সিডনী রবিবার, ৫ই মে ২০২৪, ২২শে বৈশাখ ১৪৩১

নীরা : অমিতা মজুমদার


প্রকাশিত:
২৪ জুন ২০২০ ২০:১৬

আপডেট:
২৬ জুন ২০২০ ২১:৪৫

 

মা মরা মেয়ে নীরা বাবা ভাইয়ের সংসারে আর পাচটা মেয়ের মতো বড় হচ্ছিল বলা যাবেনা। সেকালে যেমন অলিখিত নিয়মেই ঘরসংসারের দায়িত্ব মেয়েদের ছিল, নীরার বেলায়ও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। মাতৃহীন নীরা বালিকা বয়সেই সংসারের ঘরনী হয়ে উঠেছিল। প্রতিদিন সংসারের সব কাজ সেরে বাবা-ভাইদের জন্য রান্নাবান্না করে সে স্কুলে আসতো। এভাবেই সে দশমশ্রেনী অতিক্রম কওরে এস এস সি পরীক্ষার জন্য নির্বাচিত হয়।গ্রামের এক প্রান্তে নীরাদের বাড়ি। বেশ স্বচ্ছল পরিবার। নীরার গায়ের রঙ ময়লা ততোটা নয়, মুখ চোখের গড়ন তেমন আকর্ষনীয় নয় সেকারনেই হোক বা মাতৃহীন নীরা সমবয়েসিদের তুলনায় একটু প্রগলভ কম বলে তার তেমন বন্ধু ছিলনা। আবার তার প্রতি কেন যেন কোন ছেলেও আগ্রহ দেখাতোনা। তাতে নীরারও কিছু যেত আসতোনা। কেবল নীরার বাবা সারাক্ষন কারনে অকারনে নীরাকে শাপ-শাপান্ত করতেন। যদি মায়ের মতো হতি তবে এতোদিনে দু-একটা সম্বন্ধ আসতো। এরপরেতো কোন ছেলে বিয়ে করবেনা। নীরার দাদাও প্রায়ই বলতে ছাড়েনা, তার বিয়ে আটকে আছে নীরার জন্য।ঘরে সোমত্ত বোন রেখে বিয়ে করা যায় নাকি? খালি ছোট ভাইটা তেমন কিছু বলেনা।

এরই মধ্যে এসে পরলো মার্চ মাস। সব কেমন বদলে যেতে লাগলো। পরীক্ষা হবে কিনা কেউ বলতে পারছেনা। এদিকে গ্রামের লোকজন একে একে যেন কমতে শুরু করলো। সবার মধ্যে একটা গোপনীয়তার ভাব। এর মধ্যেই ২৭ শে মার্চ গ্রাম লাগোয়া শহরে আগুণ দিলো পাক হানাদারেরা। শোনা গেল শহরের অনেক মানুষকে গুলি করে মেরেছে। শুরু হয়ে গেলো মুক্তিযুদ্ধ। গ্রামের শান্ত নিরীহ মেয়ে নীরাও একদিন বাবা ভাইয়ের হাত ধরে গ্রাম ছেড়ে অজানার উদ্দেশ্যে পথে নামে।যুদ্ধ শেষে স্বাধীন দেশে নীরা আবার গ্রামে ফিরে আসে বাবা ভাইয়ের সাথে।

গল্পটা তারপর এরকম হলে সাদামাটা হলে হয়তো ভালো লাগতো।

কিন্তু তেমনটা ঘটেনি। পথে যেতে যেতে নীরা কেমন করে যেন মিশে যায় একদল সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধার দলে। তারপর নয়মাস যুদ্ধ করে পুরুষ যোদ্ধাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। সেই শান্ত নীরার এমন রূপ নিজের চোখে দেখেও কেউ বিশ্বাস করতে পারছিলোনা। যে নীরাকে গ্রামের উঠতি বয়সের ছেলেরা অযথাই বিরক্ত করতো কিন্তু নীরা প্রতিবাদ করার সাহস করতোনা। সেই নীরা অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করেছে! 

হ্যা যুদ্ধ শেষে নীরা নাকি এসেছিল বাড়িতে কিন্তু রাতের আধারে।ভোরের আলো ফোটার আগেই তাকে চলে যেতে হয়েছে কাকপক্ষীতেও টের পাওয়ার আগে। যে মেয়ে নয়মাস যুদ্ধ করেছে, কোথায় কিভাবে থেকেছে কেউ জানেনা তাকে কিকরে বাড়িতে রাখে! সমাজ সংসার বলেতো একটা কথা আছে। নীরা সেই রাতের আঁধারে নিঃশব্দে চলে যায়। আর ফিরে আসেনি। শোনা গিয়েছিল সেই রাতে নীরা গিয়ে উঠেছিল এক দিনমজুর সহযোদ্ধা মতিউরের বাড়িতে। পরে জীবন জীবিকা আর নিজের নারী শরীরের নিরাপত্তার খাতিরে ঘর বেধেছিল সেই সহযোদ্ধার সাথে। সেখানেও তার যোগ্য সম্মান মেলেনি। যে যুদ্ধের ময়দানে তারা ছিল সাথি, তাদের মধ্যেই সম্পর্কটা দাড়ায় আশ্রয়দাতা আর আশ্রিতের। বিয়ে নামক চুক্তির বিনিময়ে প্রভু ভৃত্যের।জাগতিক নিয়মেই দুই সন্তানের মা হয় নীরা। তারপর একদিন নীরার স্বামী নামক প্রভু ঘরে নিয়ে আসে আর একটি বছর পনেরোর মেয়েকে নিকা করে। কারণ নীরাকে তখন আর পরিবার বলে সমাজে চালাতে পারছিলনা মতিউর। পরিবার হবে একটু নরম, শরম থাকবে তার চলনে বলনে। কিন্তু নীরার রাইফেল ধরা হাত আর শত্রুর সাথে যুদ্ধ করার সময়ে যে চোয়াল একবার শক্ত হয়েছে তাতে কমনীয়তার পুনরাগমন হয় কি করে? তাই নীরার জায়গা হয় মতিউরের বাড়ির সীমানা ঘেঁষে একটা ছোট্ট কুড়েঘরে। দুই ছেলেকে নিয়ে শুরু হয় অন্য আর এক জীবন। নীরার আর আপন ঘর হয়না, হয়না বাপের ভিটায়ও ফেরা।

এভাবেই কেটে যায় কতোগুলো বিজয় দিবস, কতোগুলো স্বাধীনতা দিবস তার হিসেব নীরা ইচ্ছে করেই রাখেনি। কারন সব বিজয়দিবসে, স্বাধীনতা দিবসে মতিউরকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়, কিন্তু নীরার কথা কেউ জানেইনা। মতিউরও কোনদিন বলেনি কিভাবে শত্রুর গুলির মুখ থেকে নীরা তাকে বাঁচিয়ে এনেছিল।

একদিন নীরার ছেলেরাও কেন যেন নীরাকে ছেড়ে চলে যায় একটু বড় হওয়ার পর।

কোন এক ষোলই ডিসেম্বরের সকালে যখন একুশবার তোপধ্বনির সাথে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়াচ্ছিল বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিউর আর দেশবরেন্য ব্যক্তিরা। ঠিক সেইসময় এক অর্দ্ধনগ্ন, জরাব্যধিগ্রস্ত, মানষিক ভারসাম্যহীন বেওয়ারিস লাশের অস্থিচর্মসার দেহ নিয়ে টানাটানি করছিল কয়েকটি রাস্তার কুকুর। 

 

(গল্পটা লেখা হয়েছে আংশিক সত্যি ঘটনা অবলম্বনে)

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top