সিডনী বুধবার, ১লা মে ২০২৪, ১৮ই বৈশাখ ১৪৩১

রাজা মাছ : আফরোজা পারভীন


প্রকাশিত:
৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২০:৫৪

আপডেট:
৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২০:৫৬

 

তিন টুকরো রূপচাঁদা মাছ দিয়েছিল ছোটবোন। মিনা ভেবেছিল, নিশ্চয়ই রূপচাঁদা ভাজি । ভাজিতেই রূপচাঁদা খানদানি। এমনিতে রূপচাঁদা ওর মোটেই পছন্দের মাছ না। মিনার প্রথম পছন্দ ইলিশ তারপর চিংিড়ি। আরো অনেক পছন্দের মাছ আছে, বড় ছোট মাঝারি মিলিয়ে। কিছু অপছন্দের মাছও আছে। যার অনেকগুলো সে একেবারেই খায় না। কিছু মাছ আছে ভাল লাগে না, তবু খায়। কিন্তু খেতে ইচ্ছে করে না। রূপচাঁদা তেমন একটা মাছ। ভাজি হলে তবু কিছুটা খাওয়া যায়, কিন্তু রান্না! বোনকে তাই বার বার মানা করেছিল। বোন শোনেনি। বলেছিল, ওকে দেবে বলে বিশেষ যত্নে রেঁধেছে। তাই বাধ্য হয়ে এনেছে। তবে ভবিতব্য ওর জানা। ছেলে মেয়ে এ মাছ পছন্দ করে না। সত্যি বলতে কি, ওরা কোন মাছই পছন্দ করে না। ওরা মুরগি প্রজন্ম। তিনবেলা মুরগি খায় অথচ মুরগিতে অরুচি হয় না। মিনার মুরগি খেতে কেমন ঘাস ঘাস লাগে। তার মাঝে আজকাল আবার হাইব্রিড ফার্মের মুরগি । বড় বড় ঠ্যাং, বড় বড় দাপনা। দেখলেই কেমন যেন লাগে। বাচ্চাদের ওতেই রুচি। মাংস নাকী দারুণ নরোম। তা ওদের দাঁতগুলো আছে কি করতে, শক্ত জিনিসই যদি দাঁতে না কাটে!
ছেলেবেলায় ‘চান্দা মাছ’ বলতে যা চিনত রূপচাঁদা তারই বড় সংস্করণ । তাতে আবার অনেক কারুকাজ। সত্যিই রূপসী। মাছের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দামে বিকোয় রূপচাঁদা ফ্রাই, সবচেয়ে অভিজাত। স্থান হয় পাঁচতারা হোটেলে। মিনা এখনও ততটা অভিজাত হতে পারেনি, তাই অনেক অভিজাত জিনিসই ওর ভালো লাগে না। ভালো লাগে না পাস্তা, পিৎজা আরো অনেক কিছু।
কি আর করা, মাছ আনতেই হলো। বোন বারবার ড্রাইভারকে বলে দিলো, যেন বাটি কাত না হয়। ঝোল পড়ে যাবে। ঝোল শুনে আরেকবার মন খারাপ হলো মিনার। সে খুব ঝোল খায়। ঝোল দিয়ে ভাত ভিজায় ডালের মতো। শুকনো ভাত ওর গলা গিয়ে নামে না। কিন্তু তা বলে রূপচাঁদার ঝোল! ভাবাই যায় না। বাসায় এনে ডিপে রাখল। পরদিন রাখল টেবিলে । কী মনে করে ছেলে একখানা খেল। বাটিতে মাছ একখানা কম দেখে বর্তে গেল মিনা। যাক একখানার গতি হলো!
মিনার ঘরে কাজের মানুষ নেই। বছরের অনেকটা সময়ই ওর চলে ভাইবোনের অনুদানে। অনুদান মানে রান্না। ওদের বাড়িতে ঘনঘন যায় আর বাটিতে বাটিতে ভরে নানান রকম তরকারি ওরা দিয়ে দেয়। তাতে অনেকদিন চলে যায়। রান্না তেমন একটা করতে হয় না। অল্প মানুষের সংসারে এটা একটা সুবিধা। তাতে মেয়ে রাতে কিছু খায় না, আর দিনে খায় অফিসে। শুক্র শনি ছাড়া বাড়িতে তার খাবার সুযোগ নেই। ছেলে স্যুটিং থাকলে দিনের পর দিন ফেরে না। আর মিনা একবেলা ভাত খায়, একবার মাছ । সুতরাং রান্নাও তেমন একটা করতে হয় না।
প্রথম প্রথম বোনরা দিলে লজ্জা করত। এখন আর লজ্জা করে না। নিজের বয়স হয়েছে, পায়ে ব্যথা, এজমা একটুতেই হাঁপিয়ে যায়। ‘নেসেসিটি নোস নো বাউন্ড।’ তাই কোন দিন বোনরা কিছু না দিলেই খারাপ লাগে বরং। ঘরে কাজের লোক নেই বলে খাবার নষ্ট করাতেও ওর প্রবল আপত্তি। শুধু কাজের লোক নেই বলে না, ছেলেবেলাতেই মা শিখিয়েছিলেন ‘দানা নষ্ট করতে নেই। কত মানুষ না খেয়ে আছে।’ কথাটা মর্মে গেঁথে গেছে মিনার। ও একটুকরো বা একচিমটি খাবার থাকলেও তুলে রাখে। এটা ওর অভ্যাস। ওই এক টুকরোই কাজে লেগে যায়। একবেলা চলে যায়। তাই কাউকে কিছু দেয়ও না। অনেক সময় না দেয়ার কারণে ভুলে গিয়ে পঁচেও যায়। এ কারণে কেউ ওকে কৃপণ ভাবতে পারে। কিন্তু মিনা জানে, কৃপণতা নয়, এটা সে করে প্রয়োজনে।
ছেলে এক দুটরো খেলো । রয়ে গেল দু টুকরো। মেয়ে খাবে না নিশ্চিত। আর ঘরে খেতে খেতেও শুক্রবার। মিনা ভাবল, এক টুকরো খাবে। চামচ দিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখল, ইচ্ছে হল না। নিজের রান্না করা চালকুমড়ো আর রুই মাছ খেয়ে অশেষ তৃপ্তি পেল। রূপচাঁদার বাটিটা ডিপে তুলে রাখল ও।
তিনদিন পেরিয়ে গেল, রূপচাঁদার কথা মনে পড়লো না মিনার। ছেলে মুরগি আর ডাল খেয়ে তৃপ্ত থাকলো। এই এক অদ্ভুত ব্যাপার! আজকালের ছেলে মেয়েরা অধিকাংশ রকমারি খাবারের স্বাদ জানে না। খেতে পছন্দও করে না। সজনে ডাটার চচ্চড়ি বা ডাল দিয়ে সজনে ডাটা, কচু দিয়ে কচি মুরগি, রকমারি তরকারির মিক্সড সবজি, পুঁইয়ের বিচি ভাজি, চালকুমড়োর বড়া দিয়ে মাছ, কাঁঠালের বিচি দিয়ে ট্যাংরা মাছ এসব ওরা পছন্দই করে না। সরষে দিয়ে রান্না কতই না পছন্দ ছিল মিনার। আজকালের এদের নাকী তিতো তিতো লাগে। এজন্য অবশ্য মিনা নিজেকেই দায়ি করে। ছেলে মেয়ের পছন্দকে প্রাধান্য দেয়া ঠিক হয়নি। ছেলেবেলা থেকেই সব খাওয়ানোর অভ্যাস করা দরকার ছিল। বড় হবার পর অনেক চেষ্টা করেছে। ততোদিনে ওদের নিজস্ব একটা টেস্ট তৈরি হয়ে গেছে। চেষ্টায় ফল হয়নি। এতে অবশ্য মিনার কষ্ট কমেছে। সোজা সাপটা মাংস ডাল রান্না করে দিলেই হয়। কিন্তু ওরা যে কতো কিছু হারাচ্ছে তা ওরা নিজেরাই জানে না।
অনেকদিন বোনদের বাড়ি যাওয়া হচ্ছে না। ওদেরও অনেক সমস্যা। নিজেরা ভালো থাকলে তবে না অন্যকে চালাবে! ঘরে রান্না নেই বললেই চলে। ডিম ভাজি খেয়ে খেয়ে দিন কাটাচ্ছে ওরা। মিনার শরীর আরো খারাপ হয়েছে। দিন চলছে দিনের নিয়মে। ছেলে মেয়ের ব্যস্ত ছুটাছুটি, মিনার অল্পস্বল্প কষ্টকর রান্না, গাছের অনিয়মিত পরিচর্যা, অলস দুপুর, সিরিয়াল আর অসুখ বিসুখ নিয়ে আছে ও । প্রতিদিন ঘুমানোর সময় ভাবে, কাল সকালে জাগবে তো! কেমন যেন একটা আতঙ্কে ওর ঘুম ঠিকমতো হয় না। আর যেটুকু হয় সেটুকুও ভরা থাকে দুঃস্বপ্নে।
অনেকদিন ইলিশ খাওয়া হয় না। ইলিশ মিনার খুব প্রিয় মাছ। বড্ড ইলিশ খেতে ইচ্ছে করছে ওর। সেদিন রাতে স্বপ্ন দেখল। বাজারের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে মিনা। ও গেছে ইলিশ কিনতে। কিন্তু বাজারের ভিতর বাইরে ডালায় ডালায় অজস্র রূপচাঁদা। একটাও ইলিশ নেই, নেই অন্য মাছও । ও এদিক খোঁজে, ওদিক খোঁজে, পায় না। দোকানিরা ওকে ডাকছে,
:আসেন আন্টি সস্তা রূপচাঁদা নিয়ে যান
:আমার দরকার ইলিশ । আছে?
দোকানিরা হি হি করে হাসে।
:ইলিশ, ইলিশ পাবেন কই? এখন পাবেন শুধু রূপচাঁদা আর রূপচাঁদা। যদি রূপচাঁদ না নেন এ জীবনে আর মাছ খাওয়া হবে না।
ঘুম ভেঙে যায় ওর । হুড়মুড় করে বিছানায় উঠে বসে। ঘামতে থাকে। পানি খায়। এমন অদ্ভুত একটা স্বপ্ন ও দেখল কেন! আর তখনই ওর মনে পড়ে ডিপফ্রিজের এক টুকরো রূপচাঁদার কথা।
দ্রুত বিছানা থেকে উঠে রূপচাঁদার বাটি বের করে দেখল মিনা পঁচেছে কীনা। কিছুই বুঝল না। বরফে শক্ত হয়ে আছে মাছ দুখানা। ঝোলও আছে জেলির মতো জমে। মনে মনে আশ্বস্ত হল, পঁচেনি নিশ্চয়ই। বাটিটা যথাস্থানে রেখে বাকি রাতটা ঘুম নির্ঘুমে কাটালো মিনা। ছেলেবেলায় মা অনেক চেষ্টা করেছিলেন মিনাকে সব কিছু খাওয়ানো শেখাতে। পারেননি। তখন যদি সমানভাবে সব খেতো কত ভালো হতো!
পরদিন দুপুরে খাবার অনেক আগেই বাটিটা বের করে টেবিলে রাখল। তারপর ওভেনে গরম করল। ছেলে যথারীতি মুরগি দিয়ে খেয়ে উঠে গেল । এটাই মুরগির শেষ তরকারি। আবার রাঁধতে হবে। মিনা একবার মুখে বলল, বাটিটাও ওর দিকে এগিয়ে দিলো। তাকিয়েও দেখল না ছেলে। বিমর্ষ হলো মিনা। নিজে খাবার সময় বাটিটা টেনে নিয়ে শুকল । সামুদ্রিক একটা গন্ধ ভেসে আসল। এ মাছের গন্ধই এটা। অনিচ্ছায় একটা তুলে নিলো পাতে। কষ্টে তবে মুখে তৃপ্তির ভাব বজিয়ে রেখে খেল। কিন্তু রয়ে গেল আরো একটুকরো। একবারে দুটুকরো মাছ খাবার অনুমতি নেই ডাক্তারের। থাকলেও খেতে পারতো না নিশ্চিত। মাছের বাটিটা আবারও চলে গেল ডিপফ্রিজে।
ঘর বাড়িতে পা দেয়া যাচ্ছে না, কচকচ করছে বালি। কাপড় চোপড়ে চিমটি দিলে মাটি ওঠে। চুলোয় হলুদের দাগ, হাড়ি পাতিলে কালসিটে। বাথরুম দিয়ে গন্ধ ছুটছে। কোন এয়ার ফ্রেশনার তা তাড়াতে পারছে না। অনেক কষ্টে একে ওকে বলে কয়েকঘন্টা কাজের জন্য একজন মহিলা পেল মিনা। মহিলা এগারোটার দিকে যখন বাসায় ঢুকল তখন মিনা পাউরুটি আর চা খাচ্ছে । কারো সামনে কী খাওয়া যায়! ওকেও দিলো। খেতে খেতে মহিলা বলল, তার নাতি হারিয়ে গেছে । কয়েকদিন ধরে কিছুই খায়নি।
চারটে বাথরুম ধুয়ে, দু বালতি কাপড় কেচে ঘর মুছে ক্লান্ত হয়ে গেল মহিলা। এখন আর ওর কাজে সেই আগের গতি নেই। সে সদিচ্ছাও নেই। কেমন যেন নেতিয়ে পড়ল। যেন তেন প্রকারে কাজ সেরে যেতে পারলে বাঁচে। কাজ পছন্দ হচ্ছে না মিনার। কিন্তু বলে কোন লাভ হবে না এটা সে বুঝে গেছে। ক্লান্ত মানুষকে দিয়ে কত আর কাজ করানো যায়! সামান্য রসুন আর আদা বেটে ও ধপ করে বসে পড়ল মেঝেতে। রাগ হচ্ছিল মিনার। ভেবেছিল কিছু রান্না করাবে । হলো না। এ কাজ ঘন্টা চুক্তির। এই যে বসে আছে এটার জন্যও তার পয়সা গুনতে হবে। সকালে যে বসে নাস্তা খেল সেটার জন্যও টাকা গুনতে হবে। মিনার মন খুব নরোম। কাউকেই শক্ত করে কিছু বলতে পারে না। তারপরও দু একবার তাড়া দিলো। মহিলা উঠে বাকি কাজ শেষ করে যাবার জন্য বোরখা পরতে লাগল আর মিনা করতে লাগল পয়সার হিসেব। ওর হাতে পয়সা দিলো মিনা। মহিলা বলল,
:একটু লিফটটা দিয়ে দেন
মিনা ওর পেছন পেছনে এগোল। ওরও খাওয়া হয়নি। বিকেল হয়ে গেছে প্রায়। ওর সাথে সাথে থেকে কাজ করাতে গিয়ে দিনটাই শেষ হয়ে গেলো। খাবার কথা মনে হতেই মিনার চোখে ভেসে উঠল রূপচাঁদার বাটিটা। ওই মাছের টুকরো আর সামান্য ভাত ছাড়া ঘরে আর কিছু নেই। কি দিয়ে খাবে মিনা! মাছের কথা ভাবতেই ওর কেমন যেন অস্বস্তি হতে থাকল।
মহিলা শুকনো মুখে লিফটের দিকে এগোচ্ছে। ওরও সকাল এগারোটায় সেই পাউরুটি আর চা ছাড়া দিছু খাওয়া হয়নি। তাতে এতোগুলি কাজ করেছে। মিনার ঘরে কিছু নেই যে ওকে খেতে দেবে।
মহিলা লিফটের সামনে দাঁড়াল। লিফট আসছে। মিনা হঠাৎ বলল,
:শোন তুমি রূপচাঁদা মাছ খাও ?
থমকে দাঁড়ালো মহিলা।
:রূপচাঁদা মাছ আবার কেডা খায়না! ওডা তো রাজা মাছ। কিন্তু পামু কই? পাই না তাই খাই না। সেদিন এক বাড়িতে আমাকে দিয়ে রান্না করালো । কিন্তু
মহিলা আর কিছু বলল না। মিনার যা বোঝার বুঝে নিলো।
:খাবে?
মহিলার মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল । বলল,
:খাবো? আছে ? কিন্তু সময় লাগবে যে। আরেক বাড়িতে যাবো। দেরি হলে
:ও যা হয় একটা কিছু বলে দিও
মহিলা ভেতরে এসেছে । ওর পাতে রূপচাঁদা। সাথে কিছু ভাত। হাপুস হুপুস খাচ্ছে মহিলা। খাচ্ছে আর বলছে,
:খাইতে মন চায় না। নাতিটা বড় পছন্দ করত। কিন্তু পেট, লোভ কি করুম! কবে রূপচাঁদা খাইছি মনেও করতে পারি না।
খেয়ে তৃপ্ত মুখে মিনাকে বড় একটা সালাম দিয়ে লিফট দিয়ে নেমে যায় মহিলা। মিনা ভারমুক্ত হয়ে লম্বা একটা শ্বাস ছাড়ে। ভাত খেতে ভুলে যায়।
সে রাতভর খালি ইলিশের স্বপ্ন দেখে মিনা। ইলিশ আর ইলিশ।
---------------------------------------

 

আফরোজা পারভীন
কথাশিল্পী, কলামলেখক
অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top