সিডনী সোমবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১

অশান্ত এ পৃথিবীতে তবে কি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ আসন্ন? : তন্ময় সিংহ রায়


প্রকাশিত:
৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২১:৩৯

আপডেট:
৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২৩:৩৪

তন্ময় সিংহ রায়

 

তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ আসন্ন, এ কথা মুখে আনা তো দুর এ অশুভ ভাবনা আমাদের স্মৃতিতেও যেন জীবিত না থাকে সে চেষ্টাই আমরা করি। এ দুশ্চিন্তা ঘুম ভেঙে জেগে উঠলেই, আমাদের সমগ্র সত্তাকে যেন নিমেষেই গ্রাস করে ফেলতে চায় এক মহা-আতঙ্ক!  

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেই ভয়াল-ভয়ংকর ও বিভৎস অভিজ্ঞতার রূপের কথা আজও বেশ হাঁটাচলা করে ও কথাবার্তা বলে আমাদের মনে, অথচ এ পরিস্থিতি কোনোভাবেই যেন তৈরি না হয় সে ব্যাপারে বিশ্বের বেশ কিছু রাষ্ট্র আজও রয়েছে যথেষ্ট উদাসীন মনোভাবাপন্ন! সে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জন্যেই হোক বা হোক অন্য কিছু।

সাল ১৯৪৫-এর ৬ আগস্ট, জাপানের হিরোশিমা শহরে তখন সকাল ৮ টা বেজে ১৫ মিনিট, অর্থাৎ সেই দিনটা'র জন্মের কিছু পরের মুহুর্ত। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি ও প্রায়শই বোমাবর্ষণকে কেন্দ্র করে, টানটান উত্তেজনার উপরে ভর করেও নিত্যদিনের মত সেদিনও সে শহরের মানুষজন গতিশীল ছিল তাদের কর্মব্যস্ততায়! হঠাৎ-ই অকল্পনীয় বিস্ফোরণের মাধ্যমে শব্দ, তাপ ও আলোকশক্তিকে সঙ্গে করে অতর্কিতে আমেরিকার বি-২৯ বোমারু বিমান থেকে, পনেরো কিলোটন টিএনটি এর সমতুল্য ধ্বংসক্ষমতা নিয়ে, মানবসভ্যতার জন্য এক অভিশাপ হয়ে 'লিটল্ বয়' এসে পড়লো শহরটাতে! মুহূর্তের মধ্যেই যেন কেঁপে উঠলো প্রায় সম্পূর্ণ পৃথিবীটা!

ন'হাজার পাউন্ডের, দশ ফুট দৈর্ঘ্য ও আঠাশ ইঞ্চি ব্যাসের ইউরেনিয়াম বেস এই দানবাকৃতির পারমাণবিক বোমার অতি নির্মম আঘাতে চোখের পলকে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল গোটা শহরটা! ঘর-বাড়ি, পথ-ঘাট, দোকান-পাঠ, স্কুল-কলেজ প্রভৃতি নিমেষেই গেল পুড়ে ছাই হয়ে! ফুৎকারে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে নিভে গেল আশি থেকে পঁচাশি হাজার আবালবৃদ্ধবনিতা'র প্রাণপ্রদীপ!

বাঁচার প্রবল আকুতি নিয়ে আকাশ-বাতাস আন্দোলিত করা চিৎকারে চারিদিকে তখন ত্রাহি ত্রাহি রব!

কোথাও হাজারে হাজারে দলা পাকানো মৃতদেহ, কোথাও বা ঝলসে যাওয়া শরীর আবার কারো কারো ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন অঙ্গ পড়ে আছে বিক্ষিপ্তভাবে সে শহরে। প্রায় রক্তিম চতুর্দিকে শুধুই পোড়া গন্ধ! 

 

সেমতবস্থায় হিরোসিমা'র পাশের হিকিয়াম পাহাড়ে পালিয়ে বেঁচে যাওয়া কলেজের এক ইতিহাসের অধ্যাপকের সে দৃশ্যের বর্ণনা অনুযায়ী, ''সে দিন দেখলাম হিরোশিমার আর কিছুই নেই! হিরোশিমা শহরটাই আর নেই! 

আমি অবশ্যই মর্মান্তিক দৃশ্য অনেক দেখেছি, কিন্তু সে দিনের স্তম্ভিত করে দেওয়া দৃশ্যের যে অভিজ্ঞতা, তা প্রকাশ করা আমার কাছে অসম্ভব!'' পাথরে পরিণত হওয়া পৃথিবী যেন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দেখলো, নির্মমতার শেষ পর্যায়ের সেই চুড়ান্ত দৃশ্যটা!

বিশ্বে সেই প্রথমবারের মতন মানুষের উপর প্রয়োগ করা হল নিউক্লিয়ার বোমা। এর ঠিক তিনদিন পর প্লুটোনিয়াম বেস দ্বিতীয় পারমাণবিক বোমা 'ফ্যাটম্যান' নিক্ষেপিত হল জাপানের'ই আরেকটা ব্যস্ত শহর নাগাসাকি-এর উপর। ঘটে গেল একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি। 

১৯৪৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে, মানবসভ্যতা ধ্বংসকারী ও অতিমাতায় বিধ্বংসী এই দুটো বোমার আঘাতে হিরোশিমাতে আনুমানিক ১৪০,০০০ ও নাগাসাকিতে প্রায় ৭৪,০০০ লোক বরণ করেন মর্মান্তিক মৃত্যুকে এবং পরবর্তীকালে এর অত্যন্ত ক্ষতিকারক তেজস্ক্রিয় আলফা, বিটা ও গামা রশ্মির প্রভাবে, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান আরও ২১৪,০০০ জন!

জাপানের বাধ্যতামূলক আত্মসমর্পণের মধ্যে দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটলেও, এ প্রকৃতির নৃসংশতা পৃথিবী ধ্বংসের আগ পর্যন্ত মানব সভ্যতার জন্যে হয়ে রইল সবচেয়ে বড় এক কলঙ্কের জীবন্ত নিদর্শনের অধ্যায় হয়ে!

 

পারমাণবিক বোমা হামলার বিপক্ষে সমগ্র পৃথিবীর সিংহভাগ মানুষ গর্জে উঠলো প্রতিবাদে! তীব্র নিন্দা ও ধিক্কার বর্ষণে যুক্তরাষ্ট্রের কপালে পরিয়ে দেওয়া হল কলঙ্কের তিলক! এমনকি আজও পর্যন্ত বিভিন্ন ইতিহাসবিদ, গবেষকসহ সাধারণ মানুষের মনেও প্রশ্নটা রয়ে গেছে জীবিত যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল নির্ধারণ বা সেই যুদ্ধ দ্রুত শেষ করার তাগিদে এ ধরণের মানব বিধ্বংসী নতুন অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে আমেরিকার গণহত্যা আদৌ কতটা যুক্তিসংগত? 

এদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্ত হওয়ার পর থেকে আমেরিকানরা বলে আসছেন যে, যুদ্ধে দাঁড়ি টানার জন্য হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে আণবিক বোমা হামলা চালানো  হয়ে পড়েছিল অত্যন্ত জরুরী আর এভাবেই নাকি তাঁরা রক্ষা করেছিলেন হাজার হাজার মানুষের জীবন!

 

বর্তমান পৃথিবীটাও অত্যন্ত চঞ্চল! ঘুরে ফিরে যেন বারেবারেই মনের জরায়ুতে প্রশ্নের জন্ম হয়েই যায় যে, অশান্ত এ বিশ্বে তবে কি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ আসন্ন? একদিকে বিশ্ব-উষ্ণায়নের প্রভাবে পৃথিবী ক্রমশই এগিয়ে চলেছে ধ্বংসের করাল গ্রাসে!  ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাচ্ছে আন্টার্টিকা'র বরফ গলনের পরিমাণ, অবিশ্বাস্য মাত্রায় ক্রমবর্ধমান গ্রীনহাউস গ্যাসের নির্গমন!

ফলতঃ যথেষ্ট পরিমাণে নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য! অন্যদিকে পৃথিবী থেকে ক্রমশ নিশ্চিহ্ন হয়ে আসার অকৃত্রিম সংকেত বহন করে চলেছে মিষ্টি জলের উৎস, অথচ ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যানুযায়ী বেড়ে চলেছে সেই জলের-ই চাহিদা! আবার অন্যত্র আন্তর্জাতিক রাজনীতি স্তরে বৃহৎ শক্তিধর দেশগুলো পরস্পরকে নানা ধরনের হুমকি দিয়ে আসছে বহুদিন ধরেই।

 

এছাড়াও ইরাক, আফগানিস্তান, মিসর, তুরস্ক, সোমালিয়া, নাইজেরিয়া, লিবিয়া, নাইজার ও চাদ প্রভৃতি-সহ বিশ্বের বেশ কিছু দেশ সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, বিচ্ছিন্নতাবাদ ও জাতিগত সংঘাতে একেবারে জর্জরিত! এসব দেশে মৃত্যু ও রক্তপাত যেন পরিনত হয়েছে প্রায় নিত্যদিনের স্বাভাবিক ঘটনায়। বিশ্বের প্রায় প্রতিটা দেশই আজ ভীষণ ব্যস্ত তাদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে।

সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ থেকে শুরু করে ইরাক আমেরিকা, চিন, রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া প্রভৃতি'র চাপানউতোর চলছেই। আন্তর্জাতিক আইনকে তুচ্ছ করেই যে কোনো মুহুর্তে যেন ঘটে যেতে পারে মহাবিপর্যয় বা প্রলয়কান্ড!

এই বুঝি আঙুলের চাপ পড়ে গেল পরমাণু অস্ত্রের বোতামে, এমনই এক ভয়াবহ পরিস্থিতি! 

বনে-জঙ্গলে ঘুরে খাদ্যসংগ্রাহকের ভূমিকা পালন করা ও আগুন জ্বালানোর কৌশলকে আয়ত্ত করা থেকে শুরু করে লক্ষ-কোটি বছর ধরে যে সু-উন্নত সভ্যতা তিলে তিলে নিজেদের হাতে করে গড়ে তুলেছে এই মানুষ, 

সেই সভ্যতাকেই হাতিয়ার করে ক্ষমতা ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠার দম্ভে সেই মানুষ'ই এ বিশ্বকে ক্রমশ ঠেলে দিচ্ছে অনিবার্য মৃত্যুর মুখে! যেন যে কোনো মুহুর্তে পুনরুজ্জীবিত হতেই পারে ১৯৪৫-এর ৬ ও ৯ আগষ্ট। 

 

তন্ময় সিংহ রায়
কলকাতা, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top