সিডনী সোমবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১

তৈলমর্দন বা তেলবাজি : কাজী খাদিজা আক্তার


প্রকাশিত:
৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২০:৩৭

আপডেট:
২৯ এপ্রিল ২০২৪ ১১:২৪

 

"অতি পন্ডিত বড় মান্য লোক। পন্ডিত বা মান্য বলিয়া কি আমার অপেক্ষা তাঁহাদের ক্ষুধা বেশী? তা ত নয় - তেলা মাথায় তেল দেওয়া মনুষ্যজাতির রোগ - দারিদ্র্যের ক্ষুধা কেহ বুঝে না। যে খাইতে বলিলে বিরক্ত হয় তাহার জন্য ভোজের আয়োজন কর- আর যে ক্ষুধার জ্বালায় বিনা আহবানেই তোমার অন্ন খাইয়া ফেলে, চোর বলিয়া তাহার দন্ড কর- ছি!ছি! বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর "কমলাকান্তের দপ্তর" থেকে উল্লেখ্য  এই লাইনগুলো যেন বর্তমান বাস্তব চিত্রের এক নিঁখুত বয়ান। তেল মাথায় তেল দেওয়া আমাদের পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ, রাষ্ট্র পর্যন্ত বিরাজমান এক মহামারীর নাম। রাষ্ট্র পর্যন্তই লাগাম দিলাম, বিশ্বকে নিয়ে নাহয় নাই বললাম। বঙ্কিম কিন্তু একে রোগ বলেই সাব্যস্ত করেছেন। বঙ্কিম এর সময় পার হয়ে এ রোগ এখন মহামারি আকার ধারণ করেছে। 

 

তেল একটি স্নেহ জাতীয় পদার্থ। তাই তেল যত ঢালবেন সম্পর্কের স্বাস্থ্য ততই বৃদ্ধি পাবে। কর্মক্ষেত্রে আপনার পজিশন দিনের পর দিন উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছুবে। পরিবারে সবার সাথে আপনার সম্পর্ক থাকবে একদম ঝরঝরা। এতোকিছু পেয়ে আপনার জীবন হবে এক্কেবারে ফকফকা। আসলে এসত্য তেলবাজিদের অনেক আগ থেকেই জানা। একটু রসিকতা করে এই তেল ঢালার কর্মকান্ডকে আমরা তৈলমর্দনও বলতে পারি। কোথায় নেই এই তৈলমর্দন?  পরিবারের কথা যদি বলি তাহলে দেখবেন যার অবস্থান বা পজিশন ভালো তার সাথে বাকি সবার মাখামাখি, তেল মেখে গড়াগড়ি। আর সংসারের যে কলুর বলদ নামে কিছু মনুষ্য প্রাণী থাকে তাদের অবস্থা আবার অবস্থা কি? এরা ঐ তেল জাতীয় স্নেহ পদার্থ ছাড়াই মেদহীন সম্পর্ক বয়ে নিয়ে চলে সারাজীবন।

 

নিঁখুত তৈলমর্দনকারীর সমাজে কমতি নেই। হাইব্রিড জাতের মতো বৃদ্ধি পাচ্ছে এর ফলন। কিন্তু এনারা বোঝেননা এনাদের ভণ্ডামি, বিবেকহীন, পাষাণ, চাটুকারিতাকে নির্ণয় করার মানুষেরও অভাব নেই। বর্তমান সমাজে তেলবাজি যেন এক বাড়তি যোগ্যতা। হ্যা, এটা শুধু আমার কথা নয়, একথা বলে গেছেন শতবর্ষ আগে পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। তিনি বলেছেন, "বাস্তবিক তৈল সর্বশক্তিমান, যাহা বলের অসাধ্য, যাহা বিদ্যার অসাধ্য, যাহা ধনের অসাধ্য,যাহা কৌশলের অসাধ্য - তাহা কেবল তৈল দ্বারা সিদ্ধ হতে পারে"। শতবছর আগেই হরপ্রসাদ একে যোগ্যতা বলে বিবেচিত করে গেছেন। তবে তা নিশ্চয়ই সত্যিকারের যোগ্যতা নয়। সমসাময়িক সমাজচিত্র তাঁকে ভাবতে বাধ্য করেছিলো। যদিও তাঁর সময়কার সমাজচিত্র এখানে ফুটে উঠেছে তারপরও আমাদের বর্তমান সমাজচিত্রের কি অদ্ভুত যোগসূত্র। এই যোগসূত্রের কথা তিনি মারাত্মক ভাবে টের পেয়েছিলেন বলেই কি তিনি তাঁর তেল সম্পর্কিত এই লেখায় তেলবাজি শেখানোর জন্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কথা বলেছিলেন? তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে বর্তমান সমাজ এবং রাষ্ট্র এ মহামারীতে এমন ভাবে আক্রান্ত যে এনাদের কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন নেই, এনারা এ কর্মে এতোটাই পারদর্শী যে এনারা নিজেরাই এক একটি তেলবাজির শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। 

 

জ্যোতির্বিদ্যায় পারদর্শী এক বিদুষী নারী, কিংবদন্তী খনা বলে গিয়েছিলেন - "তেল মাথায় ঢালো তেল, শুকনো মাথায় ভাঙো বেল"। আদতে তাই হচ্ছে। খনার কথার মূল্য আছে। কথা দিয়ে হোক বস্তুগত জিনিস দিয়ে হোক আমরা কিন্তু তেল মাথায়ই তেল দিয়ে যাচ্ছি। শুকনো মাথায় বেল ভাঙি আর হাড়ি ভাঙি সেদিকে কজনা আর নজর রাখি। তৈলমর্দনকারী বড়ই নিষ্ঠুর। তিনি ভাবেননা তার এই চাটুকারিতায় অন্যকারোর ভাগ্য জলে ভেসে যায়। তা নাহলে কি চাকরির বাজারে সবার ভাগ্য কি সমান চমকায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে, তৈলমর্দন আর চাটুকারিতায় রাজনীতির দৌড় সবার আগে। এখানে সাধারণ চাটুকারিতার কোনো স্থান নেই। যে যত তৈলমর্দনে পারদর্শী তার স্থান তত উপরে। এবং ম্যাজিকের মতই সবকিছুর পরিবর্তন, উন্নতি । তেলবাজি ছাড়াও নিজের যোগ্যতা বলেও যে রাষ্ট্রের কর্মকান্ডে নিজেকে সামিল করা যায় আজকাল সে সময়টুকু পর্যন্ত কেউ কেউ নিতে রাজি নয়।তবে কষ্ট হয় যখন বুঝি শিল্পী গোষ্ঠীর মধ্যেও এ মহামারীর ভাইরাস মাঝে মধ্যেই আসাযাওয়া করে।  

 

চিকিৎসক এর কাছে গেলে তিনি বলবেন তেল স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, কম পরিমাণে খাবেন। অথচ এক শ্রেণির তেলবাজিরা যাকে দরকার তাকেই তৈলমর্দন করছে। চারিদিকে তেলের ছড়াছড়ি, কখনও তৈলাক্ত কথায় কখনও বা তৈলাক্ত বস্তুতে ছেয়ে যাচ্ছে সমাজ, রাষ্ট্র। অফিসের বসের কাছে, 'ইয়েস বস, ইয়েস বস'। পরিবারে যাকে প্রয়োজন তার কাছে, 'আমি আছি, আমি আছি'। রাজনীতিতে ,'জ্বি নেতা , জ্বি নেতা'। এভাবেই পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ধ্বংসের পথে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে আর আমরা সংখ্যা গরিষ্ঠ কলুর বলদরা চেয়ে চেয়ে দেখছি।    

 

বিখ্যাত গ্রীক দার্শনিক ডায়োজেনাস দারিদ্র্যতাকে ভালোবাসতেন। সেইসময় মানে তাঁর সময় তিনি রাজা ডেনেসকে তোষামোদ করতেন না বলে তাঁকে খুব কষ্ট করে দিন কাটাতে হতো, যখন আ্যরিস্টোপাস নামে আরও একজন দার্শনিক রাজাকে খুশি করে খুব আরাম আয়েশে ছিলেন।একদিন আ্যরিস্টোপাস বাড়িতে এসে দেখলেন ডায়োজেনাস শাক দিয়ে ভাত খাচ্ছেন। আ্যরিস্টোপাস ঠাট্টা করে বললেন, "একটু  তোষামোদি শিখলে তোমাকে শাক দিয়ে ভাত খেতে হতোনা"। ডায়োজেনাস উত্তরে বললেন, "আর তুমি যদি কষ্ট করে শাক দিয়ে ভাত খাওয়াটা শিখতে, তাহলে তোমাকে অমন তোষামোদি করতে হতো না"। 

 

 

কাজী খাদিজা আক্তার
লেখক ও প্রাবন্ধিক, প্রভাষক (ইংরেজি), সরাইল সরকারি কলেজ।                                 

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা                            



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top