সিডনী বুধবার, ৮ই মে ২০২৪, ২৫শে বৈশাখ ১৪৩১

কষ্টডোরে বাঁধা নিবাসউদ্দিন : আফরোজা অদিতি


প্রকাশিত:
৩০ জুলাই ২০২০ ০০:২০

আপডেট:
৮ মে ২০২৪ ০৬:১৮

 

এবারে কোভিড-১৯ এর কারণে খুব কড়াকড়ি রয়েছে হজ পালনে। এবং বৈশ্বিক মহামারীর জন্য সীমিত আকারে হজ আয়োজনের প্রেক্ষিতে হজ করার জন্য সমস্ত কার্যক্রম শেষ করার পরেও শেষরক্ষা হলো না নিবাসউদ্দিনের; জমাকৃত অর্থ ফেরত দিবে বলেছে কতৃপক্ষ। জমাকৃত অর্থ ফেরত পাওয়া না পাওয়া নিয়ে নয়, অনেকদিনের ইচ্ছে পূরণ হলো না বলে খুব মন খারাপ নিবাসউদ্দিনের। অনেকদিনের ইচ্ছে; অনেক কাজের চাপে হজে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। প্রত্যেক মানুষের ওপর ঈশ্বর প্রদত্ত কিছু দায়-দায়িত্ব থাকে, সেই অর্পিত কাজের দায়িত্ব অর্থাৎ সন্তানের দায়-দায়িত্ব, বাবা-মা-স্ত্রী-পরিবারের ন্যায্য অধিকার বুঝিয়ে না দেওয়া, দেশ ও দশের দায়িত্ব পালন না করা পর্যন্ত আল্লার দরবারে হজ কবুল হয় না; বয়ান শুনেছে! যাকগে, যাও এবারে কিছু টাকা জমিয়ে কিছু টাকা জমি বিক্রি করে হজ যাওয়ার ইচ্ছে পোষণ করেছিল; কিন্তু বিধি বাম! এবারে হজে যেতে পারছে না খরবটা শোনার পার থেকেই মন খারাপ হয়ে আছে নিবাসউদ্দিনের। মেয়ে বিদেশে থাকে! নিবাসউদ্দিনের ইচ্ছে ছিল হজ শেষে মেয়ের কাছে গিয়ে থেকে আসবে কিছুদিন! এখন বাড়িতে একাই থাকে নিবাসউদ্দিন; এতোদিন মা ছিলেন, তিনি গত হয়েছেন দুই বছর! আর স্ত্রী গত হয়েছে তো অনেকদিন। একটাই মেয়ে, বড়ো হয়েছে দাদির কাছে অর্থাৎ নিবাসউদ্দিনের মায়ের কাছে! মেয়ের বিয়ে হয়েছে; মেয়ে বিদেশ, মা-ও নেই! নিবাসউদ্দিনের এখন আগে-পিছে কেউ নেই!

নিবাসউদ্দিন বিয়ে করেছিলেন যুদ্ধের আগে। মেয়ের বয়স যখন এক তখন যুদ্ধ শুরু; যুদ্ধে গিয়েছিলেন। যুদ্ধের মাঝে মেয়ের মুখ খুব মনে পড়তো তাঁর; দেখতে ইচ্ছে হতো খুব। যুদ্ধ!যুদ্ধ! যুদ্ধ! মনের মধ্যে ছিল সেই একটিই তাগিদ; স্বাধীন দেশ! স্বাধীন দেশের স্বপ্ন ছিল। স্বাধীন পতাকা, লাল-সবুজের পতাকা উড়বে দেশের বাতাসে সেই স্বপ্নে বিভোর ছিল তাঁর মন! স্ত্রী,মেয়ে, মা-বাবা কারো কথা ছিল না মনে; মনে ছিল শুধুই দেশ, একটি স্বাধীন দেশ। কিন্তু যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে এসে দেখে মারা গেছে বাবা! বেঁচে আছে মা, স্ত্রী-আর ঐ একবছরের মেয়ে। পাকি-সৈন্যরা সব তছনছ করেছে আগুন ধরিয়ে, বাবাকে মেরেছে আর স্ত্রীকে জিন্দালাশ বানিয়ে ক্ষান্ত দিয়েছিল। নিবাসউদ্দিনের অনেক কিছুর বিনিময়ে পাওয়া এই দেশ; এই দেশ ছেড়ে কখনো বিদেশ যেতে চাননি, আর মুক্তিযোদ্ধা ভাতাও নেননি, নেননি সার্টিফিকেট! নিবাসউদ্দিন মনে করেন, দেশ স্বাধীন করেছেন সবার জন্য; শুধু নিজের জন্য নয়! দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে যে চাকরি করতেন যুদ্ধফেরত দেশে সেই চাকরি ফিরে পেয়েছেন! অভাব হয়নি; বসতবাটি ছিল, ছিল কিছু জমিজমা! চাকরি করেছেন; ক্ষেতের কাজ নিজের হাতে করেছেন।

কোন বারণ না শুনে বউটা চলেই গেল ওকে ছেড়ে। এতো করে বারণ করলো তাও চলে গেল বউটা। বউটাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল পাকি-সৈন্যরা; কয়েকমাস পর পালিয়ে এসেছিল গাঁয়ে। ফিরে আসার পরে কারো সঙ্গে কথা বলতো না, মিশতো না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যখন দেশে ফিরলো নিবাসউদ্দিন তখন সব ওকে খুলে বলেছিল নিরুপমা, ওর বউ! সব বলার পরে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেছিল, ‘তোমার সঙ্গে আমার আর থাকা চলে না। এই দেহ অচ্ছ্যুৎ! তুমি আমার ভালোবাসার মানুষ, আমার দেবতা! দেবতার পূজা কখনও বাসি ফুলে হয় না! তোমার জন্য এই দেহের পূজা নয়!’ নিরুপমার কথা শুনে খুব কান্না পেয়েছিল নিবাসউদ্দিনের; দুহাতে বুকে জড়িয়ে ধরতে গিয়েছিলেন ওকে কিন্তু নিরুপমা দূরে গিয়ে বলেছিল, ‘না, না, আমাকে ছুঁয়ো না; আমি শুধু তোমাকে একবার দেখবো এই অপেক্ষাতে ছিলাম।’ তারপর ছুটে দরোজায় খিল এঁটে দিয়েছিল। পরদিন অনেক বেলা পর্যন্ত দরোজা খুলছিল না, তখন দরোজা ভেঙে দেখে ঘরের আড়ার সঙ্গে ঝুলছে দেহটা। গলায় শাড়ির আঁচল জড়িয়ে ঝুলে আছে; ঝুলে আছে নিরুপমা!

বউটাকে প্রাণের থেকে বেশি ভালোবাসতো নিবাসউদ্দিন। ওর চলে যাওয়াটা কিছুতেই সহ্য করতে পারেননি! এখনও তাঁর মন পড়ে আছে সেইদিনে, যেদিনে গত হয়েছিল নিরুপমা; ঐ দিনেই আটকে আছে নিবাসউদ্দিন। নিরুপমা ধর্মান্তরিত হয়েছিল। ওর পরিবার মেনে নিলেও নিরুপমার পরিবার মেনে নেয়নি; নিরুপমার পরিবার এখনও দোষারোপ করে ওকে। সব কিছু মেনে নিয়ে কাটিয়ে দিয়েছে দিন! এতো কষ্টের মধ্যেও একটু শান্তি, একটু সুখ চেয়েছিল; এই একটা জীবনে কোন চাওয়া-পাওয়া ছিল না, ছিল না কোন ইচ্ছে! এই একটি ইচ্ছে পোষণ করেছিল হজ করার! কাবা শরীফ দর্শন করার ইচ্ছেতেই ওর হজ করতে চাওয়া! কিন্তু হলো না! চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু। কী জানি কেন কষ্ট হচ্ছে; আবার এই কষ্টের মধ্যেও মনে হচ্ছে ‘যা হয় তা ভালোর জন্যই হয়।’ হয়তো বা কিছু ভালো লুকিয়ে আছে এর ভেতরে।

সারাদিন এভাবেই বসে থাকে নিবাসউদ্দিন। আজ নিরুপমার মৃতুদিবস! এইদিন নিবাসউদ্দিন বের হন না কোথাও! খান না কিছু! শুধু নামাজ পড়ার সময় নামাজ আদায় করেন, আবার এসে বসেন এই চেয়ারে। বিশেষ এইদিন এবং খুব মন খারাপ হলে এই চেয়ারে এসে বসেন। চেয়ারের পেছনের কুশনটা অনেক পুরানো! ছেঁড়া ছেঁড়া হয়েছে, পাল্টান না! স্ত্রীর হাতের চিহ্ন! বড্ড মায়া লেগে আছে এর পরতে পরতে। বসে আছেন নিবাসউদ্দিন। ভাবছেন ভুলটা তাঁরই! হজ করতে না চেয়ে ঐ অর্থ কোন প্রতিষ্ঠানে, এই যারা দুস্থ-দরিদ্রদের নিয়ে কাজ করে; যারা পথশিশুদের নিয়ে কাজ করে তাদের দিয়ে দিলেই হতো! এখন তো আর কিছুই করার নেই। আরও একটা বিষয় আছে; কোরবানী! এই কোরবানীর কী হবে। একে কোভিড নামের মহামারী তারপরে চারদিক বন্যার জলে সয়লাব। শোনা যাচ্ছে আগস্ট পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে বন্যা। গরুর খামারীরা কীভাবে গরু হাটে তুলবে তাও চিন্তার বিষয়! তাছাড়া ‘সামাজিক দূরত্ব’ মেনে গরুর হাটে যাবেই বা কীভাবে গরু কিনতে? কী করা যায় এ নিয়ে ভাবছে! এবারে অন-লাইনে গরু-ছাগল বেচা-কেনা হচ্ছে চোখে পড়ার মতো! সার্চ করেছেন, দেখেছেনও! কিন্তু কথা একটা থেকেই যাচ্ছে যে গরুটা পছন্দ হলো সেটাই কি তারা দিবে? যদি না দেয়, তাদের সঙ্গে তো আর ঝগড়া বিবাদ করা যাবে না। নিবাসউদ্দিন ঝগড়া করতে পারেন না! ঝগড়া করা তো দূরে থাক কাউকে কটু কথা বলতে পর্যন্ত পারেন না। নিবাসউদ্দিন এলোমেলো ভাবনার মধ্যে ভাসছেন!

হঠাৎ বেজে ওঠে মোবাইল। আমেরিকা থেকে। মোবাইল কানে নিয়ে কথা শোনার পরেই হাত থেকে পড়ে যায় মোবাইল। হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে মেয়ে! করোনা হয়েছে! আইসিইউ-তে মেয়ে! কিছুই বলতে পারে না নিবাসউদ্দিন! বলার নেইও কিছু! নিবাসউদ্দিন বুঝতে পারছেন তাঁর জীবনটা শুধুই কষ্টের ডোরে বাঁধা; সুখ হলো দূর আকাশের ধুমকেতু! ধরাছোঁয়ার বাইরে!

দূরে আকাশে ভেসে যাওয়া মেঘ দেখছেন আর ভাবছেন; দূর আকাশের ঐ মেঘের মতো একরাশ শূন্যতা তাঁকে গ্রাস করতে ধেয়ে আসছে!

 

আফরোজা অদিতি
কবি ও কথা সাহিত্যিক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top