সিডনী বুধবার, ১লা মে ২০২৪, ১৮ই বৈশাখ ১৪৩১

রবীন্দ্র নজরুল : আফরোজা পারভীন


প্রকাশিত:
৩০ আগস্ট ২০২০ ০০:৫৬

আপডেট:
১ মে ২০২৪ ১২:৫০

আফরোজা পারভীন


বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম স্বমহিমায় উদ্ভাসিত। দুজনই বরেণ্য, দুজনই নমস্য। কেউ কারো সাথে তুলনীয় নন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে ১৯২১ সালে প্রথম দেখা হয় নজরুলের। রবীন্দ্রনাথ তখন নোবেল বিজয়ী বিশ্ব পরিব্রাজক। আর নজরুল উদীয়মান কবি, দ্রোহের কবি, শক্তির প্রতিভূ ।
প্রথম দেখা থেকে শুরু করে ১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু পর্যন্ত দু ই দশক সময়কালে এই দুই কীর্তিমানের বহুবার সাক্ষাৎ ঘটেছে। মাখামাখি যেমন হয়েছে, রাগ অভিমানের ঘটনাও ঘটেছে ।
তবে এ সব ছাপিয়ে এই দুই কবির মধ্যে ছিল শ্রদ্ধা আর ভালবাসার সম্পর্ক। রবীন্দ্রনাথের ষাটতম জন্মদিন পালন উপলক্ষে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ আয়োজিত অনুষ্ঠানে মঞ্চে রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে ডেকে পাশে বসিয়েছিলেন। নজরুল তাঁর ‘তীর্থ পথিক’ কবিতার অংশ বিশেষ রবীন্দ্রনাথকে পাঠিয়েছিলেন।
‘তুমি স্রষ্টার শ্রেষ্ট সৃষ্টি বিশ্বের বিস্ময়,-
তব গুণ-গানে ভাষা-সুর যেন সব হয়ে যায় লয়।
তুমি স্মরিয়াছ ভক্তের তব, এই গৌরবখানি
রাখিব কোথায় ভেবে নাহি পাই, আনন্দে মূক বাণী।
কাব্যলোকের বাণী-বিতানের আমি কেহ নহি আর,
বিদায়ের পথে তুমি দিলে তবু কেন এ আশিস-হার?
প্রার্থনা মোর, যদি আরবার জন্মি এ ধরণীতে-
আসি যেন গাহন করিতে তোমার কাব্য-গীতে!!”
১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার পান রবী›ন্দ্রনাথ। তখন কবির বয়স বায়ান্নো বছর। নজরুলের বয়স মাত্র চৌদ্দ। রবীন্দ্রনাথ যখন বিশ্বজয় করে বেড়াচ্ছেন, নজরুল তখন বাংলার গ্রাম গঞ্জে লেটোর দলে গান করছেন । নজরুল ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লেখেন ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা দিয়েই শুরু হয় নজরুলের দ্রোহের প্রকাশ। রবীন্দ্রনাথ তখন ছুটে বেড়াচ্ছেন ইউরোপ-আমেরিকার দেশে দেশে। বক্তৃতা করছেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। গড়ে তুলতে চাচ্ছেন শান্তিনিকেতনকে বিশ্ব সংস্কৃতির পীঠস্থান হিসেবে। রবীন্দ্রনাথ জমিদাননন্দন, পারিবারিক পরিবেশ প্রতিবেশ সবকিছুই উচ্চ, আর নজরুল গাঁয়ের দরিদ্র ছেলে। আর্থিক পটভূমি ভিন্ন রকমের। সম্প্রদায়গত পরিচয়ও অন্যরকম। তিনি সেনাবাহিনিতে যোগদানের সময়ে কলকাতাতে এসেছিলেন একবারই। সেনাবাহিনিতে যোগ দিয়েছিলেন সতের বছর বয়সে। যুদ্ধশেষে সেনাবাহিনি ভেঙে দেওয়ার পরে তাঁর স্থায়ী কোনো ঠিকানা ছিল না। থাকতেন বন্ধুদের সঙ্গে, এখানে সেখানে। কাজেই এই দুই কীর্তিমান কখনই পরস্পরের সাথে তুলনীয় নন, স্বতন্ত্র।
১৯২২ সালের ১১ আগষ্ট কলকাতা থেকে নজরুলের পরিচালনায় প্রকাশিত হয় অর্ধ-সাপ্তাহিক ‘ধুমকেতু’ পত্রিকা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ধুমকেতুর আর্শীবাণীতে লেখেন:
‘কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু ,
আয় চলে আয়, রে ধুমকেতু
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু
দুর্দিনের এই দুর্গশিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন!
অলক্ষণের তিলক রেখা
রাতের ভালে হোক না লেখা,
জাগিয়ে দেরে চমক মেরে’
আছে যারা অর্ধ চেতন!
২৪ শে শ্রাবণ ১৩২৯
শ্রী রবী›ন্দ্রনাথ ঠাকুর’
এই আর্শীবাণী থেকে বোঝা যায়, নজরুলের প্রতিভার ব্যাপারে কতটা উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন রবীন্দ্রনাথ। গভীরভাবে উপলব্ধি করতেন নজরুল রচনার বাণী।
১৯২২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ‘ধুমকেতু’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় নজরুলের কবিতা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’। কবিতাটি প্রতীকধর্মী ও রাজনৈতিক । এই কবিতার জন্য বাজেয়াপ্ত হয় ‘ধুমকেতু’র ওই সংখ্যাটি। কলকাতার চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে রাজদ্রোহিতার অভিযোগে নজরুলের বিরূদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। এ মামলায় গ্রেফতার করা হয় নজরুলকে।
নজরুল ছিলেন বিচারাধীন বন্দি। তাঁকে রাখা হয়েছিল প্রেসিডেন্সি জেলে। ১৭ জানুয়ারি বিচার শেষে তাঁকে
স্থানান্তর করা হয় আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে। পরাধীন দেশে সাম্রাজ্যবাদীর শোষণের চিত্র তুলে ধরেছিলেন নজরুল এ কবিতায়। সেদিন এ কবিতার জন্য দেশবাসী তাঁকে সেরা সন্তান মেনেছিল, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায় আনত হয়েছিল।
১৯২৩ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘বসন্ত’ গীতিনাট্য নজরুলকে উৎসর্গ করেছিলেন। ‘বসন্ত’র একটি কপিতে নিজের নাম লিখে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের হাতে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘তাকে বোলো, আমি নিজের হাতে তাকে দিতে পারলাম না বলে সে যেন দুঃখ না করে। আমি তাকে আমার সমগ্র অন্তর দিয়ে অকুণ্ঠ আশীর্বাদ জানাচ্ছি। আর বোলো, কবিতা লেখা যেন কোনো কারণেই সে বন্ধ না করে। সৈনিক অনেক মিলবে, কিন্তু যুদ্ধে প্রেরণা জাগাবার কবিও তো চাই।’
নজরুল তখন আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে। বইটি পেয়েই বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন নজরুল। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছিলেন, ‘এ সময়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বসন্ত’ নাটক আমাকে উৎসর্গ করেন। তাঁর এই আশীর্বাদ মালা পেয়ে আমি জেলের সর্বজ্বালা, যন্ত্রণা ক্লেশ ভুলে যাই।’
এই উৎসর্গের ঘটনাটি উল্লেখযোগ্য। রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত আপনজনদের বাইরে একজন অপরিচিতকে এই প্রথম বই উৎসর্গ করলেন। আর যাকে করলেন তার বয়স মাত্র ২৪। তখনও তিনি কোনো দিকেই উজ্জ্বল নন। কাজেই উৎসর্গ করতে বন্ধুজনের বাধাও পেয়েছিলেন কবিগুরু। আমলে নেননি।
‘বসন্ত’ গীতিনাট্য উৎসর্গের পর পরই নজরুল রচনা করেন কালজয়ী ‘আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ অর্থাৎ ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতাটি। অগ্নি-বীণা, দোলন-চাঁপা, ছায়ানট, সর্বহারা, ফণি-মনসা, সিন্ধু-হিন্দোল, চিত্তনামা প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের বাছাই করা কবিতা নিয়ে ১৯২৮ সালে নজরুলের ‘সঞ্চিতা’ প্রকাশিত হয়। নজরুল ‘সঞ্চিতা’ কাব্যগ্রন্থটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উৎসর্গ করেন। উৎসর্গপত্রে লেখেন:
‘বিশ্বকবি সম্রাট শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শ্রী শ্রী চরণারবিন্দেষু’
১৯২৩ সালে ১৪ এপ্রিল নজরুলকে হুগলী জেলে স্থানান্তর করা হয়। হুগলী জেলের সুপার মি. আর্সটান রাজবন্দীদের সাথে অমানুষিক দুর্ব্যবহার ও অত্যাচার করতেন। এই নির্যাতনের প্রতিবাদে নজরুল জেলে ৪০ দিন অনশন করেছিলেন।
১৯২৩ সালের ১৭ মে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লীলারাণী গঙ্গোপাধ্যায়কে এক চিঠিতে লেখেন: ‘হুগলী জেলে আমাদের কবি কাজী নজরুল ইসলাম উপুষ করিয়া মরমর হইয়াছে। বেলা ১টার গাড়ীতে যাইতেছি, দেখি যদি দেখা করিতে দেয় ও দিলে আমার আনুরোধে যদি সে আবার খাইতে রাজি হয়। না হইলে তার কোন আশা দেখি না। একজন সত্যিকার কবি। রবী বাবু ছাড়া আর বোধ হয় এমন কেহ আর এত বড় কবি নাই’। কিন্ত জেলে গেলেও শরৎচন্দ্র দেখা করতে পারেন নি।
জেলখানায় অনশনরত নজরুলের উপর অত্যাচারের মাত্রা বাড়ে। ডান্ডাবেড়ি, হ্যান্ডকাপ, সেল কয়েদ, ফোর্সড ফিডিং-এর চেষ্টা চলে। আরো দুর্বল হয়ে পড়েন নজরুল। রবীন্দ্রনাথ তখন শিলং-এ। তাঁকে বাঁচানোর জন্য শিলিং-এ চিঠি লেখা হয়। অনুরোধ করা হয় তিনি যেন নজরুলকে অনশন ভঙ্গ করতে অনুরোধ জানিয়ে পত্র লেখেন।
রবী›ন্দ্রনাথ পত্রের উত্তর দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি নজরুলকে অনশন ভঙ্গ করতে পত্র লেখেননি। বরং উত্তরে লিখেছিলেন, ‘আদর্শবাদীকে আদর্শ ত্যাগ করতে বলা তাকে হত্যা করারই সামিল। অনশনে যদি কাজীর মৃত্যুঘটে তা হলেও তার অন্তরে সত্য আদর্শ চিরদিন মহিমাময় হয়ে থাকবে।’
রবীন্দ্রনাথ তাঁর জায়গায় ঠিকই ছিলেন। নজরুলের আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন। কিন্তু শেষাবধি সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারেননি। নজরুলের স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে তিনি টেলিগ্রাম করেন: “এরাব ঁঢ় যঁহমবৎ ংঃৎরশব, ড়ঁৎ ষরঃবৎধঃঁৎব পষধরসং ুড়ঁ”. কিন্তু অন্যায় আচরণে সিদ্ধহস্ত জেল কর্তৃপক্ষ রবীন্দ্রনাথের টেলিগ্রাম নজরুলকে দিলেন না বরং রবীন্দ্রনাথকে লিখে পাঠালেন- “অফফৎবংংবব হড়ঃ ভড়ঁহফ.” টেলিগ্রামের এই জবাব পেয়েই রবীন্দ্রনাথ বুঝছিলেন এটি সাম্রাজ্যবাদীদের হীন চক্রান্ত। তারা সত্য গোপন করেছে। সেবার অনশনের চল্লিশ দিনে বিরজাসুন্দরী দেবীর হাতে লেবুর রস পান করে নজরুল অনশন ভেঙ্গেছিলেন। টেলিগ্রামের এই ঘটনাটি জানতেন না নজরুল। অভিমান হয়েছিল তাঁর রবী›ন্দ্রনাথ খোঁজ নেননি বলে। আর সে অভিমানের ফসলই ‘বড়র পিরীতি বালির বাঁধ’। তবে সে অভিমান ভেঙেও গিয়েছিল । আর তারই ফলশ্রুতিতে ১৯২৮ সালে নিজের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম সঞ্চিতা রবীন্দ্রনাথকেই উৎসর্গ করেছিলেন কবি। অন্যদিকে ১৯৩৮ সালে রবীন্দ্রনাথ সম্পাদিত বাংলা কাব্য পরিচয় গ্রন্থে নজরুলের তিনটি কবিতা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।
১৯২৭ সালে প্রকাশিত হয়েছিল নজরুলের লেখা ‘বড়র পিরীতি বালির বাঁধ’। রবীন্দ্রনাথের প্রতি অভিমান থেকে এই প্রবন্ধ রিখেছিলেন নজরুল। কিন্তু এখানেও দেখা যায় রবীন্দ্রনাথের প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধাবোধের প্রকাশ। তিনি লিখেছেন ‘বিশ্বকবিকে আমি শুধু শ্রদ্ধায় নয়, পূজা করে এসেছি সকল হৃদয়-মন দিয়ে, যেমন করে ভক্ত তাঁর ইষ্ট দেবতাকে পূজা করে। ছেলেবেলা থেকে তাঁর ছবি সামনে রেখে গন্ধ ধূপ-ফুল-চন্দন দিয়ে সকাল-সন্ধ্যা বন্দনা করেছি’।
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে অনেকগুলো কবিতা রচনা করেছেন নজরুল। রবীন্দ্রনাথের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার প্রমাণ জড়িয়ে আছে সেসব কবিতার পংক্তিতে পংক্তিতে। ‘অশ্রু-পুষ্পাঞ্জলী’ কবিতাটির রবীন্দ্রনাথের আশিতম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে রচনা করেন নজরুল।
চরণারবিন্দে লহ অশ্রু-পুষ্পাঞ্জলী,
হে রবীন্দ্র, তব দীন ভক্ত এ কবির।
অশীতি-বার্ষিকী তব জনম-উৎসবে
আসিয়াছি নিবেদিতে নীরব প্রণাম।
হে কবি-সম্রাট, ওগো সৃষ্টির বিস্ময়,
হয়তো হহনি আজো করুণা-বঞ্চিত!
সঞ্চিত যে আছে আজো সৃষ্টির দেউলে
তব স্নেহ করুণা তোমার, মহাকবি।
(নতুন চাঁদ, অশ্রু-পুষ্পাঞ্জলী)
‘কিশোর রবি’ও রবীন্দ্রনাথের প্রশস্তিতে ভরা কবিতা
হে চির-কিশোর রবীন্দ্র, কোন রসলোক হতে
আনন্দ-বেণু হাতে হাতে লয়ে এলে খেলিতে ধুলির পথে?
কোন সে রাখাল রাজার লক্ষ ধেনু তুমি চুরি করে
বিলাইয়া দিলে রস-তৃষা তুরা পৃথিবীর ঘরে ঘরে ।
কত যে কথায় কাহিনীতে গানে সুরে কবিতায় তব
সে আনন্দ- গোলেকের ধেণু রূপ নিল অভিনব।
ভুলাইলে জরা, ভুলালে মৃত্যু অসুন্দরের ভয়
শিখাইলে পরম সুন্দর চির-কিশোর সে প্রেমময়।
নিত্য কিশোর আত্মার তুমি অন্ধ তুমি বিবর হতে
হে অভয়-দাতা টানিয়া আনিলে দিব্য আলোর পথে।
(নতুন চাঁদ, কিশোর রবি)
রবীন্দ্রনাথের জন্মতিথি নিয়ে কবিতা লিখেছিলেন নজরুল । নাম ‘রবির জন্মতিথি’।
নিরক্ষর ও নিস্তেজ বাংলায়
অক্ষর-জ্ঞান যদি সকলেই পায়,
অ-ক্ষর অ-ব্যয় রবি সেই দিন
সহস্র করে বাজাবেন তাঁর বীণ।
সেদিন নিত্য রবির পুণ্য তিথি
হইবে। মানুষ দিকে তাঁকে প্রেম-প্রীতি।
( শেষ সওগাত, রবির জন্মতিথি)
রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ও জীবনে প্রসারতা ও উদারতার সন্ধান পেয়েছিলেন নজরুল।
রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সৌহার্দ্যে ভালবাসা শ্রদ্ধার অনেক কাহিনি রয়েছে। নজরুলকে খুব ¯েœহ করতেন রবীন্দ্রনাথ।‘গোরা’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্রে নজরুলকে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে মনোনীত করেন নরেশচন্দ্র মিত্র। তখন নজরুল সুরকার হিসেবে খুবই জনপ্রিয়। চলচ্চিত্রটি তখন মুক্তির অপেক্ষায়। এমন সময় বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ড থেকে আপত্তি ওঠে। আপত্তির কারণ বোর্ডের অনুমতি না নিয়ে চলচ্চিত্রে ৭টি রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহার করা হয়েছে। আর সঙ্গীতের সুরও যথাযথ নয়। কাজেই চলচ্চিত্রটি মুক্তি পেতে পারে না। মাথায় হাত পড়ল প্রযোজকের । আর ওদিকে নজরুল ফিল্মের প্রিন্ট ও প্রজেক্টর নিয়ে সরাসরি হাজির হলেন শান্তিনিকেতনে রবীন্ত্রনাথের কাছে । সব বললেন রবীন্দ্রনাথকে। সব শুনে রবীন্দ্রনাথ বললেন ‘কি কান্ড বলতো? তুমি শিখিয়েছ আমার গান, আর ওরা কোন আক্কেলে তার দোষ ধরে? তোমার চেয়ে ও আমার গান কী তারা বেশি বুঝবে? আমার গানের মর্যাদা কী ওরা বেশী দিতে পারবে’? একথা বলে আগের থেকে লিখে রাখা অনুমতিপত্র নিয়ে তাতে সই ও তারিখ দিয়ে দিলেন।
এই একটি ঘটনাই রবীন্দ্র নজরুল সম্পর্ক বোঝার জন্য যথেষ্ট। রবীন্দ্রনাতের ¯েœহ থেকে কখনই বঞ্চিত হননি নজরুল।
১৯২০ থেকে ১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণ পূর্ব কাল পর্যন্ত রবীন্দ্র-নজরুল সম্পর্ক ছিল স্নেহ ও শ্রদ্ধার।
নজরুলের সৃষ্টিশীল জীবন ছিল মাত্র ২২ বছরের, রবীন্দ্রনাথের সময়ের তিন ভাগের এক ভাগ। কিন্তু অনেক মিল দুই কবির। প্রধান মিল দু’জনেরই প্রধান পরিচয় কবি। দু’জনেই বহুমুখী; সাহিত্যের সব শাখাতেই সমান বিচরণ ছিল তাঁদের। রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন, সমাজের অগ্রগতি ও মানুষের মুক্তি নিয়ে চিন্তা ছিল সার্বক্ষণিক। দুজনেরই সঙ্গীতের প্রতি গভীর আকর্ষণ। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে দু’জনের অবদানই অসামান্য। হাজার হাজার গান তাঁরা রেখে গেছেন। গানে সুর দিয়েছেন, সুর সৃষ্টি করেছেন, সুরের মিশ্রণ ঘটিয়েছেন। নিজেরা গান গাইতেন। বাংলা সাহিত্যে সঙ্গীতে এতটা দক্ষ এবং সঙ্গীতমনস্ক আর কোনো কবির সন্ধান পাওয়া যায় না। দু’জনেই নাটক লিখেছেন, নির্দেশনা দিয়েছেন, অভিনয় করেছেন। তাঁরা প্রতিষ্ঠান গড়েছেন। দুজনেরই অসাধারণ রসবোধ ছিল। শিশুদের জন্য যা লিখেছেন তাও অতুলনীয়। বক্তৃতা করেছেন সভা-সমাবেশে। সম্পাদনা করেছেন পত্রিকা।
দু’টি ক্ষেত্রে অবশ্য মিল নেই। একটি চিত্রাঙ্কন, অন্যটি বিদেশ-ভ্রমণ। এ দুটো করেননি নজরুল। বেঁচে থাকলে হয়ত করতেন।
দৃষ্টিভঙ্গিতে দু’জনেই উদার। রোমান্টিক, স্পর্শকাতর, সংবেদনশীল। আবেগ দিয়ে লিখেছেন, রচনায় ছিল গভীর দার্শনিকতা। উভয়েই গদ্য লিখেছেন। উপন্যাস, নাটক, ছোটগল্প, প্রবন্ধ সব ধরনের রচনাতেই ছিলেন সিদ্ধহস্ত। ব্যক্তিগত জীবনে দুর্বহ দুঃখ ছিল। সে দুঃখ বইবার শক্তিও তাঁদের ছিল। দুঃখ ছিল বলেই মানুষের দুঃখ বুঝতেন তাঁরা। মানুষের দুঃখকে মূর্ত করেছেন লেখায়। পাশাপাশি তাঁদের দু’জনের লেখাতেই ছিল আনন্দের উজ্জ্বলতা; উচ্ছ্বলতা।
দুজনেই ১৯২৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রতিবাদ করেছিলেন। নজরুল ‘কান্ডারি হুঁশিয়ার’ কবিতায় লিখেছেন, ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন্ জন?’ আর রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী, নিত্য নিঠুর দ্বন্দ্ব;/ ঘোর কুটিল পন্থ তার, লোভজটিল বন্ধ’।
নজরুল আগাগোড়াই কৃষকের পক্ষে ছিলেন । চাষির মুখে হাসি না দেখতে পেয়ে বলেছেন জেগে উঠতে, বিদ্রোহ করতে : ‘বাঁশের লাঠি পাঁচন তোর তাও কি হাতে নাই?/ না থাকে তোর দেহের রক্ত, হাড় ক’টাতো চাই।’
রবীন্দ্রনাথ ১৮৯৩ সালে লিখেছেন ‘এবার ফিরাও মোরে’। বলেছেন, মানুষের মূঢ় ম্লান মূক মুখে ভাষা দিতে হবে, শ্রান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে ধ্বনিত করতে হবে আশা। ‘দুই বিঘা জমি’তে তিনি ভূমি থেকে কৃষকের উচ্ছেদের কথা বলেছেন। ছিন্নপত্রাবলীতে কৃষক পরিবারের দুর্দশার ছবি উঠে এসেছে। কিন্তু তিনি বুঝি অতৃপ্ত ছিলেন। তাই বুঝি ১৯৩১ সালে ‘প্রশ্ন’ কবিতায় লিখেছেন, তিনি দেখেছেন প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে বিচারের বাণী কীভাবে নীরবে নিভৃতে কাঁদছে; বলেছেন, ‘আমি যে দেখিনু, তরুণ বালক উন্মাদ হয়ে ছুটে/ কী যন্ত্রণায় মরেছে পাথরে নিষ্ফল মাথা কুটে’; প্রশ্ন করছেন ভগবানের প্রতি ‘তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কে বেসেছো ভালো?’ ১৯৪১ সালে ‘ওরা কাজ করে’ কবিতায় মমতায় আর্দ্র হয়ে লিখেছেন, ‘ওরা চিরকাল/ টানে দাঁড়, ধরে থাকে হাল/ ওরা মাঠে মাঠে বীজ বোনে পাকা ধান কাটে’। কবি নজরুল জানতেন ওদের মুক্তির পথ সমাজ বিপ্লব। তাই তিনি প্রশ্ন না করে সরাসরি জবাব দিয়েছেন। ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতায় তিনি জয়ধ্বনি তুলেছেন রুশ বিপ্লবের পক্ষেই।
রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সূচনাপর্বের দুটি কালজয়ী কবিতা নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ এবং বিদ্রোহী। রবীন্দ্রনাথের কবিতার বিষয় পাহাড়ী ঝর্ণার স্বপ্নভঙ্গ। নজরুলের বিষয় জাগ্রত মানুষের বিদ্রোহ। রবীন্দ্রনাথ এ কবিতায় বিশ্বময় করুণাধারা ঢালতে চেয়েছেন। কিন্তু নজরুল করুণার পক্ষে হয়েও বলছেন, করুণা যথেষ্ট নয়, অত্যাচারী শাসনের অবসান চাই। অন্যদিক রবীন্দ্রনাথের বীরশিশু লড়বে দস্যুদের সঙ্গে। আর নজরুলের শিশু রাত্রিশেষে মা’কেই শুধু নয়, জাগাবে সবাইকে, সবাই না জাগলে সকাল হবে কি করে? রবীন্দ্রনাথ উপেনের কথা লিখেছেন। তার তার বিঘে দুই ভূমি ছিল। নজরুলের কৃষকের কোনো জায়গা-জমি নেই। সে কুলি-মজুরি করে। তারা শোষকদের অধীনে কাজ করে। তবে অবশ্যই একদিন শোষকদের কাছ থেকে তারা পাওনা আদায় করে নেবে। এদের শ্রমের ওপর ভর করেই অত্যাচারীরা দালান তুলেছে, বাষ্পশকটে-আকাশযানে চলাফেরা করছে।

নজরুল গভীরভাবে রবীন্দ্রভক্ত। নজরুলের বহু রচনায় রবীন্দ্রনাথের গান, উদ্ধৃতি, বাক্য, বাক্যাংশ পাওয়া যাবে। গীতাঞ্জলির গানগুলো ছিল তাঁর মুখস্থ, রবীন্দ্রনাথের বড় বড় কবিতাও অক্লেশে মুখস্থ বলে যেতে পারতেন তিনি।
অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের ‘রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল’ প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ নজরুলকে শান্তি নিকেতনে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে নজরুল একের পর এক রবীন্দ্রসংগীত গেয়েছিলেন। সবগুলো তাঁর কণ্ঠস্থ ছিল। রবীন্দ্রনাথ মুগ্ধ ও বিস্মিত হয়ে বলেছিলেন, তাঁর নিজেরই এখন আর গানের কথা মনে থাকে না।
নজরুলই প্রথম বাঙালি যিনি হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান সকল বাঙালিকে, সকল শ্রেণিকে সাহিত্যে এনেছেন। নারী-পুরুষের বৈষম্যেও বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন।
১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট বাংলা ১৩৪৮ সালের ২২ শে শ্রাবণ বেলা বারোটা এগারো মিনিটে রবীন্দ্রনাথ অনন্তলোকে পাড়ি জমালেন। রবী›ন্দ্রনাথের মৃত্যু সংবাদ শোনার সাথে সাথে নজরুল হাতে তুলে নিলেন কলম। রচনা করলেন শোক কবিতা ‘রবি হারা’-
দুপুরের রবি পড়িয়াছে ঢলে অস্ত পথের কোলে
শ্রাবণ মেঘ ছুটে’ এল দলে দলে
উদাস গগন-তলে।
বিশ্বের রবি ভারতের কবি,
শ্যাম বাংলার হৃদয়ের ছবি।
তুমি চলে যাবে বলে।
বিদায়ের বেলা চুম্বন লয়ে যায় তব শ্রীচরণে,
যে লোকেই থাক হতভাগ্য এ জাতিরে রাখিও মনে।
(রবি হারা, সওগাত, ভাদ্র ১৩৪৮)
কলকাতা বেতার কেন্দ্রে এই কবিতাটি নজরুল আবৃত্তি করেছিলেন।
রবী›ন্দ্রনাথের প্রয়াণে নজরুল মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। তাঁর সারা পৃথিবী হয়ে ওঠে রবিময়। তিনি ‘সালাম অস্ত-রবি’ নামে আরও একটি কবিতা লিখেছিলেন। এই কবিতাটিও কলকাতা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়।
শত রূপে রঙে লীলা-নিকেতন আল্লার দুনিয়াকে
রাঙায় যে জন, আল্লার কৃপা সদা তাঁরে ঘিরে থাকে।
তুমি যেন সেই খোদার রহম এসেছিলে রূপ ধরে,
আশেরি ছায়া দেখাইয়াছিলে রূপের আর্শি ভরে।
কালাম ঝরেছে তোমার কলমে, সালাম লইয়া যাও
উর্ধ্বে থাকি’ এ পাষাণ জাতিরে রসে গলাইয়া দাও!
(সালাম অস্ত-রবি, মাসিক মোহাম্মদী, ভাদ্র ১৩৪৮)
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুতে শোকাহত নজরুল গানও রচনা করেছিলেন:
“ঘুমাইতে দাও, শান্ত রবিরে জাগায়োনা।
সারা জীবন যে আলো দিল ডেকে তার ঘুম ভাঙ্গায়োনা।”.
গানটির বাণী অত্যন্ত আবেগঘন, বেদনাময় । সুনীল ঘোষ, ইলা ঘোষ প্রমুখ শিল্পী গানটিরেকর্ড করেছিলেন। কলকাতা বেতারে প্রচারিত হয়েছিল গানটি ।
কবিগুরুর মৃত্যুর মাত্র এক বছরের মাথায় ১৯৪২ সালের জুলাইয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন নজরুল । ক্রমশ তিনি নির্বাক হয়ে যান।
নজরুলের এই নিশ্চুপতা নিয়ে অনেক কথা আছে। কথা আছে তিনি চুপ হয়ে যান নি, তাঁকে চুপ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। শক্রপক্ষে প্রথম ছিল ব্রিটিশ রাষ্ট্র। এমন কোনো নির্যাতন নেই যা রাষ্ট্র নজরুলের ওপর চালায় নি। দ্বিতীয়ত ছিল অর্থনৈতিক সঙ্কট। ব্যক্তিগত কোনো সম্পত্তি ছিল না নজরুলের । ছিল না স্থায়ী বাসগৃহ। তাঁর ছয়টি বই নিষিদ্ধ ছিল । অভাবের তাড়নায় কোনো কোনো বইয়ের গ্রন্থস্বত্ব তিনি বিক্রি করে দিয়েছিলেন। বৈষয়িক ব্যাপারে একেবারেই আনাড়ি ছিলেন, আগ্রহও ছিল না। সখ করে একটি মোটর গাড়ি কিনেছিলেন এক সময়ে। রাখতে পারেন নি। অভাবের কারণে একসময়ে পুরোপুরি গানের জগতে চলে গিয়েছিলেন।
সর্বগ্রাসী অভাবের সাথে ছিল শোক আর ব্যাধি । আদরের সন্তান বুলবুলকে হারিয়ে তিনি ভেঙে পড়েছিলেন। স্ত্রী প্রথমে বাতে আক্রান্ত হন, পরে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন। সুচিকিৎসা করতে পারেননি। সাথে ছিল অতিরিক্ত পরিশ্রম। দিনরাত লিখতেন। কোনো বিশ্রাম ছিল না। অতিরিক্ত পরিশ্রমে তাঁর মস্তিষ্কের ওপর প্রবল চাপ পড়েছিল। সে চাপ নিতে পারেননি তিনি। তাঁর ওপর যথার্থ চিকিৎসাও হয় নি। যেটুকু হয়েছে তাও দেরিতে।
রবীন্দ্রনাথ নজরুল দুজনের একজন বিশ্বকবি, আরেকজন আমাদের জাতীয় কবি । বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রধান এই দুই কবি দুই বাংলার বাঙালির গর্ব । তাঁদের দু’জনের সাহিত্যই বাংলাদেশের প্রকৃতি ও মানুষ দিয়ে পরিপুষ্ট।
নজরুল রবীন্দ্রনাথের চলে যাওয়া দেখেছিলেন, কেঁদেছিলেন, লিখেছিলেন। নজরুল চলে যাবার আগেই চলে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাই পরম ¯েœহের কবির এই অকাল নিশ্চুপতা আর চলে যাওয়া দেখতে হয়নি তাঁকে। ভাগ্যবান তিনি। দেখলে নিশ্চিত খুবই কষ্ট পেতেন!
তথ্যসূত্র:
তথ্য ঋণ: ১) কারাবাসে নজরুল শান্তনু ঠাকুর ২) রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল-ইন্দ্রজিৎ সেনগুপ্ত, ৩) নজরুলের সাংবাদিকতা- ডঃ সুশীল কুমার গুপ্ত, শতকথায় নজরুল ৪) কাজী নজরুল ইসলাম- স্মৃতিকথা , মুজফ্ফর আহমেদ ৫) রাজবন্দী কবি নজরুল : আইউব হোসেন, ৬) কল্লোল যুগ, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, ৭. চলমান জীবন (দ্বিতীয় পর্ব), পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়।

 

আফরোজা পারভীন
লেখক: কথাশিল্পী, কলামলেখক

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top