সিডনী সোমবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১

"কারাগারের রোজনামচা" পড়ে আরও আরও ভালোবাসলাম বঙ্গবন্ধুকে : কাজী খাদিজা আক্তার


প্রকাশিত:
১৩ আগস্ট ২০২০ ২০:৪১

আপডেট:
২৯ এপ্রিল ২০২৪ ১০:২৫

 

দরিদ্র মানুষের খাদ্যের দাবিতে ১৯৪৯ সালের ১৪ অক্টোবর আর্মানিটোলা ময়দানে জনসভা শেষে ভুখা মিছিল বের করলে আওয়ামী লীগের সভাপতি মওলানা ভাসানী , সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হন। এই লাইন দিয়ে আমি আমার লিখা শুরু করলাম এজন্য যে, দরিদ্র মানুষের খাদ্যের দাবিতে আজকালকার রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ মিছিল করে কারাবরণ করবেন এ যেন আমরা স্বপ্নেও আশা করতে পারিনা। অথচ এমন ভালোবাসার, ত্যাগের ইতিহাস রেখে গেছেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।  

"কারাগারের রোজনামচা" পড়ে আবিস্কার করলাম অন্যরকম এক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। কারাগারের বন্দী জীবনেও তিনি সর্বক্ষণ ভাবতেন দেশ আর দেশের মানুষের কথা। তাঁর প্রকৃতিপ্রেম, মানবতাবোধ আমাকে বিস্মিত করেছে। মাঝে মাঝে টের পেয়েছি তাঁর শিশুসুলভ সরল মনের আকুতি। ভালোলেগেছে যখন পড়েছি তাঁর জেল জীবনের আশপাশের মানুষগুলোকে নিয়েও তিনি কতোটা ভাবতেন এবং কতোটা তাদের প্রতি তিনি সহানুভূতিশীল ছিলেন। দেশকে, দেশের মানুষকে ভালোবাসতে গিয়েইতো তিনি বারবার মিথ্যে মামলায় কারাবরণ করেছেন। 

তিনি যে একজন নিরেট, স্বচ্ছ পকৃতি প্রেমিক ছিলেন তা তাঁর কারাগারে দিনযাপনের লেখনিতে সুন্দর ভাবে ফোটে উঠেছে। ভালোবাসতেন বাগান, কাক, মুরগী, কবুতর, বৃষ্টি, আকাশ। জেলখানার বাগানটাকে তিনি ভীষণ ভালোবাসতেন। বাগানে একা একা হাটতেন। নিজের হাতে বাগানের যত্ন নিতেন। বাগানটা ছিলো তাঁর বন্ধুর মতন। সেকথা প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, "ডাব খেয়ে পাইপ নিয়ে বেরিয়ে পরলাম। আবার ফুলের বাগানে। একটা মাত্র বন্ধু ফুলের বাগান। ওকে আমি ভালোবাসতে আরম্ভ করেছি। তিনি যে বাগানটাকে কতোটা ভালোবাসতেন তা তাঁর এই কথার মাধ্যমে স্পষ্টতই প্রমাণিত হয় যখন তিনি বললেন,"সকাল বেলা যখন ফুলের বাগানে বেড়াতে শুরু করি তখন রাতের কষ্ট ভুলে যাই। " মাঝে মাঝে তিনি নিজের হাতে বাগান পরিষ্কার করে দিতেন। বাগানের রুপ মাধুর্যে তিনি পুলকিত হতেন। এটি যেন সকল একাকিত্বের, যন্ত্রণার মাঝে এক টুকরো শান্তি। আগাছা পরিষ্কার করা নিয়ে তাঁর রাজনৈতিক গভীর দৃষ্টিভঙ্গি আমাকে অবাক করেছে। তিনি বলেছেন, "বাজে গাছগুলি আমি নিজেই তুলে ফেলি। আগাছা গুলিকে আমার বড় ভয়, এগুলি না তুললে আসল গাছগুলি ধ্বংস হয়ে যাবে, যেমন আমাদের দেশের পরগাছা রাজনীতিবিদ - যারা সত্যিকারের দেশপ্রেমিক তাদের ধ্বংস করে, এবং করতে চেষ্টা করে। তাই পরগাছাকে আমার বড় ভয়"। এই যে রাজনৈতিক চিন্তা তা সকল কালের সকল রাজনৈতিক ইতিহাসে থাকেনা। তাই বঙ্গবন্ধু একজনই হয়। যিনি এমন নির্ভীক সমালোচনা রাজনীতি নিয়ে করতে পারেন।  

২৮ জুন ১৯৬৬, বঙ্গবন্ধুর বাবুর্চি অসুস্থ। কিন্তু রান্নাবান্না করবে কে?  এরই মধ্যে তাঁর মেট নিয়ে এলো একটি মুরগি। সেই মুরগি আবার ডিমও দিল। একথা শুনে বঙ্গবন্ধু বললেন, "খুব খুশি জেলখানায় আবার মুরগিতে ডিম দেয়? বললাম, খুব ভাল, রেখে দেও, মুরগিকে বাচ্চা দেওয়াব। ডিম কিন্তু খাওয়া চলবেনা। " এখানে তাঁর শিশুসুলভ সরল ভালোবাসাই ফোটে উঠে। তিনি পাখি খুব ভালোবাসতেন। রোজ সকালে ঘরের কাছে আমগাছটাতে তিনি দুটো হলুদ পাখি দেখতেন। ওদের খেলা মন ভরে উপভোগ করতেন। এই পাখি দুটোও তাঁর পরম বন্ধু ছিল। তাইতো তিনি বলতেন, "আমাকে তো একেবারে একলা রেখেছে। গাছপালা, হলদে পাখি, চড়ুই পাখি আর কাকই তো আমার বন্ধু এই নির্জন প্রকোষ্ঠে। যে কয়টা কবুতর আমার বারান্দায় আশ্রয় নিয়েছে তারা এখানে বাচ্চা দেয়। কাউকেও আমি এদের ধরতে দেইনা"।  মানুষ প্রকৃতির মধ্যে বা প্রকৃতিকে ভালোবেসে যে নির্মল আনন্দ, সুখ পায় তা আর অন্য কিছুতে পায়না। তাইতো একাকিত্বের এই কারা জীবনে বঙ্গবন্ধু বারবার একটুকরো বাগানের কাছে ছুটে গেছেন কথা বলেছেন পাখিদের সাথে, উদাস হয়েছেন বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ তরঙ্গে।    

বঙ্গবন্ধু বই পড়তে ভালোবাসতেন। খবরের কাগজ ছিলো তাঁর অনেকটা সময়ের সঙ্গী। বই, কাগজের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতেন।যেদিন খবরের কাগজ আসতোনা সেদিন পুরানো কাগজ বের করে পড়তেন। কিন্তু একসময় এগুলো থেকেও তাঁকে বঞ্চিত করা হলো। খবরের কাগজ পড়ায় নিষেধাজ্ঞা দেয়া হলো। বাংলা বই, বাংলা কাগজ কোনো কিছুই তাঁর জন্য বরাদ্দ ছিলোনা। অথচ বঙ্গবন্ধুর মনটা ছটফট করতো বাংলা লেখা পড়তে আর বাংলার মানুষের খবর নিতে।   

কারাগারে থেকেও তিনি কিন্তু আশেপাশের সবার খেয়াল রাখতেন। বাড়ি থেকে কোনো খাবার এলে সবাইকে নিয়ে ভাগ করে খেতেন। তিনি নিজে খাবেন কিন্তু অন্য কেউ খাবেনা সেটা তিনি কল্পনাও করতে পারতেননা। তিনি যে এমনই ছিলেন, তা তাঁর লেখনিতে প্রকাশ করেছেন এভাবে, "বেগম সাহেবা বাড়ির আম আর বিস্কুট পাঠাইয়াছেন।  এতগুলো কি করে একলা মানুষ খাব? ভালই হয়েছে কয়েদিগুলিকে খাওয়াতে পারব, ওদের কিসমত তো ফাঁকা"। এমন করেই ভাবতেন আমাদের বঙ্গবন্ধু। 

তিনি যেমন সবাইকে ভালোবাসতেন তেমনি সকলেরও ভালোবাসা, সহানুভূতি, শ্রদ্ধা ছিলো তাঁর প্রতি। তাঁর কিছু লেখনিতে তা স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যেমন, "আমার ব্যাপারে সকলেরই সহানুভূতি আছে। আমাকে ভালো জিনিস দিতে পারলে এরা খুশিই হয়"। তিনি আরও বলেন, "কয়েদি থেকে কর্মচারী পর্যন্ত সকলেই আমার দিকে খেয়াল রাখে, যাতে কোনো কষ্ট না হয়। ডাক্তার সাহেবরাও কিছু কিছু জিনিস আমাকে দিয়ে থাকে, বলার প্রয়োজন হয়না"। এই যে ভালোবাসা দেয়া আর পাওয়ার ব্যাপার তা সকলের জীবনে প্রাপ্য হয়না। সকলে সকলের মন জয় করতে পরেনা।  ভালোবাসা দিলেই ভালোবাসা পাওয়া যায়। 

দীর্ঘ কারাগার জীবন কেটেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর শুধু দেশ আর দেশের মানুষকে ভালোবাসার অপরাধে। বারবার তিনি কারাবরণ করেছেন । এমনও হয়েছে সাজা শেষ হয়ে গেলেও বিভিন্ন অজুহাতে আবারও তাঁকে বন্দী করে রেখেছে। অনেকসময় বন্দীখানা থেকে বের হয়ে বাড়ি পৌঁছার আগেই রাস্তা থেকে আবার গ্রেফতার করে কারাবন্দী করা হয়েছে মিথ্যে মামলা দিয়ে। "কারাগারের রোজনামচা"  না পড়লে হয়ত অনেক কিছুই অজানা থেকে যেতো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবন, দেশের প্রতি মানুষের প্রতি তাঁর যে কি গভীর ভালোবাসা তা সম্পর্কে আমাদের সবার আরও আরও জানা উচিত। 

বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে মেনে চলে দেশ এগিয়ে যাক, বিশ্ববাসী অবাক হয়ে দেখুক বঙ্গবন্ধুর স্বপের সোনার বাংলাকে, যে সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখতেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।           

 

কাজী খাদিজা আক্তার
লেখক ও প্রাবন্ধিক, প্রভাষক (ইংরেজি), সরাইল সরকারি কলেজ।                                 

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top