সিডনী শনিবার, ২৭শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১

আজো শরৎ সাহিত্যের জনপ্রিয়তা ও আবেদন কমেনি : ডঃ সুবীর মণ্ডল


প্রকাশিত:
১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২০:২২

আপডেট:
২৭ এপ্রিল ২০২৪ ০৩:০৫

 

১৫ ই সেপ্টেম্বর ছিল অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম দিন। তাঁর জন্ম দিনে আমার  বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি উপলক্ষে এই নিবন্ধটির অবতারণা। স্রষ্টা বেঁচে থাকেন তাঁর সৃষ্টি কর্মের মধ্য দিয়ে।এই জীবন সত্য শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়  সম্পর্কে গভীর ভাবে প্রাসঙ্গিক বলে আমার নিজস্ব বিশ্বাস। সেই ভাবনা থেকেই এই নিবন্ধটির অবতারণা। শরৎচন্দ্রের  মৃত্যুর পর(১৮৭৬,১৫ই-সেপ্টম্বর--১৯৩৮) ৭৩ বছরেও বেশি অতিক্রান্ত হয়েছে। বাংলা কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আবির্ভাব,অপরাজেয় কথাশিল্পী আখ্যালাভ এবং তারপর এই বিগত ৭৩ বছরেও  অধিক বিশেষ করে শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে শরৎচন্দ্র প্রসঙ্গে বহু আলোচনা, গবেষণা যাদের অধিকাংশই চর্বিতচর্বন, প্রকাশিত হয়েছে। উপন্যাস সাহিত্যে শরৎচন্দ্রের আবির্ভাব শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, সমগ্র ভারতীয় সাহিত্যেই  এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ভারতীয় সাহিত্যে শরৎচন্দ্রের প্রভাব ও জনপ্রিয়তা শরৎচন্দ্রের অসাধারণ প্রতিভার ই পরিচায়ক। এ প্রসঙ্গে ভারতসরকার কর্তৃক প্রকাশিত' ন্যাশনাল বিবলিওগ্রাফিতে'  ভারতীয় ভাষায় অনূদিত গ্রন্হের তালিকায় শরৎচন্দ্রের শীর্ষস্থান লক্ষ্যনীয়। বাংলা সাহিত্যের আঙিনায় প্রথম শরৎচন্দ্রের আত্মপ্রকাশ 'বড়দিদি' উপন্যাসটি দিয়ে। 'ভারতী' মাসিকপত্রে  ১৯০৮ সালে উপন্যাসটি  প্রকাশিত হলে পাঠকমহলে বিপুল পরিমাণ সাড়া পড়ে। অনেকেই লেখাটিকে রবীন্দ্রনাথের রচনা বলে ভুল করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ও কাহিনীটির  প্রসংসা করেন এবং রচনাটি তাঁর না হলেও সেটি যে  একজন শক্তিশালী লেখকের রচনা সেকথা অকপটেই  স্বীকার করেন। উপন্যাসটির কাহিনীর   অভিনবত্ব পাঠককে গভীর ভাবে আকৃষ্ট করেছিল সন্দেহ নেই।

শরৎচন্দ্রের আত্মকথনে জানতে পাই, "ওটা, বাল্যকালের রচনা, ছাপা না হইলেই  বোধকরি ভালো  হইত।" রচনাভঙ্গী কাঁচা হলেও শরৎচন্দ্রের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি প্রথম প্রকাশিত রচনাটিতেই উন্মোচিত হয়েছিল, এ ব্যাপারে সবাই হয়ত  একমত হবেন। সেই দিক দিয়েই শরৎচন্দ্রের  উপন্যাসের অসাধারণ জনপ্রিয়তার আলোচনার ক্ষেত্রে  'বড়দিদি'র উল্লেখ অপরিহার্য বলে মনে হয়। বড়দিদি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই  শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের আঙিনায় লেখক হিসাবে স্বীকৃতি পান---এটিও  একটি উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক ঘটনা। সাধারণত  সাহিত্যের অঙ্গনে নতুন সাহিত্যিকের প্রথম পদক্ষেপ থাকে কুন্ঠিত, উপেক্ষা,ও অসহযোগের ভাবনায় ক্লিষ্ট। কিন্তু তিনি প্রথমেই বীরোচিত সংবর্ধনা লাভ করেছিলেন। তিনি নিজেই তাঁর এই সৌভাগ্যের কথা উল্লেখ করেছিলেন পরবর্তীকালে তাঁর  শ্রীকান্ত' উপন্যাসের ইংরাজি অনুবাদের ভূমিকায়-----'In Bengali perhaps I am the  only  fortunate writer who was not  had to struggle'---প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য ঘটনা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ই  সম্ভবত সমগ্র ভারতে প্রথম পেশাদার লেখক সেই সময়ে--লেখাই যাঁর একমাত্র জীবিকা।

একটা সময় শরৎচন্দ্রকে পিছনে তাকাতেই হয়নি। বড়দিদির  সাফল্যের পর একেএকে 'বিরাজ বৌ', 'পরিণীতা,' 'পল্লীসমাজ', বৈকুণ্ঠের উইল', 'পণ্ডিতমশাই,' 'শ্রীকান্ত', 'চরিত্রহীন', 'গৃহদাহ', 'দেনা পাওনা', 'পথের দাবী', 'শেষপ্রশ্ন', ইত্যাদি কালজয়ী, বিখ্যাত, অসাধারণ জনপ্রিয় উপন্যাসগুলি  প্রকাশিত হতে থাকে। জীবিতকালে অসাধারণ জনপ্রিয়তা এবং সাধারণ মানুষের,পাঠকসমাজের অকুণ্ঠ ভালোবাসা তিনি পেয়েছিলেন। এটি ঐতিহাসিক ভাবে সত্য। আমাদের স্মরণে রাখতেই হবে যে শরৎচন্দ্রের আবির্ভাবের পূর্বেই রবীন্দ্রনাথ কাব্যে, গল্পে, উপন্যাসে বাংলাদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছেন এবং তাঁর যশ পৃথিবীব্যাপ্ত  হয়েছে। এই পটভূমিতে শুধুমাত্র পাঠক হৃদয়ে  স্হান করে নিয়ে অসাধারণ এবং মৌলিক প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। উপন্যাসের ক্ষেত্রে তিনি জনপ্রিয়তার দিক থেকে রবীন্দ্রনাথকেও অতিক্রম করেছিলেন। এপ্রসঙ্গে  রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব স্মরণীয় মন্তব্য---' গল্পে উপন্যাসে শরতের শ্রেষ্ঠত্ব  মেনে নিতে আমার আপত্তি থাকত  যদি না আমি নিঃসন্দিগ্ধভাবে   জানতুম যে কবিতায়  আমারই জিৎ' ঈষৎ কৌতুকের চলে কথাটি বলা হলেও কৌতুকের ভিত্তিটুকু মিথ্যা নয়। সেই সত্য ইতিহাসগত ভাবেই প্রমাণিত। সেই সময় বিপুল জনপ্রিয়তার অধিকারী শরৎচন্দ্রের অসাধারণ সাহিত্য প্রতিভা সম্পর্কে সমসাময়িকাল  থেকেই বুদ্ধিজীবী মহল দ্বিধাবিভক্ত হয়েছেন।

বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথের তুলনায় তিনি অকিঞ্চিৎকর প্রতিভার অধিকারী--এবং সস্তা ভাবাবেগের দ্বারা  চালিত হয়ে গল্প--উপন্যাস রচনা করে বাঙালি পাঠক মহলে জনপ্রিয় হয়েছেন।। তাঁর রচিত উপন্যাসের চিরন্তন মূল্য সম্পর্কে এই বুদ্ধিজীবীর দল তাই ছিলেন সন্ধিহান। আবার শরৎচন্দ্রের গুণমুগ্ধ ভক্তের  দল মনে করেন  বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথের  পরই বাংলাসাহিত্যের ইতিহাসে  শরৎচন্দ্রের চিরস্থায়ী আসন পাতা। একথা সত্য, সাহিত্য সমকালের ফসল। বাস্তবে, যে বিষয়গুলি নিয়ে শরৎসাহিত্য উপজীব্য বা  গঠিত হয়েছিল,যে পরিবেশ এবং পটভূমিকায় গল্প--উপন্যাসকে দাঁড় করানো হয়েছিল, সেই সামাজিক, রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক পটভূমি কখনই চিরস্থায়ী হতে পারে না এবং কাম্য হতে পারে না। শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে উত্থাপিত সমস্ত সমস্যাগুলি বর্তমান সময়ের পাঠকের হৃদয়ে দাগ কাটবে না সেটাই স্বাভাবিক। পুরাতন মূল্যবোধের প্রতি আজকের মানুষ আস্হাহীন, শুধু তাই নয়, আজকের সচেতন মানুষ জগৎ ও জীবনকে  দেখবেন সম্পূর্ণ আলাদা দৃষ্টিকোণ থেকেই। এটাই যুগ ধর্ম। কিন্তু তা সত্ত্বেও আজকের সময়েও  শরৎচন্দ্র  বাংলাসাহিত্যে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়তে পারেন না। কারণ তাঁর সাহিত্যে আছে চিরকালীনত্ত্বের ধর্ম, যা সময়ের মালিন্যে  শেষ হতেই পারে না। তাঁর সাহিত্যের হৃদয়াবেগ ও ভাবাবেগ নিত্যকালের বস্তু। কোন কালেই মুছে যাওয়ার নয়।

শরৎচন্দ্র তাঁর জীবদ্দশায় সবচাইতে জনপ্রিয় লেখক ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর  ৭২ বছরেও অধিক অতিক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু আজকের সময়েও তাঁর জনপ্রিয়তা এতটুকুও হ্রাস পায়নি। বাঙালির জীবনের তিনি রূপকার রবীন্দ্রনাথ যথার্থ ই বলেছেন-------" জ্যোতিষী অসীম আকাশে ডুব মেরে সন্ধানকরে বের করেন  নানা জগৎ, নানা রশ্মিসমবায়ে গড়া, নানা কক্ষপথে নানা বেগে আবর্তিত। শরৎচন্দ্রের দৃষ্টি ডুব দিয়েছে বাঙালির হৃদয়রহস্যে। সুখে-দুঃখে, মিলনে-বিচ্ছেদে সংঘটিত বিচিত্র সৃষ্টির তিনি এমন করে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন বাঙালি যাতে আপনাকে প্রত্যক্ষ জানতে পেরেছে। তাঁর প্রমাণ পাই তাঁর অফুরান আনন্দে। তেমন অন্তরঙ্গের সঙ্গে তারা খুশী হয়েছে এমন আর কারো লেখায় তারা হয়নি।অন্য লেখকরা অনেকে প্রশংশা পেয়েছে কিন্তু সর্বজনীন হৃদয়ের এমন আতিথ্য কেউ পায় নি। এ বিস্ময়ের চমক নয়, এ প্রীতি। অনায়াসে যে  প্রচুর সফলতা  তিনি পেয়েছেন তাতে  তিনি আমাদের ঈর্ষাভাজন।" শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলাদেশে সর্বজনীন হৃদয়ের আতিথ্য পেয়েছিলেন এই কারণে যে, তিনি বাঙালির মর্মস্হলে তাঁর বেদনা কেন্দ্রে আপন বাণীর স্পর্শ দিয়েছেন।  এই ব্যাপারে সাহিত্য সমালোচক শ্রী মোহিতলাল মজুমদারের মন্তব্য খুবই প্রাসঙ্গিক বলে আমার মনে হয়েছে।----"রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা তখন মধ্য গগনের শেষ সীমা পর্যন্ত উদ্ভাসিত করিয়াছে, তখনই সেই রবীন্দ্রালোকিত  মহাদেশের এক প্রান্তে একটা নতুন আলো বিচ্ছুরিত  হইল,নিথর নিবিড় জ্যোস্নাকাশের এক কোণে বিদ্যুৎ শিহরণ আরম্ভ হইল।"

অপরাজেয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র জনপ্রিয়তার দিক থেকে রবীন্দ্র  যুগেই নয়, আজও সম্ভবত বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক। যুগ ও রূচির ব্যাপক পরিবর্তন   হওয়া সত্ত্বেও শরৎচন্দ্রের এই বিশাল জনপ্রিয়তা অম্লান  হওয়ার কারণ হিসাবে নানা কারণ আমরা খুঁজে পেতে পারি

(১) শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের প্রধানতম আকর্ষণ তার কাহিনি অংশটির জন্য। বাঙালি সমাজের পটভূমিকায় রচিত শরৎ কাহিনির মূল উপজীব্য বিষয় বিশুদ্ধ ঘরোয়া রোমান্স রস।  কাহিনীগুলির গতিপ্রকৃতি, ঘটনার বিন্যাস এবং কাহিনীর  পরিণতির মধ্যে যে  নৈপুণ্য শরৎচন্দ্র  দেখিয়েছেন তা আজ ও  বাঙালি  পাঠককে  মোহাবিষ্ট করে তোলে। শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে ঘটনার গতি সহজ ও স্বাভাবিক, যা  নিশ্চিত ভাবে পরিণতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় এবং কাহিনীর বর্ণনে অনন্য  সাধারণ দক্ষতার অধিকারী লেখক পাঠকচিত্তকে গভীর ভাবে আকৃষ্ট করে রাখে।

(২) আমাদের উনবিংশ শতাব্দীর সামাজিক অন্যায় - অবিচারে মানব হৃদয়ের হৃৃদয়়ানুভূতির যে সব দিকগুলো উপেক্ষিত হত ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্রের অন্যতম কৃতিত্ব হলো সেগুলিকে সুগভীর সহানুভূতি  সহকারে রূপ দেওয়া। আজ একুশ শতকের প্রথম দিকে যখন  আমাদের সমাজ , সেই সমাজ ব্যবস্হা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন,তখন শরৎ সাহিত্যের জনপ্রিয়তা না কমার কারণ  পাঠক  শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে ভাব ও চিন্তার  যে  বৈশিষ্ট্যগুলি ফুটে উঠেছে তার আবেদন আজও  অন্তর্হিত হয়়নি ।

(৩) সামাজিক অন্যায়- অবিচারে নির্যাতিত নারীদের জীবন, তাদের অন্তর বেদনা অপরিসীম  সহনশীলতার মাধূর্য্য,     প্রেমনিষ্ঠ যে ভাবে শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে গভীর  সহানুভূতি সহকারে  চিত্রিত হয়েছে , সেই সঙ্গে সমাজের বিশ্বাস , স়ংস্কার চত্রিরগুলির অঙ্গীভূত হয়়ে সেগুলির মধ্যে  গভীর অন্তর্বেদনা ও  যে অন্তরদ্বন্দ্ব  বেদনাঘন আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, তার মর্মস্পর্শী সজীব চিত্র আধুনিক পাঠককেও  অভিভূত করে তোলে। পারিবারিক জীবনের পটভূমিকায় সৃষ্ট বাস্তব ও জীবন্ত নারী চরিত্রগুলিতে মে স্নেহরসধারায় ও একনিষ্ঠ প্রেমের উজ্জ্বলতা চিত্রিত হয়েছে আধুনিক পাঠকের কাছেও তার আবেদন সমানভাবেই বর্তমান।

(৪) বাস্তবানুগ চরিত্র চিত্রণে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যে সাফল্য অর্জন করেছিলেন তা, তাঁর সাহিত্য সৃষ্টির একটি বিশিষ্ট দিক। আপন বাস্তব জীবনের ব্যাপক অভিজ্ঞতাকেই গভীর জীবনদৃষ্টি দিয়ে বিচার করে সেগুলিকে তিনি যেভাবে সাহিত্যের আঙিনায় উপস্থাপিত করেছেন, তাতে চরিত্রগুলো  সাময়িক কালের গণ্ডী অতিক্রম করে শাশ্বতকালের চরিত্ররূপে প্রতিভাত হয়েছে। নিপিড়িত মানুষের হৃদয়ের দুঃখ- বেদনাও জীবনতৃষ্ণাকে  সমস্ত হৃদয় দিয়ে অনুভব করে তাদের রূপদান চরিত্রগুলিকে অত্যন্ত জীবন্ত ও বাস্তব করে তুলেছে। তাই আজকের বদলে যাওয়া সময়ে ও সমাজ ব্যবস্থায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাহিত্যের জনপ্রিয়তা অম্লান  রয়েছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।

(৫) যুগ ও রুচির পরিবর্তন সত্ত্বেও মানুষের মনে এমন কতকগুলো প্রবৃত্তি  আছে যাদের কোন পরিবর্তন হয় না। যা সুন্দর, যা মহৎ তার চিরকাল দেশে- দেশে, যুগে- যুগে  একই আবেদন নিয়ে উপস্থিত হয়। যথার্থ সাহিত্য তাই যুগের প্রহরা অতিক্রম করে যুগান্তরের পথে তার  চিরকালীন শাশ্বত আবেদন ছড়িয়ে দেয়। বহুকাল আগে কোন এক'আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে' নব বর্ষার নবীন মেঘ কালিদাসের মেঘদূতের বিরহী যক্ষের মনে যে প্রিয়বিরহের বেদনা  সঞ্চারিত করেছিল, তা আজ ও  বর্ষার আগমনে  মানব মনে সৃষ্টি করে নিবিড় আনন্দ।

কারণ মহাকবি কালিদাস সেই বিরহের ভাবকে সঞ্চারিত করে দিয়েছেন যুগান্তরের মানুষের মনে। মানব জীবনের অপূর্ণতার বেদনা  সাহিত্যের সোনার কাঠির স্পর্শে  জীবন্ত হয়ে ওঠে।এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি মন্তব্য খুবই প্রাসঙ্গিক বলে আমার মনে হয়েছে"  জগতের উপর মনের  কারখানা বসিয়াছে, এবং মনের উপর বিশ্বমনের কারখানা ----সেই উপরের তলা হইতে  সাহিত্যের উৎপত্তি।" শরৎচন্দ্রের সাহিত্য ও এই গুণে গুণান্বিত। তাই শরৎচন্দ্রের উপন্যাসগুলি আজকের যুগেও  পাঠক সমাজে সমাদৃত , ভবিষ্যতেও  তার যে সমান সমাদর লাভ করবে, তাতেও কোন সন্দেহই নেই বলে আমার বিশ্বাস।

শেষ কথাঃ শরৎচন্দ্র অপরাজেয় কথাশিল্পী আখ্যা পেয়েছিলেন জীবনকালেই। আজ ও জনপ্রিয়তার ক্ষেত্রে তিনি অপরাজিত। তবে সৃষ্টি কর্ম কালজয়ী হবে কিনা--এ প্রশ্ন এখনও কেউ কেউ করে থাকেন। শরৎচন্দ্রের সমসাময়িক সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পরিবেশ আজ আর নেই ---কালের সঙ্গে তার পরিবর্তন ঘটেছে। এ কথা সত্য। কেউ কেউ বলেন তাঁর উপন্যাসের পটভূমিগত আবেদন এখন  আর নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও যে হৃদয়াবেগ দিয়ে তিনি লিখেছেন ----সেই হৃদয়াবেগ এখনও বর্তমান এবং তার নিত্যকালের বস্তু। দৃষ্টান্ত হিসেবে 'অরক্ষনীয়া'র কাহিনী বিশ্লেষণ করলে সেই জীবন সত্য প্রমাণিত হতে পারে। এই উপন্যাসের উপজীব্য বিষয় ও কাহিনী অতীতাশ্রয়ী। সেই গ্রামকে, গ্রাম উজাড় করা ম্যালেরিয়ার প্রকোপ আজ আর দেখা যায় না।--নেই জমিদারী প্রথাও --কিন্ত  নিরুপায় জ্ঞানদার মধ্যে দিয়ে শোষিতের যে বিশ্বস্ত ছবি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এঁকেছেন, তার ভবিষ্যৎ পাঠকদের চোখ ও অশ্রুসিক্ত করবেই, এবিষয়ে কোন সন্দেহই নেই বলে আমার বিশ্বাস। এর কারণ, বিশেষ দেশ-কাল-পাত্রের আধারে শরৎচন্দ্র নির্বিশেষ মানবজীবনকে প্রত্যক্ষ করেছেন। মহৎ ও শ্রেষ্ঠ সাহিত্য এইভাবে বিশেষের  সীমা অতিক্রম করে নির্বিশেষের কক্ষে ধাবমান হয়। সেই কারণে ভিন্নতর রূচির ভিন্নভাষাভাষী পাঠকের অন্তরে দোলা দেয় আজ ও।আসলে মহৎ শিল্প সমসাময়িকতাকে  ছাড়িয়ে যায়। ইতিহাস যেহেতু কালের দ্বারা সীমাবদ্ধ তখন  কোন কিছুই অনন্ত নয়, না সাহিত্য,না জীবন। তবু কোন কোন  সারস্বত সৃষ্টি অমরত্ত্বের আংশিক অধিকার নিয়ে আসে। শরৎচন্দ্রের পাশাপাশি গল্পের মধ্যে সেই সীমাতিশায়ী  অনন্ত বৈচিত্র্যকে  আমরা উপলব্ধি করতে পারি। এইজন্য  তিনি বারবার ভূগোল--ইতিহাসের সীমানা লঙ্ঘন করে যাবেন । আসলে বাঙালির অন্তরলোক থেকে তিনি উত্থিত হয়েছেন, সারা ভারতের অন্তর্লোকে তিনি প্রবিষ্ট হয়েছেন, বাঙালি হিসাবে এ আমাদের পরম গৌরব।

শরৎচন্দ্রের রোমান্টিক অশ্রুকণাময় পরিচিত কাহিনিগুলো আজ ও অবসরের সঙ্গী, একবার নয়, বহুবার। সুতরাং দ্বিধাহীন চিত্তে আমরা বলতেই পারি,যুগ-রুচির পরিবর্তন সত্ত্বেও  শরৎ সাহিত্যের জনপ্রিয়তা ও আবেদন আজকের একুশ শতকেও   আদোও কমেনি। ভবিষ্যতেও জনপ্রিয়তা অটুট থাকবে। আমাদের হৃদয়ের মানচিত্রে তিনি  চিরদিন অমর হয়ে আছেন ও থাকবেন। মানবদরদী, জীবনরসিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উৎপীড়িত ও লাঞ্ছিত মানুষের জন্য কেঁদেছেন। আত্মভাবনা তিনি বলেছিলেন----"ঋণ কি শুধু আমার পূর্ববর্তী পূজনীয় সাহিত্যাচার্যগণের কাছেই?   সংসারে যারা শুধু দিলে, পেলে না কিছুই, যারা বঞ্চিত, যারাদুর্বল, উৎপীড়িত, মানুষ হয়েও মানুষ যাদের চোখের জলের কখনই হিসেব নিলে না, নিরুপায় দুঃখময় জীবনে যারা কোনদিন ভেবেই পেলো না। সমস্ত থেকেও কেন তাদের কিছুতেই অধিকার নেই, এদের কাছেও কি ঋণ আমাদের কম? এদের বেদনাই দিলে আমার মুখ খুলে, এরাই পাঠালে আমাকে মানুষের কাছে মানুষের নালিশ জানাতে। তাদের প্রতি কত দেখেছি অবিচার, কত দেখেছি কুবিচার, কত দেখেছি নির্বিচারের দু্ঃসহ সুবিচার। তাই আমার কারবার শুধু এদের নিয়ে"।

সময়ের প্রেক্ষিতে মানুষের রুচি, জীবনবোধ, জীবনদর্শন পালটে যায়। কিন্তু মানুষের প্রতি মানুষের শোষণ, অবিচার, লাঞ্ছনা, উৎপীড়ন আজ ও চলেছে একই ভাবে। হয়তো ধরনটা শুধুমাত্র বদলেছে। সুতরাং শরৎ সাহিত্যের প্রাসঙ্গিকতা আজকের সময়েও সমান ভাবে প্রাসঙ্গিক।

তথ্যসূত্র--(১) শরৎচন্দ্র: শ্রী গোপাল চন্দ্র রায় (তিনখণ্ড) (২) বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত ডঃ অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়(১--৬খণ্ড)/ (৩) শরৎচেতনা: শ্যামসুন্দর বন্দ্যোপাধ্যায় (৪) শরৎ রচনাবলী

(৫) শরৎচন্দ্র: পুনর্বিচার,কালের প্রতিমা, বাংলা উপন্যাসের পঁচাত্তর বছর:  ডঃ অরুণ কুমার মুখোপাধ্যায় (১৯২৩--১৯৯৭)

 

ডঃ সুবীর মণ্ডল
লোক গবেষক, প্রাবন্ধিক ও ছোট গল্পের এবং ভ্রমণের লেখক, বাঁকুড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top