সিডনী সোমবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১

গহীন দেশপ্রেমে আবদ্ধ এক অনির্বাণ শিখা'র নাম ক্ষুদিরাম বসু! : তন্ময় সিংহ রায়


প্রকাশিত:
১৮ আগস্ট ২০২০ ২৩:০০

আপডেট:
১৮ আগস্ট ২০২০ ২৩:১৯

ছবিঃ ক্ষুদিরাম বসু

 

"একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি।
হাসি হাসি পরব ফাঁসি দেখবে ভারতবাসী!"

রেটিনায় এই সুন্দর পৃথিবী'র আলো'র প্রতিবিম্ব  সদ্য গঠনের পর, চোখসহ তাঁর শরীরেই আবার সারাজীবনের মতন নিভে যাবে সে আলো! পূর্বের দুই পুত্রের অকালে মৃত্যুবরণের হেতু, অজানা ও গভীর ভয়-প্রসূত অন্ধবিশ্বাসকে অন্ধের মতন জড়িয়ে ধরে তাঁর মা, মুঠো তিনেক খুঁদের বিনিময়ে, শিশু-পুত্রটিকে বাঁচাবার একান্ত ইচ্ছায় বাধ্য হয়ে তাঁকে বিক্রি করে দিয়েছিলেন মাসির কাছে, আর সেই থেকেই তাঁর নাম হয় ক্ষুদিরাম।

১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৩ ডিসেম্বর, তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত বর্তমান পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা'র মৌবনী (হাবিবপুর) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ক্ষুদিরাম বসু। পিতা ত্রৈলোক্যনাথ বসু ছিলেন নাড়াজোলের তহসিলদার ও মা গৃহবধূ লক্ষ্মীপ্রিয় দেবী। ক্ষুদিরামের বয়স যখন মাত্র ৫ বছর তখন তিনি  হারান তাঁর মাকে!

এর ঠিক পরের বছর পিতার মৃত্যু'র পর তাঁর বড় দিদি তাঁকে দাসপুর থানার এক গ্রামে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসলে, দিদি অপরূপা'র স্বামী অমৃতলাল রায় ক্ষুদিরামকে ভর্তি করিয়ে দেন তমলুকের হ্যামিল্টন হাই স্কুলে।

অতঃপর, ১৯০২ এবং ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে শ্রী অরবিন্দ এবং সিস্টার-নিবেদিতা মেদিনীপুর ভ্রমণ করে স্বাধীনতার জন্যে জনসমক্ষে ধারাবাহিক বক্তব্য রাখেন এবং বিপ্লবী গোষ্ঠীগুলোর সাথে চালিয়ে যান গোপন অধিবেশন।

সেমতবস্থায় বিপুল অনুপ্রাণিত কিশোর ছাত্র ক্ষুদিরাম, শুরু করেন এই সমস্ত বিপ্লবী আলোচনায় সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং পরবর্তীতে তিনি আত্মপ্রকাশ করেন একজন পূর্ণ বিপ্লবী হিসেবে।

 

কৈশোর পর্যায় শেষ করে সদ্য যৌবনে পা রাখা বাংলার গর্বিত মায়ের সেই অদম্য ও বীর সন্তান ক্ষুদিরাম, নিজের দেশ মা'কে স্বাধীন করার স্বপ্নে বিভোর হয়ে প্রফুল্ল চাকি'র সাথে মিলিত হয়ে বোমা ছুঁড়েছিলেন অত্যন্ত স্বৈরাচারী ও ভারত বিদ্বেষী ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডের ঘোড়ায় টানা গাড়িতে। 

কিন্তু কিংসফোর্ডের সেই গাড়িতে ছিলেন  মিসেস কেনেডি ও তার কন্যা এবং বোমার আঘাতে মৃত্যু হয় তাঁদের!

অপর এক গাড়িতে বসে থাকার দরুণ, ভাগ্য প্রসন্ন হয়ে সে যাত্রায় বেঁচে যান বিচারক, কিন্তু দু'জন নিরপরাধ ব্রিটিশ মহিলাকে হত্যা'র অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করা হয় ক্ষুদিরাম'কে এবং শুরু হয় যথারীতি বিচার প্রক্রিয়া!  

বিচার শেষে চূড়ান্ত রায় হিসেবে মুজাফ্ফরপুর আদালতে, মাত্র ১৮ বছর ৭ মাস ১১ দিনে তাঁকে দেওয়া হয় ফাঁসির আদেশ! 

ফাঁসির সাজা'র ঘোষণা শুনে শুধু হেসেছিলেন ভারতের অগ্নিপুত্র ক্ষুদিরাম বসু! এরপর নির্ধারিত দিনে অর্থাৎ ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ১১ ই আগষ্ট ফাঁসি-কাঠে দাঁড়িয়ে যখন তাঁকে পরানো হল কালো মুখোশ, তখনও পর্যন্ত শেষবারের মতো দেখা গিয়েছিল তাঁর সেই নিষ্পাপ হাসি!

অবশেষে ফাঁসির পর ব্রিটিশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ক্ষুদিরামের নিথর মৃতদেহের সেই মর্মান্তিক ছবি! 

এদিকে গ্রেপ্তারের আগেই পিস্তলের গুলিতে আত্মহত্যা করে ভারত মায়ের বুকে রক্তাক্ত শরীরে লুটিয়ে পড়েন বাংলা'র আর-এক বীর স্বাধীনতা সৈনিক ও ক্ষুদিরামের সহযোগী প্রফুল্ল চাকী! 

কিন্তু এ হেন নৃশংস হত্যার দায়ে ক্ষুদিরাম বসু ইতিহাসের পাতায় চিরটাকাল'ই বিবেচিত হয়ে রয়ে গেলেন একজন অপরাধী হিসেবেই কিন্তু, সুদূর প্রাচীনকাল থেকেই ভারতীয় তথা বিশ্ব ইতিহাস, বহু ক্ষেত্রে তার গর্ভে লুকিয়ে রেখেছে বা রাখে অনেক প্রকৃত সত্য তথ্যকেই এবং অনেক সময়ে সম্পূর্ণ সঠিক না জেনেই রচিত হয় ইতিহাস! কারণ উল্লেখ না করেই জানাই, এটা যেন পরিণত হয়েছে এক অতি স্বাভাবিক বিষয়ে।

 

তাহলে ঠিক কি হয়েছিল সেদিন? সাল ১৯০৮, ২১ মে,  বিচারপতি জনক প্রসাদ, নাথুনি প্রসাদ ও কর্ন ডফ-এর এজলাসে বিচার শুরু হয় ক্ষুদিরাম বসু মামলা'র। সেই মামলায় তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে মাঠে নেমেছিলেন বিনোদবিহারী মজুমদার ও আর-এক আইনজীবী।  বিপরীতে ক্ষুদিরাম বসুর হয়ে লড়েছিলেন উপেন্দ্রনাথ সেন, কালীদাস বসু, নগেন্দ্রনাথ লাহিড়ী এবং সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী প্রভৃতি বাঙালী আইনজীবীরা।

১৩ জুন রায়দানের দিন একটি চিঠি এসে পৌঁছায় বিচারপতি ও ব্রিটিশ সরকারের হয়ে সওয়াল-জবাবকারি আইনজীবীদের উদ্দেশ্যে। তাতে উল্লেখ ছিল, 'ওই ইংরেজ সাহেবকে হত্যা করার উদ্দ্যেশ্যে পাঠানো হচ্ছিল আরও একটি বোমা, তবে বাঙালি নয় কাজটি করবেন একজন বিহারী।'

আর ক্ষুদিরাম বসুর পক্ষের আইনজীবীদের বক্তব্য ছিল এটাই, এই চিঠির মাধ্যমেই বোঝা যায় যে গাড়িতে বোমা মারার ঘটনায় জড়িত ছিলেন অন্য কোনও বড় মাথা! 

তাঁরা প্রায় কিশোর ক্ষুদিরামকে শুধু কাজে লাগিয়েছিল, এই মাত্র! অতএব, তাঁর মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যায় না। 

সম্পূর্ণ ঘটনাটাই ঘটানো হয়েছে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবেই। তাঁকে ফাঁসানো হয়েছে রীতিমত।  

আদালতে ক্ষুদিরাম বসুর পক্ষে সওয়াল করা আরেক আইনজীবী নরেন্দ্রকুমার বলেন, প্রফুল্ল চাকি ছিলেন অনেক বেশি শক্তিশালী, পরিণত এবং বোমা বাঁধার ব্যাপারে দক্ষ। তাই বলা যেতে পারে বোমা ছুঁড়েছিলেন প্রফুল্ল ওরফে দীনেশ, কারণ এই ঘটনার ঠিক পরমুহুর্তেই আত্মঘাতী হন তিনি! 

অনুমান এটাও করা হয় যে, ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে ক্ষুদিরামের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছিল পুলিশের ভয় দেখিয়ে, কারণ সাক্ষ্য গ্রহণের সময় সেখানে উপস্থিত ছিল পুলিশ। এমন কি ক্ষুদিরামের জবানবন্দী থেকেই বোঝা যায় তিনি এই অপরাধ করে, করে ফেলেছেন বোকামি!

কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ শেষ পর্যন্ত এ হেন কোন সাক্ষ্যপ্রমাণ, আইনি যুক্তি ও তথ্যকে সঠিক বিচার-বিবেচনার ভিত্তিতে গুরুত্ব না দিয়েই বিচারপতি মৃত্যুদণ্ড দেন ক্ষুদিরামকে! আইনজীবী কালীদাস বসু, উপেন্দ্রনাথ সেন এবং কেশরীনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও পরবর্তীতে নগেন্দ্রনাথ লাহিড়ী, সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী ও আরো এক আইনজীবী ক্ষুদিরামের পক্ষে আপ্রাণ লড়াই চালিয়েও সে যাত্রার শেষ রক্ষা হয়নি তাঁর!

 

এখন প্রশ্ন এখানে যে, কেন সৃষ্টি হয়েছিল এই পরিস্থিতি? বিংশ শতাব্দীর জন্মের কিছু পরের দিকের সময়টায় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ভারতে ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায়। এ পর্যায়ে এসে ভারতীয়দের একাংশ বিশ্বাস প্রায় হারিয়েই ফেলে অহিংস আন্দোলনের উপর থেকে!

 

দীর্ঘদিন যাবৎ ব্রিটিশ রাজের অন্যায়, অত্যাচার, শোষণ, লুন্ঠন মিশ্রিত কু-শাসনে ভারতীয় উপনিবেশ সেই সময়ে পরিণত হয়েছিল এক সুপ্ত আগ্নেয়গিরিতে! আর সেই আগ্নেয়গিরি'র জ্বালামুখ থেকে অগ্নুৎপাতের সূত্রপাত ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহে।

 

তন্ময় সিংহ রায়
কোলকাতা

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top