সিডনী সোমবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১

নজরুলে বিদ্রোহী সত্তার সন্ধান : মীম মিজান


প্রকাশিত:
২৭ আগস্ট ২০২০ ২২:৫১

আপডেট:
২৯ এপ্রিল ২০২৪ ১৫:৪৭

ছবিঃ কবি কাজী নজরুল ইসলাম

 

কাল চলে যায়। ঊর্মিমালা বহে যায়। পবন বয়ে যায়। কিছুই নাহি রয়ে যায়। তবে রয়ে যায় কীর্তি। আর এমনি একজন কীর্তিমান মানস আমাদের রক্তে জাগানিয়া কথামালার অমর স্রষ্টা জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তাকে যদি বিদ্রোহী কবি বলে ক্ষান্ত দেই তবে তা হবে অবিচার। তিনি যেমনি বিদ্রোহী মানসের বীর্যবান পুরুষ তেমনি প্রেমের কোমল হৃদয়ের রাজা। বাবরি দোলানো গায়ক কিম্বা শিল্পসফল একাধিক সিনেমার অন্যতম নায়ক। যেমনি বাঁকা বাঁশের বাঁশরির সুরস্রষ্টা তেমনি প্রবন্ধে বা নাটকে সাম্য, সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা, উদারতা ও সুন্দর আগামীর স্বপ্নদ্রষ্টা। বাঁধা যায় না তাকে কোন ফ্রেমে। তিনি বন্দি থাকতে জন্ম নেননি, কাউকে কুর্নিশ না করার দৃপ্ত অঙ্গীকারের কথা তাই বলেছেন অহর্নিশ। স্বশিক্ষিত অনন্য মানস নজরুল ছিলেন সাহিত্যরস পিপাসু। তাঁর সাহিত্য পাঠে বুঝা যায় কতখানি তাঁর পাঠের গভীরতা। আরবি শিখেছিলেন। শিখেছিলেন ফারসি। অন্যান্য ভাষার প্রতিও তাঁর আগ্রহ ছিল। তবে এ দুটো ভাষায় তাঁর গভীরতার স্বাক্ষর অত্যুজ্জ্বল তিনটি অনুবাদ। সম্পাদনার হাত ছিল পোক্ত ও ডরহীন। এক্ষেত্রে লেখক সুভাষ বসুর একটি উক্তি প্রণিধানযোগ্য, ‘‘আমরা যখন যুদ্ধে যাব- তখন নজরুলের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে যাব-তখনও নজরুলের গান গাইব।” আর আমি বলবো মসজিদ, মন্দির, বিয়েবাড়ি, বাসরঘর, মিছিল, সমাবেশ, নেই কোথায় এই নজরুলের প্রবেশ?

শতাব্দীর প্রোজ্জ্বল আফতাব এই ভাস্বর কবি ১৮৯৯ সালের ২৪ মে (১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। চুরুলিয়া গ্রামটি আসানসোল মহকুমার জামুরিয়া থানায় অবস্থিত। পিতামহ কাজী আমিনউল্লাহর পুত্র কাজী ফকির আহমদের দ্বিতীয়া পত্নী জাহেদা খাতুনের ষষ্ঠ সন্তান তিনি। তাঁর বাবা ছিলেন স্থানীয় এক মসজিদের ইমাম। তাঁরা ছিলেন তিন ভাই এবং দুই বোন। তাঁর সহোদর তিন ভাই ও দুই বোনের নাম হল: সবার বড় কাজী সাহেবজান, কনিষ্ঠ কাজী আলী হোসেন, বোন উম্মে কুলসুম। কাজী নজরুল ইসলামের ডাকনাম ছিল দুখু মিয়া। তিনি স্থানীয় মক্তবে (মসজিদ পরিচালিত মুসলিমদের ধর্মীয় স্কুল) কুরআন, ইসলাম ধর্ম, দর্শন এবং ইসলামী ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়ন শুরু করেন। ১৯০৮ সালে যখন তাঁর বাবা মারা যান তখন তাঁর বয়স মাত্র নয় বছর। 

যিনি আগামীর দীপ্তশিখা তিনি প্রকৃতি থেকে নিয়েছেন পাঠ। তাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা মাধ্যমিকের বেশি গড়ায়নি। ছোট্টবেলায় বাবা গত হওয়ায় জীবন যাপনের সংকুলানের খোঁজে অভিজ্ঞতার্জনের নানা উৎসের কর্মজীবন তিনি বেছে নিয়েছিলেন। মসজিদ সংলগ্ন মক্তব ও মাজারের খাদেম, রুটি দোকানের কর্মচারী, সৈনিক বেশে বেনিয়াদের অত্যাচারের সাক্ষী তিনি হয়েছিলেন। কুমিল্লার নার্গিসের সাথে বিয়ের নানা নাটকীয়তার পর প্রমিলা দেবীকে বিয়ে করে সৃজনজীবনের পাশাপাশি সংসার জীবনে হোন থিতু। তবে দারিদ্র ছিল সেই সংসারের নিত্যসঙ্গী। তবুও থেমে থাকেনি সৃজন কলম। সময় সময় পরিবর্তিত হয়েছিল কর্মক্ষেত্র। তবে তা ছিল ঐ সুন্দরের আহ্বান সৃজন সম্পর্কিত।

নজরুল বাংলাকে ভালোবাসতেন। ভালোবাসতেন বাঙালিকে। বাঙালির সুখের জন্য স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে অর্জন করার ও বিভূঁই থেকে আগত জোচ্চোরদের হাত হতে নিজ অধিকার আদায়ের কথা বলতেন উচ্চকিত কণ্ঠে। ভণ্ড, মুখোশ পরিহিত সমাজের তথাকথিত সমাজসেবকদের স্বরূপ করেছেন উন্মোচন। আর সেই কথাগুলো তিনি লিপিবদ্ধ করতেন মনের গভীর সাগরের তলদেশে ঝিনুকে সঞ্চিত মুক্তোদানার শব্দ সম্ভারের মাধ্যমে। যা হয়ে উঠতো নিপীড়িত মানুষদের কথা। যা গাত্রদাহ তৈরি করত মোড়লদের। সেসব সম্ভারের মধ্যে সবথেকে আবেদনমূলক সৃষ্টি হলো তাঁর অনন্য কাব্যমালা। প্রখর এক সূর্য ছিলেন সামসময়িক বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আর সেই প্রখর সূর্যের আলো থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে এক স্বতন্ত্র কাব্যধারা তৈরি করে নিজেকে অনন্য হিশেবে
প্রতিষ্ঠা করা কতখানি শক্তিমত্তার কাজ সমঝদার ব্যক্তির কাছে অনুমেয়। তাঁর সেই অনন্য স্বতন্ত্রধারার কাব্যগ্রন্থগুলির অন্যতম হলো,  অগ্নিবীণা, সঞ্চিতা (কবিতা সংকলন), ফনী-মনসা, চক্রবাক, সাতভাই চম্পা, নির্ঝর, নতুন চাঁদ, মরুভাস্কর, সঞ্চয়ন, সাম্যবাদী, দোলন-চাঁপা, বিষের বাঁশি, ভাঙ্গার গান, ছায়ানট, চিত্তনামা, সাম্যবাদী ইত্যাদি।

নজরুল যে অবদানগুলোর জন্য অবিস্মৃত তার প্রধানতম একটি অবদান হিশেবে নজরুলের সঙ্গীতকে আমরা জানি। তিনি নিজে নিজে গান রচনা করতেন। অতঃপর সেগুলিতে সুরারোপ করে ও নিজেই গাইতেন। আসলে তিনি ঠিকই বলেছিলেন তাঁর গানে, "আমি চিরতরে দূরে চলে যাব, তবু আমারে দেব না ভুলিতে।" তাঁর গানের সংকলনগুলি নজরুলগীতি হিসেবে বাংলায় প্রচলিত হচ্ছে। এরুপ গীতি সংকলনের অন্যতমগুলি হলো, বুলবুল, সন্ধ্যা, চোখের চাতক, নজরুল গীতিকা, নজরুল স্বরলিপি, চন্দ্রবিন্দু ইত্যাদি।

“নজরুল সর্বসমেত প্রায় তিন হাজারেরও বেশি সঙ্গীতের রচনাকার। পৃথিবীতে সঙ্গীত রচনার  ইতিহাসে এর চেয়ে বড় রেকর্ড আমার জানা নেই। রবীন্দ্র-প্রতিভা আনুমানিক দু’হাজারের কিছু বেশি গান রচনা করেছিল।” (নজরুল চরিত-মানস, ড. সুশীল কুমার গুপ্ত।) নজরুলের সঙ্গীতভাণ্ডারের অমূল্য সম্পদ হলো- ইসলামী সঙ্গীত। এ সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট নজরুল গবেষক কবি আবদুল আজীজ আল-আমান তাঁর “নজরুলের ইসলামী সঙ্গীত” প্রবন্ধে বলেন, “বাংলা সাহিত্যের আদি থেকে আজ পর্যন্ত হাজার হাজার মুসলিম কবি-সাহিত্যিক সম্মিলিতভাবে জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা রূপায়ণে যা না করতে পেরেছেন। মাত্র শ’ দুই ইসলামী সঙ্গীত রচনা করে এক নজরুল ইসলাম নিশ্চিতভাবে তার চেয়ে অনেক বেশি কাজ করেছেন।”

"ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ"- এই গানটির জনপ্রিয়তা সমকক্ষ আর একটি গান খুঁজে পাওয়া যাবে না। এ গানটি ছাড়া বাঙালি মুসলমানদের ঈদুল ফিতর  উদযাপন প্রায় অসম্ভব।  এ গানটি রচনার ইতিহাসটি নিম্নে উল্লেখ করছি।

অমর কণ্ঠশিল্পী আব্বাস উদ্দিন আহমদের ‘গীতিকার নজরুল’ প্রবন্ধে নজরুলের সাঙ্গীতিক প্রতিভার পরিচয় তুলে ধরতে গিয়ে উক্ত গানটি রচনার ইতিহাস সম্পর্কে বলেন-

“কুচবিহার কলেজের ছাত্র আমি। স্কুল কলেজ মিলে প্রতি বৎসর মিলাদ করতাম। সেই মিলাদ মাহফিলে কবিকে আমন্ত্রণ করি। সেই থেকে পরিচয়ের সূত্রপাত। তিনি আমার গান শুনে আমাকে উৎসাহ দিলেন। বললেন, “সুন্দর মিষ্টি কণ্ঠ, কলকাতায় চল, তোমার গান রেকর্ড করা হবে।” ১৯৩০ সনে প্রথম গান রেকর্ড করে কুচবিহার চলে আসি। ১৯৩১ সনে আবার কলকাতায় যাই এবং স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করি। গ্রামোফোন কোম্পানি রিহার্সেল ঘর তখন চিৎপুর রোডে। শুনলাম- কাজী সাহেব সেখানে রোজই যান। এক ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম, “কাজী সাহেব কোথায়?” তিনি বললেন, “পাশের ঘরে গান লিখছেন।” আমি ঢুকলাম। তিনি মহাউৎসাহে বলে উঠলেন, “আরে আব্বাস, তুমি কবে এলে? বস বস বস।” ... সামনে এগিয়ে গিয়ে কদমবুছি করলাম। তিনি বললেন, “সবাই আমাকে কাজী সাহেব বলে, তুমি কিন্তু কাজী দা বলে ডাকবে আমাকে হ্যাঁ, তোমার জন্য গান লিখতে হয়। আচ্ছা ঠিক হবে।”

“আচ্ছা ঠিক হবে” তো বললেন, কিন্তু যতবারই যাই গ্রামোফোন কাবে ততবারই দেখি তাকে ঘিরে রয়েছেন অনেকে। আমি সংকোচে কিছুই বলতে পারি না। পাশের ঘরে পিয়ারু কাওয়াল রিহার্সেল দিচ্ছেন উর্দু কাওয়ালী গানের। বাজারে সে সব গানের কী বিক্রি। আমি কাজীদাকে বললাম- এমনিভাবে বাংলা কাওয়ালী গান লিখে দিতে পারেন আমার জন্য?” গ্রামোফোন কোম্পানির বাঙালি সাহেব বললেন, “না, না, ও ধরনের বাংলা গান বিক্রি হবে না।” অবশেষে প্রায় এক বৎসর পরে সাহেব রাজী হলেন।  কাজীদাকে বললাম, “সাহেব রাজি হয়েছেন।” কাজী দা তখনি আমাকে নিয়ে একটা কামরায় ঢুকে বললেন, “কিছু পান নিয়ে এসো।” পান নিয়ে এলাম ঠোঙা ভর্তি করে। তিনি বলেন, ‘দরজা বন্ধ করে দিয়ে চুপ করে বসে থাক।” ঠিক ১৫-২০ মিনিটের মধ্যে লিখে ফেললেন, ‘ও মন রজমানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।” সুর সংযোগ করে তখনি শিখিয়ে দিলেন গানটা।”

নজরুল সঙ্গীত সৃষ্টি, সুরারোপ ও গাইতে ছিলেন সপ্রতিভ। বিশিষ্ট নজরুল-গবেষক শাহাবুদ্দিন আহমদ তাঁর ‘বহুরূপে নজরুল’ গ্রন্থে বলেন-

“নজরুলের কবিতার মত নজরুলের সঙ্গীতের যে বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে সে কথাটা আমি জোর দিয়ে বলতে চাই। এবং আমার ধারণা নজরুলের গানগুলো গীতি হিসেবে নয় সঙ্গীত হিসেবেই পরিচিত হওয়া উচিত। কেননা আসলেই নজরুলের গান ভাব-মিশ্রিত। চিত্র-মিশ্রিত, সুর-মিশ্রিত গান; তাই তাকে গীতি অপেক্ষা সঙ্গীত হিসেবে চিহ্নিত করাই যুক্তিসঙ্গত।”

ক্ষণজন্মা এ বহুমুখী প্রতিভা নজরুল ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, অনুবাদ ও সম্পাদনায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তাঁর তিনটি গল্পগ্রন্থ, উপন্যাসসহ ও কয়েকটি শিশুতোষ নাটক আমাদের মননকে আজও জাগ্রত করছে। পারস্যের বুলবুল এবং মহাকবির দিওয়ান ও রুবাইয়াৎ এর শ্রেষ্ঠ অনুবাদক তিনি। পবিত্র কুরআনের শেষোক্ত অংশ আম্মাপারার চমৎকার কাব্যানুবাদ করেছেন তিনি।

বাংলাদেশ স্বাধীনের পরে ১৯৭২ সালের ২৪শে মে সকাল ১১:৪০টায় ভারত সরকার থেকে অনুমতি নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে দেশে ফিরিয়ে আনেন। ১৯৭৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি কবিকে দেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। দুরারোগ্য ব্যাধিতে কবি আক্রান্ত ছিলেন অনেকদিন, দেশ বিদেশের বহু জায়গায় চিকিৎসা করেও কবিকে সুস্থ করা সম্ভব হয়নি, জীবনের অনেক দশক তিনি নির্বাক ছিলেন। ১৯৭৬ সালের ২৯শে আগস্ট (১২ই ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ) সকাল ১০:১০ টায় তৎকালীন পিজি হাসপাতালে নিউমোনিয়ার অধিক সংক্রমণে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুতে শ্লাঘাময় বাংলাসাহিত্যের এক অপূরণীয় ক্ষতি হয়। যদিও কবির সৃজন জীবনের অপমৃত্যু ঘটেছিল ১৯৪১ সালে পিকস ডিজেজে আক্রমিত হওয়ার সাথে সাথেই।

১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর কলকাতায় অ্যালবার্ট হলে কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয়ভাবে সংবর্ধনা জানানো হয়। ১৯৪৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এই বিদ্রোহী সত্তার কবিকে ‘‘জগত্তারিণী’’ স্বর্ণপদকে ভূষিত করে। তৎকালীন ভারত সরকার ১৯৬০ সালে কবিকে ‘‘পদ্মভূষণ’’ খেতাবে ভূষিত করে। এছাড়াও ১৯৬৯ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় নজরুলকে সম্মানসূচক ডি. লিট প্রদান করে। সেসময়ে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নজরুলকে সম্মানসূচক ডি. লিট ডিগ্রি প্রদান করে। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে ‘‘একুশে ফেব্রুয়ারি স্বর্ণপদক’’ প্রদান করে।

আমাদের শিকল ভাঙার কবি, বিদ্রোহী কবি নজরুল তাঁর চিন্তাভাবনায় ছিলেন অন্যসবার থেকে এগিয়ে। দেশের জমিন যখন বিদেশী বেনিয়াদের অত্যাচারে প্রলয়ের খণ্ডাংশ। তখন তিনি নির্ধারণ করে নিয়েছিলেন নিজস্ব কর্মপন্থা, সৃজনধারা। তিনি কায়মনোবাক্যে চাইতেন এই বেনিয়ারা হঠে যাক দেশ হতে। জনতা মুক্তি পাক কালো আইন ইত্যাদির কষাঘাত থেকে। নিজের দেশে আমরা নিজেই চাষবাস করে দু'মুঠো খেয়েপরে নিশ্বাস ফেলবো স্বস্তির। যখন অন্য কবিগণ ছিলেন পদ-পদবী, পদক, বিশেষ সুবিধা লাভের জন্য উন্মুখ। কাব্যের কোন শব্দ বিদ্রোহ করাতো দূরের কথা ঘৃণামিশ্রিত দৃষ্টিতে তাকায়নি ওদের(বৃটিশ) দিকে। সেখানে কী অদম্য এক প্রাণ ও সাহস নিয়ে হুংকার ছাড়লেন তিনি লোলুপ বৃটিশদের প্রতি।

নজরুল তাঁর প্রবন্ধ সংকলন 'যুগবাণী'তে আপামর সাধারণকে জেগে উঠতে বলেছিলেন। বৃটিশদের সম্বন্ধে আলোচনা করেছিলেন। ফলে
১৯২২ সালের ২৩ নভেম্বর সেন্ট্রাল প্রভিন্স ও বর্মা সরকার যুগপৎ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে তা নিষিদ্ধ করে। ফৌজদারি বিধির ৯০-এ ধারানুসারে বইটি বাজেয়াপ্ত এবং গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বিপণন নিষিদ্ধ করা হয়। নজরুল দমে যাওয়ার কোন ঠুনকো মানসের কবি ও স্বপ্নদ্রষ্টা নন যে ইংরেজের এই রক্তচক্ষুকে ভয় পাবেন। তিনি স্বীয় কর্ম নিজস্ব ভঙিতে চালাচ্ছিলেন। এরপর ১৯২৪ সালের ২২ অক্টোবর ফৌজদারি বিধির ৯৯-এ ধারায় বাজেয়াপ্ত করা হয় সেসময়ে সাড়া ফেলানো 'বিষের বাঁশী' কাব্যগ্রন্থটি।

অব্যাহতি কাল পরেই সাদা চামড়ার বৃটিশরা ও ওদের এদেশীয় দোসররা বিদ্রোহে পুষ্ট ও আগুন জ্বালানিয়া কাব্যগ্রন্থ 'ভাঙ্গার গান' নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ১৯২৪ সালের ১১ নভেম্বরে। এরপর নিষিদ্ধ হয় 'প্রলয় শিখা' এবং এর মাসখানিক পর বেনিয়া, আমলা এবং গোয়েন্দাদের রোষানলে পড়ে 'চন্দ্রবিন্দু' গ্রন্থটি।

'প্রলয় শিখা' নামক কাব্যগ্রন্থটির জন্যও দণ্ডিত হতে হয়েছিল নজরুলকে। 'আনন্দময়ীর আগমনে' একটি এ্যটমবোমার ন্যায় কবিতা। এই কবিতা প্রায় দুমড়েমুচড়ে দিয়েছিল ইংরেজ গদি। নজরুল সম্পাদিত যুগের প্রতিনিধিত্বকারী পত্রিকা 'ধূমকেতু'তে ১৯২২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর সংখ্যায় নজরুলের এই কবিতাটি প্রকাশ হয়। এ কবিতার জন্য ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪-এ ধারানুসারে কবিকে ১ বছর সশ্রম কারাভোগ করতে হয়। কবিতা লিখে হাততালি পাবে। সে কিনা সেই কবির স্থান হয় কারাগারে। অন্ধকার প্রকোষ্ঠ কবিকে আরো আলোয়রাঙা জন্মভূমি দেখার কবিতার রসদ জোগায়। বেনিয়াদের করা
এ মামলায় নজরুল আদালতে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, "আমার ওপর অভিযোগ, আমি রাজবিদ্রোহী! তাই আমি রাজকারাগারে বন্দি ও রাজদ্বারে অভিযুক্ত। একধারে 'রাজার মুকুট', আর একধারে 'ধূমকেতুর শিখা'; একজন রাজা, হাতে রাজদ; আর একজন সত্য, হাতে ন্যায়দ। রাজার পক্ষে রাজার নিযুক্ত বেতনভোগী রাজকর্মচারী। আমার পক্ষে সকল রাজার রাজ, সকল বিচারকের বিচারক জাগ্রত ভগবান। রাজার পক্ষে যিনি তার লক্ষ্য স্বার্থ; আমার পক্ষে যিনি, তার লক্ষ্য সত্য।"

নজরুল বিদ্রোহী। তাঁর বিদ্রোহ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে। কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে। ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে। ভণ্ডামির বিরুদ্ধে। শঠতার বিরুদ্ধে। দ্রোহ জাগাতেন গরীবের হৃদে। শ্রমজীবী মানুষদের মর্মযন্ত্রণা ধারণ করে রচেছেন কাব্যমালা। অসহায়, নিঃস্বদের দুঃখব্যক্ত করেছেন শব্দের বুননে।

যুগে যুগে কালে কালে অত্যাচারীদের খড়গের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল কবিদের মসি। যেখানে তাদের থামাতে পারেনি শোষকের তীক্ষ্ণ অসি। সেরূপ আধুনিক বাংলাসাহিত্যের প্রথম বিদ্রোহী কবি আমাদের আধুনিকতার জনক মাইকেল। তাঁর কাব্যমালা পাঠে নিজের ভিতরে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ধারণ করেছিলেন উপমহাদেশের প্রথম কারান্তরীন সাহিত্যিক সৈয়দ ইসমাঈল হোসেন সিরাজী। তাঁর 'অনল প্রবাহ' কাব্যগ্রন্থটিকে ইংরেজ শাসকেরা সর্বপ্রথম বাজেয়াপ্ত করেছিলো এবং লেখক হিশেবে সিরাজীকে দিয়েছিল দু'বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। আর সেই সিরাজীর বড়ছেলে সৈয়দ আসাদ উদ্দৌলা সিরাজীর নিমন্ত্রণে ১৯৩২ সালে সিরাজগঞ্জ এসেছিলেন নজরুল। ‘বঙ্গীয় মুসলিম তরুণ সম্মেলনে’ তিনি সভাপতিত্ব করেন। সেই অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, "শিরাজী ছিলেন আমার পিতৃতুল্য, তাঁর সমগ্র জীবন ছিল অনল-প্রবাহ। আমার রচনা সেই অগ্নিস্ফুলিঙ্গের প্রকাশ।"

সুতরাং নজরুলের দ্রোহী গুরু হচ্ছেন সিরাজী। বাংলাসাহিত্যে আজও অনেক কবিদের কলম লিখে চলেছে দ্রোহী কবিতা। কিন্তু নজরুলের 'বিদ্রোহী' কবিতা এখনো অনতিক্রম্য। তাই বলা যায় নজরুলের যে দ্রোহী সত্তা তা বাংলাসাহিত্যের সর্বোত্তম।

 

মীম মিজান
লেখক ও সাহিত্যিক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top