সিডনী শুক্রবার, ৩রা মে ২০২৪, ২০শে বৈশাখ ১৪৩১

দাদা গণতন্ত্র কাকে বলে? : দেবনাথ সুকান্ত 


প্রকাশিত:
১ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২৩:১৫

আপডেট:
১ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২৩:৩৪

 

-এই যে দাদা শুনছেন, আপনাকেই বলছি, শুনুন না, খুব নিশ্চয়ই ব্যস্ত নয়, বাজারেই তো যাচ্ছেন, একবার আমাদের সাথে না হয় দুটো কথা বলে যান।
-বলুন কি বলছেন। আর কোথা থেকে আসছেন আপনারা। 
-আমরা এসেছি বিশ্ব বাংলা নিউজ চ্যানেল থেকে। সামান্য একটি প্রশ্ন নিয়ে। দাদা ভোট তো আসছে, তা গণতন্ত্র কাকে বলে? 
-এ প্রশ্ন আমাকে কেন? ঐ যে ঘরের বউগুলো বেরিয়েছে পেরাম্বুলেটরে করে, বা ঐ যে ঘাসের উপর বসে আছে কলেজ ফেরত, প্রথম ভোটার, নতুন জোড়া, বা ঐ যে হাঁটতে বেরনো সুগার পেসেন্ট ভদ্রমহিলা, ওদের কে কেন জিজ্ঞেস করছেন না? 
-ওদের সবাইকে জিজ্ঞেস করা হয়ে গেছে। 
-তা যারা যারা বলতে পেরেছে তাদের নিশ্চয়ই এডিট করে দিয়েছেন।  
-না না তা কেন। তা হলে তো মার খেতে হবে। 
-আর না হলে কি আপনার চ্যানেল চলবে?  
-চলবে দাদা চলবে। সত্যের জয়। বুঝলেন। এখন একই প্রশ্ন আপনাকেও। 
-ক্যামেরাটা কি চলছে নাকি এমনি আমার দিকে ফিরিয়ে রেখেছেন? 
-চলছে দাদা চলছে।     
-কি যেন প্রশ্নটা ছিল?    

-গণতন্ত্র কাকে বলে? 
-(কিছুক্ষণ থেমে) গণতন্ত্র, আমার পাশের বাড়ি থাকতো। এখন অবশ্য নেই, মারা গেছে অনেক দিন।  
-সে কি ইয়ার্কি করছেন?  
-ইয়ার্কি করবো এই সকাল সকাল কি কারণে। সত্যি কথা বলছিলাম তা আপনার ঘটে যদি কিছু থাকে তো বুঝতে পারবেন, না হলে গোটা জীবন সব জান্তা গামছা ওয়ালা টাইপের হয়েই নিজের পিঠ চাপড়াবেন। গণতন্ত্রেরও জন্ম মৃত্যু হয় জানেন না। ও দেখছি হোম ওয়ার্ক করে আসেননি। বা হয়তো ভেবেছিলেন জগতের সবাই বোকা __ আর আপনারাই একমাত্র চালাক __। তাই না?  
-না না তা কেন আমরাও বোকা __ হতে পারি। তা দেখি কি ব্যাখ্যা আছে আপনার। 
-আরে গণতন্ত্র মণ্ডল, আমার পাশের বাড়িতেই থাকতো। বেচারা সিধা সাধা মানুষ ছিল। ভালোই বলতে গেলে। বেঘোরে মারা গেল।   
-কেন আর কিভাবে?   
-কেন আবার, তার পাশেই তো থাকতো কমরেড বিশ্বাস। তার সাথেই দিন নেই রাত নেই সর্বক্ষণ খিটিমিটি ঝগড়া ঝাটি ঝামেলা। এই তোমার বাড়ির গাছের পাতা আমার ঘরে পড়ে কেন। এই আমার ঘরের গাছের আম তোমার ঘরে গেল কেন। এই তোমার বেড়ার ফুটো দিয়ে আমার ঘরে ছাগল এলো কেন? এই সব রাত দিন আর কি। কত আর ভালো লাগে। আমার ঘরের বৌ পর্যন্ত শুনে শুনে বিরক্ত। বুঝলে। এই যাঃ আবার তুমি বলে ফেলেছি, এডিট করে নিও। 
-ও কিছু না, কিন্তু তারপর কি হল? 
-কি আর হবে, একদিন ঐ গণতন্ত্র মণ্ডলের বৌ কে নিয়ে কমরেড বিশ্বাস পালাল।    
-অ্যাঁ সে কি। আর কমরেড বিশ্বাসের বৌ। 
-সে তো বিয়েই করেনি, ফুল টাইমার। আসলে কি জানো, বউটাও বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল। অতগুলো লেড়ি লেড়ি বাচ্চা। 
-কার?    
-কার আবার গণতন্ত্র মণ্ডলের। সবকটাই একটু আধটু অ্যাবনরমাল। এখন কি যেন বলে চ্যালেঞ্জড। গণ্ডে পিণ্ডে প্রতি বছর যদি একটি করে ঐ বাচ্চা হয় তবে ভাবুন একবার। কোনোটি ডান দিকে তাকিয়ে থাকে তো ডান দিকেই তাকিয়ে থাকে। কোনোটি বাঁ দিকে তো বাঁ দিকেই। কোনোটি হাসছে তো হেসেই যাচ্ছে, কোনোটি কেঁদেই যাচ্ছে। কোনোটি হেগে হেগে গঙ্গা। সে এক বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। অন্যদিকে কমরেড বিশ্বাস কে দেখুন, ছিমছাম সুন্দর। বয়স যে তার কত? তার কোনো গাছ পাথর নেই বটে তবে বোঝার উপায় নেই।  
-কমরেড একা থাকতো?   
-না না তার ঘরেও অনেক লোক ভাই বোন মা বাপ, ভায়ের ছেলে পিলে, বোনের জামাই, করেনা কামাই। ছিল অনেক, সবকটি একে একে ঐ কমরেডের নিয়ম কানুনের ঠেলায় পালিয়েছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে একবার কমিউনিস্ট ইন্টার ন্যাশানাল, না হলে কোনো বড় কমরেডের ভাষণ শোনো। তারপর লাইন দিয়ে হাগতে যাও। সেখান থেকে এসে সকালের মর্নিং ওয়াক। সেখান থেকে এসে আবার লাইন লাগাও ফিকা চা আর মেরি বিস্কুটে। যেখানেই যাবে লাইনে লাইনে। তারপর যে যার কাজে। দুপুরে ডাল ভাত আর একটা ঝোল-তরকারি। সন্ধ্যে বেলায় ফিরে এসে আবার এক কাপ ঐ ঘোড়ার মুতের মত চা আর সাথে কোনো একটা গণসংগীত। সেই ডি ডি ওয়ানের রেকর্ডিং গুলো এখনও সিডি করে রেখে দিয়েছে। এখন তো আবার নেট থেকে খুঁজে খুঁজে বার করে চালায়। তা এই গেল সন্ধ্যা। তারপর আবার রাত ন’টার সময়  সবাই একসাথে জড় হয়ে সারাদিনের কি খরচ পাতি হল তার হিসাব নিকাশ। আর তার ভাগ বাটোয়ারা। কোনো সারপ্লাস যেন না থাকে। তা এই ভাবে বলুন তো কত দিন আর চলে। প্রথম প্রথম সবাই বেশ মন দিয়েছিল। কিন্তু দিন যত যায় সমাজে ঘুণ পোকা ধরে, পুরানো মালে পচন ধরে, সে ঘরেও তাই হল। সবাই বোঝালাম তুমিও এবার নিজেকে একটু আপ-টু-ডেট কর। তা কে আর কার কথা শোনে। আর বলুন তো যে ছেলেটা ঐ ঘর থেকে একটু পড়াশুনো করে অফিসার র‍্যাঙ্কে ভালো চাকরি পেয়েছে সে কেন আর বৌ নিয়ে লেড়ো বিস্কুট দিয়ে ফিকা চা খাবে। তার আবার যদি বউয়ের পেটে মেয়ে হয় তবে তো বলার কথাই নেই। তাই একে একে সবাই সরে পড়লো। এর জন্য শুধু রেখে গেল পাশের ঘরের সাথে কারণে অকারণে ঝগড়া করার মানসিকতা।       

 

-তা এই যখন অবস্থা গণতন্ত্র মণ্ডল তাকে কিছু হেল্প করেনি?
-
না সে করেনি, তবে তার বৌ, ফতেমা মণ্ডল করেছিল।  
-কি গণতন্ত্র মণ্ডলের বৌয়ের নাম ফতেমা মণ্ডল?  
-আইজ্ঞা হ। তার বৌয়ের নাম ফতেমা মণ্ডল। 
-তার ঘরের কোনো তেমন নিয়ম ছিল না?  
-নিয়ম, গণতন্ত্র মণ্ডলের বাড়িতে! একটিই নিয়ম যার যা খুশি কর। সকালে হয়তো রান্না হল, যে ছেলেটি খেতে এলো সে একটির জায়গায় তিনটি কি চারটি ডিম খেয়ে চলে গেল। তারপরে যে এলো সে দুটো খেয়ে গেল, তারপরের জন শুরু করলো চেঁচানি। অ্যাঁ, আমার ডিম নাই অ্যাঁ, আমি কি দিয়ে ভাত খাবো। সকালের অবশ্য টিফিন ফিপিন নাই ঐ ভাত সকাল এগারোটা নাগাদ। তারপর আবার যখন খিদে পাবে তখন দুটি রান্না চড়ানো যাবে। 
-সেই বাচ্চাগুলো স্কুলে যেত না? 
-হ্যাঁ যেত, সরকারি এত ভালো স্কুল আছে যাবে না। তার মধ্যে এক দুটো খুব ভালো রেজাল্টও করতো। এখন ভালো অবস্থা। অবশ্য বাকিগুলো ---         

-তারপর ফতেমা মণ্ডলের কি হল?    
-
ও হ্যাঁ, সেটাই তো আসল কথা তাই না। ফতেমার কথা না বললে তো তোমার কথার রসই থাকে না। অমন ডবকা  চেহারা। অমন বড় বড়  উপর নিচ। তা তার কথাই যদি না বলি তো চলে কি ভাবে? খাটুনে মহিলা ছিল, চালের বস্তা কাঁখে করেই ঘরে ঢোকাতে পারতো। দাপিয়ে কাজ যাকে বলে। সেই ভোর থেকে উঠে রাতে ঘুমানো পর্যন্ত। ঘুমালে অবশ্য মড়া। তখন রোগা পেকাটি গণতন্ত্র কি পারে তাকে সোহাগ দিতে। সেই হয়তো মাঝেমধ্যে টেনে গায়ের উপর শোয়াত। কোনো এক কালে হয়তো ভুল বসতো সে উঠে থাকবে গণতন্ত্রের গায়ে। আর সেদিন দেখে কে, সেই যে শ্বাস কষ্ট শুরু হল, গণতন্ত্র যেন যায় যায়। লোকে বলে কি হল কি হল। আমি দেখছি একমাত্র কমরেড দাঁড়িয়ে আছে আর মুচকি মুচকি হেসে যাচ্ছে। সে দেখতো নাকি ফুচি মেরে কে জানে। যাইহোক, এমনই চলছিল সেখানে, একে একে কমরেডের ঘর খালি হচ্ছিল আর একে একে গণতন্ত্রের ঘরে বাচ্চা। তা এমনই এক দিন, একদিন ভোর বেলা তখনও আলো ফোটেনি। ফতেমা হয়তো ফুল তুলতে বেরিয়ে থাকবে, সবাই কিন্তু বলে সে মাঠে গেছিল। যদিও তা মানা যায়না। কেননা তাদের ঘরে তো পায়খানা  আছে। তাকে নাকি ভুতে ধরলো। রাত দুপুরে মহিলারা যদি মাঠে যায় তখনই নাকি বাতাস লাগে। মহিলাদের গায়ের গন্ধে তা ঘরে চলে আছে। অবশ্য সে মাঠের মাঝে অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিল। কমরেড দেখতে পায়। তুলে আনে। মুখে চোখে জল  দেয় গণতন্ত্র। কিন্তু সে ঠিক আর স্বাভাবিক হয়নি। চুপ করে জানালা দিয়ে তাকিয়ে বসে থাকতো। না কোনও কথা না কোনও শব্দ উচ্চারণ। শুধু জানালার দিকে তাকিয়ে বসে থাকা। খাওয়া নেই ঘুম নেই, স্নান নেই কাজ নেই। ছেলে মেয়েদের খবর নেই। একেই কি ভুতে ধরা বলে নাকি? কেজানে বলে হয়তো। তবে যে যাই বলুক না কেন আমি বিশ্বাস করতে পারিনি। এভাবেও কেউ শুকিয়ে শুকিয়ে মারা যেতে পারে। আমি তো অনেক দূর কমরেড তো কোনও দিন এসব মানেইনি। ফতেমার নিজের মেয়েকে নিয়ে, তার ভায়ের বউকে দিয়ে সে ফতেমা কে ধরে বেঁধে বুঝিয়ে সুজিয়ে স্নানে পাঠাতো। ফতেমা যখন স্নান সেরে ফিরে আসতো তাকে দেখাতো স্বয়ম্বরা। সে যেন প্রথম বার এভাবে কোনও পুরুষের সামনে এসেছে। অথচ গণতন্ত্রের কোনও হেলদোল নেই। সে যেন একেবারে নিশ্চুপ। তবে আর যাই হোক সেই যে সেই তাদের ঘরের মাঝের দেওয়াল। সেই যে গাছের পাতা নিয়ে ঝগড়া ঝাটি। সেই যে কলহ প্রিয়তা। তা যেন একেবারে উবে  গেল মাঝ থেকে। শ্রান্ত হয়ে গেল সব বুঝলে, অস্বাভাবিক রকম শ্রান্ত।  

 

-তারপর কি হল? ফতেমা কি ঠিক হল? 
-সে কি আর ঠিক হওয়ার মতো ছিল বলে মনে হয় আপনার। কিছুদিন পরে কেউ একজন দেখতে পেল ফতেমা চলে যাচ্ছে ঠিক সেই মাঠ ধরে। পাশে কমরেড বিশ্বাস। আর দূরে দাঁড়িয়ে দেখে যাচ্ছে একমনে গণতন্ত্র। গণতন্ত্র তাদের চলে যেতে দেখে ছিল। কিছু বলেনি। তাদের চলে যাওয়ার পরেও সপ্তাহ-খানেক গণতন্ত্রকে দেখা যায় খ্যাপার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে এদিক ওদিক। তারপর সেও কোথায় যেন গায়েব হয়ে যায়। আর আট কি দশ মাস পরে সেই হারিয়ে যাওয়া গণতন্ত্রের লাশ খুঁজে পাওয়া যায় ঠিক যেখানে ফতেমাকে পাওয়া গেছিল। প্রথমে তো কেউ দেখে চিনতেই পারেনি। পরে বুঝতে পারে আধ ন্যাংটো এই ভিখারিই আমাদের গণতন্ত্র মণ্ডল। 

কি কি ভাবছেন, মরাল অফ দি স্টোরি? 

 

-হ্যাঁ, তাই ভাবছিলাম, কিন্তু আপনিই বলে দিন।
-গণতন্ত্র ওদের চলে যেতে সত্যিই দেখে ছিল। তারা হাত ধরে চলে যাচ্ছে। রয়ে যাচ্ছে সে একা। একজন নীতি বিবশ আর একজন শ্রান্ত উদার, যখন একসাথে হেঁটে যায়, তখন পিছনে যা পড়ে থাকে তাই হয়তো গণতন্ত্র। চলে যাচ্ছে তারা সেই মাঠের মাঝ দিয়ে, এক ধোঁয়ার মধ্যে। ওদিকে যা শুয়ে থাকছে তা এক দিক-হীন রাস্তা।  

 

সুকান্ত দেবনাথ 
দুর্গাপুর, ভারত



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top