সিডনী বুধবার, ১লা মে ২০২৪, ১৭ই বৈশাখ ১৪৩১

শহীদ জননী জাহানারা ইমাম: এক মা ও একাত্তরের দিনগুলি : আফরোজা পারভীন


প্রকাশিত:
৭ জুলাই ২০২০ ২৩:২৬

আপডেট:
১ মে ২০২৪ ০৪:৪৪

ছবিঃ জাহানারা ইমাম



জাহানারা ইমাম (১৯২৯-১৯৯৪) লেখক, দেশপ্রেমী, সংগঠক। শহীদ জননী হিসেবে সবাই তাঁকে চেনে। একাত্তরে তাঁর প্রথম পুত্র রুমি মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন। তিনি কয়েকটি সফল গেরিলা অপারেশনে অংশ নেন। এর পর পাকিস্তানি মিলিটারির হাতে শহীদ হন তিনি। দেশ স্বাধীন হবার পর রুমির বন্ধুরা রুমির মা জাহানারা ইমামকে সকল মুক্তিযোদ্ধার মা হিসেবে বরণ করে নেন। তখন থেকেই তিনি ‘শহীদ জননী’র মর্যাদায় ভূষিত। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির আহবায়ক।
অবিভক্ত বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলার সুন্দরপুর গ্রামে ১৯২৯ সালের ৩ মে জাহানারা ইমাম জন্মগ্রহণ করেন। সেকালের অন্য দশটা পরিবারের মতো তাঁর পরিবারও ছিল রক্ষণশীল। মুসলিম পরিবারের মেয়েদের জন্য শিক্ষালাভের পথ অবারিত ছিল না। তাঁর পিতা ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল আলী। পিতার কারণে শিক্ষালাভের সুযোগ ঘটে জাহানারার। পিতার তত্ত্বাবধানে রক্ষণশীলতার বাইরে এসে আধুনিক শিক্ষা লাভ করেছিলেন তিনি। বিয়ে হয়েছিল পুরকৌশলী শরীফ ইমামের সাথে। বিয়ের পর লেখাপড়ায় স্বামীর দিক থেকে তিনি উৎসাহ ও আনুকূল্য পেয়েছিলেন। দেশবিভাগের পর ১৯৪৮ সালে স্বামী শরিফুল ইমামের সঙ্গে ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৫১ সালে প্রথম সন্তান রুমির জন্ম হয়।
পিতার চাকরিসূত্রে জাহানারা ইমাম বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করেন। যুগের তুলনাম আধুনিক ছিলেন তিনি। ডাক নাম জুডু। জুডু নামের এই কিশোরী কুড়িগ্রাম শহরে সাইকেল চালাতেন। বাম রাজনীতিতে যোগ দিয়ে মুকুল ফৌজ সংগঠনের সঙ্গে কাজ করতেন। ম্যাজিস্ট্রেট বাবার সংগৃহিত দেশি-বিদেশি বই, পত্রপত্রিকা পড়তেন। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময়ই পরিচিত হয়েছিল টলস্টয়, দস্তয়ভস্কি, শেক্সপিয়ারের লেখালেখির সঙ্গে। কারমাইকেল কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। ১৯৪৫ সালে কলকাতার লেডি ব্রাবোন কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। বিএড পাস করার পর ১৯৬৫ সালে তিনি প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় ময়মনসিংহের বিদ্যাময়ী গার্লস স্কুলে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে। ১৯৫২ থেকে ১৯৬০ পর্যন্ত তিনি ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন। জাহানার ইমাম ফুলব্রাইট স্কলারশিপ পান। ১৯৬৪-৬৫ সালে ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যান । আমেরিকা থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে ১৯৬৬ সালে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি ১৯৬৮-র দিকে চাকরি ছেড়ে দেন। পরে ১৯৭৭ সালে আবার স্বল্পকালীন প্রশিক্ষণে যুক্তরাষ্ট্র যান।
জাহানারা ইমাম ষাটের দশকে ঢাকার সংস্কৃতি মহলে পরিচিত ছিলেন শিশুকিশোর উপযোগী রচনার জন্য। তবে তাঁকে তুঙ্গস্পর্শী খ্যাতি এনে দেয় দিনিলিপি হিসেবে লেখা একাত্তরের ঘটনাবহুল দিনের কাহিনি ‘একাত্তরের দিনগুলি।’ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি পুত্র রুমি ও স্বামীকে হারান। স্বামী, পুত্রহারা এই জায়া জননীর মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ নয় মাস কেটেছে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও ভয়ে। সাথে ছিল গভীর দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার স্বপ্ন। সেই দুঃসহ দিনগুলির প্রতিদিনের ঘটনা এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার বৃত্তান্ত লিখেছিলেন তিনি নানা চিরকুটে, ছেঁড়া পাতায়, সাংকেতিক ভঙ্গি ও চিত্রে। ১৯৮৬ সালে গ্রন্থরূপ পায় বইটি। প্রকাশের পরই বইটি জনগণ বিপুলভাবে গ্রহণ করে । এ গ্রন্থ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা ও মর্মস্পর্শী ঘটনা বৃত্তান্ত।
জাহানারা ইমামের গল্প, উপন্যাস ও দিনপঞ্জি জাতীয় রচনা মিলিয়ে উল্লেখযোগ্য বইগুলো হলো: অন্য জীবন (১৯৮৫), বীরশ্রেষ্ঠ (১৯৮৫), জীবন মৃত্যু (১৯৮৮), চিরায়ত সাহিত্য (১৯৮৯), বুকের ভিতরে আগুন (১৯৯০), নাটকের অবসান (১৯৯০), দুই মেরু (১৯৯০), নিঃসঙ্গ পাইন (১৯৯০), নয় এ মধুর খেলা (১৯৯০), ক্যানসারের সঙ্গে বসবাস (১৯৯১) ও প্রবাসের দিনলিপি (১৯৯২)।
একাত্তরের দিনগুলি একাত্তরের দলির। এক সন্তানহারা মায়ের রক্তক্ষরণের দলিল। এক অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধার আত্মত্যাগের দলিল্ ১৯৭১ সালে অবরুদ্ধ ঢাকার লোমহর্ষক দিনগুলোর দলিল। ডায়েরির আকারে জাহানারা ইমাম লিখছেন,
‘...রুমির সঙ্গে কয়েকদিন ধরে খুব তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে। ও যদি ওর জানা অন্য ছেলেদের মতো বিছানায় পাস বালিশে শুইয়ে বাবা মাকে লুকিয়ে পালিয়ে যুদ্ধে চলে যেতো, তাহলে একদিক দিয়ে বেঁচে যেতাম। কিন্তু ওই যে ছোটবেলা থেকে শিখিয়েছি, লুকিয়ে বা পালিয়ে কিছু করবে না। নিজের ফাঁদে নিজেই ধরা পড়েছি। রুমি আমাকে বুঝিয়েই ছাড়বে, সে আমার কাছে মত আদায় করেই ছাড়বে। কিন্তু আমি কি করে মত দিই? রুমির কি যুদ্ধ করার বয়স? এখনত তার লেখাপড়ার সময়...
ছেলের সঙ্গে বুঝতে বুঝতে একসময় একসময় ছেলের কথাই মেনে নিলেন।
‘ঠিক আছে তোর কথাই মেনে নিলাম। দিলাম তোকে দেশের জন্য কোরবানি। যা তুই যুদ্ধে যা।’
অন্যত্র তিনি লিখছেন,
‘প্রায় গ্রীনরোডে গাড়ি পৌঁছে গেছে। এমন সময় রুমির হঠাৎ চোখে পড়ল, একটি মিলিটারি জিপ তাদের পিছু নিয়েছে। সে চেঁচিয়ে উঠল, ‘লুক লুক আ জিপ ইজ ফলোয়িং আস’ এবং সঙ্গে সঙ্গে স্টেনের বাঁট দিয়ে আঘাত করে পেছনের কাচ ভেঙে ফায়ার শুরু করে জিপটির ওপর। একই সঙ্গে রুমির দুপাশ থেকে বদি আর স্বপনও ফায়ার শুরু করে ভাঙা কাচের ফাঁক দিয়ে। কজন মরল তার হিসেব না পেলেও জিপের ড্রাইভার যে প্রথম চোটেই মরেছে, তার প্রমাণ পাওয়া গেল ব্রাশফায়ারের সঙ্গে সঙ্গেই জিপটি হঠাৎই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মোড়ের ল্যাম্প পোস্টে গিয়ে ধাক্কা খেলো এবং সঙ্গে সঙ্গে উল্টে গেল।’
ওই দিন অপারেশন সেরে বাসায় এসে রুমি জাহানারা ইমামকে বলে, ‘আম্মা পাশের গলিতে এক বাড়িতে অস্ত্র রেখে এসেছি। এক্ষুনি নিয়ে আসতে হবে। তোমাকে যেতে হবে গাড়ি নিয়ে। মহিলা ড্রাইভার দেখলে ওরা গাড়ি থামাবে না আশা করা যায়। আমি যাব তোমার সঙ্গে।’ জাহানারা ইমাম ছেলেকে পেছনে বসিয়ে গাড়ি ড্রাইভ করে নিয়ে গেলেন যেখানে রুমিরা অস্ত্র রেখে এসেছে। বুকে কাঁপুনি নিয়ে গাড়ি পার্ক করে গাড়িতেই বসে রইলেন। ঝিমঝিম করে বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টির শব্দে প্রতি মুহূর্তেই মনে হচ্ছে, এই বুঝি পাকিস্তানি সেনারা এল। বস্তাভর্তি অস্ত্র নিয়ে রুমি ফিরে এলে গাড়ির পেছনের বুটি খুলে দিলেন। বুকে প্রচন্ড ধুক্ধুকানি। হাত-পায়ে শিথিলতা । তা সত্ত্বেও গাড়ি চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ছেলেকে অস্ত্রসহ নিরাপদে বাড়ি নিয়ে এলেন। বাড়ি ফিরে এসে হাতে পায়ে জোর ফিরে পেলেন।
জীবনে প্রথমবারের মতো অস্ত্র দেখলেন তিনি। ধুকধুকানি নয় বুকে এখন চরম উত্তেজনা। অস্ত্রগুলো লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করলেন।
এই ঘটনায় আমাদের সামনে উদ্ভাসিত হয় এক দুঃসাহসী মায়ের চিত্র। যিনি তাঁর প্রাণাধিক পুত্রকে শুধু মুক্তিযুদ্ধেই পাঠাননি, সন্তানের সাথে সাথে নিজেও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন।
রুমি যে বাহিনীতে ছিল সে বাহিনির নাম বিচ্ছু বাহিনী। ১৯৭১-এ বিচ্ছু বাহিনী ছোট ছোট অপারেশনের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় কাজ করেছিল । এই বিচ্ছু বাহিনীকে আশ্রয়, সাহায্য, সহযোগিতা, সমর্থন দিয়ে বাংলাদেশ অর্জনে নেপথ্যে কাজ করেছিলেন যাঁরা, তাঁদেরই একজন বিচ্ছু বাহিনীরই এক বিচ্ছুর মা, শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। তাঁদের এলিফ্যান্ট রোডের বাড়ি কণিকায় প্রায়ই আসত গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা। তিনি তাদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা করতেন। অসুস্থদের সেবা দিতেন। নিজের ছেলের মতো স্নেহ করতেন। অতিথি কক্ষে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রসদ জমিয়ে রাখতেন। যাতে করে হঠাৎ এসে গেলে খালি মুখে তাদের যেন ফিরে যেতে না হয়। ওষুধ, দেশলাই, ওয়াটারপ্রুফ লাইটার সংগ্রহ করে প্যাকেট করে রেখে দিতেন। যখনই কোন মুক্তিযোদ্ধা আসত তাদের দিয়ে সেগুলো রুমি ও তার সহযোদ্ধাদের জন্য পাঠিয়ে দিতেন।


জাহানা ইমাম লিখছেন,
২৯ আগস্ট ১৯৭১।
রুমি তার মাকে বলছে-‘আম্মা মাথাটা কেন জানি খুব দপদপ করছে। ভালো করে বিলি করে দাওতো।’ জাহানারা ইমাম ছেলের মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছেন, এমন সময় রেডিওতে ক্ষুদিরামের ফাঁসির সেই বিখ্যাত গানের কয়েকটা লাইন।
-‘একবার বিদায় দে মা
ঘুরে আসি
ওমা হাসি হাসি পরব ফাঁসি
দেখবে জগৎবাসী’
বেজে উঠল। তখন রুমি বলল,
-‘কী আশ্চর্য আম্মা, আজকেই দুপুরে এই গানটা শুনেছি। একই দিনে দুইবার গানটা শুনলাম।
না জানি কপালে কী আছে!’
ওই দিন মাঝরাতে রুমিদের এলিফ্যান্ট রোডের কণিকা বাড়ি থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী উঠিয়ে নিয়ে গেল রুমি, জামী, ওদের বাবা শরীফ ইমাম, কাজিন হাফিজ ও মাসুমকে।
জাহানারা ইমাম লিখছেন,
‘আমি খানিকক্ষণ স্তম্ভিতের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম শূন্য পোর্চে। একবার গলির মাঝখানে দাঁড়াই। আবার পোর্চে ফিরে আসি। মাঝে মাঝে বারান্দায় বসি। আধঘণ্টা গেল। এক ঘণ্টা গেল। দেড় ঘণ্টা গেল। ওরা ফিরে আসে না। ক্যাপ্টেন কাইয়ুম বলেছিল, ‘আধঘণ্টা পৌনে এক ঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসবে।’
‘আমিও সেই বিশ্বাসে ঘর বার করে পাঁচ ঘণ্টা কাটিয়ে দিলাম।’
বইটি লেখা শুরু হয়েছিল ১ মার্চ ১৯৭১, শেষ হয়েছে ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১।
দুদিন-দুরাত অমানুষিক অত্যাচার আর জেরার পর ৩১ আগস্ট দুপুর নাগাদ রুমিকে রেখে অন্যদের ছেড়ে দেয় পাকিস্তানিরা। রুমিকে তেজগাঁও ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এরপর আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি। রুমি আর ফেরেনি।
২৯ আগস্টের পর একাত্তরের দিনগুলির প্রতিটি পাতা ভেজা সন্তান রুমির জন্য মা জাহানারা ইমামে অঝোর কান্নায়। এখানে তিনি শুধুই মা, রুমির মা, শাশ্বত বাঙালি মা। সন্তানের শোকে মুহ্যমান এক মা। তাঁর শুধুই অপেক্ষা এই বুঝি তাঁর রুমি এলো। অথবা এলো তার কোন খবর। রুমির খবর পাবার সব চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হলেন মা-বাবা।
ছেলের শোকে ১৩ ডিসেম্বরে শরীফ ইমাম হৃদরোগে আক্রান্ত হলেন। তাকে নিয়ে যাওয়া হলো পিজি হাসপাতালে। পাকিস্তানিদের পরাজয়ের পূর্ব মুহূর্তে তখন। ঢাকায় কারফিউ জারি করেছে। রাতে লাগাতার ব্যাকআউট। শুরু হয়েছে আলবদর বাহিনীর বাঙালি বুদ্ধিজীবী নিধন। এমনি এক দমবন্ধ অবস্থায় পিজি হাসপাতালের এক অন্ধকার কেবিনে বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেন শরীফ ইমাম। স্বামীর লাশের মাথার কাছে বসে রইলেন পাথর জাহানারা ইমাম।
পরদিন ১৪ ডিসেম্বর । বোমাবর্ষণ হলো ঢাকায়। আশপাশের বাড়ির আহতরা এসে আশ্রয় নিয়েছিল কণিকায়। তাদের ফার্স্ট এইড দিয়ে, বেশি আহতদের মেডিকেলে পাঠালেন জাহানারা। সবার খাবারের বন্দোবস্ত করলেন তিনি ।
১৭ ডিসেম্বর লিখেছেন, ‘২৫ মার্চ যে ফ্ল্যাগ পোলটায় বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে আবার নামিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিলাম, সেই ফ্ল্যাগ পোলটায় আজ আবার সেদিনের সেই পতাকাটাই তুললাম। সবাই কাঁদতে লাগলেন। আমি কাঁদতে পারলাম না। জামীর হাত মুঠিতে চেপে দাঁড়িয়ে রইলাম।’
ম্যাক্সিম গোর্কির মা-এর দ্বিতীয় খন্ডের প্রথমেই দেখা যায় মায়ের আর কান্না আসে না। জাহানারা ইমামাকে দেখে গোর্কির মাকে মনে পড়ে। একজন শহীদ রুমির মা ক্রমশ যেন লাখো শহীদের মা হয়ে উঠছিলেন। রুমি ছিল তাঁর বড় সাধের সন্তান প্রথম সন্তান। দেশেল জন্য তিনি তাঁর রুমিকে হারানোর শোক মেনে নিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘এ দেশের লাখো মা যদি তাদের পুত্র হারানোর শোক সহ্য করতে পারে, তাহলে তিনি কেন পারবেন না?’
জাহানারা ইমামের পুত্র হারানোর শোক তাঁর অজান্তেই মনের মধ্যে রূপান্তরিত হলো হত্যাকারী ও তার সমর্থকগোষ্ঠীর প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষে। আগে তিনি রাজনীতিসচেতন ছিলেন তবে রাজনীতিবিদ ছিলেন না। কিন্তু এবার তাঁকে চলে আসতে হয় রাজনীতির অঙ্গনে। তিনি বিভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে পড়লেন। স্বাধীনতার পর জামায়াতের চিহ্নিত নেতাদের ‘যুদ্ধাপরাধী’ হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। গোলাম আযমের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়। কিন্তু ‘দালাল আইন’এ চিহ্নিত অপরাধী ব্যতীত অন্যদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। গণধিকৃত এই অপশক্তি বিভিন্ন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় পুনরায় জনগণের মাঝে নিজেদের জায়গা করে নিতে থাকে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় জীবনে স্বাধীনতাবিরোধী ধর্মান্ধ ঘাতক-দালালদের ক্রম পুনর্বাসনে তিনি বিক্ষুব্ধ হয়েছিলেন । বিভিন্ন সভা-সমিতিতে বক্তৃতা করতে থাকেন তিনি এর বিপক্ষে। লেখালিখি করে জনসচেতনতা গড়ে তোলেন। তিনি ‘সাম্প্রদায়িকতা ও ফ্যাসিবাদবিরোধী নাগরিক কমিটি’, ‘ স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটি’র সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন স্বাধীনতার পক্ষের মানুষদের একত্র করতে না পারলে বিরোধী দুষ্ট চক্রকে আটকানো যাবে না। তিনি ছিলেন সংস্কৃতি অঙ্গনের লোক। কিন্তু তিনি এসময় রাজনীতির অঙ্গনেও সুপরিচিত হয়ে ওঠেন। তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা ছিল অসাধারণ । দূরদর্শী রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ছিল। ১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর গোলাম আযমকে জামায়াতে ইসলামী তাদের দলের আমির ঘোষণা করে। শুরু হয় গণবিক্ষোভ। বিক্ষোভের অংশ হিসেবে ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ১০১ সদস্যবিশিষ্ট একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয়। তিনি এই কমিটির আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। আন্দোলনকে বিস্তৃত করার প্রয়োজনে ১৯৯২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’গঠিত হয়। এই কমিটিরও আহ্বায়ক নির্বাচিত হন জাহানারা ইমাম। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল বরেণ্য বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিকর্মী, রাজনৈতিক দল ও কর্মিবৃন্দ, দেশপ্রেমিক তরুণ সমাজ এবং প্রজন্ম ’৭১ তাঁর আহবানে এগিয়ে আসেন। সবার ঐকান্তিক সহযোগিতা ও সমর্থনে জাহানারা ইমাম ১৯৭১-এর স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের বিরুদ্ধে গণআদালত গড়ে তোলেন।
১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ এই কমিটি ‘গণআদালত’-এর মাধ্যমে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গোলাম আযমের ঐতিহাসিক বিচার অনুষ্ঠান করে। গণআদালতে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ১০টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপিত হয়। ১২ জন বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত গণআদালতের চেয়ারম্যান জাহানারা ইমাম গোলাম আযমের ১০টি অপরাধ মৃত্যুদন্ডযোগ্য বলে ঘোষণা করেন।
গণআদালতের রায় কার্যকর করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানানো হয়। গণআদালত অনুষ্ঠিত হবার পর তৎকালীন সরকার ২৪ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিসহ জাহানারা ইমামের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে জামিন অযোগ্য মামলা দায়ের করে । পরবর্তীতে হাইকোর্ট ২৪ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির জামিন মঞ্জুর করেন। ১০০ জন সংসদ সদস্য গণআদালতের রায়ের পক্ষে সমর্থন ঘোষণা করেন।
জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে আন্দোলন আরো বেগবান হয়। ১৯৯৩ সালের ২৮ মার্চ ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সমাবেশে পুলিশ বাহিনী হামলা চালায়। পুলিশের লাঠিচার্জে আহত হন জাহানারা ইমাম। এ সময় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে, এমনকি বিদেশেও নির্মূল কমিটি গঠিত হয়। শুরু হয় ব্যাপক আন্দোলন।
১৯৯৩ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে গণআদালতের প্রথম বার্ষিকীতে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গণতদন্ত কমিটি গঠিত হয় এবং আটজন যুদ্ধাপরাধীর নাম ঘোষণা করা হয়। তারা হলেন - আব্বাস আলী খান, মতিউর রহমান নিজামী, মো: কামরুজ্জামান, আব্দুল আলীম, দেলোয়ার হোসেন সাঈদী, মাওলানা মান্নান, আনোয়ার জাহিদ এবং কাদের মোল্লা।
১৯৯৪ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে গণআদালতের দ্বিতীয় বার্ষিকীতে গণতদন্ত কমিশনের রিপোর্টে আরো আটজন যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে তদন্ত অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেওয়া হয়।
গণআদালত ছিল স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের অন্যায় অপকর্ম নৃশংসতার বিরুদ্ধে একটি প্রতীকী প্রতিবাদ। কিন্তু তৎকালীন সরকার এ প্রতিবাদ মেনে নেয়নি। বরং তারা জাহানারা ইমামসহ গণআদালতের সঙ্গে যুক্ত ২৪জন বরেণ্য বুদ্ধিজীবীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে মামলা দায়ের করেছিল যা আগেও উল্লেখ করা হয়েছে। জাহানারা ইমামের মৃত্যু পর্যন্ত এ মামলা চলমান ছিল। এ অভিযোগ থেকে মুক্তি পাননি।
জাহানারা ইমাম ছিলেন অনিন্দ্য সুন্দরী। একসময় সবাই তাঁকে বলত ‘ঢাকার সুচিত্রা সেন’। ছিলেন বিদূষী, আধুনিকা, উচ্চবিত্ত। প্রকৃত শিক্ষিত ছিলেন তিনি। সংকীর্ণতা শব্দটি তাঁর অভিধানে ছিল না। কোনো কিছুরই অভাব ছিল না তাঁর জীবনে। আর দশজন আপসকামীর মতোই স্বচ্ছন্দে অতিবাহিত করতে পারতেন নিজের জীবন। ছেলেকে যুদ্ধে পাঠানোর কোনো প্রয়োজন ছিল না, প্রয়োজন ছিল না নিজের ঝুঁকিপূর্ণ জীবন বেছে নেয়ার। কিন্তু তা তিনি করেছেন। করেছেন দেশকে ভালবাসার জন্যই।
১৯৮১ সালে জাহানারা ইমাম মুখের ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। তাঁর রোগ উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে। এজন্য প্রতি বছর একবার যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে চিকিৎসা নিতে হতো তাঁকে। কথা বলাও ভীষণ কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে। কিন্তু তিনি অদম্য । রোগজীর্ণ শরীরেও নিজের বাড়িতে পোষা ময়না পাখিটির কাছে দাঁড়াতেন। যেন সামান্য ক্ষণের জন্য ভুলে যেতেন মরণব্যাধি ক্যান্সারের যন্ত্রণা ।
তিনি ক্যান্সারাক্রান্ত ছিলেন। কিন্তু ক্যান্সার তাঁর অদম্য মনোবল, কর্মস্পৃহা ও আদর্শকে একটুকু স্তিমিত করতে পারেনি। তিনি ওই মারাত্মক অসুস্থ শরীর নিয়েই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির কর্মকান্ড সমান উৎসাহে চালিয়ে যেতে থাকেন।
১৯৯৪ সালের ২ এপ্রিল শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে চিকিৎসার জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান ডেট্টয়টে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন জাহানারা ইমাম। চিকিৎসকরা জানান, তাঁর অবস্থা সঙ্কটাপন্ন। তাঁর মুখগহ্বর থেকে ক্যান্সারের বিপজ্জনক দানাগুলো অপসারণ করা সম্ভব নয়। কথা ও শব্দ উচ্চারণের ক্ষমতা হারান তিনি। কেমো থেরাপির পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় জিভে কিছু সমস্যা তৈরি হয়। অস্পষ্ট হয়ে ওঠে তার উচ্চারণ। একসময় বাকশক্তি হারিয়ে কথা বলা বন্ধ হয়ে যায় তাঁর। এ সময় ছোট ছোট চিরকুট লিখে প্রিয়জনদের সঙ্গে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা চালিয়ে যেতেন তিনি।
১৯৯৪ সালের ২২ জুনের পর থেকে তাঁর অবস্থার দ্রুত অবনতি হতে থাকে। সব ধরনের খাবার গ্রহণ ও ওষুধ প্রয়োগ বন্ধ হয়ে যায়। ২৬ জুন মিশিগানের ডেট্টয়টের সাইনাই হাসপাতালে ৬৫ বছর বয়সে জাহানারা ইমাম শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁকে ঢাকায় এনে সমাধিস্থ করা হয়।
মৃত্যুর পূর্বে তিনি দেশবাসীর কাছে শেষ আহ্বান রেখে যান, ‘মরণব্যাধি ক্যান্সার আমাকে শেষ মরণ কামড় দিয়েছে। আমি আমার অঙ্গীকার রেখেছি। রাজপথ ছেড়ে যাইনি। মৃত্যুর পথে বাধা দেবার ক্ষমতা কারো নেই । তাই আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই। আপনারা আপনাদের অঙ্গিকার ও ওয়াদা পূরণ করবেন। আন্দোলনের শেষ পর্যায় পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ে থাকবেন। আমি না থাকলেও আপনারা, আমার সন্তান- সন্ততিরা আপনাদের উত্তরসূরিরা সোনার বাংলায় থাকবে।’
জাহানারা ইমাম দ্বিমুখী যুদ্ধ করেছেন দেহের ক্যানসার আর জাতির শরীরে লেপ্টে থাকা দুরারোগ্য ক্যানসারের বিরুদ্ধে। তিনি বিশ্বাস করতেন, দেশের প্রতিটি তরুণ যেদিন এক একজন রুমির তেজকে ধারণ করে গেরিলা হবে সেদিনই ঘাতকের থাবা থেকে মুক্তি পাবে দেশ।জাহানারা দেখিয়ে দিয়ে গেছেন বাংলার মায়েরা কত সাহসী, কত শক্তিমান, কত ক্ষিপ্র, কত ত্যাগী আর মহান হতে পারেন।
আজ শহীদ জননী জাহানারা ইমাম আমাদের মাঝে আর নেই। কিন্তু তাঁর জীবন থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। তাঁকে শ্রদ্ধা জানাই।
সূত্র: একাত্তরের দিনগুলি
বাংলাপিডিয়া

 

আফরোজা পারভীন
কথাশিল্পী, কলামলেখক
অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top