সিডনী বুধবার, ১লা মে ২০২৪, ১৮ই বৈশাখ ১৪৩১

মাটিলগ্ন শিল্পী এসএম সুলতান : ড. আফরোজা পারভীন


প্রকাশিত:
১২ আগস্ট ২০২০ ২২:৪৪

আপডেট:
১ মে ২০২৪ ১৮:৪৯

ছবিঃ চিত্রশল্পিী এস এম সুলতান

 

( শেখ মোহাম্মদ সুলতান: ১০ আগস্ট ১৯২৩ - ১০ অক্টোবর ১৯৯৪। যিনি এস এম সুলতান নামে সমধিক পরিচিত। একজন বাংলাদেশী প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী। তিনি ছিলেন একজন সুর সাধক । বাঁশিও বাজাতেন। কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১৯৮২ সালে তাঁকে এশিয়ার ব্যক্তিত্ব হিসেবে ঘোষণা করে)।
এস.এম সুলতানের পুরো নাম শেখ মোহাম্মদ সুলতান। তবে তিনি সুলতান নামেই সমধিক পরিচিত। তিনি একজন বড় চিত্রকর। আড়ালচারী, ক্ষণজন্মা । তাঁর শিল্পচেতনায় মূল উপজীব্য ছিল স্বদেশ-ঐতিহ, প্রকৃতি-পরিবেশ ও মানুষ। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষ শক্তিময়তার দিক থেকে অনেক বড়। সকল শক্তির আধার তারা। তাদের অস্থি-মজ্জায় পুঞ্জীভূত অঢেল প্রাণরস। এ ভাবনার পরিচয় মেলে সুলতানের সৃষ্টি করা ক্যানভাসে। তাঁর ছবিতে কখনো কৃশকায় মানুষ দেখা যায় না, দেখা যায় পেশীবহুল স্বাস্থ্যবান অবয়ব। কেন সে জিজ্ঞাসার জবাব তাঁর নিজের জীবন।
১৯২৩ সালের ১০ আগস্ট চিত্রা নদীবিধৌত তেভাগা আর নীলবিদ্রোহের স্মৃতিধন্য নড়াইলের মাছিমদিয়া গ্রামে জন্ম সুলতানের। মাছিমদিয়ায় কয়েকটি পরিবার নিয়ে গড়ে উঠেছে ধাউড়িয়া বাড়ি। ধাওড়িয়া বাড়ির লোক মেছের নড়াইলের জমিদার বাড়িতে রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। স্ত্রী, ছেলে লালমিয়া ও মেয়ে ফুলমণিকে নিয়ে তাঁর চারজনের সংসার। অভাব অনটন লেগেই আছে এ সংসারে। মেছেরের একার উপার্জনে চলে এই সংসার। লালমিয়া ও ফুলমণিকে রেখে মেছেরের স্ত্রী হঠাৎ মারা যান। মেছের দ্বিতীয় বিয়ে করেন নড়াইল থানার দুর্গাপুর গ্রামের আয়াতুন্নেসাকে। পরিবারের আভাব-অনটন লেগেই আছে। রাজমিস্ত্রির কাজ করে মেছের যা আয় করেন তার পরিমাণ খুব সামান্য। সংসারের অভাবের যন্ত্রণার সাথে বাড়তি যোগ হয় লালমিয়ার উপর সৎ মায়ের অত্যাচার।
প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দেওয়ার সামর্থ্য তার পরিবারের ছিল না। তা সত্ত্বেও তাঁর পিতা ১৯২৮ সালে তাঁকে নড়াইলের ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি করে দেন। পাঁচ বছর চলে সে শিক্ষা। কিন্তু আর দশটা ছেলে মেয়ের মতো নিরবচ্ছিন্নভাবে পড়াশুনা করার সৌভাগ্য হয়নি সুলতানের। ছেলেবেলাতেই বাবার সাথে রাজমিস্ত্রির কাজ শুরু করেন। জীবনের শুরুতেই তাঁকে সবকিছু বাদ দিয়ে পেশীতে নির্ভর করে নির্বাহ করতে হয়েছে জীবিকা। লড়াই করতে হয়েছে দৈনন্দিন দারিদ্রের সঙ্গে। এ লড়াইয়ের জন্য কোমল পেশীতে সঞ্চার করতে হয়েছে শক্তি ও সাহস। পরবর্তী সময়ে তিনি যে মানুষকে শক্তিমান ও মহীয়ান করে চিত্রিত করেছেন তা নিছক শিল্প নয়, ঘনিষ্ট জীবনবোধ ও সমাজ বাস্তবতারও বহিঃপ্রকাশ। কেন তাঁর পুরুষেরা পেশীবহুল, নারীরা শক্তিমত্ত সে প্রশ্নেরও জবাব।
আর সে কারণেই জীবনবাদী শিল্পী সুলতান বলেন, “আমি আমার বিশ্বাসের কথা বলছি। আমার সকল চিন্তা, সবটুকু মেধা, সবটুকু শ্রম দিয়ে যা কিছু নির্মাণ করি তা কেবল মানুষের জন্য, জীবনের জন্য, সুন্দর থেকে সুন্দরতম অবস্থায় এগিয়ে যাবার জন্য। আমার ছবির মানুষেরা, এরা তো মাটির মানুষ, মাটির সঙ্গে স্ট্রাগল করেই এরা বেঁচে থাকে। এদের শরীর যদি শুকনো থাকে, মনটা রোগা হয়, তাহলে এই যে কোটি কোটি টন মানুষের জীবনের প্রয়োজনীয় বস্তু সকল আসে কোত্থেকে? ওদের হাতেই তো এসবের জন্ম। শুকনো, শক্তিহীন শরীর হলে মাটির নিচে লাঙলটাই দাববে না এক ইঞ্চি। আসলে, মূল ব্যাপারটা হচ্ছে এনার্জি, সেটাই তো দরকার। ঐ যে কৃষক, ওদের শরীরের অ্যানাটমি আর আমাদের ফিগারের অ্যানাটমি, দুটো দুই রকম। ওদের মাসল যদি অতো শক্তিশালী না হয় তাহলে দেশটা দাঁড়িয়ে আছে কার উপর? ওই পেশীর ওপরেই তো আজকের টোটাল সভ্যতা।”
কষ্টে চলছিল লালমিয়ার পড়াশোনা, বাবার কাজে সহযোগিতা আর বাঁশি বাজানো। চমৎকার সুন্দর বাঁশি বাজাতেন লালমিয়া। তাঁর এই গুণটির কথা স্কুলের সহপাঠীসহ এলাকার সব মানুষ জানত। নড়াইলের জমিদার বাড়ির পুকুর ঘাট, স্কুলের অনুষ্ঠান ছাড়াও বনবাদাড়ে ঘুরে ঘুরে বাঁশি বাজাতেন তিনি। লালমিয়ার বাঁশি বাজানোর সুখ্যাতি ছিল দিকে দিকে। এমন কথাও শোনা গেছে, জমিদার বাড়ির পুকুর ঘাটে লালমিয়া বাঁশি বাজানোর সময় কালো কেউটে সাপ দুই পাশে নাচত।
লালমিয়া বাবার কাজে সহযোগিতা করার জন্য প্রায়ই বাবার সাথে নড়াইলের জমিদার বাড়ি যেতেন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে দালানের ছবি আঁকতেন তিনি । সে কারণে জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ রায়বাহাদুর ও তাঁর শিল্পরসিক ছোট ভাই লালমিয়ার ছবি আঁকার নেশার কথা জানতেন। সুলতানের ইচ্ছা ছিল কলকাতায় গিয়ে ছবি আঁকা শেখার। কিন্তু আর্থিক অসঙ্গতি সে ইচ্ছার পথে ছিল বড় বাধা।
সৎমায়ের সাথে রাগারাগি করে ১৯৩৮ সালে কলকাতা যান তিনি। কলকাতায় গিয়ে তিনি ধীরেন্দ্রনাথ রায়ের বাড়িতেই ওঠেন। ওই বাড়িতে গিয়ে উঠার পর একদিন ধীরেন্দ্রনাথ রায় লালমিয়াকে বিলেত থেকে ছবি আঁকার উপর বিভিন্ন স্কেচের দুটো বই এনে দিয়ে বললেন, 'লালমিয়া, যদি ভালো করে ছবি আঁকা শিখতে চাস, তাহলে তোকে এই প্রাথমিক বিদ্যেগুলো শিখতে হবে।' বই দুটো হাতে পাওয়ার পর ধীরে ধীরে ছবি আঁকায় আরো দক্ষ হয়ে ওঠেন লালমিয়া। জমিদারের ছোট ভাই একদিন লালমিয়াকে ডেকে নিয়ে বললেন, ' দেখো লালমিয়া, তুমি যদি বড় শিল্পী হতে চাও, তাহলে তোমাকে ভালো শিক্ষকের কাছে ছবি আঁকা শিখতে হবে। তার মানে, তোমাকে আর্ট স্কুলে বা কলেজে ভর্তি হতে হবে। তার আগে তোমাকে ইন্টারভিউ দিতে হবে এবং ইন্টারভিউ দিয়ে পাশও করতে হবে।'
সে সময় কলকাতা আর্ট কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য অন্তত এন্ট্রান্স ( মেট্রিক) পাশের যোগ্যতা প্রয়োজন হতো। সে যোগ্যতা লালমিয়ার ছিল না। কারণ পাঠ অসমাপ্ত রেখেই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এসেছিলেন তিনি। এ নিয়ে যখন লালমিয়ার আর্ট কলেজে পরীক্ষা দেওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়ে তখন জমিদার বাবু বললেন, 'একটা উপায় অবশ্য আছে। শাহেদ সোহরাওয়ার্দীকে ধরতে হবে। তিনি এই কলেজের ভর্তি কমিটির সদস্য। তিনি বলে দিলে আর কোনো সমস্যা থাকবে না।'
ঠিকানা নিয়ে শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর বাড়িতে যান লালমিয়া। তিনি যখন সেখানে পৌঁছান যে মুহূর্তে সোহরাওয়ার্দী গাড়িতে করে বাইরে বেরুচ্ছিলেন। বাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন লালমিয়া। তাঁকে দেখতে পেয়ে সোহরাওয়ার্দী ইশারায় ডাকলেন। লালমিয়া সোহরাওয়ার্দীর কাছে গিয়ে বিষয়টা অকপটে খুলে বললেন । সোহরাওয়ার্দী সব কথা শুনে গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির ভেতর নিয়ে গেলেন তাঁকে। একটি ঘর দেখিয়ে বললেন, 'ঐ ঘরের খাটে যিনি বসে আছেন তাঁকে তুই মা বলে ডাকবি।’ ঐ মহিলা সোহরাওয়ার্দীর চাচার স্ত্রী, নিঃসন্তান। লালমিয়া ঘরে ঢুকে দেখলেন, বিশাল খাটের ধবধবে বিছানার উপর সোনার গহনা পরা প্রৌঢ়া এক সুন্দরী মহিলা বসে আছেন। লালমিয়া সোহরাওয়ার্দীর কথামতো মহিলাকে 'মা' বলে ডাকলেন। খাট থেকে নেমে এসে লালমিয়াকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি।
এর পর আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়া নিয়ে আর কোনো সমস্যাই হয়নি লালমিয়ার। ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে প্রথম হলেন তিনি। ১৯৪১ সালে আর্ট কলেজে ভর্তি হলেন। আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়ার পর শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর বাড়িতে থেকেই কলেজে যেতেন লালমিয়া। সোহরাওয়ার্দী লালমিয়ার নতুন নাম রাখেন শেখ মোহম্মদ সুলতান। শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর ছিলেন আর্টের অসাধারণ সমঝদার ও সমালোচক। তাঁর বিশাল লাইব্রেরির তত্ত্বাবধায়ক হলেন তিনি। সুলতানকে নিজের ছেলের মতোই ভালবাসতেন শাহেদ সোহরাওয়ার্দী। সে বাড়িতে কোনোকিছুরই অভাব ছিল না তাঁর। লাইব্রেরি জুড়ে ছিল বিশ্ববিখ্যাত সব চিত্রকরদের শিল্পকর্ম আর সেরা সেরা সমালোচকদের বই পুস্তক। পাশাপাশি সোহরাওয়ার্দী পরিবারে থাকার কারণেই আরবি, ফারসি ও ইংরেজিতে বেশ দক্ষ হয়ে উঠলেন তিনি। সে সময় আর্ট কলেজের কোর্সের মেয়াদ ছিল ছয় বছর। সুলতান প্রথম বছরের পরীক্ষায় দ্বিতীয় এবং পরের দুই বছর পর পর প্রথম হলেন। ভালোই চলছিল সবকিছু, কিন্তু সুলতান চার বছরের মাথায় এসে হাঁপিয়ে ওঠেন। জেগে ওঠে তার বোহেমিয়ান সত্তা। এই বাঁধাধরা লেখাপড়া রীতি-নীতি তাঁর অসহ্য লাগে। সেটা ১৯৪৪ সাল। সুলতানের মাঝে জেগে ওঠে মাছিমদিয়ার দুরন্ত লালমিয়া। টান পড়ে নিরুদ্দেশ হওয়ার। কলেজ, কলেজের সহপাঠী, প্রিয় শিক্ষকদের ভালবাসা, সোহরাওয়ার্দী পরিবারের স্নেহ-মমতা, সোনালি সাফল্যের হাতছানি- কোনোকিছুই সুলতানকে আর আটকাতে পারল না। সব পেছনে ফেলে একদিন কলকাতা ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন তিনি। প্রথমে গেলেন দিল্ল¬ী, দিল্ল¬ী থেকে লখনউ, সেখান থেকে হিমালয়ের পাদদেশ। এভাবেই তাঁর ভবঘুরে শিল্পী জীবন কাটতে লাগল ঘুরে ঘুরে। কন্যাকুমারিকা থেকে হিমালয় পর্যন্ত গোটা ভারতবর্ষ চষে বেড়ান তিনি।
তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়। ছোট বড় শহরগুলিতে ইংরেজ ও আমেরিকান সৈন্যদের ছবি এঁকে ও তাদের কাছে ছবি বিক্রি করে জীবন ধারণ করেছেন এবং প্রদর্শনীও করেছেন। শিল্পী হিসেবে তিনি তখন কিছুটা পরিচিতি লাভ করেছিলেন। ভয় নেই, ভাবনা নেই, নেই কোনো দায়-দায়িত্ব, আছে শুধু সুন্দরের প্রতি সুতীব্র টান আর ছুটে চলার গতি। এরপর কাশ্মীরের উপজাতীয়দের সাথে বসবাস শুরু করেন । তাদের ছবি আঁকেন তিনি। মিসেস হাডসন নামে কানাডিয় এক মহিলার উদ্যোগে ১৯৪৫ সালে ভারতের সিমলাতে সুলতানের প্রথম চিত্র প্রদর্শনী হয়। সেখানকার মহারাজা প্রদর্শনীটির উদ্বোধন করেন। প্রদর্শনীতে বেশিরভাগই ছিল বাংলা ও কাশ্মীরের নয়নাভিরাম ল্যান্ডস্কেপ। মানুষের অবয়ব নিয়ে কিছু কাজও ছিল। এরপর সুলতান চলে যান পশ্চিম পাকিস্তানে।
দেশ বিভাগের পর সুলতান কিছুদিনের জন্য দেশে ফেরেন। কিন্তু ১৯৫১ সালে আবার করাচি চলে যান। সেখানে পারসি স্কুলে শিল্প শিক্ষক হিসেবে দুবছর কাজ করেন। এ সময় চুঘতাই ও শাকের আলীর মতো শিল্পীদের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব হয়। এর আগে ১৯৫০ সালে চিত্রশিল্পীদের এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য তিনি আমেরিকা যান। নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, শিকাগো, বোস্টন এবং এরপর লন্ডনে তাঁর ছবির প্রদর্শনী হয়।
কিন্তু সুলতানের চরিত্রে ছিল পার্থিব বিষয়ের প্রতি অনীহা এবং কোনো এক স্থানে শিকড় ছড়িয়ে বসার প্রতি তীব্র অনাগ্রহ। এ কারণে তখনকার আঁকা ছবির নমুনা, এমনকি ফটোগ্রাফও এখন আর নেই।
১৯৫৩ সালে আবার নড়াইল ফিরে তিনি শিশু শিক্ষায় মনোনিবেশ করেন। শিশুদের নিয়ে সুলতানের অনেক স্বপ্ন ছিল। শেষ বয়সে নড়াইলে ‘শিশুস্বর্গ’ ও ‘চারুপীঠ’ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সে স্বপ্নের বাস্তব রূপ দেয়ার চেষ্টা করেছেন। নড়াইলে তিনি ‘নন্দন কানন’ নামের একটি প্রাইমারি ও একটি হাইস্কুল এবং একটি আর্ট স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।
মধ্য পঞ্চাশে ঢাকায় আধুনিক চিত্রকলার ক্ষেত্রে অনেক কাজ শুরু হয়। প্রচুর উৎসাহ এবং আগ্রহের সাথে শিল্পীরা শৈলী, ফর্ম, মিডিয়া নিয়ে নতুন নতুন পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন। তখনও সুলতান রয়ে গেলেন সকলের দৃষ্টির আড়ালে, নড়াইলে। মাঝে মাঝে ঢাকায় আসতেন। কিন্তু তাঁর মন, তাঁর জীবনের মূল সুরটি বাঁধা ছিল গ্রামীণ জীবন, কৃষক ও কৃষিকাজের সঙ্গে। সেখানেই বাঙালির ইতিহাস ও সংস্কৃতি আবিষ্কার করেছিলেন তিনি। বাঙালির দ্রোহ ও প্রতিবাদ, সংগ্রাম এবং নানান প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকার ইতিহাস এবং অনুপ্রেরণা ছিল সেখানেই। তিনি কৃষক পুরুষের শরীরকে করেছেন পেশীবহুল এবং বলশালী, কৃষক রমণীর শরীরকে এঁকেছেন সুডৌল ও সুঠাম গড়নে, তাকে দিয়েছেন যুগপৎ লাবণ্য এবং শক্তি। সুলতানের ছবিতে পরিপূর্ণতা এবং প্রাণপ্রাচুর্যের পাশাপাশি আছে শ্রেণির দ্বন্দ্ব, এবং গ্রামীণ অর্থনীতির কিছু ক্রুর বাস্তবতার চিত্রও। হত্যাযজ্ঞ (১৯৮৭) ও চরদখল (১৯৮৮) এরকম দু’টি ছবি।
১৯৭৬ সাল পর্যন্ত সুলতান শিল্পরসিকদের দৃষ্টির আড়ালেই থেকে যান। মধ্য সত্তরে তাঁর কিছু শুভানুধ্যায়ী তাঁকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। ঢাকায় থেকে তিনি কিছু ছবি আঁকেন এবং ১৯৭৬ সালে সেসব ছবি দিয়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী এক প্রদর্শনীর আয়োজন করে। এ প্রদর্শনীটিই তাঁকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়।
তাঁর ছবিতে গ্রাম হচ্ছে সৃষ্টির কেন্দ্র, কৃষকই প্রকৃত জীবন শিল্পী। গ্রাম ও গ্রামের মানুষের মধ্যেই তিনি খুঁজেছেন তাঁর সৃষ্টির অনুপ্রেরণা। এজন্য কৃষক ও কৃষকের জীবন একটা কিংবদন্তী তুল্য শক্তি নিয়ে উপস্থিত তাঁর ছবিতে।
তাঁর কাজে অবয়বধর্মিতাই প্রধান। তিনি আধুনিক, বিমূর্ত শিল্পের চর্চা করেননি; তাঁর আধুনিকতা ছিল জীবনের শাশ্বত বোধ ও শিকড়ের শক্তিকে প্রতিষ্ঠা করা। তিনি ফর্মের নিরীক্ষাকে গুরুত্ব দেননি, দিয়েছেন মানুষের ভেতরের শক্তির উত্থানকে, উপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই এবং উপনিবেশিকোত্তর সংগ্রামের নানা প্রকাশকে তিনি সময়ের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে উপস্থাপনা করেছেন। তাঁর স্টাইলের ক্ষেত্রে তিনি অননুকরণীয়। তাঁর কোনো অনুসারী বা স্কুল নেই, কারণ তাঁর মতো মৃত্তিকা সমর্পিত জীবন তাঁর সময় আর কোনো শিল্পী যাপন করেননি। সুলতান তেলরঙ ও জলরঙের ছবি এঁকেছেন, ব্যবহার করেছেন সাধারণ কাগজ, সাধারণ রং ও চটের ক্যানভাস। এজন্য তাঁর অনেক ছবির রং নষ্ট হয়ে গেছে । সেদিকেও তাঁর কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিল না।
সুলতান আশির দশক থেকে নড়াইলেই বসবাস করেছিলেন। তাঁর কাছে আশ্রয় নেওয়া মানুষ, শিশু এবং জীবজন্তুর প্রতি তাঁর ভালবাসায় তাঁর বাড়িটিকে এদের জন্য ছেড়ে দিয়েছিলেন। একটি চিড়িয়াখানা ছিল তাঁর। শিশুদের জন্য একটি বিরাট নৌকাও বানিয়েছিলেন।
শেষ জীবনে অসুস্থ সুলতানের আয়ের উৎস ছিল শিল্পকলা একাডেমি থেকে পাওয়া কিছু টাকা আর ছবি বিক্রির টাকা। সেই সময় সুলতানের ছবির কদর অনেক বেশি ছিল। কিন্তু অনেকেই ছবি নিয়ে অথবা বিক্রি করে টাকা দিত না। সে কারণে সংসারে দিন দিন সংকট বাড়তে থাকে। সুলতান দিনরাত উৎকন্ঠায় থাকতেন। বিশেষ করে 'শিশুস্বর্গ' ও শিশুদের নিয়ে। ইচ্ছে থাকলেও তখন আর ভবঘুরে হতে পারেননি তিনি। কারণ বিশাল এক সংসারের দায় তখন তাঁর কাঁধে। তাছাড়া শরীরের ভারেও অনেকটা নত হয়ে পড়েছেন। নব্বইয়ের দশকের শুরুতেই সুলতানের শরীর অনেক ভেঙে পড়েছিল। শেষের দিকে এসে তাঁর শরীর আরো দ্রুত খারাপ হতে শুরু করে।
১৯৮৭ সালে ঢাকার গ্যেটে ইনস্টিটিউটে সুলতানের ছবির একটি প্রদর্শনী হয়। ১৯৯৪ সালে ঢাকার ‘গ্যালারি টোনে' সুলতানের স্কেচ নিয়ে একক প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। এই প্রদর্শনীটি ছিল সুলতানের জীবনের শেষ প্রদর্শনী। এ বছরের ১০ আগস্ট শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে অনাড়ম্বরভাবে নড়াইলে শিল্পীর বাসভবনে ৭০তম জন্মদিন পালন করা হয়।
১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর যশোরের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে মহান এই শিল্পীর জীবনাবসান ঘটে।
মাটিলগ্ন এই অমর শিল্পীর প্রতি অতল শ্রদ্ধা।

আফরোজা পারভীন
কথাসাহিত্যিক, প্রবন্ধকার, কলামলেখক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top