সিডনী মঙ্গলবার, ৭ই মে ২০২৪, ২৪শে বৈশাখ ১৪৩১

মিহিকা : আফরোজা অদিতি


প্রকাশিত:
৩০ জুন ২০২০ ২৩:৫১

আপডেট:
১ জুলাই ২০২০ ০০:১১

 

কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান ভালোই লাগলো। এই করোনাকালে রোজ রোজ উপস্থিত থাকতে পারে না; মাঝেমধ্যে যোগ দেয়! এই সময়ে তো বাইরে যাওয়া ওর পক্ষে কঠিন! যেতেও পারে না। কোন অনুষ্ঠান তো দূর; পরিচিতজনদের কাউকেই দেখতে যেতে পারে না! সেই প্রথম যখন ‘লকডাউন’ শুরু হয় তখন থেকেই বেশকিছু গ্রুপ হয়েছে যেখানে পুরাদমে সাহিত্যচর্চা হয়! মাঝেমধ্যে নেট-বিভ্রাটে ঘরে ঠিকঠাক নেট পাওয়া যায় না তাই যেদিন অন-লাইন সাহিত্যসভাতে অংশ নেয় সেদিন ছাদে আসে মিহিকা। প্রতিদিন কেন যেন ভালো লাগে না; এতো মৃত্যু সহ্য করতে পারে না! করা কঠিন। বিশ্বের অনেক দেশ থেকে ওর দেশে মৃত্যুহার কম তবুও ভালো লাগে না। ভালো লাগে না মৃত্যুর মিছিল; ভালো লাগে না লাফিয়ে লাফিয়ে ওঠা আক্রান্তের খবর! মনের ওপর চাপ সহ্য করতে পারে না মিহিকা! টেলিভিশন তো দেখেই না এখন খবরের কাগজ পড়াও প্রায় ছেড়ে দিয়েছে! দেখলে-শুনলে মনটা খারাপ হয়ে যায়! বুকের মধ্যে টইটুম্বর জল খলবল করে! সেই জলে টুপটাপ বৃষ্টিধারার ফোঁটা ঝরে। যখন খুব কষ্ট বাড়ে তখন কবিতা পড়তে ইচ্ছা করে মিহিকার; কবিতার মধ্যে ডুবে যেতে ইচ্ছা করে; তখন মনে হয় বিশ্বসংসারের সব কিছু ছেড়ে কাব্যপ্রেমে পথ হাঁটতে; শুধুই হাঁটতে আর কাব্যবৃষ্টিতে ভিজতে! আজ ওর মনের অবস্থা সেই রকম! কিছুই ভালো লাগছে না! কিছুই না!

কবিত পড়া শেষ করে গ্রুপ থেকে বেরিয়েছে; দেখছে রাতের আকাশ। বেশিরভাগ সময় মেঘলা থাকায় আকাশে তারা-নক্ষত্র খুব
কম দেখা যায় এই সময়। আকাশে চাঁদ আছে; এখনও কিশোরী তবুও আকাশের বুক-হৃদয় আলো করে হাসছে! চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালোই লাগছে ওর! আকাশের বুকে মেঘ আর চাঁদের লুকোচুরির খেলা দেখতে দেখতে নিজের মনেই কবিতা আউড়ে গেলো মিহিকা...।
আকাশের ওপারে উড়ছে আকাশ-
সেখানে মেঘের পরে জমেছে সবুজ ঘাস...
ঘাসের ডগায় থোকা থোকা বেতরং ঘাসফুল
মাছরাঙা রঙ এক ফড়িং সেখানে
ভালোবাসার কবিতা আওড়ে যাচ্ছে অবিরত!
শুনতে পাচ্ছো! শুনতে পাচ্ছো তুমি! পাচ্ছো না!

শুনতে পাবে না জানি, কারণ কাছে নেই তো আমি...।
তোমার কাছে যখন থাকি তখন ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও
গ্রীষ্মের চৌচির মাঠ ভেসে যাবে মিঠা জলে
অনেক বিরল দৃশ্য দেখতে পাওয়া যাবে সেখানে-
সাপের মুখে মাছ, ব্যাঙের মুখে ফড়িং!

ব্যাঙের মুখে ফড়িং তবুও মানায় কিন্তু সাপের মুখে মাছ !

সাপগুলো ইদানিং বাঁচার তাগিদে খেতে শুরু করেছে মাছ,
আবহাওয়া পরিবর্তন, পরিবেশ দূষণে ব্যাঙ যাচ্ছে কমে!
কী ? আবোল-তাবোল কথা! কথার কী কোন লাইসেন্স লাগে!
লাগে না, তাই তো! তাহলে?

বৃষ্টি পড়ছে টিপটিপ টুপটাপ
বৃষ্টি মাথায় রেইনকোটে একহাঁটু জল ছপছপ হাঁটতে
দারুণ মজা, চলো হাঁটি, হাঁটি দুজনে। হাঁটতে হাঁটতে
দেখতে পাবে পৃথিবীটা কতো সুন্দর! তারও চেয়ে
সুন্দর এই অদ্ভুত রকম বেঁচে থাকা!

এসো, এসো হাত ধরো, হাঁটি, বৃষ্টিতে ভিজি দুজনে!
কবিতাটি পড়তে পড়তে অনেকদিন আগের কথা মনে পড়ে মিহিকার। সেদিন ইউনিভার্সিটি থেকে ক্লাস শেষ হওয়ার আগেই বৃষ্টি শুরু হয়েছিল; ভিজতে ইচ্ছা করাতে বৃষ্টিধারার মধ্যেই নেমেছিল মিহিকা; বেরিয়ে দেখে রাস্তাতে থইথই জল! একটাও রিকশা নেই; আর অপেক্ষা করা ওর ধাতে নেই; হাঁটতে শুরু করে; রিকশা পেতে পেতে জোর বৃষ্টি শুরু হলো। শেষে কাকভেজা হয়ে বাসায়। কয়েকদিন জ্বর! কিন্তু এই সময়ে কোভিড -১৯ এর কালে জ্বর বাধিয়ে শুয়ে থাকা যাবে না। কোভিড সন্দেহে কেউ কাছে আসবে না; ‘আইসোলেশনে’ যেতে বাধ্য হতে হবে! ‘আইসোলেশন’, হোমকোয়রেন্টাইন’, ‘বৃষ্টিবাদল’ কথাগুলো মনে হতেই ঘরে যাবার জন্য সিড়ির দরোজায় দাঁড়ায়; ওমা! দরোজা বন্ধ! কে দরোজা বন্ধ করলো? কে বন্ধ করলো! কে? কে? খুব ভয় পেলো মিহিকা। ভয় পেলে ওর মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয়! ভয়ে বিবশ মন ভাবতেই পারছে না হাতে একটি মোবাইল আছে; যা দিয়ে বাসায় কল্ করে ডেকে আনা যায় রত্নদীপা বা নিরোদকে।

রত্নদীপা, ওর মেয়ে আর নিরোদ, ওর মেয়ের বাবা। তাছাড়া মোবাইলে তো একটা-দুইটা নম্বরই থাকে না আরো নম্বর থাকে। মনে হতেই হাতে নেয় মোবাইল; হাতে নিয়েই অবাক মিহিকা! কোন নম্বর নাই মোবাইলে; কালো স্ক্রীণ। কখন মোবাইল অফ হয়েছে বুঝতে পারেনি; মোবাইলের অন-বাটন টিপছে কিন্তু অন হচ্ছে না, হলো না! চার্জ ফুরিয়েছে না ব্যাটারি বুঝতে পারছে না। এখন কী করবে? মিহিকার বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করছে ভয়ে ! হাত-পা শিরশির করে পায়ের তালুতে এসে জমা হচ্ছে শরীরের তাবত লোহিত কণা।

ছোটবেলা থেকেই খুব ভীতু মিহিকা। ছোটবেলাতে দাদি শিখিয়ে দিয়েছিল ভূতের ভয় পেলে কী সুরা পড়তে হবে! ঐ সুরা পড়ে বুকে
ফুঁ দিতে হবে তিনবার; এখন কিছুতেই মনে পড়ছে না; মনে পড়ছে না তো পড়ছেই না! অনেক চেষ্টা করেও ভূতের ভয় তাড়ানো সুরা মনে করতে পারলো না! ভূতের ভয়ে ভীত মিহিকা ভূত তাড়ানো মন্ত্র যখন মনে করতে চেষ্টা করছে তখন ওর অজান্তে আকাশ ঢেকে গেছে কাজল-কালো মেঘে; ও বুঝতেই পারেনি; বুঝতে পারলো তখন যখন উল্টোপাল্টা সজল বাতাসে এলামেলো হয়ে উড়তে লাগলো একমাথা কালোচুল আর শাড়ির সবুজ আঁচল! হঠাৎ ঝড়ো-হাওয়ায় আরও বেশি ভয় পেয়ে গেল মিহিকা! মনে মনে আল্লা-খোদা-ভগবান-ঈশ্বর যতো নাম আছে সব নাম একে একে জপতে লাগলো! ভয় একটু কমলে খেয়াল হলো ভয় তাড়ানো সুরার বদলে মনে মনে বলে চলেছে দুটি লাইন; আল্লা ভগবান আছে বুকে / ভূতরে এবার মরবি দুখে! নিজের মনে নিজেই হাসলো! কী অদ্ভূত; কী অদ্ভূত! দুই লাইনের কবিতা! মন একেবারে কিশোরবেলার মতো উড়ে বেড়াতে লাগলো; আকাশ বাতাস চিরে ছড়িয়ে গেল ওর হাসি!

এমন সময় মোবাইলে জ্বলে উঠলো আলো সঙ্গে রিংটোন! ফোন করেছে ঘর থেকে নিরোদ; মোবাইল কানে ধরেই বললো, ছাদের দরোজা বন্ধ! কিছুক্ষণ পর ছাদের দরোজা খুলে দাঁড়ায় নিরোদ। ততোক্ষণে ঝুম বৃষ্টি। দুই পাশে হাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছে মিহিকা। নিরোদ ধমকে উঠতে যাচ্ছিল; কিন্তু দিলো না। কী মনে হতেই নিজেও দুই হাত ছড়িয়ে স্ত্রীর পাশে দাঁড়ায় নিরোদ। আকাশ ভেঙে ঝুম বৃষ্টি; কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ওরা হাত ধরাধরি করে ছাদময় নেচে বেড়াতে লাগলো যেন একজোড়া শঙ্খচিল ওরা দুজনে!
ওরা নেচে নেচে গাইতে লাগলো :

আকাশ ভরা মেঘে
বাদল প্রাণে ডেকে
নিরোদ বলে আসছি আমি।

নিরোদ কথা শুনে
কল্পনায় জাল বুনে
মিহি ভাসছে দিবা-যামী।

 

আফরোজা অদিতি
কবি ও কথা সাহিত্যিক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top