সিডনী শনিবার, ২৭শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১

পাঠ আনন্দ : ড. শাহনাজ পারভীন


প্রকাশিত:
২০ জুলাই ২০২০ ২৩:৪৫

আপডেট:
২০ জুলাই ২০২০ ২৩:৪৬

 ড. শাহনাজ পারভীন

 

মানুষের দুঃখ কষ্ট হা হুতাসের টোপে ঘেরা ক্ষুদ্র এই জীবন। চলার পথের বাস্তব ঘাত প্রতিঘাতে প্রতিনিয়ত মানুষ মনোবৈকল্যের শিকার হয় প্রতিনিয়ত। সূর্য উদয় থেকে সূর্য অস্ত পর্যন্ত এবং রাতের গভীরের শেষ সময়টুকুও মানুষ মনোযাতনার অভিশাপ থেকে রেহাই পায় না। সারাক্ষণ প্রেতপুরীর দেও দত্তর মত তার পিছে মরিচিকার অন্ধকার তাড়া করে ফেরে। তার আনন্দ দিন, আনন্দ রাত কুরে কুরে খায়। নিজের অজান্তেই সে হাঁপিয়ে ওঠে। সে নিস্তার চায়। পালাতে চায় জীবন থেকে। সে শান্তি চায়, প্রশান্তির বাতাশে নিজেকে জুড়াতে চায় অহর্নিশ। তাই নিজেকে তাড়া করে ফেরে। কোথায় সেই শান্তির সুবাতাসে নিজেকে সমর্পিত করা যাবে। নিজেকে কিছুটা হলেও ভুলে থাকা যাবে। বাস্তব জীবনের এই ঘাত প্রতিঘাত, দুঃখ কষ্ট লাঘব করে শান্তির সুধাময় সুধায় নিজেকে ভরিয়ে তোলা যাবে। পৃথিবীর বিলিয়ন, মিলিয়ন, লক্ষ, কোটি মানুষ তাই নিরন্তর সুখের পেছনে ছুটছে। সে সুখের রেশে বুদ্বুদ তুলে কিছুটা সময়ের জন্য হলেও বর্তমানের বাস্তব ঘানি থেকে পলায়নপর মনোভাবের কারণে মুখ গুজে দেয় কত শত বোহেমিয়ান জীবনের খোঁজে! কখনো ভ্রমণে পিপাসা মেটায়। কখনো ভুলতে চায় অন্য কোন ভুল নেশায়। কিন্তু এতকিছু রেখেও যদি একটি ভাল বইয়ের মধ্যে মুখ গুজে জীবনের অপর প্রান্তের সুখ আস্বাদন করা যায় তো সেই আনন্দ সীমাহীন। সেই আনন্দ অনন্ত। জীবনের পরতে পরতে সে আনন্দ লেগে থাকে অন্তহীন।

ওমর খৈয়ামের ‘রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে যাবে। কিন্তু বইখানা অনন্ত যৌবনা। যদি সে রকম বই হয়।’ সেই চিরন্তন বাণী আজও মানুষের মুখে মুখে ঘোরে। হৃদয়ে হৃদয়ে ফোটে। ভাল বইয়ের নেশায় মানুষ ছোটে। প্রিয়ার ঘন কালো চোখের সাথে ভালো বইয়ের মিলন ঘটায়। প্রিয়ার ঘন কালো চোখ এক পাশে রেখে, রুটি মদের নেশায় বুদ না হয়ে ভাল বইয়ের পেছনে ছোটা মানুষের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। তাই তো বর্তমানে এই ডিজিটাল যুগ ছাড়িয়ে স্যাটেলাইট যুগে এখনো বই ছাপার অক্ষরে প্রকাশ হচ্ছে। এবং আগের যে কোন সময় থেকে এখন বেশিই হচ্ছে। কারণ যতই আমরা ডিজটাল সময়ের কথা বলি না কেন, এ্যান্ড্রোয়েড ফোন, কম্পিউটারের কথা বলি না কেন, লিখতে সেগুলো জরুরি কিন্তু পড়তে ততটা নয়। বিছানায় আয়েশ করে শুয়ে কিংবা চেয়ারে পড়ার মুডে আমরা যেভাবে আমাদের পাঠাভ্যাস গড়ে তুলেছি সেটা কখনো মোবাইলের নব টিপে পড়া সম্ভব নয়। বড় জোর দ‘ু এক পেজ পড়া যেতে পারে, কিন্তু কখনোই বিশ^ সাহিত্যের ঢাউস ঢাউস বই ই-বুক, পিসি কিংবা এ্যান্ড্রোয়েড ফোনে পড়া সম্ভব নয়। তাই পৃথিবী যতদিন থাকবে ততদিন ছাপার অক্ষরে বইও থাকবে।
গদ্য সাহিত্যের জনক ফ্রান্সিস বেকন বলেছেন ‘কিছু বই চেখে দেখতে হয়, কিছু বই গিলে ফেলতে হয়, আর কিছু বই হজম করতে হয়’। সবসময়ই বই প্রেমীরা বই ছুঁয়ে দেখেন। নতুন বইয়ের গন্ধ নেন। বইটা তাকে টানলে শেষ পর্যন্ত শেষ করেন, না টানলে সরিয়ে রাখেন, ছুঁড়ে ফেলেন অনিচ্ছাকৃত।

কোন ভাল বই যদি একবার শুরু করে কোন কারণে শেষ পর্যন্ত শেষ করা না যায় তো তার বেদনা সারা জীবন মনে থাকে। অপ্রাপ্তির বেদনায় নুয়ে থাকে। আমারও মাঝে মাঝেই সেই অপ্রাপ্তিতে ভার হয়ে যায় মন। আমারও আছে এমন মনোঃকষ্টের অভিজ্ঞতা। আমি একটি বই শুরু করে শেষ পর্যন্ত শেষ করতে পারি নি। তখন আমি অষ্টম অথবা নবম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। পড়ছিলাম ‘আমি সিরাজের বেগ’ম বইটি। বইটির লেখকের নাম আজ আর মনে নেই। বইটি অনেক খুঁজেছি। কিন্তু পাই নি কোথাও। তো বইটি শেষ করতে না পারার বেদনা আমার এই দীর্ঘ সময়েও ভুলতে পারি নি। বইটি পেয়েছিলাম আমার ঢাকা থেকে আগত বন্ধু কলির কাছে। তো হঠাৎই ওকে বিনা নোটিশে চলে যেতে হলো বিধায় বইটি আমার শেষ পর্যন্ত শেষ করা হয়ে ওঠে নি। কিন্তু ভুলতে পারি নি এখনও, সেই বই শেষ করতে না পারার যাতনা। আমি তাকে যাতনাই বলবো, যে সময় অসময়ে আমাকে কষ্ট দেয়, আমাকে মনে রাখাতে বাধ্য করে, সে তো যাতনাই!

এই ছোট্ট জীবনে খুব বেশি পড়তে পারি নি। তবে একেবারেও কম পড়িনি। পড়েছি ঠাকুমার ঝুলি থেকে দেশী বিদেশী সাহিত্যের অখ্যাত বিখ্যাত কত লেখা। কত উপন্যাস। কিন্তু সারাজীবনে পড়ে ফেলা সেরা বই বাছাই করব কিভাবে? সেই বই পড়া শুরুর কাল থেকে আজ অবধি। কত বই যে পড়া হয়েছে, পঠিত বই থেকে কত যে রস আস্বাদিত হয়েছে, কত বইয়ের কাহিনী যে ভুলে গেছি তা কি আর লেখার অক্ষরে প্রকাশ করা সম্ভব? কত বই থেকে যে জগৎ সংসারের দুর্নিবার ঘুর্ণিপাকের কবল থেকে রক্ষা পেয়েছি কিছুটা সময় ভুলেছি, আড়াল করেছি নিজেকে। তার হিসাব কি আর আজ একটি প্রবন্ধে মেলানো সম্ভব? তাছাড়া কোনটা আগে, কোনটা পরে, কোনটা চিকন, কোনটা মোটা, কোনটা প্রসিদ্ধ, কোনটা অপ্রসিদ্ধ, কোনটা জনপ্রিয়, কোনটা ততটা জনপ্রিয় নয় সে হিসাব মেলানো বড় কঠিন। তবে কোন বইটা বুকের গভীরে কত জোড়ে ধাক্কা দিয়েছিল, জগৎ সংসারকে ভুলিয়ে দিয়েছিল কিছুক্ষণ, চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল, খাবারে অরুচি এনে দিয়েছিল, কোন বইটা তরতর করে পড়ে গিয়েছিলাম, কে আমাকে রাত্রি জাগরণে বাধ্য করেছিল, কোন বইটা পড়তে যেয়ে হুচোট খেয়েছি বার বার, কোন বইটা হজম করতে কষ্ট হয়েছিল অনেক, কোন বইটা গলাধঃকরণ করতে সময় নিয়েছিল অনেক, কোন বইটা বুঝে উঠতে সময় নিয়েছিল ক্ষণিক কিংবা কোন বইটা চোখের কোণে জল এনেছিল থেকে থেকে কিংবা কোন বইটা ঠোঁটের কোণায় চিকচিক হাসি ফুটিয়েছিল অহর্নিশ তা খুব সময় নিয়ে ভাবছি না। সেই হিসাবে অনেকগুলি বইয়ের নাম সামনে চলে আসে। অনেকটা সময় নিয়ে পড়তে হয়েছিল নোবেল বিজয়ী জার্মান লেখক গুন্টার গ্রাস এর ‘দ্য টিনড্রাম’ বইটি। ১৯৯৯ সালে নোবেল পুরষ্কার প্রাপ্ত বইটি অনুবাদ করেছেন প্রমিত হোসেন। র‌্যাল্ফ ম্যানহেইম জার্মান ভাষা থেকে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেছেন ‘দ্য ট্রিন ড্রাম’। প্রথমত: ম্যান হেইমের করা ইংরেজি অনুবাদ থেকে বাংলা অনুবাদ করেছেন প্রমিত হোসেন।

বইটি ২০০২ সালে আমার চৌত্রিশ তম জন্মদিনে আমার স্নেহাস্পদ তরুণ কবি অনি আলমগীর আমাকে উপহার দিয়েছিল। বইটি পড়তে আমার অনেকটা দিন সময় লেগেছিল। শুরু করতাম। আবার থেমে যেতাম। আবার প্রথম থেকে শুরু করতাম। যেমনটি অনেকেই পবিত্র কুরআন শেষ করবার আগে করে থাকেন। প্রথম প্রথম হুজুরের কাছে যায়। কিছুদিন পর হুজুর চেঞ্জ হয়। নতুন হুজুর আসে। আবার পুরনো হুজুরের পড়া বাদ দিয়ে প্রথম থেকে শুরু করে। এই আর কি। কিন্তু আমার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। গুন্টার গ্রাসকে রেখে মাঝখানে আমি অনেক লেখককে পড়ে এসেছি। তারপর যখন ও আমাকে টানলো তখন কত রাত জেগেছি। কত রাত্রি জাগরণ শেষে দ্য টিনড্রাম শেষ করেছি। আলো আঁধারির এক বিখ্যাত উপন্যাস। উপন্যাসটি তিনটি অংশে বিভক্ত। প্রথম দুই অংশের পরষ্পর সংলগ্নতার সাথে তৃতীয় অংশের তুলনামূলক বিচ্ছিন্নতার অবস্থান রয়েছে। চেষ্টা করা হয়েছে যথাযথ অনুবাদ পাঠকের হাতে তুলে দিতে। কিন্ত যেহেতু আমি জার্মান ভাষা সম্পর্কে অজ্ঞ এবং ইংরেজি অনুবাদ আমার পড়া হয় নি। সেহেতু এই বাংলা অনুবাদকে মূল ধরেই আমি আমার পাঠকে আনন্দময় করবার চেষ্টা করেছি।

বাংলা উপন্যাসগুলোতে সাধারণত প্রথম পর্ব বা দ্বিতীয় পর্ব থাকলেও পর্বভিত্তিক শিরোনাম চোখে পড়ে নি। কিন্তু এই উপন্যাসটিতে গল্পগ্রন্থের মত পর্বভিত্তিক শিরোনাম একটি অংশকে আরেকটি অংশের সাথে মিলিয়েছে। প্রথম অংশটিতে ষোলটি শিরোনাম দ্বিতীয় অংশে বিশটি শিরোনাম এবং তৃতীয় অংশে তেরটি শিরোনাম সম্বলিত উপন্যাসটির শরীর বেড়ে উঠেছে। তিনশত বিশ পৃষ্ঠার উপন্যাসটিতে যন্ত্রণাকাতর স্মৃতির বুনন রয়েছে পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়। তবে বাংলা সাহিত্যের এমন কোন জনপ্রিয় উপন্যাসের মত নয় যে, নিঃশ^াস বন্ধ করে এক নিঃশ^^াসে পড়ে যেতে হবে তাকে। ঐ যে শুরুতেই বলেছিলাম! একবার শুরু করে আবার রেখে দিয়েছি। আবার শুরু করে আবার রেখে দিয়েছি। তারপর শুরু করে আর রেখে দিতে হয় নি। আজ থেকে পনের ষোল বছরের আগের পাঠ অনুভূতি। তবে এখনো কখনো কোন সংকটে আমি আমার দিগন্ত জোড়া গুন্টার গ্রাসের সাথে আমার সেই পরিচিত মাঠে অবস্থান নেই। যেখানে মাঝে মাঝেই লাইটপোষ্টে ছোট ছোট পাখির কিচির মিচির, আলু পোড়ার লোভনীয় গন্ধ, গরম আলু যেন অর্ধেক মুখে পুড়ে হা করে তাকে বাইরের হাওয়া যেয়ে ঠান্ডা হতে দেই। আর এক অর্ধেক একবার ডান হাত আর একবার বাম হাত করে গরম আলুর উষ্ণতা হাতের সাথে হাত সওয়া করতে থাকি। আর নাকের কাছে আলু পোড়ার গন্ধ ভুরভুর করে আমার। ক্ষেতের পরে ক্ষেত সবুজের সমারোহ বাতাশে মায়ার বাঁধন, উস্কো খুস্কো চুলের ওড়াওড়ি। মনোভূমিতে লাগছে ঝড়ের দোলা। সার্টের আস্তিন, স্কাটের ঘের, সর্ট টপসের গায়ের সাথে লেগে থাকার এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি আমাকে এখনো অন্য এক ভূবনে অন্য এক আদলে মাঝে মাঝেই দাঁড় করায়। মেডিটেশানের মনের বাড়ির মতো আমিও ছুটে যাই আমার নিজস্ব মাঠে, আঙিনায়, ভূবনে।

আমি অবাক হয়ে ভাবতে থাকি, আলু ক্ষেতে আলু পোড়া খেতে খেতে কি করে বিপ্লবের বীজ বুনতে হয় তা গুন্টারের জানা। কি করে প্রেমিককে নিজের ঘাঘড়ার মধ্যে ঢুকিয়ে তাকে লুকিয়ে ফেলতে হয়। সেটা পঞ্চাষোর্ধ নানী তার আলু রঙা ফেড হয়ে যাওয়া কিংবা চকচকে নতুন রংয়ের প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম স্কার্টের মাধ্যমে সিদ্ধহস্ত। যা অনুপমভাবে পাঠককে ডেকে নেয়।

১৯২৭ সালে পোল্যান্ডের বাল্টিক সাগরে তীরবর্তী তৎকালীন ডানজিগ শহরে গুন্টার গ্রাসের জন্ম। ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস ‘দ্য টিন ড্রাম’। মহাকাব্যিক এই উপন্যাস যুদ্ধোত্তর জার্মানিকে ভাষিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের ভষ্মস্তুপ থেকে নবজন্মের প্রেরণায় জেগে উঠতে উদ্বুদ্ধ করে। গোটা জার্মান সাহিত্যেরই ভিত নাড়িয়ে দেয় উপন্যাসটি। এমন কি সমাজকেও। এই উপন্যাসের পরতে পরতে রয়েছে যুদ্ধ পরবর্তী জার্মান সমাজের ভয়াবহ চিত্র। স্মৃতি কথাও তাতে দৃশ্যমান।‘দ্য টিন ড্রাম’ উপন্যাসটি চলচ্চিত্রে রুপদান করেন ফোলকার স্লোয়েনডর্ফ। ছবিটি কান এবং অস্কার পুরস্কার লাভ করে। বইটি আজও মনের পরতে পরতে দোলা দেয়। আজ থেকে পনের ষোল বছর আগে অনেকটা সময় নিয়ে পঠিত উপন্যাসটা কখনো কখনো এখনো মনের মনিকোঠায় জ¦লতে থাকে আকাশে মেঘভরা তারার মত মিটিমিটি।

মনিকা আলী’র ‘ব্রীকলেন’ উপন্যাসটাও একটা রাজনৈতিক, মনোজাগতিক উপন্যাস। আদিব হোসেন অনুদিত নতুন প্রকাশ প্রকাশনা নভেম্বর, ২০০৩ সালে বইটি প্রকাশ করে জাবি, সাভার। বইটি আমার হাতে আসে ২০০৪ সালের ৭ মে। আমার ছত্রিশতম জন্মদিনে আমার এক স্নেহাষ্পদ কবি বইটি আমাকে উপহার দিয়েছিল। তিনি লিখেছিলেন- ‘একজন আন্তরিক ও প্রকৃত লেখক হবার মিছিলে আপনার যাত্রা শুরু হোক নতুন রুপে।’ আমার যাত্রা নতুন রুপে শুরু হয়েছে কি না, জানিনা। তবে নতুন নতুন স্বপ্নের দরজা আমার সামনে খুলে গেছে নানান পারঙ্গমতায়, না কি অক্ষমতায় তা আর পেছনে ফিরে দেখা হয় নি কখনো। চলছি। উপন্যাসের নাজনীন, শাহানা, হাসিনার মত। নানান অনুসঙ্গে। কখনো বা নাজনীন হয়ে উঠি, কখনো বা আমার নিক নেমের সাথে মিল রেখে শাহানা হয়ে উঠি কখনো বা হাসিনার মত ফুসে উঠি আকাশ ছাড়িয়ে। কিংবা শেষ পর্যন্ত নাজনীন হয়ে যাই কুশলতায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই হতে পারি বলে মনে হয় না। এই উপন্যাসটিতে হাসিনা নামের একটি বিদগ্ধ চরিত্র আছে যে ঢাকায় থাকে। উপন্যাসের নায়িকা এবং তার পরিবার থাকে ল-নের টাওয়ার হ্যামলেটসে। হাসিনাকে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে কয়েকটি চিঠির মাধ্যমে। একের পর এক দুর্ভাগ্যে তার জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। হাসিনা চরিত্রটি সৃষ্টি করতে লেখকের মধ্যে এক ধরনের তাড়না কাজ করেছে। তাড়নার পেছনে লুকিয়ে ছিল তার উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া স্মৃতি, তার ভেতরে লুকায়িত লোককাহিনী, যে কাহিনী সে তাকে জানিয়েছে।

এ উপন্যাসটিতে অভিবাসীদের প্রথম ও দ্বিতীয় প্রজন্মের মধ্যে সংঘাতের ব্যাপারে লেখক তার অভিজ্ঞতার কথা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বলতে চেয়েছেন। লেখকের বাবা তার কাছে তার গ্রামের যে সমস্ত গল্প তাকে শোনাতেন সেগুলোও তার মধ্যে ছাপ ফেলে থাকবে। লেখক মনিকা আলী ১৯৬৭ সালে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সাড়ে তিন বছর বয়সে বাংলাদেশ ছেড়ে পরিবারের সঙ্গে ব্রিটেনে চলে যান। সেখানেই বেড়ে ওঠেন। তার বাবা বাঙালি, মা ইংরেজ। স্বামী ও দু সন্তানের সাথে তিনি বর্তমানে ল-নে বসবাস করছেন। একই সাথে তিনি দুইটি কখনো তিনটি কালচার কিংবা সিভিলাইজেশানকে সাথে নিয়ে বেড়ে উঠেছেন। এবং এখনো এক ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্যে বেড়ে চলছেন নির্মিমেখ। তাই এই উপন্যাসে এক মনোজাগতিক ভাঙা গড়ার খেলা রয়েছে যা সহজেই একজন পাঠককে যে কোন পরিস্থিতিতে তার উদ্ভুত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে চলতে সাহায্য করবে। এই উপন্যাসে একই সাথে ব্রিটেন এবং বাংলা দেশের শিক্ষা, সভ্যতা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, রাজনীতির যে সংমিশ্রণ এবং তুলনামূলক আলেখ্য তা অনুধাবনযোগ্য। বইটির লেখক নিজেই স্বীকার করেছেন আমি ফিকশন হিসেবে যা লিখেছি-, তার কতটুকু আসলে কল্পনা আর কতটুকু আমার অভিজ্ঞতার ফসল? বইটির একটি চরিত্র ‘দেশে ফিরে যাওয়া রোগ’ বলে একটা কথা উল্লেখ করে। এটা আমার অনুসন্ধানের একটা উর্বর ক্ষেত্র হতে পারে।’ ব্রিকলেন উপন্যাসের অনেক চরিত্র স্বদেশের স্বপ্ন লালন করে। এমন কি যে সব তরুণ এ দেশে জন্মগ্রহণ করেছে, কখনও বাংলাদেশ দেখেনি, তারাও এবং বিশেষ করে তারাই এ স্বপ্ন দেখে। আমরা জানিনা, লেখকের পরিবারের ইতিহাসের সাথে এ সব চরিত্রের সুস্পষ্ট মিল খুঁজে পাওয়া যাবে কি না? তবে এর অনুস্বরণ অনুরণন অনুভব করতে পারি। সবমিলিয়ে স্বদেশ চেতনা স্বদেশের প্রতি দূর্বার আকর্ষণ, প্রেম, প্রেমের ভাঙন আবার তাকে কিভাবে জোড়া দিতে হয় নিজের সর্বস্ব দিয়ে তা এ উপন্যাসের পরতে পরতে খেলা করে। অবাক কা-, ‘দ্য টিন ড্রাম’ উপন্যাসটির মতো এই উপন্যাসটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩২০। এই দীর্ঘ পৃষ্ঠার এ উপন্যাসটিতে সব মিলিয়ে এক একটি সময়কে ধারনের মাধ্যমে তার গতিশীল লেখনী এগিয়ে নিয়েছেন লেখিকা। যা মনের কোনে দোলা দিয়ে যায় সময় অসময়। অনেক বইয়ের ভিড়ে মনিকা আলী’র ব্রিকলেন মনে পড়বে পাঠকের।


আমি এবার যে উপন্যাসটির কথা লিখবো সেটির নাম সাতকাহন এর কথা। যে উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যের বহুল পঠিত উপন্যাসের তালিকায় উঠে এসেছে বহু আগে থেকেই। আমার মনে হয়, এমন কোন কিশোরী বালিকা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, যে জীবনে একবার সাতকাহন এর দীপাবলী’র মতো হতে চায় নি। কৈশোরের প্রথম সময়ে দীপাবলীর সংগ্রাম আমাদেরকে নতুন এক সংগ্রামকে চিনিয়েছে। যা আমি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি। জীবনের কত বাঁকে বাঁকে দাহ্য সময়ে মনে মনে যে আমি দীপাবলী হয়ে উঠেছি। এবং ভেবেছি শক্তি সঞ্চয় করেছি, নিশ্চয়ই দীপাবলীর চেয়ে তো ভাল আছি। শৈশবে হয়ত মাকে হারিয়েছি বাবা তো নিখোঁজ নন। বাবা তো হারিয়ে যান নি। তাহলে কেন পারবো না। আবার জেগে উঠেছি। পাশ ফিরেছি। বাঁক বদল করেছি। দীপাবলী হয়েছি। যুদ্ধ সহজ করেছি। তাই মনে হয়, কৈশোরে প্রতিটি মেয়েরই একবার সাতকাহন পড়ে নিতে হয়। এ যুগের অন্যতম জনপ্রিয় কথাকার সমরেশ মজুমদারের কুশলী কলমে আখ্যান বর্ণনার সুদীর্ঘ, সুকল্পিত, সুবিন্যস্ত, সাবলীল এই সাতকাহন।
এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র সাহসী, স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত নায়িকা দীপা দীপাবলী। ভাগ্যের প্রতিকুলতার বিরুদ্ধে নিরন্তর যুদ্ধ করতে করতে বহু বাঁধা, বহু বিপর্যয়, বহু যন্ত্রণা পার হতে হতে কীভাবে দীপা সন্ধান পেলো অমল এক তীরের, তাই নিয়েই এ কাহিনীর প্রথম খন্ড।
সাতকাহন উপন্যাসের প্রাকৃতিক বর্ণনা এত মাধুর্যম-িত যে, মনে হয় নিজ চোখে দেখছি। এই পা দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছি উত্তর বাংলার চা বাগান, গাছ গাছালি আর আঙরাভাসা নদীতে স্নান করছি যখন তখন। যা এই উপন্যাসের সূচনায় পাঠককে দেখিয়ে দিয়েছেন আখ্যানকার। উপন্যাসের কাহিনী বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে এর পটভুমি ক্রমশ বিস্তৃত হয়েছে। চালচিত্রে যুক্ত হয়েছে পঞ্চাশের কলকাতা ও শহরতলি, কো এডুকেশন কলেজ, মেয়েদের হোস্টেল, কফি হাউস, সমকালীন ছাত্র ও রাজনৈতিক আন্দোলনের ছবি।

উপন্যাসের উত্তরবঙ্গের ভাগ্যবিড়ম্বিত সেই মেয়ে শৈশবে যে মাকে হারিয়েছে, বাবা নিখোঁজ এবং দীর্ঘকাল পর্যন্ত মাসী ও মেসোমশাইকে জেনে এসেছিল মা বাবা হিসেবে। দশ বছর বয়সে মাত্র বাহাত্তর ঘন্টার জন্য যাঁর সিঁথিতে উঠেছিল সিঁদুর আর হাতে শাঁখা- নোয়া, দুঃস্বপ্ন^বৎ এই নিষ্ঠুর অতীতকে মুছে ফেলে যে শুরু করতে চেয়েছে নতুন জীবন, বদলাতে চেয়েছে নিজের ভাগ্য। সেই মেয়ে লাখ লাখ টাকার সম্পত্তি দাতব্য করে যে নিজে কর্পদশুন্য, কাছের মানুষদের ভিতরের বিভৎস, লোভী চেহারা তাকে বারবার আঘাত করে, তবু পারে না পর্যুদস্ত করতে, যা জীবনে এসে মেশে নাটক, আবার জীবন কেবলই ছাপিয়ে যায় নাটককে। একদিকে দীপার এই চরিত্রচিত্রণে, অন্যদিকে বহুবিচিত্র ঘটনার প্রবল ঘাতপ্রতিঘাতে, চারপাশের চরিত্রাবলীর সঙ্গে সম্পর্কের সুক্ষè টানাপোড়েনে, মানষী হৃদয়ের বহু অচেনা দিকের নিপূণ উদঘাটনে সাতকাহন সত্যি অনন্য। ৩৫২ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটি প্রকাশ করেছে আনন্দ পাবলিশার্স লিঃ এর পক্ষে আনন্দ প্রেস, কলকাতা।

উত্তরাধিকার। হ্যাঁ বলছিলাম সমরেশ মজুমদার এর বিখ্যাত উপন্যাস উত্তরাধিকার এর কথা। উত্তরাধিকার এর পৃষ্ঠা সংখা ৪০৮। সে দিক থেকে একে আমি ঢাউসই বলবো। কিন্তু দীর্ঘ উপন্যাস পাঠের যে যাতনা তা এতে নেই। কি করে যেন জলপাইগুড়ি শহর আর ডুয়ার্সের চা- বাগানের সময়গুলো কেটে যায় ছায়াবৃক্ষের সাথে সন্ধা সকাল। বইটি হাতে নিলে পাঠক মাত্রই তা জানতে পারবেন।
উত্তরাধিকার এর যে সংখ্যাটি আমার পড়া হয়েছে সেটি দ্বাত্রিংশ মুদ্রণ। মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ ১০ শ্যামাচরণ দে স্ট্রীট কোলকাতা ৭০০০৭৩ থেকে এস. এন. রায় কর্তৃক প্রকাশিত।

 

ড. শাহনাজ পারভীন
কবি, গবেষক, কথাসাহিত্যিক, উপাধ্যক্ষ, উপশহর মহিলা কলেজ, যশোর।
সম্পাদক: দ্যোতনা, নান্দনিক ধারার সাহিত্য কাগজ, যশোর।
ছড়াঘর, ছড়া বিষয়ক সাহিত্যের কাগজ, যশোর।
সভাপতি, অগ্নিবীণা, কেন্দ্রীয় সংসদ, যশোর।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top