সিডনী সোমবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১

কবিতার মানুষ রফিক আজাদ : মীম মিজান


প্রকাশিত:
১০ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২০:২৮

আপডেট:
২৯ এপ্রিল ২০২৪ ১৭:৪৩

ছবিঃ রফিক আজাদ

 

একটি কিশোর। কৈশোরত্তীর্ণ হওয়ার আগে তার ভিতরে কি ফুটে উঠে দ্রোহের চিহ্ন? সাধারণত হওয়ার কথা না। কিন্তু মাত্র তৃতীয় শ্রেণির একজন শিক্ষার্থী হয়ে বাবার বকুনি ও শাসন উপেক্ষা করে ভাষার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করা শহীদদের স্মরণে খালি পায়ে হেঁটে মিছিলে যাওয়া সে চিহ্নেরি বহিঃপ্রকাশ। এই দ্রোহী ছেলেটি যে একদিন দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের জন্য মৃত্যুর ভয়কে পরোয়া না করে স্বৈরশাসকদের লেলিয়ে দেয়া বশংবদের কবর রচনা করবে তা বুঝা গেছিল। পরিণত বয়সে কাব্যের জমিনে যিনি এঁকেছেন সমকাল। সামসময়িক ঘটনার প্রতিবাদ। প্রেম, দ্রোহ, অধিকার বাস্তবায়ন, পেঁচাদের ত্রাসন, হতাশাবাদ থেকে আশার সঞ্চারণ ইত্যাদি যাঁর কাব্যকে করেছিল প্রোজ্জ্বল তিনিই আমাদের রফিক আজাদ। শিল্পিত মানদণ্ডের নিক্তিতে কোন শিল্পই তার সমকাল ও প্রতিবেশ বিচ্ছিন্ন নয়। যদি হয় তবে তা পরিত্যাজ্য ও দুর্মুখতা। রফিক আজাদ সজ্ঞানে তা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাই তিনি কালকে কালোত্তীর্ণ মানে ধারণ করেছেন নিজ সৃজনে।

কবি কীভাবে নিজেকে বলেছেন, পারমাণবিক বোমার থেকে মাত্র চার বছরে বড় তিনি! অর্থাৎ ১৯৪১ সালে অবিভক্ত ভারতের টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইলের গুণী গ্রামে ১৪ ফেব্রুয়ারি তিনি জন্মগ্রহণ করেন। প্রকৃত নাম মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম খান। ডাক নাম জীবন। রফিক আজাদ তাঁর কবি নাম। তবে তিনি এ নামেই সমধিক খ্যাত। ছয়বছর বয়সে দেখলেন দেশবিভাগ। এরপরই উপলব্ধিতে, দেশের সংস্কৃতিবানদের মধ্যে, মুখে মুখে শুনেন ভাষা আন্দোলনের কথা। নিজেকে সেভাবেই মিশিয়ে দিলেন ভাষা আন্দোলনে মহাত্নাগণের স্মরণের মিছিলে। ময়মনসিংহ এলাকার প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পড়েন। জাদুবিদ্যা শিখতে চেয়েছিলেন তিনি বাড়ি পালিয়ে। বাউণ্ডুলে ও দ্রোহী মানসিকতার জন্য অনেক সময় কাটত তাঁর আড্ডায়। ফলে অনেক পরীক্ষায় সফলতার মুখ দেখতে পারেননি। শিক্ষিত জনক-জননীর তিন সন্তানের মধ্যে তাঁর উপর ছিল আদুরে শাসন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি বাংলা বিভাগে অধ্যয়ন করেন। স্বাধীনতার যুদ্ধে কলম চালিয়েছিলেন। তার থেকে বেশি চালিয়েছিলেন বন্দুক। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর কাদেরিয়া বাহিনীতে তাঁর অংশগ্রহণ ছিল। ২৪ জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধুর কাছে অস্ত্র সমর্পণের সময় পর্যন্ত রফিক আজাদ ছিলেন কাদের সিদ্দিকীর সাথে।

কর্মজীবনে বাংলা একাডেমি, সাপ্তাহিক রোববার, বিরিশিরি উপজাতীয় সংস্কৃতি কেন্দ্র ইত্যাদিতে সফলতা ও সুনামের সাথে কর্মসম্পাদন করেছেন। টাঙ্গাইলে কলেজে প্রভাষক পদেও কিছুকাল শিক্ষকতা করেছেন। ষাটের দশকের একজন অন্যতম প্রোজ্জ্বল কবি তিনি। স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত করেছিলেন নিজ কাব্য ধারাকে। তবে ওপার বাংলার শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কাব্যের কলা ও ভাবের সাথে সাযুজ্য অনেকখানি।

তাঁর রচিত কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে অন্যতমগুলি হচ্ছে, 'অসম্ভবের পায়ে', 'সীমাবদ্ধ জলে', 'সীমিত সবুজে', 'চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া', 'পাগলা গারদ থেকে প্রেমিকার চিঠি', 'প্রেমের কবিতাসমগ্র', 'বর্ষণে আনন্দে যাও মানুষের কাছে', 'বিরিশিরি পর্ব', 'রফিক আজাদ শ্রেষ্ঠকবিতা', 'রফিক আজাদ কবিতাসমগ্র', 'হৃদয়ের কী বা দোষ', 'কোনো খেদ নেই', 'প্রিয় শাড়িগুলো' ইত্যাদি। তিনি জীবদ্দশায় বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ও একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে দীর্ঘ ৫৮ দিন লাইফ সাপোর্টে থাকার ২০১৬ সালের ২২ মার্চ তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

নারীর প্রতি প্রেম, ললনার অবগুণ্ঠনের বর্ণনা, দ্রোহ, সৌন্দর্য প্রিয়তা, হতাশাময়তা, ব্যঞ্জনাত্নক শব্দ ইত্যাদির সংমিশ্রণ আমরা পাই তাঁর কাব্যে। 'ভাত দে হারামজাদা! নইলে মানচিত্র চিবিয়ে খাব' কী প্রেরণা জাগানিয়া কবিতার লাইন। শাসকের গদি কাঁপানো কার্যকরিতা। সেই লাইনটির কবিই হচ্ছেন রফিক আজাদ। ১৯৬৪ থেকে ১৯৭৪ এর কবিতাগুলি এক ধাঁচের। এরপরের কবিতাগুলি মোড় নিয়েছে ভিন্ন সুরের ভিন্ন পথের। এরকমই একটি কবিতা 'নগর ধ্বংসের আগে'। উপর্যুক্ত সময়কালে লেখা একটি স্যাড থিমের কবিতা। তবে অন্যান্য স্যাড ইজমের কবিদের কবিতায় যেমন মাত্র হতাশা দেখা যায়। সেরকমটি হতাশাবাদ এখানে পরিলক্ষিত হয় না। এখানে শাব্দিক কলার মাধ্যমে কবি একটি বা দু'টি শব্দ ব্যবহার করে ফিনিক্স পাখির মতো আশার সঞ্চারণ করেছেন। আমাদের হতাশার সাগরে ডুবিয়ে নিঃশেষ করে দেননি। দেখিয়েছেন খুব বেশী দূরে নয় এমন একটি জাহাজের চিমনির আলো। কবিতাটি সনেট ধাচের। অন্ত্যমিলের। টায়ে টায়ে শব্দের চয়ন ও বুনন।

মানুষের এই নির্মমতা, হৃদয়হীনতা, যুদ্ধাংদেহী মনোভাব, নাগরিকতার পানে ছুটে চলা, বিলাসিতার আকাঙ্ক্ষী, আমিত্ব জাহির ইত্যাদি আজ দিয়েছে আমাদের ধ্বংসের এক মোক্ষম অস্ত্র। এই ধ্বংসের মুখে পতিত সবাই বাঁচার জন্য করবো হাপিত্যেশ। এক ত্রাতা জাহাজ বা নাবিকের জন্য চরম অপেক্ষা সবার। কিন্তু পাবো কি আদৌ সেরকম কোন জাহাজ বা নাবিক? এমনই লিখেছেন কবি,

"নগর বিধ্বস্ত হ’লে, ভেঙ্গে গেলে শেষতম ঘড়ি
উলঙ্গ ও মৃতদের সুখে শুধু ঈর্ষা করা চলে।
‘জাহাজ, জাহাজ’ – ব’লে আর্তনাদ সকলেই করি
তবুও জাহাজ কোনো ভাসবে না এই পচা জলে।"
(নগর ধ্বংসের আগে, রফিক আজাদ শ্রেষ্ঠকবিতা)

আমরা নিজেরাই তো নিজেদের ভালোথাকার, ভালোরাখার মাধ্যম প্রকৃতিকে করেছি ক্ষতবিক্ষত। আশির দশক ক্যানো, বর্তমান কালের বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যাসহ শহুরঘেঁষা তটিনীর অবয়ব আজ কী বিশ্রী! দুর্গন্ধ, দূষণ, বর্ণহীন শৈল্পিক কারখানার ভাগাড় এই নদীগুলি। আর কতোকটিকে এমনভাবে গ্রীবা চেপে ধরেছে যে এক ফোঁটা জলও আর পড়ে না পেটে। অভুক্ত থাকতে থাকতে সব খাঁখাঁ করছে। প্রকৃতির উপর খড়গহস্ততা। আর পরস্পরের কামড়াকামড়ি, হানাহানিতে মৃত্তিকাও খুনে, পুঁজে লেপ্টে ধারণ করেছে বিবর্ণতা। নেই ভালোবাসার ছিটেফোঁটা। আদৌ কি মিলবে সুস্থতার কোন চিহ্নের সাক্ষাৎ? কবি বলতেছেন,

"সমুদ্র অনেক দূর, নগরের ধারে-কাছে নেই :
চারপাশে অগভীর অস্বচ্ছ মলিন জলরাশি।
রক্ত-পুঁজে মাখামাখি আমাদের ভালবাসাবাসি;
এখন পাবো না আর সুস্থতার আকাঙ্খার খেই।"
(নগর ধ্বংসের আগে, রফিক আজাদ শ্রেষ্ঠকবিতা)

সবাই মত্ত, উম্মত্ত, বেসাতি নিয়ে বুঁদ। আমার দামি বাটি। চলার জন্য আছে যুগশ্রেষ্ঠ চার বা ততোধিক চাকার বাহন। কিংবা উড়ন্ত বোয়িং আমার বাসস্থল। সকালের নাস্তা জার্মানিতে। বিকেলে আরাম নিবো বালিয়াড়িতে। কাশ্মির থেকে পাচার হওয়া উচু নাকের ঘোটকীর সাথে রাত কাটাবো দুবাইয়ে। কিন্তু আদৌ কি মিলে এসবে কোন নিষ্কলুষ আরামবোধের ছিটেফোঁটা? তুমি সুখ সুখ করে কাটিয়ে দিবে সমস্ত আয়ুষ্কাল। হঠাৎই দেখবে তুমি আর নও উপযোগী অবস্থানের একদিনের তরে তোমার বানানো থিমপার্কে। সবাই চাইবে তাড়াতাড়ি তোমাকে ঢেকে দিতে পৃথিবীর অতল গহ্বরে। পারবে না আর ফিরতে কভু। জানানও দিবে না কেউ তোমায় 'এই তোমার অন্তিম কাল'। নিপুনভাবে সে কথাগুলিই সনেটের ষষ্ঠকের প্রথম চার ছত্রে লিখেছেন,

"যেখানে রয়েছো স্থির – মূল্যবান আসবাব, বাড়ি;
কিছুতে প্রশান্তি তুমি এ-জীবনে কখনো পাবে না।
শব্দহীন চ’লে যাবে জীবনের দরকারী গাড়ি -
কেননা, ধ্বংসের আগে সাইরেন কেউ বাজাবে না।"
(নগর ধ্বংসের আগে, রফিক আজাদ শ্রেষ্ঠকবিতা)


সনেটের শেষ দুই পঙক্তিতে রফিক আজাদ খানিকটা আশার সঞ্চারণ করেছেন। তার চিন্তা, কল্পনা ছিল মাটিতে শেকড়ের মতো বা মূলের মতো ছড়িয়ে থাকবেন। একবারের তরেও উপরে যেতে চায়নি তার কল্পনা। আশায়, সাধে লালন করতেন একদিন এই জগৎটা হবে পুষ্পময়। ফুড়ুৎ ফাড়ুৎ উড়াল দিবে পক্ষীকূল। নানা রঙের প্রজাপতি ও ফড়িং বসে বসে শোভাবর্ধক হবে। নির্ভয়ে থাকবে পশুগুলি। হত বা জালে বন্দির কোন ভয় থাকবে না তাদের। উঁচু গ্রীবার জিরাফ মগডালের পত্র-পল্লব ছিঁড়ে চিবিয়ে খাবে। আর কবি চেয়ে চেয়ে দেখে চোখকে শীতল করবেন। এমনই চাওয়ার কথাগুলি,

"প্রোথিত বৃক্ষের মতো বদ্ধমূল আমার প্রতিভা -
সাধ ছিল বেঁচে থেকে দেখে যাবো জিরাফের গ্রীবা।"
(নগর ধ্বংসের আগে, রফিক আজাদ শ্রেষ্ঠকবিতা)

কবির কাব্যের আকাঙ্ক্ষা বা প্রকৃতির অভয়ারণ্য হোক আমাদের এই ধরণী।

 

মীম মিজান
লেখক ও সাহিত্যিক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top