সিডনী সোমবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১

সেলিব্রেটি লেখক (রম্য গল্প) : সত্যজিৎ বিশ্বাস


প্রকাশিত:
২৪ আগস্ট ২০২০ ২৩:৩৬

আপডেট:
২৯ এপ্রিল ২০২৪ ২৩:৪৪

সত্যজিৎ বিশ্বাস

 

কাসেম বক্স দুর্দান্ত স্ট্যাটাস লেখক। ফেসবুকে কোন কিছু লিখিয়া মুহুর্তকাল স্থির হইতে না হইতেই আষাঢ় মাসের বৃষ্টির ন্যায় লাইক পড়িতে শুরু করে। শুধু তাহাই নয়, ইতিমধ্যে তাহার নিজস্ব পাঠক জোট পর্যন্ত তৈরি হইয়া গিয়াছে। কাসেম বক্সের জ্বালাময়ী, হৃদয়স্পর্শী স্ট্যাটাসসমূহ বিশে¬ষণ করিয়া পাঠক গুষ্টি ক্ষোভে গর্জন করিয়া উঠে, ‘ভাইয়া, পৃথিবীর সব অগা-বগারা পুস্তক লিখিয়া ফাটাইয়া ফেলিল, আর আপনি এখনও কানা বগার ন্যায় এক ঠ্যাং তুলিয়া কীসের অপেক্ষায়? সেই সব কমেন্ট পড়িয়া কাসেম বক্স আবেগে আপ¬ুত হয়। বিনয়ের অবতার হইয়া কমেন্টের জবাবে লিখে, প্রাণপ্রিয় ভ্রাতাগণ, এইসব কী বলিতেছেন? আমার কী আর সেই যোগ্যতা আছে? ভক্তকূল পাল্টা জবাব দেয়, আপনি হইলেন সেলিব্রেটি লেখক। আপনার যোগ্যতা না থাকিলে এই সৌরজগতে আর কাহার আছে শুনি?

প্রচন্ড গরমেও কাসেম বক্স এসির শীতলতা অনুভব করে। নেত্রদ্বয় দিগন্তের পাণে স্থির করিয়া ভাবে, কথা তো মিথ্যা নহে। নিজের মধ্যে এই অত্যাশ্চার্য্য ক্ষমতা তো সত্যই সুপ্তমান। তবে ক্ষমতা প্রয়োগে আর বিলম্ব কেন? কম্পিত হস্তে কাসেম বক্স ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়, সবার ভালবাসা পাইলে আগামী একুশে গ্রন্থমেলায় স্বরচিত অর্ধ-জীবিত, উজ্জীবিত, সুপ্ত, বিলুপ্ত সাহিত্য রচনাসমূহ একত্র করিয়া একখানা পুস্তক গ্রন্থিত করিতে পারি।

স্ট্যাটাস লিখিতে দেরী, লাইক পড়িতে নয়। কমেন্টের বন্যায় স্ট্যাটাস ভাসিয়া যাইবার যোগাড় হইল। ‘অগ্রিম অভিনন্দন’, ‘শুভেচ্ছা’, ‘স্বাগতম’, ‘অপেক্ষায় রইলাম’, ‘ভালবাসা অফুরান’, ‘কাসেম বক্স, আমাদের রকস’ এই টাইপ ভালবাসা মাখানো কমেন্টগুলো যদি বাঁধাই করা হইতো উহাই একখানা মাঝারি সাইজের উপন্যাসের সমান বইকি, কম হইত না।

প্রেরণায় জর্জরিত হইয়া কখনো নাক ভর্তি সর্দি, কখনো বা জ্বর চাপা দিয়া মাস দুয়েক কঠোর পরিশ্রম করিলো কাসেম বক্স। অতঃপর গদ্য সাহিত্যখানা রচনা করিয়াই সাথে সাথেই ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলো, ‘এইমাত্র কালজয়ী রচনা সমগ্র শেষ হইল। পাঠক/পাঠিকাগন যাহারা এই ত্রিকালজয়ী সৃষ্টির প্রথম মুদ্রণের কপি সংগ্রহ করিতে আগ্রহী, অতিস্বত্তর যোগাযোগ করুন।’ স্ট্যাটাসখানা পোস্ট করিয়া কাসেম বক্স পরম আবেশে চক্ষু মুদিয়া বিশ্রাম লইতে গেল। দুই মাসের কঠোর পরিশ্রমে নিদ্রা আসিতে দেরী হইলনা। একটির সাথে আরেকটি ফ্রির ন্যায় নিদ্রার সাথে আসে খোয়াব।

একুশে বইমেলায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ভক্তকূল লাইন ধরিয়া ত্রিকালজয়ী পুস্তক কিনিয়া অটোগ্রাফ সংগ্রহের নিমিত্তে ঠায় দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। কাসেম বক্স প্রাণপণে অটোগ্রাফ দিয়াও সামলাইতে পারিতেছে না। চারিপাশের মানুষ অবাক হইয়া অনবরত উঁকিঝুঁকি মারিতেছে। সকলের মনে কৌতুহল, কে এই কাসেম বক্স? এতদিন কোথায় ছিল এই কালজয়ী লেখক? উঁকিঝুঁকি কিঞ্চিৎ বাড়িতে না বাড়িতেই তাহাকে ঘিরিয়া থাকা ভিড়ের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি শুরু হইলো। সাগর উত্তাল হইলে ঢেউ যেরূপ কুলে আছড়াইয়া পড়ে তদ্রূপ ঠেলাঠেলির বেগ বাড়িয়া গিয়া কাসেম বক্সের কোলে আছড়াইতে লাগিলো। কম্প মৃদু হইতে মাঝারি, মাঝারি হইতে তীব্রতে পরিনত হইবার পর টিকিতে না পারিয়া ‘এত ধাক্কাধাক্কি কীসের’ বলিয়া কাসেম চিৎকার দিয়া উঠিতেই শোনে পাল্টা চিৎকার। ‘বাপের হোটেলে খাওয়া, ঘুম আর ফেসবুকিং ছাড়া আর কী কোনো কর্ম জগতে নাই? ওঠ, এইবেলা বাজারটা নিয়া আসিয়া আমাকে উদ্ধার কর’ -মায়ের ধাক্কাধাক্কিতে ধরমর করিয়া উঠিয়া বসে কাসেম বক্স। হায়রে মা, সে কি কল্পনা করিতে পারে, এই পুত্রকে নিয়া আর দুইদিন পর কী তুগলঘি তোলপাড়টাই না হইবে। আচমকা মনে পড়িল তাহার ফেসবুকে দেওয়া স্ট্যাটাসের কথা। এতক্ষণে নিশ্চয়ই শত শত লাইক, শেয়ার আর প্রকাশকদের লাইন পড়িয়া গিয়াছে পুস্তকখানা ছাপাইবার জন্য।

ফেসবুকে প্রবেশ করিয়া কাসেম বক্স তাহার স্ট্যাটাসের পানে চাহিয়া অবাক হয়! কী ব্যাপার, ফেসবুকে কি হরতাল চলিতেছে নাকি ১৪৪ ধারা? সেই ১৪৪ ধারা ভাঙ্গিয়া জনতার স্রোত কি তাহার স্ট্যাটাস পর্যন্ত আসিতে পারিতেছে না? মোটে তেরখানা লাইক আর কমেন্টের বাক্স ধূ ধূ মরুভূমি! কাসেম বক্স খেপিয়া গিয়া জানাশোনা দুই/চারজন প্রকাশককে তৎক্ষণাৎ ইনবক্সে বার্তা পাঠায়।
গালে হাত দিয়া অপেক্ষা করিতে করিতে কাসেম বক্স অনুধাবন করে অপেক্ষা শুধু অপেক্ষাই বাড়ায় আর বাড়ায় আক্ষেপ। বার্তা পাঠানোই সার। জবাব আর আসে না।

তবে কাসেম বক্সও এত সহজে হাল ছাড়িয়া দেওয়া কৃষক নহে। পান্ডুলিপি বগলদাবা করিয়া প্রকাশকগনের দ্বারে দ্বারে ত্রিকালজয়ী বীজ বপনের উদ্দেশ্যে ঘোরাঘুরি শুরু করিয়া দিলো। মাসখানেক ঘুরিবার পর মর্মে মর্মে যে মর্মর মর্মবেদনা শুরু হইল, তাহার সারমর্ম এই- ‘অর্থবিনে কেহই নতুন লেখকের পুস্তক বাহির করিতে রাজি নহে।’

নাওয়া, খাওয়া এমনকি ফেসবুকে অনিয়মিত কাসেম বক্স অর্থের এই অনর্থ ঘটনা স্ট্যাটাসে লিখিয়া তীব্র প্রতিবাদ জানাইলো। মনে আশা, এইবার বুঝি জনস্রোত তৈরি হইবে তাহার পক্ষে। অবাক হইয়া দেখে তাহার স্ট্যাটাসে লাইকের সংখ্যা পুর্বে যেখানে তিন ডিজিটের নিচে থাকিতো না, তাহা দুই ডিজিটেই আর আসে না। উপরন্তু যে দুই/চারজন প্রকাশক বন্ধু বন্ধু-তালিকায় ছিল তাহারাও কাসেমকে ব¬ক মারিয়াছে। অতি সুহৃদ বন্ধু-বান্ধবকে দিয়া খোঁজ লাগাইয়া জানা গেল, সে এখন কালো তালিকাভুক্ত লেখক। টাকা দিয়া ছাপাইতে চাহিলেও কোনো প্রকাশক তাহার বই ছাপাইবে না।

সহ্যেরও একটা সীমা থাকে। সেটায় যখন ‘অ’ যোগ হয় তখনই শুরু হয় অনিষ্ট। অসীম অসহ্যকর খবরখানা শুনিয়া কাসেম বক্স রাগে দুঃখে ফেসবুক আইডি ডিএক্টিভেট করিয়া পাথর হইয়া গেল।

পরিশিষ্টঃ
রোজ গগনে কত তারারই না আবির্ভাব ঘটে। কেউ কী তাহা গুনিয়া রাখে? অব্যর্থ ব্যর্থতায় একটি সম্ভাবনাময় জ্বলজ্বলে তারকা, সিস্টেমের ঘোরপ্যাঁচে পড়িয়া ঘোর অমানিশায় কৃষ্ণ গহ্বরে হারাইয়া গেল। বইভাগ্য যেমন সেলিব্রেটি লেখকের কপালে জুটিলো না, তেমনি সেলিব্রেটি লেখকের লেখনীও আর পাঠকের ভাগ্যে জুটিলো না। তাহাকে আর কোথাও খুঁজিয়া পাওয়া গেলো না।

সত্যজিৎ বিশ্বাস
রম্য লেখক ও শিশু সাহিত্যিক
* রম্য বিভাগীয় সম্পাদক- কিশোর বাংলা
* নির্বাহী সম্পাদক- কিশোরকাল
* কন্ট্রিবিউটার – মাসিক স্যাটায়ার কার্টুন ম্যাগাজিন ‘উন্মাদ’, জাতীয় দৈনিক যুগান্তর ‘বিচ্ছু’, দৈনিক ইত্তেফাক ‘ঠাট্টা’।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top