সিডনী সোমবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১

বিবেকানন্দে নিবেদিতা সিস্টার : তন্ময় সিংহ রায়


প্রকাশিত:
২৩ আগস্ট ২০২০ ২২:৪৬

আপডেট:
২৩ আগস্ট ২০২০ ২৩:১৩

 

"Suppose he had not come to London that time! Life would have been like a headless dream; for I always knew that I was waiting for something. I always said that a call would come. And I did........." সিস্টার নিবেদিতা

১৮৯৬ সাল, মহামারি রূপে ছড়িয়ে পড়ে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে প্লেগ বোম্বাইকে করে ফেলে একেবার ছারখার ও ১৮৯৮ সালে কলকাতায় শুরু করে তান্ডবলীলা! এর ঠিক আগের বছর অর্থাৎ ১৮৯৭-তে, বেলুড়ে জমি কিনে স্বামী বিবেকানন্দ, আধ্যাত্মিক ও সেবার মন্ত্রে চলার শপথ গ্রহণ করে রামকৃষ্ণের আদর্শে গড়ে তোলেন 'রামকৃষ্ণ মিশন' নামে এক প্রতিষ্ঠান। এমতবস্থায় নানান মাধ্যমে তাঁর কানে বারেবারে আঘাত করতে থাকে প্লেগ রোগের মর্মান্তিক মৃত্যুর বিভিন্ন সংবাদ!

অবশেষে, বর্গী'র মতন বাংলায় যে বছর প্লেগ হানা দিল, সে বছরের জানুয়ারি মাস নাগাদ, নিঃস্বার্থ সেবার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে বাংলা তথা সমগ্র ভারতের মাটিতে পরম গুরু স্বামী বিবেকানন্দের ডাকে আবির্ভূত হলেন এক খ্রিষ্টান ধর্মযাজকের কন্যা ও মাতৃরূপিনি নারী মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল।

ছিলেন ব্রিটিশ সাজাত্যবোধে অটুট নারী, হয়ে উঠলেন যেন ভারতীয় জাতীয়তাবোধ ও দেশপ্রেমের এক ব্যতিক্রমী অস্মিতা ভগিনী নিবেদিতা! এ যেন মার্গারেট সত্তাকে একেবারে ভেঙ্গেচুরে, বিসর্জন দিয়ে হয়ে ওঠা এক শুদ্ধ ভারতীয় সন্ন্যাসিনী! মান, যশ ও পাশ্চাত্যের ঐশ্বর্য, মায়া সবকিছুকে উপেক্ষা করে মানবজাতির উদ্দেশ্যে তাঁর প্রাণ ছিল একান্ত নিবেদিত!

বলাবাহুল্য এমন নারীকেই তো স্বামীজি চেয়েছিলেন ভারতীয় নারীসমাজের জন্যে! ভগিনী নিবেদিতার পিতা'র ভবিষ্যত বাণী('একদিন আসবে ঈশ্বরের আহ্বান!')   অনুযায়ী'ই হয়তো ১৮৯৫ সালের নভেম্বরে, ৩৩ বছরের সিংহপুরুষ স্বামী বিবেকানন্দের সাথে ২৮ বছরের তরুণী মার্গারেট নোবেল-এর লন্ডনে সাক্ষাৎ হয় প্রথমবার।

 

এদিকে, সে সময়ে ভারতের শাসনভার ন্যস্ত ছিল 'ভারত সম্রাজ্ঞী' মহারানি ভিক্টোরিয়ার হাতে। তাঁর আশ্বস্ত বাণী থেকে ভরসা ও ডাক্তারদের শত চেষ্টাকে নস্যাৎ করে প্লেগ-এর হিংস্রতা থেকে রেহাই পেলনা সে সময়ে কেউই। নৃশংস মৃত্যু, চুড়ান্ত নির্দয় হয়ে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে গেল লক্ষ লক্ষ প্রাণ! 

অসহায়ের মত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল হাজার হাজার, লাখ লাখ মানুষ! বেলুড়ে থেকে ক্রমাগত এ হেন হৃদয়বিদারক মৃত্যু সংবাদ বিবেকানন্দকে ক্রমশই করে তুলছিল অস্থির! মানসিকভাবে প্রস্তুতি আরও জোরালো করে তিনি নিজেই ঝাঁপিয়ে পড়বেন এ পরিস্থিতির বুকে, এমনটাই মনে করলেন তিনি। এদিকে মহামারি চলাকালীন, তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারী প্লেগ কমিশন ও সেনাদের উপর অর্পিত হয়েছিল আক্রান্ত ও মৃতদের দায়িত্বভার।

নানা কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ভারতীয়দের অস্পৃশ্যতা ও ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণে ব্রিটিশদের ব্যাঙ্গের পাত্র হলে, অনেক জায়গায় সেনাদের তরফ থেকে তাদের উপর করা হয় অশোভন আচরণ, তাচ্ছিল্য! ফলস্বরূপ, আত্মসম্মানের তীব্র দহন থেকে ভারতীয়দের সাথে ব্রিটিশদের শুরু হয় তুমুল গন্ডগোল! এ সমস্ত কিছুও নজর এড়াতে পারেনি স্বামীজির। 

একসময় মিশনের গুরুভাইদের নিয়ে তিনি নিজেই নেমে পড়লেন মাঠে। সবকিছু উজার করার চিন্তা করে, আগু-পিছু না ভেবেই, ১৮৯৮ সালের ৩ মে তিনি প্রস্তুত করলেন এক ঘোষণাপত্র। যার সারমর্ম, 'রামকৃষ্ণ মিশন আর্তের সেবা করবে! সেই সাথে আপ্রাণ চেষ্টা করা হবে , যতটা সম্ভব সংক্রমণ ও মৃত্যুতে দাঁড়ি টানা'র।'

সে তো নয় হল কিন্তু, প্রয়োজন-মাফিক এত টাকা'র জন্ম গর্ভ'টা কোথায়? গর্জে উঠলেন স্বামীজি –'দরকার হলে নতুন মঠের জমি বিক্রি করে দেব! আমরা ফকির, ভিক্ষা করে গাছতলায় শুয়েও দিন কাটাতে পারি। এই জমি বিক্রি করলে যদি  প্রাণ বাঁচানো যায় হাজার হাজার মানুষের,  তবে কিসের জায়গা? কিসের'ই বা জমি?' যদিও তার দরকার হয়নি শেষ পর্যন্ত। অথচ এই জমি আর মঠ তৈরি করা ছিল তাঁর বহুদিনের গহীন স্বপ্ন!

মানুষের বিপদের দিনে সেটাকেও বিক্রি করে দেওয়ার কথা বলতে ও বাস্তবে তার প্রয়োগে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি তিনি।

আর তাঁর এই কাজে যোগ্য সঙ্গী হয়েছিলেন ভগিনী নিবেদিতা। মৃত্যুভয়কে তুচ্ছজ্ঞানে স্বশরীরে প্লেগ আক্রান্তদের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়া থেকে শুরু করে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আর্তের সেবাই ছিল তাঁর একমাত্র পরম ধর্ম! রাতের পর রাত কাটিয়েছেন ফুটপাতে, বস্তিতে, রাস্তায়! নিজের সন্তানের মতই তিনি বুকে তুলে  নিয়েছিলেন সর্বধর্ম নির্বিশেষে আর্ত সন্তানদের! আর প্রমাণস্বরূপ, নিবেদিতার এই উদ্যোগ নিজের চোখে দেখেছিলেন ডাঃ রাধাগোবিন্দ কর, যিনি আজকের 'আর জি কর' হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা। 

১৯১১ সালে ভগিনী নিবেদিতার মৃত্যুর পর স্মৃতিচারণায় উঠে এসেছিল সেই সমস্ত অবর্ণনীয় ও অকল্পনীয় আত্মত্যাগের ইতিহাসের মর্মস্পর্শী  কাহিনী!

১৯০৪ সালে নিবেদিতা কলকাতা থেকে, স্বামীজি সম্পর্কে তাঁর এক বন্ধুকে লেখেন, "Suppose he had not come to London that time! Life would have been like a headless dream; for I always knew that I was waiting for something. I always said that a call would come. And I did........."

১৩১৮ বঙ্গাব্দে 'ভগিনী নিবেদিতা' নামক প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, 'নিজেকে এমন করিয়া সম্পূর্ণ নিবেদন করিয়া দিবার আশ্চর্য শক্তি আর কোন মনুষ্যে প্রত্যক্ষ করি নাই!' নিবেদিতার মধ্যে একটা প্রবল ব্যক্তিত্বের বল ছিল, যাকে রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেছেন 'যোদ্ধৃত্ব' রূপে!

বিখ্যাত বিবেকানন্দ গবেষক শঙ্করী প্রসাদ বসুর মত অনুযায়ী ভগিনী নিবেদিতা, বিপ্লবের মহাদেবী কালীকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন স্বামীজির মধ্যে এবং নিবেদিতার 'Kali The Mother'-নামক গ্রন্থটি পড়ে অনুপ্রাণিত হয়েই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর অঙ্কন করেছিলেন সেই 'ভারতমাতা'-র চিত্রটি।

প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্তও তাই তো যথার্থই মন্তব্য করেছিলেন নিবেদিতা সম্পর্কে যে, 'এক বিদেশিনী মহিলার এরূপে ভারতীয় হইয়া উঠিবার কাহিনী সভ্যতার ইতিহাসে এক রহস্যময় ঘটনা!'

 

তন্ময় সিংহ রায়
কোলকাতা, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top