষর। তার উপন্যাসে রাজনৈতিক সময়, আন্দোলন, নারীর শাশ্বত দৃষ্টি, সনাতন আদর্শ বজায় থাকে মেধার উজ্জ্বলতায়। তিনি স্বদেশ ও স্বজাতির ঐতিহ্যের প্রতি দৃঢ়। কোন অবস্থাতেই তিনি নিজস্ব ঐতিহ্যকে, নিজস্ব উত্তরাধিকারকে, মুক্তিকামী বাঙালির সংগ্রামকে ছোট করে দেখেন নি। তার রচনায় মুক্তিকামী মানুষের উত্তরাধিকার খুঁজে পেয়েছে নির্ভাবনায়, উচ্চতায়।

তাঁর রচনায় স্বাধীন ভূ-খন্ড, স্বায়ত্বশাষিত-বৈষম্যহীন সমাজ ও জাতীয় আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়গুলো উন্মোচিত হয় সাবলীল সংগ্রাম মুখর আকাঙ্খায়। তিনি তার নিজস্ব ভাবনায় ইতিহাসকে সমকালীন ভাবনার সাথে একত্রিত করে ইতিহাসের কঙ্কালেই নির্মান করেছেন সমকালের জীবনালাখ্যা। ইতিহাস ও শিল্পের রসায়নে তিনি একীভূত। ‘ইতিহাসের সাথে সমকালীন মানবভাগ্য বিমহিত করতে যেয়ে সেলিনা হোসেন অদ্ভুত এক নিরাশক্তিতে, উভয়ের যে আনুপাতিক সম্পর্ক নির্মান করেন, বাংলা উপন্যাসের ধারায় তা এক স্বতন্ত্র অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছে। তার উপন্যাস পাঠ করলে বিস্মৃত হতে হয় কোনটা ইতিহাস আর কোনটা কল্পনা।

তার উপন্যাস যে শুধু ইতিহাস এবং রাজনীতি নির্ভর তা কিন্তু নয়, তার উপন্যাসে জীবন ও সমাজ বাস্তবতার চমৎকার যোগসুত্র দেখতে পাই। ‘জীবন যেখানে যেমন’ সেলিনা হোসেন এই আদর্শে বিশ্বাসী। তাই তার লেখনীতে শিল্পমানের চেয়ে জীবনের রূঢ় বাস্তবতা চমৎকার ভাবে প্রাণ সঞ্চার করে। ইতিহাস এবং বাস্তব জীবনের পরতে পরতে যে মায়াবী জীবন, সংগ্রাম, উষ্ণতা, প্রেম, বিরহ, রিরংসা, ক্লেদ, ধ্বংস, ক্ষয়, মৃত্যু, সৃষ্টি, স্বপ্ন তার উপন্যাসে উপজীব্য করেছেন চরম পারঙ্গমতায়। যা সত্যি অনন্য। তার এই মৌলিকত্বই বাংলা সাহিত্যে তাকে অনন্য করেছে, অন্য এক উচ্চতার আসনে অধিষ্টিত করেছে।

ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে তার দুটি উপন্যাস। যাপিত জীবন (১৯৮১ খ্রি.) এবং নিরন্তর ঘন্টাধ্বনি (১৯৮৭ খ্রি.)। যাপিত জীবন উপন্যাসে সমকালীন রাজনীতি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের বস্তুরূপের সাফল্য নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি করা হলেও এ উপন্যাসে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাণপ্রবাহী সুর অনুরণিত হয়েছে। এ উপন্যাস উনিশ’শ সাতচল্লিশ থেকে বায়ান্নের একুশ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়কে ধারণ করেছে। আমরা জানি, সেলিনা হোসেন সময়ের ইতিহাসকে চরিত্রের মধ্যে প্রবিষ্ট করেন নিশ্চিন্ততায়, নির্ভাবনায়, সাবলীলভাবে। সেখানে ‘সময়’ই চরিত্র। সোহরাব হোসেন, মারুফ ও তার স্ত্রী সুমনা, জাফর, আঞ্জুম প্রতিটি চরিত্র পারিবারিক জীবনের দৈনন্দিনতার ভেতরে নিজস্ব মূল্যবোধ ও রুচির চর্চা করতে যেয়ে ইতিহাসকে নিজেদের জীবনে জড়িয়ে ফেলেছেন অতপ্রোত। সেখানে রাষ্ট্রের সংগ্রামের সাথে নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনের সম্পৃক্ততা রয়েছে। চরিত্রগুলো সমস্ত ঘটনার সাক্ষী হয়ে চলন্ত জীবনপঞ্জিতে নড়াচড়া করে, সমস্ত ঘটনার কেন্দ্রিক চরিত্র হয়ে যায়। এখানেই সেলিনা হোসেনের মুন্সিয়ানা। যাপিত জীবন উপন্যাস প্রসঙ্গে প্রথমা রায় মন্ডলের মন্তব্যটি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য:
‘নতুন দেশে জীবন যাপন শুরু হয় নতুন অস্তিত্বে। ব্যক্তিগত ভালোবাসা ও স্বদেশপ্রেমে একাকার হয়ে বাঙময় হয়ে ওঠে; সঙ্গে আসে সমকালীন-আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট ও রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্ত। উপন্যাসের সূচনায় যে ভয় ভীতির চিত্র উদ্ভাসিত হয় তা থেকে বেরিয়ে আসবার মধ্য দিয়ে উপন্যাসের পরিসমাপ্তি।’

নিরন্তর ঘন্টাধ্বনি মধ্যবর্তী শ্রেণির প্রস্তুতিকাল এবং সাংস্কৃতিক বিপ্লবে তাদের উত্থানের সাফল্য দেখানো হয়েছে। ঐতিহাসিক চরিত্র ‘সোমেন চন্দ’ বিকাশের মধ্য দিয়ে নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন। এ উপন্যাসে ঢাকার আন্দোলনের পটভূমিতে ভাষা আন্দোলনে প্রগতিশীল মধ্যবিত্তের যে ভূমিকা- তা দেখানো হয়েছে। এ উপন্যাসটি দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের কিছু পূর্বকাল থেকে শুরু করে ১৯৫৩ সালে জেলখানায় বসে মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ নাটক লেখা পর্যন্ত বিস্তৃত। নিরন্তর ঘন্টাধ্বনি র কেন্দ্রীয় চরিত্র ছাত্রনেতা মুনিম বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রনেতা। আসাদ, সালাম, রাহাত, বেণু, নীলা, রেণু এরা উপন্যাসের মূল কাহিনীর সাথে কেন্দ্রীয় ভ’মিকায় সহায়ক চরিত্র হিসাবে কাজ করেছে। মাত্র তিন দিনের ঘটনা প্রবাহে আমরা দেখতে পাই একুশের চেতনা কিভাবে তিমির বিনাশী আয়োজনে প্রগতিশীল ছাত্রদের আগামীর পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। তিন দিনের কাহিনীতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শোষক গোষ্ঠীর নিপীড়ন, দমমনীতি, পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শোষকগোষ্ঠীর নিপীড়ন ও দমননীতির পাশাপাশি মুক্তিকামী বাঙালির অপ্রতিরোধ্য সাহসিকতা যেমন ফুটে উঠেছে তেমনি বাঙালির চেতনাকামী ঐতিহ্য কিভাবে উত্তরাধিকার খুঁজে পেয়েছে তা বিধৃত হয়েছে। এ উপন্যাসের কাহিনী আবর্তিত হয়েছে ঢাকাকে কেন্দ্র করে। এখানে রাজনীতি ও ইতিহাসের পাশাপাশি ব্যক্তিগত অনুভব, ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের পথ এক প্রেমময় আবহের মধ্যে পূর্ণতা পেয়েছে। এখানেই সেলিনা হোসেনের সার্থকতা।

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক তার হাঙ্গর নদী গ্রেনেড (১৯৭৬ খ্রি.), গায়ত্রী সন্ধ্যা, ত্রয়ী (১৯৯৪-৯৬ খ্রি.), কাকতাড়ুয়া (১৯৯৬ খ্রি.) চারটি উপন্যাস। চারটি উপন্যাসের মধ্যে কাকতাড়ুয়া কিশোর উপন্যাস। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসের মাধ্যমে সাধারণ জনগণের জাগরণটাকেই তিনি ধরতে চেয়েছেন, দেখিয়েছেন। হাঙর নদী গ্রেনেড তাঁর প্রত্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস। এ উপন্যাসটি লিখতে তিনি সমকালীক স্থানে বার বার স্বশরীরে গিয়েছেন। তত্ব উপাত্ত্ব গ্রহণ করেছেন। উপন্যাসটি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র একটি পূর্ণদৈঘ্য সফল চলচ্চিত্র নির্মান করেছে। উপন্যাসে হলদী গাঁয়ের মানুষের মুক্তিযুদ্ধে সম্পৃক্ততা, সলীমের যুদ্ধে যাওয়া, কলিমের আহত হওয়া, বোবা রইসের অদম্য প্রতিরোধের তীব্রতায় আবর্তিত হয়। এ উপন্যাসে প্রধান শক্তি বুড়ির মাতৃত্ব। দেশপ্রেমের কাছে পরাজিত হয় সে মাতৃত্ব। মাতৃত্বকে অতিক্রম করে বোবা সন্তান রইসের হাতে যুদ্ধে ব্যবহৃত এল.এম. জি তুলে দিয়েছে। মুহূর্তে মুক্তিযোদ্ধাদের বাঁচানোর জন্য নিজের সন্তানকে নিশ্চিত মৃত্যূর সামনে ঠেলে দিয়েছে। হলদী গাঁয়ে বুড়ির পরিবারসহ সাধারণ অধিবাসীর যে স্বাধীন দেশের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবার জন্য ত্যাগ তা অতি নিখুঁত চিত্রে তিনি তুলে এনেছেন। এখানে বুড়ি শুধু তাঁর সন্তানের মা নন, বরং সকল বীর মুক্তিযোদ্ধার মা, শহীদ জননী।

গায়ত্রী সন্ধা উপন্যাসের কাহিনী সাতচল্লিশের দেশভাগ থেকে শুরু হয়ে পচাত্তরের স্বাধীন বাংলাদেশের সিভিল শাসকের পতন পর্যন্ত বিস্তৃতি পেয়েছে। তেইশ বছরের পাকিস্তানী শাসকের নিগড় থেকে মুক্তির প্রক্রিয়া তার কার্যকরণ সূত্র, স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম, তার রাজনৈতিক নেতা, নেতৃত্বের ইতিহাসবিদ্ধ হওয়া উপন্যাসের অন্তঃপ্রবাহের চরিত্র উপন্যাসে বিধৃত হয়েছে। স্বাধীন দেশের দুরূহ পুনর্গঠন, দুর্ভিক্ষ, অব্যবস্থাপনার সুযোগে অপশক্তির হাতে দেশনায়ক বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু; সব মিলিয়ে সিভিল শাসনের অপমৃত্যুর মধ্যদিয়ে উপন্যাসের সমাপ্তি ঘটেছে। কাকতাড়ুয়া কিশোর উপন্যাসে বুধা নামের এক অনাথ কিশোরকে কেন্দ্র করে এক যথার্থ কাহিনী গড়ে উঠেছে। যা পুরো বাংলাদেশের চিত্র। যেখানে যুবক, বৃদ্ধ, কিশোর কেউ এই মহতী যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে বাদ যায় নি। তার মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসগুলোতে দেখিয়েছেন যেমনভাবে একজন পুরুষ মুক্তিযোদ্ধা তার সর্বস্ব দিয়ে যুদ্ধ করেছেন, তেমনি একজন নারী মুক্তিযোদ্ধাও তাঁর সর্বস্ব দিয়ে যুদ্ধ করেছেন, যুদ্ধ করেছেন একজন কিশোরও।

সেলিনা হোসেনের যমুনা নদীর মুশায়রা কবি মির্জা গালিবকে নিয়ে লেখা ভিন্নধর্মী এক বৃহৎ পরিসরের উপন্যাস। ৩৯৯ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটিতে তিনি কবি মির্জা গালিবকে নানান বৈচিত্রে উপস্থাপন করেছেন। মির্জা গালিব উপমহাদেশের একজন শক্তিশালী কবি। তাঁর জীবন নানা বৈচিত্রে ভরপুর। ইতিহাসের ক্রান্তিকালে এই কবিকে নিয়ে রচিত যমুনা নদীর মুশায়রা পাঠকের এক অন্য ধরনের তৃষ্ণা মিটিয়েছে। বলা যায়, এই উপন্যাস পড়তে পড়তেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আপাকে নিয়ে আমি একটি উপন্যাস লিখবো। সে জন্যই আপার লেখাগুলো আমি নিরন্তর পড়ে চলেছি। আশা করছি খুব শীঘ্রই আমি এই কাজটিতে হাতে দিতে পারবো।

সেলিনা হোসেনের যমুনা নদীর মুশায়রা উপন্যাসে তিনি ইতিহাসের সঙ্গে সাহিত্যের যথার্থ মিশ্রণ ঘটিয়েছেন। সাহিত্যের সেই শিল্পকে, যে শিল্পকাহিনীর ভেতর মানুষের আবেগের জায়গার শক্ত বাঁধুনী তা অত্যন্ত পারঙ্গমতার সাথে এঁকেছেন। মির্জা গালিবকে নিয়ে নানান ধরনের পুস্তক রচিত হয়েছে। তাঁকে নিয়ে পৃথিবীর নানান সৃজনশীল মানুষ রচনা করেছেন তাদের কাব্য, তাদের কথাশিল্প। কারণ তাঁর জীবনদর্শনের নানা দিক আকৃষ্ট করেছে নানাজনকে নানাভাবে।
আবু সায়ীদ আইয়ুব বলেছেন, ‘গালিব উর্দু ভাষার দুরহতম কবি।’ তিনি গালিবের উদ্বৃতি দিয়েছেন ধর্ম সম্পর্কে। গালিব বলেছেন, ‘ আমি একেশ্বাবরদী, সর্ব প্রকার আচার অনুষ্ঠান বর্জন করাই আমার নীতি। ধর্ম সম্প্রদায়গুলো লুপ্ত হলে সত্য ধর্মের উপাদান হয়ে যাবে।’ গালিবের অনুপুঙ্খ নানা বিবরণ একজন অসাধারণ শক্তিশালী কবির মানস -দর্শন প্রতিফলিত হয়েছে এই উপন্যাসে। বিষয় বৈচিত্রের জন্য পাঠকের আকাক্সক্ষা নানা মাত্রিকতায় পূর্ণতা পেয়েছে। এই উপন্যাসের শেষে তিনি যেসব গ্রন্থের উল্লেখ করেছেন সেসব গ্রন্থের কয়েকটিতে গালিবের কবিতার সরাসরি অনুবাদ আছে। এ সম্পর্কে সেলিনা হোসেন লিখেছেন, ‘উপন্যাসের শেষে যেসব গ্রন্থের উল্লেখ করেছি সেসব গ্রন্থের কয়েকটিতে গালিবের কবিতার অনুবাদ আছে। সেখান থেকে আমি কবিতাগুলো সংগ্রহ করে এই উপন্যাসে ব্যবহার করেছি। আবু সায়ীদ আইয়ুবসহ সকল অনুবাদকের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।’ এই উপন্যাসে সেলিনা হোসেন অধ্যায়ভিত্তিক উপশিরোনামের মাধ্যমে উপন্যাসটিকে পাঠকের সামনে আরো সহজবোধ্য করে উপস্থাপন করেছেন।

শৈশবের নদী, শহরের বর্ষা-বসন্ত, কুঠুরি ও বারান্দা, পথের যাত্রায় দিনের সূচনা, ঘোড়ার খুরের শব্দ, মৃত্যুর মুশায়রা, তবুও অসীম আকাশ, দিনের শেষ ছায়া, শেষ হয়ে যায় বসন্তের দিন এই নয়টি উপশিরোনামের মাধ্যমে তিনি উপন্যাসের বিভিন্ন সময় এবং ঘটনাকে উপস্থাপন করেছেন। উপন্যাসটি ১৭৯৭ খ্রি. এর ২৭ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়ে ১৮৬৯ খ্রি. এর ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দীর্ঘ বিস্তৃতি পেয়েছে। শুরুটা খুব চমৎকার। এখানে রজব হুসেন জং। তাঁর এক ধরনের গর্ববোধ আছে, যেটি জাহির করেন তার চার স্ত্রীর উপর। যিনি দিনের শুরুতে সে দিনের তারিখটা মাথায় রাখেন। লিখে রাখেন। দিনের প্রথম সূর্যরশ্নিতে যমুনা নদীর পাড় ধরে হেঁটে যেতে ভালবাসেন। তাজমহলের ছায়াবুকে আগ্রাবাসীর ভালবাসায় যার দিনের শুরু। দিনের শুরু, সারাটা দিন, মধ্যাহ্ন, অপরাহু, সূর্যাস্ত এবং শেষ পর্যন্ত জীবনের শেষ পর্যন্ত সেলিনা হোসেন কি গভীর মমতায়, ভালবাসায়, হিসাবে, রাজনৈতিক দর্শন, সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল, প্রেম, ভালবাসা, বিরহ, ক্লেদ, সামাজিকতা, পারিবারিক জীবন, দুঃখ-দুর্দশা, অভাব দারিদ্রতা, প্রাচুর্য বেহিসেবী জীবনকে তিনি চিত্রের পর চিত্র, রঙের ওপর রঙের পরত দিয়ে যেন পৃষ্ঠার পরে পৃষ্ঠা ছবি এঁকেছেন। উপন্যাসটি পড়া শুরু করলে ক্রমান্বিক পড়ে যেতে হয়। একটিবারও দম ফেলবার ফুরসত থাকে না পাঠকের। কি অপূর্ব রচনাশৈলী!

কবির জীবনের শুরু থেকে শুরু করে শেষ দিন পর্যন্ত পুঙ্খানুপুঙ্খু লিখেছেন। কবির শেষ শয়নে স্নিগ্ধ জানাজায় যোগ দিতে এসেছেন শোকার্ত মানুষ। কিন্তু তাদের হৃদয়ে স্নিগ্ধতার স্পর্শ নেই। ‘তখন শিয়া সম্প্রদায়ের একজন বললেন, মির্জা সাহেব শিয়া ছিলেন। তাই শিয়া প্রথা অনুসারে তাঁর দাফন করতে চাই। নওয়াব জিয়াউদ্দিন খান দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, আমার চেয়ে বেশি আর তাঁকে কে চেনে? আমার কিশোর বয়স থেকে আমি তাঁকে চিনে। তিনি সুন্নী মুসলমান ছিলেন। তাঁর শেষ কাজ সুন্নী মতে হবে। এ থেকেই বোঝা যায় মির্জা গালিবের জীবন নানা বৈচিত্রে বৈচিত্রময় ছিল এবং শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি মানুষের ভালোবাষায় রঞ্চিত হয়েছেন। তাঁর শেষ ‘শের’ এ তিনি লিখেছেন-
‘বন্ধু, তোমাদের পুষ্পাদ্যানে আমি
এক আগাছা
যদি চলে যাই
দুঃখ পেয়ো না।
সাইপ্রাস ও সুগন্ধী ফুল
তোমরা, আমি নই।
যদি ভালোবাসা নাও থাকে
তবু বাহবা দিও উচ্চকণ্ঠে,
যে কবিতা তোমাদের দিলাম
তার শেষ পারিশ্রমিক
দিতে ভুলো না।
জানি ভুলে যাবে
বন্ধুজন আনন্দ সমাবেশে
হয়ত পড়বে মনে কোনওদিন
কোনও কবিতার মজলিসে।’
বাংলা কথাসাহিত্যে সেলিনা হোসেন প্রকৃতভাবে একটি নিজস্ব কণ্ঠস্বর তৈরি করেছেন নিজস্ব পারঙ্গমতায়। সাহিত্যিক হিসাবে তিনি কখনোই নিজের সামাজিক দায়বদ্ধতাকে ভুলে যান নি, উপেক্ষা করেন নি। তাই আমরা তাঁর রচনায় সামাজিক অঙ্গিকার, পরিবর্তনের দায়বদ্ধতা, প্রগতিশীল মানসিকতা এবং শিল্পের সহনশীলতা, নারীর ব্যক্তিক এবং একই সাথে ব্যক্তিত্বের গভীর স্বাধীনতা উপভোগ করি নান্দনিকতায়। তার শৈল্পিক চেতনায় সব সময় ইতিহাসের দায়বদ্ধতা জড়িয়ে থাকে পুঙ্খানুপুঙ্খু। ইতিহাসের সাথে সময়কে উপভোগ্য করে সাহিত্যিক পথচলাকে নির্মান করেছেন ঐতিহাসিক মানদন্ডে। তাই সেলিনা হোসেন সর্বক্ষণ আমাদের প্রেক্ষিতে পরিণত হয়েছেন। তার সর্বাঙ্গীন পথচলা হোক মধুর।

 

ড. শাহনাজ পারভীন
কবি, গবেষক, কথাসাহিত্যিক, উপাধ্যক্ষ, উপশহর মহিলা কলেজ, যশোর

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top