সিডনী সোমবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১

নানান রঙের সম্পর্ক : কাজী খাদিজা আক্তার


প্রকাশিত:
৩১ আগস্ট ২০২০ ২০:৪৭

আপডেট:
২৯ এপ্রিল ২০২৪ ১৩:৫৩

কাজী খাদিজা আক্তার

 

খুব ছোটবেলায় থানার নদীর ঘাটে একবার এক বেদের দল অনেকগুলো নৌকা বেধেছিলো।  বিকেল হলেই ছোটে যেতাম নদীর ঘাটে। অনেক কথা অনেক প্রশ্ন হতো। কখনও কখনও ওদের নৌকায় বসে একসাথে খেতাম। ওদের মাছ ধরা দেখতাম। ঝগড়া শুনতাম। তারপর একদিন ওরা কোথায় যেন হারিয়ে গেলো। আর কোনোদিনও দেখা হলোনা। এমনতর সম্পর্কের স্মৃতি আমাদের সবার জীবনেই আছে। কে কবে মনে রেখেছে এমন ছোট ক্ষনস্থায়ী সম্পর্কগুলোকে? তবে এটাতো অস্বীকার করা যায়না যে এই মধুর সম্পর্কগুলো আমাদের জীবন স্মৃতিকে অনেক সমৃদ্ধ করেছে।

                                 

সম্পর্কের সুতো ধরে টান দিলে লক্ষ্য কোটি সম্পর্ক চোখের সামনে দৃশ্যমান হয়ে উঠে নানান রঙে, সুরে বেসুরে, অস্পষ্ট আলোয়, ধূসর দূরত্বে, অসীম গভীরে, আড়ালে সংগোপনে। সম্পর্কের কোনো সংজ্ঞা হয়না বলেই আমি বিশ্বাস করি। জীবনে চলার পথে কতো সম্পর্কে আমরা প্রতিনিয়ত জড়িয়ে যাই। সম্পর্কের সাথে সম্পর্কিত শব্দগুলো ভালোবাসা, মায়া মমতা, আন্তরিকতা, শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা হলেও সূক্ষ্মভাবে লুকায়িত থাকে  "স্বার্থ"  শব্দটি। 

সম্পর্কের শুরু থেকে যদি বলি তাহলে সেটা রক্তের সম্পর্ক। সন্তানের সাথে মা-বাবার সম্পর্ক পৃথিবীর সবচাইতে বিশুদ্ধ এবং নিরেট আর নিঃস্বার্থ সম্পর্ক। মা-বাবার মতো নিঃস্বার্থ ভাবে সন্তানের সাথে সম্পর্ক কেউ টিকিয়ে রাখতে পারেনা।এ এক মধুর নির্মল সম্পর্ক। তারপরও একটা সময় পার হয়ে গেলে সন্তান যখন পৃথিবীর মাটিতে শক্ত হয়ে চলতে শিখে যায় তখন অনেক ক্ষেত্রেই মা-বাবার সম্পর্কটাও কি একটু হাল্কা হয়ে যায় না? শুনতে অস্বাভাবিক  লাগলেও কোনো কোনো সময় এটাই স্বাভাবিক। আর স্বাভাবিক বলেই আমাদের সাধারণ সমাজে হাজারো পরিবারে ভালোবাসার ভাগবাটোয়ারায় তারতম্য এক নিত্য চিত্র। এবং চরম কঠিন হলেও একটা সত্য যে সত্যিই সত্য সেটা হলো, কন্যা সন্তান এবং পুত্র সন্তানের মধ্যে ভালোবাসার এবং মেনে নেয়ার পার্থক্য।সেক্ষেত্রে কন্যা সন্তানের এমন নেতিবাচক  অবস্থান পৃথিবীর এক আদিম বিষয়।  আবার এমন পার্থক্যও  আছে যে, সন্তানের বিবাহিত জীবন শুরু হলে মা-বাবার ভালোবাসায় আমাদের এ সমাজের বহু পরিবারে ছেলে মেয়ের পার্থক্য  অন্য এক  চরম আকার ধারণ করে। আর সেজন্যেই পুত্রবধূ কখনও মেয়ে হতে পারেনা তবে মেয়ের জামাই পরম আত্মীয় হয়ে যায় খুব সহজেই । এগুলো আমাদের সমাজের খুব সাধারণ হতে হতে এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, তার ব্যতিক্রম বা উল্টোটা হলেই আমরা কেবল আশ্চর্য হই। তবে পার্থক্য না থাকাটাই যে স্বাভাবিক সেটা কেউ প্রমাণ করতে রাজি নয়।তারপরও মা-বাবার আশীর্বাদ সবসময়ই আমাদের জীবন চলার শক্তি এবং একমাত্র খাটিঁ সম্বল। কিন্তু আমরা সন্তানেরা মাঝে মাঝে এতোটাই অকৃতজ্ঞ হই যে তাঁদের সকল ভালোবাসা এবং মমতাকে অস্বীকার করে তাঁদের দূরে ঠেলে দিতে এতটুকুও কার্পণ্য করিনা। সেজন্যই বোধ করি আজকাল বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা এবং তার বাসিন্দা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।সকল অসামঞ্জস্যতা সত্বেও পৃথিবীতে সন্তানের সাথে মা-বাবার এবং মা-বাবার সাথে সন্তানের সম্পর্কই শ্রেষ্ঠ সম্পর্ক। 

 

রক্তের সম্পর্ক বাদ দিলে সবচেয়ে কাছের এবং মধুর সম্পর্ক হলো বন্ধুত্ব। বন্ধু এক পরম আশ্রয়ের নাম, ভালোবাসা আর অভিমানের নাম। প্রত্যেক মানুষের জীবনে বন্ধু হলো এক পৃথিবী স্বাধীনতার নাম। যেখানে কোনো বাধা নেই, নিয়ম নেই, ভালোবাসার সীমান্ত নেই। এই রোদ্দুর এই বৃষ্টি। এ এক অন্যরকম অনুভূতি। এই যে বন্ধুত্ব, এখানেও টানাপোড়েন আছে। স্বার্থের টানে অনেকেই দূরে চলে যায়। সম্পর্ক এমনই। পৃথিবীর সকল সম্পর্কেই টানাপোড়েন আছে, উত্থান পতন আছে। পৃথিবীর সকল সম্পর্কের মধ্যে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক জীবনের এক বিরাট অধ্যায়। পারস্পরিক ভালোবাসা,বিশ্বাস    সমঝোতা এবং একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাই টিকিয়ে রাখে এসম্পর্ককে। তবে ইদানীংকালে  এসম্পর্কেই ফাটল ধরেছে  সবচেয়ে বেশি। একক পরিবারগুলোও ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে।এক্ষেত্রে এই পরিবারগুলোতে  সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তাদের সন্তানগুলো।                          

 

এতোকিছুর পরও আমরা সম্পর্কের কাঙাল।সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখার সেকি আকুলতা। আমরা কখনও চাইনা সম্পর্কের কারণে সংসার ভেঙে যাক,ভেসে যাক সময় স্মৃতি, আবছা হয়ে যাক প্রিয় প্রিয় মুখগুলো।এই সম্পর্ক কে টিকিয়ে রাখতে যে শব্দগুলোর প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশি তা হলো কৃতজ্ঞতা, ছাড়দেয়া,সহজ হওয়া, সহজ করে ভাবা এবং চাওয়া পাওয়ায় সীমিত হওয়া। আমরা সংসার জীবনে হরহামেশাই একটা কথা শুনতে পাই যা হলো, 'ও ছাড় দিচ্ছেনা আমি কেন দিব?'  এমন করে যদি জেদ ধরে বসে না থেকে আপনার একটুখানি ছাড়ে যদি সকল কঠিন সহজ হয়ে যায় তাহলে একটুখানি ছাড় দিয়ে আপনি মহান হওয়া থেকে কেন নিজেকে বঞ্চিত করবেন? 

 

আগেই বলেছি সম্পর্কের কোনো সংজ্ঞা আমার জানানেই বা সম্পর্ককে আমি কোনো সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করতে চাইনা। সম্পর্কের সংজ্ঞা দিয়ে সম্পর্কের সীমানা বা গভীরতা অনুমান কিংবা অনুভব করা যেমন অসম্ভব তেমনি জীবনে চলার পথে কতো কতো সম্পর্কের সাথে আপনি আমি জড়িয়ে আছি বা ছিলাম সে পরিসংখ্যান বের করাও কিন্তু সম্ভব নয়। মাঝে মাঝে সম্পর্কের টানাপোড়েনের নোনাজলে ভেসে যায় সম্পর্কের সঠিক গতি এবং সুমধুর সুর। সেক্ষেত্রে আপনাকে একটি বিষয়ে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে কোনো তৃতীয় ব্যক্তি কিংবা আপনার পরিবারের বাইরের কারোর সাথে আপনি আপনার পরিবারের দূর্বলতা কখনও শেয়ার করবেন না। কারণ এই দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে সে যে আপনাকে কখনও আঘাত  করবেনা সে গ্যারান্টি কিন্তু আপনি দিতে পারেননা।   

সম্পর্ক প্রতিনিয়তই জন্ম নেয়। চলার পথে, কর্মক্ষেত্রে, পারিবারিক সম্পর্কের মিলনে  আমরা সবসময়ই সম্পর্কের বৃত্তে আবদ্ধ হচ্ছি। সবকিছু সঠিক থাকলে এ এক সুন্দর প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি। বর্তমান ভার্চুয়াল দুনিয়ায় ভার্চুয়াল সম্পর্কেরও কিন্তু কোনো কমতি নেই। এতো সম্পর্কের ভেতরেও বাস্তব জীবনে সম্পর্কের অধপতনই লক্ষ্য করা যায় বেশি, যা মোটেও কাম্য নয়। সম্পর্কে স্বার্থপরতা দুর্গন্ধ ছড়ায় কিন্তু ভালোবাসা এনে দেয় এলাচদানার মতো সুগন্ধ ।ভোরের আলোর মতো কোমল, কচি লেবুপাতার মতো সবুজ আর রাতের তারার মতো স্নিগ্ধ হয়ে  উঠোক আমাদের সকল সম্পর্কগুলো। সম্পর্কগুলো পাশে থাকুক জীবনের শেষ সূর্যাস্ত পর্যন্ত।                                             

 

কাজী খাদিজা আক্তার
লেখক ও প্রাবন্ধিক, প্রভাষক (ইংরেজি), সরাইল সরকারি কলেজ।                                 

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top