সিডনী মঙ্গলবার, ৩০শে এপ্রিল ২০২৪, ১৭ই বৈশাখ ১৪৩১

কাব্যব্যঞ্জনায় বঙ্গবন্ধু : মীম মিজান


প্রকাশিত:
১ জুলাই ২০২০ ২৩:৪৫

আপডেট:
৩০ এপ্রিল ২০২৪ ১১:১৭

 

বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এদেশের মাটি, আলো, বাতাস, নদী, আবহ ইত্যাদি সবকিছুর সাথে মিশে আছেন। বাঙালির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠায় তার দীর্ঘ সংগ্রামী রাজনৈতিক জীবন তাকে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ইতিহাসের পাতায় অমর করে রেখেছে। তার সংগ্রামী চেতনা রাজনৈতিক অঙ্গনে যে গভীর প্রভাব ফেলেছে, একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে; তেমনি তা সাহিত্য অঙ্গনেও আলোড়িত হয়েছে। সমসাময়িক সাহিত্যিকদের লেখায় শেখ মুজিব উঠে এসেছেন নানা ভাবে। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান,জাপান, রাশিয়া, জার্মানি, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে, আমেরিকা, ল্যাটিন আমেরিকা ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কবি-সাহিত্যিকরা তাদের লেখায় বঙ্গবন্ধুকে ফুটিয়ে তুলেছেন অসাধারণভাবে।

আমরা জানি যে, আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম 'নিউজ উইকস' বঙ্গবন্ধুকে রাজনীতির কবি বলেছিলেন। এছাড়াও তার অবিস্মৃত অবদানে স্বাধীন দেশের কবি নির্মলেন্দু গুণ তার এক কবিতায় সাতই মার্চের ভাষণের মঞ্চের পরিবেশ বর্ণনায় বঙ্গবন্ধুকে কবি বলেছেন। নবীন কবি সবুজ আহমেদ কক্স তার 'তোমার জন্য সহস্র শ্রদ্ধা হে বঙ্গ পিতা' নামক কবিতায় শেখ মুজিবকে কবি বলে অভিহিত করেছেন। কেউ কবি ভেবেছেন, কেউ ভেবেছেন পিতা, কেউ ভেবেছেন স্বপ্নের সারথি, বুলেট, চেতনা, মুখের খাবারের সঙ্কুলান ইত্যাদি স্তুতিতে। বাংলার কবিগণ তাদের মনের মণিকোঠায় অবস্থান দিয়েছেন তাকে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্ব থেকে আজ অবধি কবিগণের মসির কালিতে খাতায় খাতায় পাতায় পাতায় অসংখ্যবার, অসংখ্যসারিতে বঙ্গবন্ধুর জন্ম, বেড়ে ওঠা, আন্দোলন, কারাবরণ, স্বাধীনতার পূর্বাপর, ১৫ আগস্ট ইত্যাদি শ্রদ্ধারসাথে আলোড়িত ও আচরিত হয়েছে, হচ্ছে।

বরাবরই প্রখ্যাত ও প্রতিষ্ঠিত কবিগণের কাব্যগুলো আলোচিত হয়েছে। আমি আমার এ ক্ষুদ্র প্রয়াসে প্রখ্যাত কবিগণের পাশাপাশি নবীনদের বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কাব্যসম্ভার তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। কবিতায় বঙ্গবন্ধুর নাম প্রথম উচ্চারিত হয় নির্মলেন্দু গুণের কবিতায়। তাঁর একাধিক কবিতা কিংবা বলা চলে সবচেয়ে বেশি কবিতায় বঙ্গবন্ধুর প্রসঙ্গ উচ্চারিত হয়েছে। মুজিবকে বিবেচনায় নিয়ে ১৯৬৭ সালের ১২ নভেম্বর প্রথম তিনি কবিতা লেখেন ‘প্রচ্ছদের জন্য’ (পরে এটি ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’ কাব্যগ্রন্থে ‘স্বদেশের মুখ শেফালি পাতায়’ নামে অন্তর্ভুক্ত); তখন শেখ মুজিব কারাবন্দি। ১৯৬৯ সালে রচিত ‘হুলিয়া’ কবিতায় নির্মলেন্দু গুণ তাঁকে নায়কের আসন দান করেন। এছাড়া সুফিয়া কামালের ‘ডাকিছে তোমারে’, সানাউল হকের ‘লোকান্তর তিনি আত্মদানে, আবুল হোসেনের ‘শিকারের কবিতা’, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর ‘কোন ছবিগুলি’, শামসুর রাহমানের ‘যাঁর মাথায় ইতিহাসের জ্যোতির্বলয়’, হাসান হাফিজুর রহমানের ‘বীর নেই আছে শহীদ’, কায়সুল হকের ‘সমষ্টির স্বপ্নের নির্মাতা’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘পিতা তোমার কথা এখন এখানে আর’, দিলওয়ারের ‘বিতর্কিত এই গ্রহে’, বেলাল চৌধুরীর ‘রক্তমাখা চরমপত্র’, মহাদেব সাহার ‘আমি কি বলতে পেরেছিলাম’, হেলাল হাফিজের ‘নাম ভূমিকায়’, শিহাব সরকারের ‘পিতা’, অসীম সাহার ‘প্রতিশোধ’, সিকদার আমিনুল হকের ‘আত্মজের প্রতি’, আসাদ চৌধুরীর ‘দিয়েছিলো অসীম আকাশ’, আবু কায়সারের ‘সূর্যের অনল’, শান্তিময় বিশ্বাসের ‘ঝড় আর মেঘের সমান’, আখতার হুসেনের ‘আজ থেকে তুই নিজে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর’, রবীন্দ্র গোপের ‘আমার বুকে অর্ধনমিত পতাকা’, নাসির আহমেদের ‘গুলিবিদ্ধ বাংলাদেশ’, কামাল চৌধুরীর ‘এখনো দাঁড়িয়ে ভাই’, ত্রিদিব দস্তিদারের ‘বাঙালির ডাক নাম’, মিনার মনসুরের ‘কেউ কী এমন করে চলে যায়’ প্রভৃতি কবিতা থেকে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানা যায়। কেন তিনি বাঙালি জাতির জনক, কেন তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি সেই প্রসঙ্গও কবিরা তুলে ধরেছেন। আমিনুর রহমান সুলতানের ‘বাংলাদেশের জনক তুমি’ এবং শামীম রেজার ‘ভূর্জপাতায় লিখি নাম তার’ এ ধারারই কবিতা। আবিদ আনোয়ার ‘প্রতিরোধ’ কবিতায় ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তানিদের গণহত্যা ও বঙ্গবন্ধুকে জেলে বন্দি করার ঘটনা বর্ণনা করেছেন। 

খ্যাতিমান কবিদের মধ্যে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা ‘শোনো একটি মুজিবুরের থেকে’ কবিতাটি, যা গান হিসেবে এখনো সমান জনপ্রিয়। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে

"শোনো একটি মুজিবরের থেকে,
লক্ষ্য মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি,
প্রতিধ্বনি,
আকাশে বাতাসে উঠে রণ।
বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ।"

সংক্ষুব্ধ বাঙ্গালীদের হৃদয়ে অফুরন্ত আশার সঞ্চার করেছিল।

তেমনি অসম্ভব জনপ্রিয় আরেকটি কবিতা লিখেছেন অন্নদা শংকর রায়। তিনি লিখেছেন,
"যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা
গৌরি যমুনা বহমান
ততদিন রবে কীর্তি তোমার
শেখ মুজিবুর রহমান।
দিকে দিকে আজ অশ্রুগঙ্গ
রক্তগঙ্গা বহমান
নাই নাই ভয় হবে হবে জয়
জয় মুজিবুর রহমান।"

বাংলা সাহিত্যের প্রধান মহিলা কবি সুফিয়া কামাল বঙ্গবন্ধুকে আবার বাংলাদেশের বুকে ফিরে আসার আহ্বান জানাচ্ছেন এভাবে, 

"এই বাংলার আকাশ বাতাস
সাগর গিরি ও নদী
ডাকিছে তোমারে বঙ্গবন্ধু
আবার আসিতে যদি।"

সব্যসাচী কবি সৈয়দ শামসুল হক তার ‘আমার পরিচয়’ কবিতায় বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে লিখেছেন, "এই ইতিহাস ভুলে যাবো আজ, আমি কি তেমন সন্তান?
যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান;
তাঁরই ইতিহাস প্রেরণায় আমি বাংলায় পথ চলি-
চোখে নীলাকাশ, বুকে বিশ্বাস, পায়ে উর্বর পলি।"

আরেক বিখ্যাত কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ তার ‘আমি কিংবদন্তির কথা বলছি’ কবিতায় বঙ্গবন্ধুকে চিত্রিত করেছেন এভাবে,

"আমি কবি এবং কবিতার কথা বলছি।
সশস্ত্র সুন্দরের অনিবার্য অভ্যুত্থান কবিতা;
সুপুরুষ ভালবাসার সুকণ্ঠ সংগীত কবিতা;
জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি মুক্ত শব্দ কবিতা;
রক্তজবার মতো প্রতিরোধের উচ্চারণ কবিতা।
আমরা কি তাঁর মত কবিতার কথা বলতে পারবো;
আমরা কি তাঁর মত স্বাধীনতার কথা বলতে পারবো।"

মহাদেব সাহা তার ‘সেই দিনটি কেমন ছিলো’ কবিতায় লিখেছেন:

"সেদিন কেমন ছিলো- ১৫ই আগস্টের সেই ভোর,
সেই রাত্রির বুকচেরা আমাদের প্রথম সকাল,
সেদিন কিছুই ঠিক এমন ছিলো না, 
সেই প্রত্যুষের সূর্যোদয় গিয়েছিলো,
সহস্র যুগের কালো অন্ধকারে ঢেকে,
কোটি কোটি চন্দ্রভুক অমাবস্যা তাকে গ্রাস করেছিলো,
রাত্রির চেয়েও অন্ধকার ছিলো সেই অভিশপ্ত দিন।"

১৫ আগস্ট কালোরাত নিয়ে লেখা এটিই সম্ভবত এখন পর্যন্ত শ্রেষ্ঠ লেখা।

আওয়ামী লীগ নেতা ও কবি নূহউল আলম লেনিন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেকগুলো কবিতা লিখেছেন। নূহ-উল-আলম লেনিন তার ‘আমরা আজ আর শোক করবো না’ কবিতায় লিখেছেন, 

" আমরা আজ আর শোক করবো না,
আমাদের শোক এখন শক্তির দ্যোতনা।
ওরা বলেছিল কেউ তাদের কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারবে না,
ওদের দম্ভ ও ঔদ্ধত্যের জবাব দিয়েছে বাংলাদেশ।"

কবি এখানে বঙ্গবন্ধুর হত্যার রায় নিয়ে চূড়ান্ত কথাটি বলেছেন।

কবি আবু জাফর তার 'বঙ্গবন্ধু মানে' কবিতায় বঙ্গবন্ধুর প্রায় সমগ্র সংগ্রামী জীবনকেই ধারণ করে লিখেছেন, 
"বঙ্গবন্ধু মানেই বায়ান্ন, ছেষট্টি, ঊনসত্তর,
বঙ্গবন্ধু মানেই উত্তাল ঊনিশশো একাত্তর।
বঙ্গবন্ধু মানেই সাতই মার্চ, দশই জানুয়ারী,
বঙ্গবন্ধু মানেই ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বর বাড়ী।"

বর্তমান সময়ের উদীয়মান কবিদের মধ্যে খায়রুল আলম সবুজ তার 'চন্দ্র-সূর্য  ধ্রুব হয় যদি' নামক কবিতায় অন্যান্য সকল ধ্রুব সত্যের সাথে বাঙালি জাতির জনককে তুলনা করে বলতেছেন,
"সে আমার  ধ্রুব তারা
এ আকাশ তলে
নদী-মাটি-জলে
লক্ষ ঘরের দীপ-
শেখ মুজিব-শেখ মুজিব-শেখ মুজিব।"

গদ্যকবিতায় যিনি সিদ্ধহস্ত তিনি হলেন আসলাম সানী। তিনি বাংলাদেশের এ উর্বর পলিমাখা জমিনে বাংলার সূর্য সন্তান সূর্য সেন, শহীদ তিতুমীর, শেখ মুজিব প্রমুখের ন্যায় শহীদ হয়ে মিশে যেতে চান। আর সেই গদ্যকবিতার প্রথমাংশ হলো, 

"আমি সূর্য সেনের মতো, তিতুমীরের মতো,
-শেখ মুজিবের মতো
এই নদীমাতৃক দেশে- পলিমাটি গায়ে মেখে
নির্বিঘ্নে ঘুমিয়ে পড়ব নরম ঘাসের কোলে।"

সমসাময়িক যুগের মহিলা কবি কাজী রোজী তার 'ভিন্ন আকাশ খুঁজছি' কবিতায় বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর তিনি আর এ দেশের আকাশের সীমানার ভিতর থাকতে চান না। খোঁজ করছেন এমন এক আকাশের যে আকাশের সীমানার ভিতর বঙ্গবন্ধুর হত্যার দৃশ্য থাকবে না। থাকবে না সেই রক্তাক্ত সিঁড়ি। 

"সেই থেকে একটি ভিন্ন আকাশ খুঁজছি
যেখানে পঁচাত্তরের পরে
সিঁড়িভাঙা অঙ্কের মতো
বারবার সেই সিঁড়িতেই থমকে দাঁড়ায় সব।
যেখানে সিঁড়ির দাগে
জাতির পিতার নাম মুছে দিতে চাইলেও
স্পষ্ট পৃতিভাত হবে
স্বচ্ছ আরশিতে রাখা বঙ্গবন্ধুর মুখ।"

উত্তর আধুনিক কালের কবি হাসানআল আব্দুল্লাহ্ শেখ মুজিবকে নিয়ে অনেকগুলি কাব্য করেছেন। তিনি বাংলাদেশের অস্তিত্ব বলতে শেখ মুজিবকে বুঝেছেন। দ্যার্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন বাঙালির জাতির জনকের দেশপ্রেমের মহত্ত্ব। যেমনটি তার 'অন্তরাত্মার আহ্বান' কবিতার কিয়দংশ,

"আমি শেখ মুজিবর রহমানের কথা বলি
কারণ, তিনি বাঙালী জাতির মুক্তির কথা বলতেন।
আমি উচ্চ কণ্ঠে ঘোষণা করি
তাঁর মহত্ত্ব ও অসাধারণ দেশ প্রেমের
জ্বলজ্বলে ইতিহাস। তিনিই বাঙালী
জাতির জনক, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা,
এতে কোনো সন্দেহ নাই।
বাংলার ফুল-পাতা, নদী-নালা
পাহাড়-পর্বতে
একটি নাম সর্বক্ষণ আলোক ছড়ায়;
বস্তুতঃ বাংলাদেশের ডাক নাম শেখ মুজিব।"

হাসানআল আব্দুল্লাহর মতোই বাংলাদেশের পথে, মাঠে-ঘাটে, নদী-নালায়, ক্ষেত-শষ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি-প্রতিচ্ছবি এঁকেছেন ও দেখেছেন আমীরুল ইসলাম। যেমনটি তার কবিতা, 

"নীল আকাশের তারায় তারায়
মুগ্ধ আমার দু’চোখ হারায়
ঘাসের বনে-কাশের বনে
একটি ছবি থমকে দাঁড়ায়,

শীষে-শীষে হলদে ধানের
সুরে সুরে পাখির গানের
ছবিটা কার? ছবিটা কার?
শেখ মুজিবুর রহমানের।"

'হৃদয়ের রজনীগন্ধা' শীর্ষক শোককাব্যে গোলাম কিবরিয়া পিনু ১৫ই আগস্টের জাতীয় শোক দিবসে অনেককেই রঙ্গিন রঙ্গিন সাজ সজ্জায় দেখেছিলেন। তিনি এ দিনটিতে নিজের মধ্যে লজ্জা ও শোকাতুরতা ব্যক্ত করে সবাইকে শোকে মূহ্যমান করেছেন। 

"এসো, আমরা মাটির সাথে মিশে যাই
লজ্জায়! লজ্জায়!
তাঁর মৃত্যুদিনে কীভাবে দাঁড়াই
রঙিন সজ্জায়!
আমরা কি এত দীনহীন।
যে দিল বুকের রক্ত, যে দিল পরিচয়ের ভিতমাখা মাটি
যে দিল মন্ত্রী, নেতা ও জেনারেলদের পতাকাশোভিত দিন
তাঁকে কেন করতে চেয়েছি বারবার অমাবস্যায় বিলীন।"

আগেই উল্লেখ করেছিলাম যে, নবীন কবি সবুজ আহমেদ কক্স তার 'তোমার জন্য সহস্র শ্রদ্ধা হে বঙ্গ পিতা' নামক কবিতায় শেখ মুজিবকে কবি বলে উল্লেখ করেছেন। তবে তার কল্পিত এ কবি সারা বাংলার আবাল-বৃদ্ধ বণিতার। এ কবি লাল-সবুজের বিজয় কেতনের। তার বর্ণনায়, 

"তুমি আজ সারা বাংলা জুড়ে
লাল-সবুজ পতাকায় আকাঁ ছবি
তুমি আজ সারা বাংলা জুড়ে
ক্ষণে
ক্ষণে
মনে
মনে
আবাল-বৃদ্ধা বণিতার শ্রেষ্ঠ কবি
তুমি আজ সারা বাংলা জুড়ে
সারা বাংলার …হে বঙ্গ পিতা।"

আনজীর লিটন বঙ্গবন্ধুকে তৎকালীন সাড়ে সাত কোটি বাংলাদেশীর ছায়া হিসেবে দেখেছেন। খাঁ খাঁ করা রোদে পথিক ক্লান্ত হয়ে ছায়াশীতল বটবৃক্ষের নিচে বসে জিড়োয়। সে সময় ক্লান্তি-অবসাদ দূর করতে বট গাছে বসা দোয়েলের শীশ ও মধুর লাগে। কবি আনজীর লিটন তার
'তিনি আমাদের' নামক কবিতায় উপর্যুক্ত সকল বৈষয়িকে বঙ্গবন্ধুকে খুঁজে পান। কবির ভাষায়, 

"কখনো কখনো একটা মানুষ কোটি মানুষের ছায়া
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর তেমনই একটা মায়া।
মায়ায় জড়ানো ছায়ায় মেশানো
যেমন বটের ডালে
ডানা মেলে বসে অচেনা পাখিরা
ছন্দসুরের তালে-
গেয়ে গেয়ে গান নিজেকে জুড়োয়
পথিক জুড়োয় ঘাম
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর
তেমনই বটের নাম।"

মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে একটি স্লোগান চেতনাকে জাগ্রত করত। তারা সবকিছু ভুলে পাকবাহিনীর সঙ্গে প্রাণপণ যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়তেন। আর সেই স্লোগানটি ছিল 'জয়বাংলা'। সেই বিষয়টিকে ফুটিয়ে তুলেছেন 'একটি বুলেট' নামক কবিতায় কবি সেলিম রেজা। তার ভাষ্যে,

"শ্যামল ভূমির নিসর্গরূপে লোভের বেসাতি
বীভৎস দৃশ্যের অবতারণা; হত্যাযজ্ঞ
রক্তের হোলিখেলায় মৃত্যুর আর্তনাদ
বাংলার মাটির জন্য
বজ্রমুষ্টি অগ্নি শপথ
পিশাচ দম্ভের তীক্ষ্ম প্রতিরোধ
বিপ্লবীর হাতে জ্বলন্ত মশাল
বাতাসে কামানের গর্জন
চোখে প্রতিশোধের আগুন
অজস্র ঢেউ রক্ত কণিকায়
মাথায় হেলমেট
ক্ষুদ্ধ রাইফেল হাতে
মরণজয়ী সৈনিক
শুধু একটি বুলেট
যে বুলেট সাতকোটি জনতার
যার বিপ্লবী নাম
জয়বাংলা।"

লেখক নিজেও বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ নিয়ে দু'য়েক কলম লিখেছিল। সেখান থেকে কিছু উদ্ধৃতি করা হলো,

"তুমি হ্যামিলিওনের বাঁশি ওয়ালা।

তোমার বাঁশির সুর নাদে অবিমৃষ্য করে আবাল-বৃদ্ধ কিংবা কাস্তের হাত কৃষক।

রান্না ছেড়ে রাধুনী, পাঠ ছেড়ে স্কুল বালক ছুটলো মোহনায় রেসকোর্স মাঠে।

তুমি আণবিক বোম।
৯৩ হাজার সৈন্যকে করেছিলে ঘায়েল। 
বন্দি থেকেও ঐ পশ্চিমে।
কি তেজষ্ক্রিয়া তোমার!

ধ্রুবতারা বলে ডাকবো তোমায়।
মিটি মিটি অসংখ্য তারকার মধ্যমণি তুমি।

বাঙালি জাতির ভাগ্যাকাশ প্রোজ্জ্বল করেছ।"

দেশের সীমানাকে ছাড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর আবেদন প্রায় সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে গেছে। সারা বিশ্বের কবিগণও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, দেশপ্রেম, অবিস্মরণীয় অবদান নিয়ে সাড়াজাগানো কবিতা লিখেছেন।  বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রতি উত্তরে নয়াদিল্লির সাহিত্য একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত মনিপুরের অন্যতম শীর্ষ কবি এলাংবম নীলকান্ত তাঁর ‘তীর্থযাত্রা’ গ্রন্থে ‘শেখ মুজিব মহাপ্রয়াণে’ কবিতায় লিখেছেন। বিদেশিদের সেইসব কাব্যমালায় বঙ্গবন্ধু মূর্ত হয়ে উঠেছেন। মার্কিন লেখক রবার্ট পেইনের ‘দি চর্টার্ড এন্ড দ্য ডেমড’, সালমান রুশদীর ‘মিড নাইট বিলড্রেম’ এবং ‘শেইম’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘পূর্ব পশ্চিম’, জাপানি কবি মাৎসুও শুকাইয়া, গবেষক ড. কাজুও আজুমা, প্রফেসর নারা, মার্কিন কবি লোরি এ্যান ওয়ালশ, জামান কবি গিয়ার্ড লুইপকে, বসনিয়া কবি ইভিকা পিচেস্কি ও ব্রিটিশ কবি টেড হিউজসহ বিভিন্ন বিদেশি লেখকদের কবিতায় বঙ্গবন্ধু উপস্থাপিত হয়েছেন নানাভাবে। উরিষ্যা ও মণিপুরী ভাষার কয়েকজন কবি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখে ও নিজে নিজে অনুবাদ করেছিলেন। এছাড়া ভারতীয় ও পাকিস্তানি প্রচুর কবিই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেক কবিতা রচনা করেছেন।

পাকিস্তানের পাঞ্জাবি কবি আহমেদ সালিম পাঞ্জাবি ভাষায় ‘বাংলাদেশ দীর্ঘজীবী হোক এবং সোনার বাংলা’ শিরোনামে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কবিতা লিখে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। পরে লাহোর ডিস্ট্রিক্ট জেলে বসে তিনি ‘সিরাজউদ্দৌল্লাহ ধোলা’ কবিতাটি লিখে উৎসর্গ করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর নামে। কবিতাটিতে তিনি সিরাজউদ্দৌল্লাহ ও শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীনতার রক্ষক হিসেবে বর্ণনা করেন।

ভারতের উর্দু কবি কাইফি আজমী ‘বাংলাদেশ’ কবিতায়, বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত অস্ট্রেলিয়ান সাহিত্যিক আবিদ খানের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা ‘সিজনাল এডজাস্টমেন্ট’ উপন্যাসে প্রসঙ্গক্রমেই বঙ্গবন্ধুর কথা ওঠে এসেছে।

মার্কিন সাংবাদিক এবং ঔপন্যাসিক এ্যানি লোপা তার স্মৃতিচারণে বলেছিলেন- "শেখ মুজিবের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল ঘরোয়া পরিবেশে। একবারও মনে হয়নি এতো বড় একজন নেতার সামনে বসে আছি। বন্ধু সুলভ মুজিব নিজে চা-এর কাপ তুলে দিলেন আমার হাতে। এমন অসাধারণ মনের পরিচয় পাওয়া কঠিন। আমার সাংবাদিক জীবনে পৃথিবীর নানা দেশ ঘুরেছি, বহু নেতানেত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি, কিন্তু বাংলাদেশের শেখ মুজিবের মতো এমন সহজ-সরল মানুষ আর পাইনি।"

বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর শঙ্খ ঘোষ বলেছিলেন- "আজকের দিন যদি ব্যর্থ হয় তাহলে আছে কাল, একশ মুজিব যদি মিথ্যে হয় তবুও থাকে সত্য।"

কবি আবু জাফর শামসুদ্দিনও তার ‘আরেক ভুবন : সোভিয়েত ইউনিয়ন’ গ্রন্থে লিখেছিলেন যে ওই দেশের মানুষ কিভাবে বাংলাদেশ বলতে বঙ্গবন্ধুকেই চিনে।

বঙ্গবন্ধু কবিগণের হৃদয়কে কতটুকু আলোড়িত করেছিল তা তাকে নিয়ে সংকলিত কবিতার বইয়ের সংখ্যা ও কবিতার সংখ্যা জানলে অনুমেয়। কবিতা সংকলন এ পর্যন্ত জানামতে ৬টি। আর কবিতার সংখ্যা এখনো জ্ঞাত হওয়া যায়নি। 

বাঙালির স্বপ্নের সারথি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত কবিতা ছড়া নিয়ে যেকয়েকটি সংকলিত কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে তন্মধ্যে বেবী মওদুদ সম্পাদনা করেন একটি সংকলন। এছাড়া বিশাকা প্রকাশণ থেকে প্রকাশিত হয়েছে ‘মুজিব মঙ্গল’ নামে ২২ কবির কবিতা সম্বলিত একটি কাব্য সংকলন। নামটি ২২ কবির মনসা মঙ্গল হতে নেয়া হয়েছিল। কবি ও প্রাবন্ধিক সুমন্ত রায় অমর একুশে বই মেলায় প্রকাশ করেছেন ‘ছোটদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিবেদিত শ্রেষ্ঠ কবিতা’ নামক একটি সংকলিত কাব্যগ্রন্থ। এই কাব্যগ্রন্থটির ভূমিকা লিখেছেন কবি, ‘প্রাবন্ধিক, সংগঠক ও রাজনীতিবীদ নূহ- উল- আলম লেনিন। তিনি লিখেছেন, আসলে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অসংখ্য কবিতা/ছড়া রচিত হলেও সেসব কবিতার একটি পূর্ণাঙ্গ সংগ্রহের অভাব বঙ্গবন্ধুভক্ত মাত্রই অনুভব করেন।

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের কবিদের কবিতা নিয়ে একটি গ্রন্থ ‘দুই বাংলার কবিতায় বঙ্গবন্ধু’, সম্পাদনা করেছেন প্রত্যয় জসীম, প্রকাশিত হয়েছে একুশের বইমেলা ২০১০-এ। মোট ৮৫ জন কবির কবিতা রয়েছে গ্রন্থটিতে। কবিতাগুলো এসেছে কবিগণের নামের বর্ণনানুক্রম অনুসারে। ‘দুই বাংলার কবিতায় বঙ্গবন্ধু’ গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে জিনিয়াস পাবলিকেশন্স।

মোনায়েম সরকারের সম্পাদনায় বঙ্গবন্ধুর ওপর খ্যাতিমান ও তরুণ পাঁচশ’ কবির লেখা কবিতা সংকলন ‘মুজিব মানে মুক্তি’ একটি বই প্রকাশ করেছে পারিজাত প্রকাশনী।

এ ছাড়াও প্রবাস প্রকাশনী থেকে ২০০৭ সালের মার্চে প্রকাশিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু বিষয়ক কবিতা সংকলন 'বাংলাদেশের আকাশ'। যে বইটির সম্পাদনা করেছেন কাজল রশীদ।

দেশের অভ্যন্তর ও বাহিরে স্বপ্নের সারথি বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিগণ আজও সরব আছেন। যাকে নিয়ে অসংখ্য কাব্যমালা তিনি হোক সকল কবিদের প্রাশস্ত্যের ক্ষেত্র।

 

মীম মিজান
প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, কলামিস্ট, গল্পকার
এম ফিল গবেষক, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়


বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top