সিডনী সোমবার, ৬ই মে ২০২৪, ২২শে বৈশাখ ১৪৩১

গজারের ডানা : লিপি নাসরিন


প্রকাশিত:
২ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২২:০৯

আপডেট:
৬ মে ২০২৪ ০৩:৩১

 

গত কয়েকদিন ধরে প্রচণ্ড বৃষ্টিতে খাল বিল উপচে পানি ইটের খোয়া বিছানো রাস্তা ডিঙিয়ে বাড়ির উঠোন ছোঁয় ছোঁয় ভাব । রোদের দেখা নেই। বাড়ন্ত লতাগুল্ম চারিদিকে। মুন্সীকান্দি গ্রামটা খুব বেশি বড় না। সবাই সবার আপনজন হয়ে বসবাস করছে।।

সকালের দিকে একটু ধরণ থাকার পর বিকেল থেকেই আবার টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হয়েছে। রাহেলা বাবার পাশে বসে ছিলো। বয়স কতো হবে- এই পনের কী ষোল। দারুণ ডানপিটে স্বভাবের অবশ্য সেজন্য রমিজ মিয়াকে সবসময় দোষ দিয়ে থাকে আকলিমা। মেয়ের এই দস্যিপনার জন্য নাকি সেই দায়ী। রমিজ মিয়া সে কথা শুনে আকলিমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতো, কইরে মা, খারা নে আয়, মাছ ধরতে যাবি না? রাহেলা শোনা মাত্র বইখাতা গুছিয়ে আসতিছি  আব্বা, বলেই রান্নাঘরে ঢুকতো। আকলিমার চোখ রাঙানিকে অগ্রাহ্য করে রাহেলা বাবার সঙ্গে  বিলে যেতো বিশেষ করে ভরা বর্ষায় এবং তারপর খাল বিল শুকনা না হওয়া পর্যন্ত। কী সকাল কী সন্ধ্যা রমিজ  মিয়া মেয়েকে নিয়ে আর জাল নিয়ে মাছ ধরতে যেতো। সন্ধ্যা হয়ে গেলে রাহেলা ছোট্ট নরম হাতে তিন ব্যাটারির টর্চটা ধরে থাকতো, কখনো বাবার নির্দেশ মেনে বিলের পানিতে আলো ফেলতো যাতে মাছ কিনারে চলে আসে। এভাবে কোনদিন খারা ভরে মাছ নিয়ে রমিজ মিয়া বাড়ি ফিরতো, কোনদিন হয়তো খারার নিচে দুই চারটে মাছ পড়ে থাকতো। বাবার সাথে এভাবে ছোটবেলা থেকে খালে-বিলে ঘুরতে ঘুরতে রাহেলা জাল ফেলে মাছ ধরতে শিখে যায়। রমিজ মিয়াও মেয়ের হাতে জাল দিয়ে বিলের পাড়ে বসে থাকতো। মেয়েকে জাল ফেলার কৌশল ভালো করে শিখিয়ে দিতো। মাছ উঠলে খুশিতে রজিম মিয়ার চোখ বড় বড় হয়ে যেতো।

আকলিমার মেয়ে নিয়ে এইভাবে বিলে-খালে মাছ ধরতে যাওয়াটা  মোটেই পছন্দ ছিলো না। -এখন তো তুমি আলীমরে নিয়া যাইতে পারো বিলে, আকলিমা ভাত বাড়তে বাড়তে স্বামীকে বলে। ছোট ছেলেটার বয়স যখন সাত বা আট তখন আকলিমা স্বামীকে বলতো ছেলেকে সাথে করে নিয়ে যেতে কিন্তু রমিজ মিয়া বলতো, পোলা মানুষ এমনি মাছ ধরা শিখবো, সাথে নেওয়া লাগবো না। আকলিমার রাগ বাড়তো তাতে। রমিজ মিয়া স্ত্রীকে রাগাতে পারলেই যেন আনন্দ এমন একটা ভাব। আর রাহেলারও মাছ ভাগ্য বলতে হবে। ও জাল ফেললেই যেন মাছেরা অদৃশ্য থেকে ভেসে আসে।রমিজ মিয়া তাই আজকাল নিজে বসে থেকে মেয়েকে জাল বাইতে বলে।

- রাহেলা এখন বড় হইছে।ওরে আর তোমার পিছ পিছ বিলে-খালে নিয়া যাইয়ো না। আকলিমা  রমিজ মিয়ার গায়ে কাঁথাটা বিছিয়ে দেয়।

-কেন কী হইলো আবার? রমিজ মিয়া পা দু'টো লম্বা করে কাঁথা ঠিক করে নেয়।

- মাইয়া সন্তান বিয়া দিতে হইবো না

- তা তো হইবো।সময় হলেই দিতে হইবো।

-ষোল বছরে পড়লো রাহেলা। এইভাবে খালে- বিলে মাছ ধইরা বেড়াইলে মাইয়ারে বিয়া দিতে পারবা?

-কী কও তুমি? আমার মাইয়ার বিয়া হইবো না!

- হইবো না তাতো কই নাই।

আচ্ছা হইছে এখন ঘুমাও। পরের চিন্তা পরে করা যাইবো।

আকলিমা উঠে পাশের ঘরে যায়। রাহেলা আলীম তখনো ঘুমায়নি। ভাইবোন বসে লুডো খেলছে। আকলিমা গিয়ে বসে রাহেলার পাশে। মাথায় হাত দিয়ে বলে,

-মারে তুই আর তোর আব্বার পিছ পিছ বিলে যাস না মাছ ধরতে। এখন থেকে আলীম যাইবো। বড় হইছোস,পরের বাড়ি যাইতে হইবো না

রাহেলা লুডুর চালটা দিয়ে মায়ের দিকে না তাকিয়েই বলে,

-আচ্ছা যাবো না তবে আমি কিন্তু ম্যাট্রিক পাশ কইরা কলেজে পড়বো।

-আমরা গরীব মানুষ।কলেজে পড়তে মেলা টাকা লাগেরে মা। রাহেলা খেলা বন্ধ করে মায়ের দিকে তাকায়।

রাত বাড়ে, বৃষ্টির বেগও বাড়ে। চারিদিকে কেবল বৃষ্টির শব্দ। সবার মনে একটা চাপা আতঙ্ক বিরাজ করছে। এই বৃষ্টি কতোদিন স্থায়ী  হবে কে জানে। বর্ষাকালে এই গ্রামের পুরুষ মানুষগুলো খালে-বিলে টইটুম্বর পানিতে মাছ ধরে দিন পার করে। সন্ধ্যার পর তারা ঘুমিয়ে পড়ে। প্রায় পুরো বর্ষাকাল বিলে ধান লাগানোর পর এভাবেই তাদের সময় কাটে। পুরুষরা আবার মোড়ের দোকান বা কারো বাড়িতে তাস খেলার আড্ডায় মেতে ওঠে। নারীরা দুপুরের পর বাকি সময়টুকু কাঁথা সেলাই করে কাটায়। অবিবাহিত মেয়েরা ফ্রেমে বেঁধে রুমালে বা টেবিল ক্লথে ফুল পাখিতে সুতার কাজ করে।

আকলিমা নিজের ঘরে ফিরে দেখে রমিজ মিয়ার নাক ডাকছে।

বৃষ্টি একটু কমে আবার বাড়ে। রাহেলা আর আলীম লুডুর শেষ চালটা খেলে নিয়ে ঘুমের প্রস্তুতি নেয়। খোপের মধ্যে পায়রাগুলো নড়েচড়ে উঠে।

-বুবু পায়রা ডাকে কেন? খোপের মধ্যে সাপ ওঠে নাই তো?

-চলতো গিয়া দেখে আসি, রাহেলা প্রায় নিভিয়ে ফেলা হারিকেনটার বাতি উঠিয়ে নেয়, হাতে নিয়ে বাইরে আসে। হারিকেন উঁচু করে ধরে দুই ভাইবোন পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে দেখে নেয়।

-এমনি ডাকতাছে, চল ঘরে যাই।

আকলিমা ছেলে-মেয়ের বাইরে বের হবার শব্দ পেয়ে ঘর থেকে চেঁচিয়ে উঠে

- রাহেলা বাইরে কী করতাছোস ? ঘরে গিয়া ঘুমা।

যাইতেছি মা বলে, রাহেলা ভাইকে নিয়ে ঘরের দরজা লাগায়। দুই ভাই-বোন নিজ নিজ তক্তপোষের বিছানায় শুয়ে পড়ে।

কিছুসময় পর রাহেলা আলীমকে  বলে

-আলীম ঘুমাইছোস?

-ঘুম পাইতাছে বুবু

-তোর খালি ঘুম পায়, দুপুরেও তুই ঘুমাইস।

শোন না ভাই আমার একটা খুব ইচ্ছে করে

আলীম ঘুম ঘুম চোখে বলে কী ইচ্ছে বুবু?

- একদিন চান্নি রাতে বিলে তুই আর আমি মাছ ধরতে যাবো। যাবি?

- মা কোনদিন যাইতে দিবো না বুবু

- মা জানতেই পারবো না। আব্বাকে বলে তুই আর আমি যাবো। তারপর যখন একটা বিরাট বড় মাছ ধরে এনে মায়ের সামনে রাখবো মা খুব খুশি হবে।

রাহেলার কথা শেষ না হতেই আলীম ঘুমিয়ে পড়ে। রাহেলা ডাকে, আলীম এই আলীম...

বৃষ্টির বেগের সাথে সাথে রাহেলার কল্পনা অন্ধকারকে পিছনে ফেলে ছুটে চলে লক্ষীদাঁড়ি বিলের পানিতে। পানিতে টর্চের আলো, জাল ফেলার ঝপাৎ ঝপাৎ শব্দ রাহেলা শুনতে পায়। পরক্ষণেই বড় একটা মাছসহ জাল টেনে তোলার দৃশ্যটি অন্ধকারের মধ্যেও তার চোখের সামনে ভাসতে ভাসতে থাকে। ছোট নৌকা নিয়ে একদম বিলের মাঝখানে চলে যাচ্ছে সে। মাথার উপর চাঁদের আলো, নীচে পানিতে নৌকা দুলছে, সে দোলায় রাহেলা ভাসতে ভাসতে ঘুমিয়ে পড়ে।

সকালে আকলিমার ডাকাডাকিতে রাহেলার ঘুম ভাঙে। সারারাত বৃষ্টিতে পানি খাল- বিল ভেঙে পায়ে হাঁটা রাস্তায় ঢুকে পড়েছে। রাহেলা ঘুম জড়ানো চোখে ওড়নাটা বুকে পেঁচিয়ে দৌড়ে রাস্তায় গিয়ে মানুষের ভিড়ে গিয়ে দাঁড়ায়। পা দিয়ে পানি কাটে, তার কেমন যেন ভালো লাগে এই পানি দেখতে। সবাই চেষ্টা করছে এই পানি আর যাতে বাড়ির উঠানে না ঢুকতে পারে সেই উপায় বের করতে। রাহেলা কিছুক্ষণ পানিতে পা ডুবিয়ে বাড়ি ফিরে আসে।

গ্রামে এই সময়টা পানিবাহিত রোগের খুব প্রকোপ দেখা যায়। জেলা শহরে যেতে নদী পার হতে হয়, তার আগেই অনেক রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে যায়।গতবার ছালাম মিয়ার পাঁচ বছরের ছেলেটা কলেরায় প্রায় যায়যায় অবস্থা। তারও আগের বছর পশ্চিম পাড়ার মুকুন্দ ঠাকুরের বৃদ্ধা মা আর ফিরলেন না। গ্রামের মানুষের স্বাস্থ্য সেবার একমাত্র অবলম্বন অমল ডাক্তার। সাইকেল চড়ে চড়ে এই মানুষটি এই গ্রামসহ আশেপাশের আরো দুই একটি গ্রামে ঘুরে বেড়ায়। হাতযশ ভালোই তার। তার কালো ডিসপেনসারি ব্যাগটা সাইকেলের হ্যান্ডেলে ঝোলে, ওটাকে খুব রহস্যময় মনে হয় রাহেলার কাছে। একদিন আকলিমা অসুস্থ হলে রাহেলাদের বাড়িতে  অমল ডাক্তার এলো তাঁর সেই রহস্যময় কালো ব্যাগটা নিয়ে। রাহেলা দৌড়ে গিয়ে অমল ডাক্তারের হাত থেকে ব্যাগটি নিয়ে বাড়ির ভিতরে আনলো। অমল ডাক্তার যখন ছোট ছোট কাঁচের শিশি থেকে ঔষধ ঢালছিল রাহেলা তখন ব্যাগের ভিতরটা কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে দেখেছিল। থরে থরে সাজানো ছোট ছোট কাঁচের শিশি। কোনটার মধ্যে পানির মতো, কোনটার মধ্যে সাদা ছোট গোল বড়ি। এসব রাহেলার কাছে সেই বোঝার বয়স থেকেই খুব বিস্ময়কর জিনিস। রাহেলা ভাবে তারও একটা ওরকম ব্যাগ থাকবে। সেও বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষের চিকিৎসা করবে। এখন সে বুঝতে শিখেছে ব্যাপারটা খুব সহজ নয়। এখন সে নবম শ্রেণীতে পড়ে। তারপর আরো অনেক লেখাপড়া করে ডাক্তার হতে হয়। কিন্তু তার আব্বা কি পারবে? ডাক্তার হবার স্বপ্ন এই সময়টাতে এসে আরো বেশি তাকে পেয়ে বসে যখন দেখে কলেরা,জন্ডিসে গ্রামের মানুষ কতো অসহায় ।

- মা আইজ আমি স্কুলে যাবো। ভাত দেও।

-চারিদিক পানিতে ডুবে আছে। এখন স্কুলে যাওয়া লাগবো না। ঘরের কামে হাত লাগা মা।

-না, আইজ আমি স্কুলে যাবোই। দুদিন যাইনি। আজ রূপা, মিনা সবাই যাবে। আমিও যাবো

আকলিমা দেখলো এই মেয়েকে বলে কোন লাভ নেই। বড় চিন্তা মেয়েকে নিয়ে তার। এ বয়সে রাহেলা তার কোলে ছিলো, সংসার করেছে, শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা যত্ন করেছে। আকলিমা মেয়ের বিয়ের কথা আবারও  স্বামীর কাছে বলে সকালে পান্তা খেতে খেতে।

- আমিতো ভুইলা গেছি তোমারে বলতে রাহেলার বিয়ের একটা সমন্ধ আইছে।

- ওমা, মেয়ের বিয়ের সম্বন্ধ আইছে আর আমারে বলতে ভুইলা  গেছো। যেমন বাপ তেমন তার মাইয়া! তা ছেলে কোন গ্রামের?

-তুমি চিনবা না। উত্তরপাড়ার আবুল ম্যার কুটুমের ছেলে।

- তা বাড়ির অবস্থা কেমন? ছেলের শিক্ষা কী?

-অতো কিছু জিগাই নাই। হাটে দেখা হলো, কইছি বর্ষা কাল যাক তারপর দেখবানি।

- একটু খবর নিতা ছেলের। এরপর দেখা পাইলে খোঁজ খবর ভালো কইরে নিও।

-রাহেলা পড়তে চায় আর দু'এক ক্লাস পাশ দিক তারপর দেখবানি।

- শোন ভালো ছেলে সবসময় পাওয়া যায় না। ভালো সম্বন্ধ হলি আর দেরি করোন যাইবো না। রাহেলার বয়স ষোল বছর হলো। আর মাইয়ারে খালে- বিলে সাথে নিবা না। সেয়ানা হইছে। শেষে কিন্তু মাইয়া বিয়া দিতে পারবা না।

রমিজ মিয়া আকলিমার এই কথার কোন উত্তর দেয়ার আগেই  উঠোনে কার যেন ডাকাডাকির আওয়াজ শোনা যায়।

রমিজ মিয়া হাত ধুয়ে রান্নাঘর থেকে বাইরে আসে।

বর্ষা শেষ হয়ে আসে। ধীরে ধীরে পানি নেমে খাল- বিলে গিয়ে জমা হয়, রোদে শুকায়। মানুষ আবার প্রয়োজনে নদী পার হয়ে জেলা সদরে যায়, এ গ্রামের মানুষ  সে গ্রাম, সে গ্রামের মানুষ এ গ্রামে আসে। বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়ে রাহেলা দশম শ্রেণীতে ওঠে। পড়াশুনায় রাহেলা প্রথম থেকেই ভালো। স্কুলের শিক্ষকরা তাকে বেশ স্নেহ করেন। সময়ের চাকায় পিষে যাওয়া কথাগুলো আবার জাগতে থাকে। রাহেলার বিয়ে নিয়ে এবার জোরেসোরে আকলিমা স্বামী কে তাগিদ দেয়। উত্তরপাড়ার আবুল মিয়ার সাথে কথা চলতে থাকে। একদিন ছেলে পক্ষ রাহেলাকে এসে দেখে যায়। মেয়ে তাঁদের পছন্দ হয়। কিন্তু রমিজ মিয়া চাচ্ছে মেয়ের ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষ হলে বিয়ে হবে, পাত্রপক্ষ দেরি করতে চায়না। আকলিমারও ইচ্ছে বিয়ে হয়ে যাক তারপর ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর মেয়ে শ্বশুর বাড়ি যাবে। এই দোটানার মধ্যে শেষমেশ রাহেলা নারাজি সত্ত্বেও বিয়ের দিন ধার্য হয়ে যায়।ছেলেদের অবস্থা ভালো, লেখাপড়াও জানে।

বিয়ের দিন ঠিক হবার পর থেকেই রাহেলা মনমরা হয়ে থাকে। মায়ের উপর তার রাগ বেশি। রমিজ মিয়া মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে অভিমান ভাঙানোর চেষ্টা করে কিন্তু কোন কাজ হয়না। ভাইয়ের সাথে তার কথাবার্তা হয়। রাগ করে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করেছে। ঘর থেকে তেমন বাইরে আসে না। বিয়ের আর বেশি দেরি নেই। রমিজ মিয়া তার সাধ্য অনুযায়ি আয়োজনে ব্যস্ত থাকে, আকলিমা ঘরদোর গোছানো কাছে লেগে পড়ে।

ভরা পূর্ণিমার আগের দিন সন্ধ্যায় রমিজ মিয়া গাব দেওয়া জাল উঠোন থেকে তুলে বারান্দায় বসেছে কেবল। এমন সময় রাহেলা এসে বাবার পাশে বসে।

- কিছু কবি মা

রাহেলা মাথা নাড়ে, রমিজ মিয়া মেয়ের মাথায় হাত রাখে।

-আমি কাল রাতে পূর্ণিমায় লক্ষ্মীদাঁড়ির বিলে জাল ফালাইতে যাইতে চাই আব্বা।

- কী কস মা?

-তুমি না করবা না বলো

-তোর মা...

- মাকে জানান  যাইবো  না। আমি আর আলীম যাবো। রমিজ মিয়া চিন্তায় পড়ে যায়।

- বলো আব্বা আমারে যাইতে দিবা। আর তো কখনো যাইতে পারবো না আব্বা।

রমিজ মিয়ার চোখ ভিজে যায় । মেয়ে তার সত্যি পর হয়ে যাচ্ছে। রমিজ মিয়া কোন কথা বলে না।বারান্দায় উঁকি দিয়ে আকাশ ফুঁড়ে উঠে আসা চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকে। জ্যোৎস্নায় ঘর - উঠোন সব কেমন অচেনা লাগে তার কাছে। রাহেলা উঠে ঘরে যায়।

রাহেলা আলীমকে রাজি করানোর চেষ্টা করে।

-কিন্তু বুবু মা যদি জানতে পারে?

- জানবে না। আব্বারে রাজি করাইছি। মা ঘুমাইয়া  পড়লে জাল নিয়ে তুই আর আমি বেরবো। আলীম তবু ভয়ে থাকে। মাকে তার খুব ভয়। বলে, 

- বুবু তোমার বিয়া আর ক'দিন পর, না গেলে হয়না?

- ঠিক আছে তোরে যাইতে হবে না। আমি একাই যাবো ।

আলীম চুপ করে বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

গ্রামের মধ্যে সন্ধ্যায় রাত নেমে আসে। অনেক বাড়িতে সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। কোন কোন বাড়িতে হয়তো ছেলে-মেয়েরা লেখাপড়া করে কিছুক্ষণ।

তবে চাঁদনি রাতে একটু দেরিতে শোয়। বাড়ির এক চিলতে উঠোনে হয়তো বউ-ঝিরা হেঁটে চাঁদ দেখে, কোলের বাচ্চাকে চাঁদমামার গান শোনায় তারপর একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। পঞ্চাশ বা যাট দশকের গ্রামগুলোতে মানুষের জীবনযাত্রার হালহকিকত এমনই ছিলো। ধান কাটা শেষ হলে মাঠে বসতো যাত্রাপালা। মানুষ ভেঙে পড়তো সেসব যাত্রা দেখতে। বাড়ির বউরাও স্বামী বা দেবরের সাথে সেসব যাত্রাপালা দেখতে যেতো শ্বশুর-শাশুড়িকে লুকিয়ে। টকি বায়োস্কোপ গ্রামের পথে পথে ঘুরে বেড়াতো। সেসব দিনে মানুষের বিনোদন বলতে  ছিলো এসব।

রাহেলা আর আলীম খুব আস্তে জাল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। রমিজ মিয়া ঘুমের ভান করে ছিলো। ওরা কিছু দূর যেতেই রমিজ মিয়া আকলিমা ডাকে

- আমি একটু বাইরে যাইতাছি। এখনি আইসা পড়বো। তুমি দরজাডা  লাগাইয়া ঘুমাও

এতো রাতে কই যাইবা? আকলিমার খাঁচা ঘুম ভাঙে

-আইসা কমুনে।

রমিজ মিয়া বেরিয়ে ওদের পিছু ধরতে থাকে।চাঁদ যেন আজ নিজেকে সম্পূর্ণ খুলে দিয়েছে পৃথিবীর কাছে। উতলা পৃথিবী পূর্ণ গ্রাসে চুমুক দিচ্ছে সে পাত্রে। বনে জঙ্গলে আঁধারের লেশমাত্র নেই। রমিজ মিয়া এতো জোরে হেঁটেও ছেলে-মেয়ের নাগাল পাচ্ছে না। রাহেলা যেন বাতাসের সাথে হেঁটে চলেছে আর জ্যোৎস্না তার হাত -পায়ে ঠোঁকর খেয়ে পাশ কেটে কেটে বেরিয়ে যাচ্ছে। ওরা বিলের পারে এসে থামে। দূরে দুই একজনের অস্পষ্ট কথা শোনা যায়।

-বুবু আরো লোকে মাছ ধরতাছে মনে হয়

- হ, তুই বেশি কথা কইস না, নৌকার বাঁধন খুলে ওরা দুজন উঠে পড়ে। আলীম আস্তে করে নৌকা বায়। ততক্ষণে রমিজ মিয়া বিলের পাড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। রাহেলা বেশ কবার জাল ফেলে। একটা বেশ  মাঝারি সাইজের কাতলা মাছ উঠলো। রাহেলা মাছ ছাড়িয়ে নৌকার মধ্যে রাখে।

- আরেকটু সামনে চল বলতেই রাহেলার নজর যায় পানির দিকে। অগভীর পানির নিচে সাদা কী যেন চকচক করে উঠে। রাহেলা সাথে সাথে তীব্র গতিতে জাল ছুঁড়ে দড়ি ছেড়ে দেয়। আলীম নৌকা বেয়ে আর একটু সরে আসতেই রাহেলা ধীরে ধীরে জাল টানতে শুরু করে। জাল টেনে উপরে তুলতেই রাহেলা  কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিশাল গজার মাছটা তার পেটে গুতো দিয়ে জাল কেটে বিলের পানিতে অদৃশ্য হয়ে যায়। রাহেলা বাবাগো বলে পেট চেপে ধরে নৌকায় লুটিয়ে পড়ে। রাহেলার রক্তে ভেসে যায় লক্ষ্মীদাঁড়ি বিলের জ্যোৎস্না।

- বুবু কী হইলো তোমার, বলে আলীম বৈঠা ফেলে রাহেলার কাছে আসে।

রাহেলার মুখ দিয়ে গোঙানির মতো আওয়াজ বের হয়। আলীম আব্বা বলে জোরে চিৎকার দিয়ে দ্রুত নৌকা বিলের পাড়ে দিকে আনতে থাকে। রমিজ মিয়া ছেলের চিৎকারে শুনতে পেয়ে বিচলিত হয়ে উঠে কিছু বুঝতে না পেরে।

নৌকা পাড়ে ভিড়তে ভিড়তে রক্তে ভিজে যায় রাহেলার শরীর।

-আব্বা ,বুবুরে কী মাছে যেন পেট ফুটো  করে দেছে। আলীম হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে থাকে। হতবিহ্বল রমিজ মিয়া, রাহেলা, মারে, বলে চিৎকার করতে করতে নৌকা থেকে রাহেলাকে নামিয়ে আনে।

-তোমরা কে কোথায় আছো, এদিকে আইসো, আমার মারে হাসপাতালে নিতে হইবো। বিলের মাছধরা  মানুষরা রমিজ মিয়ার চিৎকার শুনে এদিকে দৌড়ে আসতে থাকে।

রমিজ মিয়া গায়ের গামছা দিয়ে মেয়ের পেট বেঁধে দেয়। একজন বাড়ি থেকে দৌড়ে একটা বড় তক্তা নিয়ে আসে। তার উপর রাহেলাকে শুইয়ে দিয়ে তিন-চারজন মিলে অমল  ডাক্তারের বাড়ির দিকে নিয়ে চলে। রমিজ মিয়া কাঁদতে কাঁদতে মেয়ের পাশে পাশে চলে আর মারে মারে বলে ডাকতে থাকে। রাহেলার কোন সাড়াশব্দ নেই।আলীম মাকে নিয়ে অমল ডাক্তারের  বাড়ি আসে। উঠোনে মেয়েকে এই অবস্থায় দেখে চিৎকার দিয়ে রাহেলা অজ্ঞান হয়ে যায়। সেই পূর্ণিমার রাতে অমল ডাক্তারের বাড়ির উঠোনে গ্রামের অর্ধেকের ও বেশি মানুষ জড়ো হয়েছে । অমল ডাক্তার হ্যাচাক জ্বালিয়েছে উঠোনে। বাঁধন খুলে দেখলো পেটের নাড়ি কিছুটা বাইরে বেরিয়ে এসেছে।

- দিদি ভাই, দিদি ভাই, বলে রাহেলাকে ডাকলো অমল ডাক্তার 

রমিজ মিয়া মেয়ের মুখের উপর ঝুঁকে আছে। রাহেলা হ্যাচাকের উজ্জ্বল আলোয় একটু খানি বুঝি চোখ খুললো, ঠোঁট দুটো একটু ফাঁক হলো। রমিজ মিয়া জোরে কেঁদে ওঠে। রাহেলার দৃষ্টি তার বাবার চোখে তাকিয়ে স্থির হয়ে যায়।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top