সিডনী বুধবার, ১লা মে ২০২৪, ১৮ই বৈশাখ ১৪৩১

শ্রদ্ধা ভালবাসা কর্মে নজরুল- বঙ্গবন্ধু : ড. আফরোজা পারভীন


প্রকাশিত:
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২৩:৪৫

আপডেট:
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২৩:৪৯

 

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের কবিতার ভক্ত ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর কবিতার দীর্ঘ দীর্ঘ চরণ বঙ্গবন্ধুর মুখস্থ ছিল। মাঝে মাঝেই আওড়াতেন। কবি ১৯৪২ সালে অসুস্থ হবার পর কলকাতাতে চিকিৎসাধীন ছিলেন মূক অবস্থায়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কবিকে ভীষণ ভালবাসতেন। পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন। ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি মন্ত্রিপরিষদের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত, রণসঙ্গীত নির্ধারিত করা হয়। এ সময়ই কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘চল্ চল্ চল্ ঊর্ধ্ব গগণে বাজে মাদল’ গানটিকে রণসঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করা হয়। কাজী নজরুল ইসলামকে ‘জাতীয় কবি’ ঘোষণা করা হয়। তাঁর ভাতা অব্যাহত রাখা এবং প্রয়োজনে ঢাকায় এনে চিকিৎসা ও শুশ্রুষার ব্যবস্থা করার সিদ্ধান্ত নেয়য়া হয়।
১৯৭২-এর মধ্য-জানুয়ারিতে এই সিদ্ধান্তের পর মাত্র চার মাসের মাথায় বঙ্গবন্ধু কাজী নজরুল ইসলামকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। কাজটা খুব সহজ ছিল না। মানুষটি বঙ্গবন্ধু না হলে নজরুলকে ঢাকায় আনা সম্ভব নাও হতে পারত। কাজী নজরুল তখন ছিলেন সম্পূর্ণ বাকরহিত, অসুস্থ । তাঁর কোনো পাসপোর্ট ছিল না; তিনি ঢাকায় এসে কোথায় ও কীভাবে থাকবেন সেটি তাঁর আত্মীয়-স্বজনরা জানতেন না। এই পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরাসরি আলোচনা করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে। বঙ্গবন্ধু প্রস্তাব দেন, ১৯৭২-এর নজরুল জয়ন্তীতে (১১ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৮০ অনুসারে ২৫ মে, ১৯৭২) কাজী নজরুল ইসলামকে তিনি বাংলাদেশে নিতে চান। ইন্দিরা গান্ধী সম্মতি দেন। এরপর বঙ্গবন্ধু বিশেষ দূত হিসেবে পূর্তমন্ত্রী মতিউর রহমান ও আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক মুস্তাফা সারওয়ারকে ভারতে পাঠান। তাঁদের হাতে ‘ হে কবি’ সম্বোধন করে একটি পত্রও প্রেরণ করেন। পত্রটি পরবর্তীতে পাওয়া যায়নি। এই পত্রটি পাওয়া গেলে সেখানে নজরুলকে বঙ্গবন্ধু কী লিখেছিলেন, তা জানা যেত। সে সময় দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার ছিলেন শিক্ষাবিদ ড. এ. আর. মল্লিক। তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রী শরণ সিঙের সঙ্গে এ বিষয়ে সাক্ষাৎ করেন। পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের নাতি সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় বঙ্গবন্ধুর অভিপ্রায়ের কথা শুনে সানন্দে সহযোগিতা ও অনুমোদনের হাত বাড়িয়ে দেন। আর সে কারণেই মাত্র দুদিনের মধ্যে আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে কাজী নজরুল ইসলামকে ঢাকায় আনা সম্ভবপর হয়। সেই ঐতিহাসিক দিনটি ছিল ১৯৭২ সালের ২৪ মে।
কাজী নজরুল ইসলামকে স্বাগত জানাতে সেদিন বিমানবন্দরে মানুষের ঢল নেমেছিল। অধ্যাপক কবীর চৌধুরী লিখেছেন: ‘বিপুল জনসমাবেশের কারণে নজরুলকে বিমানের পেছন দিকের দরজা দিয়ে বের করে একটি এম্বুলেন্সে তুলে অন্য পথে ধানমন্ডিতে আনা হয়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার ২৮ নম্বর সড়কের (পুরাতন) ৩৩০-বি সরকারি দোতলা বাড়িটি আগেই সাজানো হয়েছিল এবং সেই বাড়িতেই কলকাতা থেকে আগত কাজী নজরুল ইসলাম, সঙ্গে আসা সস্ত্রীক দুই পুত্র কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধ আর কবির দুই পৌত্রী খিলখির কাজী ও মিষ্টি কাজী ওঠেন। নজরুল এ বাড়িতে পৌঁছার পরই প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী সাদওে গ্রহণ করার জন্য পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন তাঁর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব।’ বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে নজরুলের জন্য মাসিক এক হাজার টাকা ভাতা প্রদান ও কবির চিকিৎসার জন্য মেডিক্যাল বোর্ড গঠনের ঘোষণা দেয়া হয়। ধানমন্ডির এই বাড়িটির ‘কবি ভবন’ নামটি বঙ্গবন্ধুরই দেয়া। তাঁরই অভিপ্রায় অনুসারে কবিকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় রাখা হয় এবং কবি ভবনে প্রতি দিন জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। পর দিন ২৫ মে প্রবল বর্ষণ উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধু আবার কবি ভবনে যান। সাথে ছিলেন বেগম মুজিব ও তাঁদের দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। বঙ্গবন্ধু ধানমন্ডির বাড়ির বুকশেলফ থেকে বের করেন নজরুলের কাব্যগ্রন্থ ‘সঞ্চিতা’। আবৃত্তি করেন ‘বিদ্রোহী’ কবিতা। মহাবিদ্রোহী রণক্লান্ত আমি সেইদিন হবো শান্ত, আবৃত্তি করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসেন। তাঁর বাড়ি থেকে ২৮ নম্বর কবির বাড়ি যাওয়া পর্যন্ত আওড়ান এ কবিতার চরণ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কবির সাক্ষাতের সময়টা ছিল বেশ হৃদয়স্পর্শী। যেন দীর্ঘদিনের অপেক্ষার অবসান ঘটলো। বঙ্গবন্ধু গেট ঠেলে ঢুকলেন। কবিকে যেখানে রাখা হয়েছে সে কক্ষে গিয়ে পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে পরিয়ে দিলেন ফুলের মালা। কবির মাথা ও শরীরে হাত বুলিয়ে দেন। কবি নির্বাক চোখ মেলে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন বঙ্গবন্ধুর দিকে। হাত বাড়িয়ে বিড় বিড় করে কি যেন বললেন। কিন্তু কি বললেন বোঝা গেল না। দুর্বোধ্য ছিল সেসব কথা। বেগম মুজিবও নিজের হাতে তুলে দেন অতি যত্নে গাথা ফুলের তোড়া। কবিকে জন্মদিনের শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করেন।
১৯৭২ সালে নজরুল জয়ন্তী উপলক্ষ্যে দেওয়া এক বাণীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উল্লেখ বলেন, ‘সাম্রাজ্যবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে নজরুলের অগ্নি-মন্ত্র বাঙালি জাতির চিত্তে জাগিয়েছিল মরণজয়ী প্রেরণা- আত্মশক্তিতে উদ্বুদ্ধ হওয়ার সুকঠিন সংকল্প। শুধু বিদ্রোহ ও সংগ্রামের ক্ষেত্রেই নয়, শান্তি ও প্রেমের নিকুঞ্জেও কবি বাংলার অমৃতকণ্ঠ বুলবুল। দুঃখের বিষয়, বাংলা ভাষার এই বিস্ময়কর প্রতিভার অবদান সম্বন্ধে তেমন কোনো আলোচনাই হলো না। বাংলার নিভৃত অঞ্চলে কবির বিস্মৃত-প্রায় যে-সব অমূল্য রত্ন ছড়িয়ে আছে তার পুনরুদ্ধারের যে কোন প্রচেষ্টাই প্রশংসার যোগ্য।’
বাণীতে বঙ্গবন্ধু কবির সৃষ্টি পুনর্মূল্যায়নের দায়িত্ব নিতে বাংলাদেশের বিদগ্ধ সমাজকে আহ্বান জানান। তিনি আরও বলেন, ‘নজরুল একাডেমী কাজে অগ্রণী হয়েছে জেনে আস্বস্ত হওয়া গেছে। নজরুল জন্ম দিবসের উৎসবে মিলিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই কাজে বিদগ্ধ সমাজ আত্মনিয়োগ করবে বলে আশা রাখি।’
বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টিতে নজরুল ছিলেন: ‘কবি নজরুল বাংলার বিদ্রোহী আত্মার, বাঙালির স্বাধীন সত্তার রূপকার।’ পবিত্র মাটিতে স্বাধীনতা সংগ্রামের চারণ কবি বিদ্রোহী কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম দিবস পালিত হচ্ছে সেটিকে আনন্দ ও গর্বের বিষয় উল্লেখ করেন বঙ্গবন্ধু।
একই বছর চট্টগ্রাম এডুকেশন সোসাইটি প্রতিষ্ঠা উপলক্ষ্যে অভিভাষণে তিনি বলেন, ‘ভারত যে আজ পরাধীন এবং আজো যে স্বাধীনতার পথে তার যাত্রা শুরু হয়নি- শুধু আয়োজনেরই ঘটা হচ্ছে এবং ঘটাও ভাঙছে- তার একমাত্র কারণ আমাদের হিন্দু-মুসলমানের পরস্পরের প্রতি হিংসা ও অশ্রদ্ধা। আমরা মুসলমানেরা আমাদেরই প্রতিবেশী হিন্দুর উন্নতি দেখে হিংসা করি, আর হিন্দুরা আমাদের অবনত দেখে আমাদের অশ্রদ্ধা করে।’
জন্মদিনে দেয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণের একাংশ, ‘বাংলা ভাষার এই বিস্ময়কর প্রতিভার অবদান সম্বন্ধে তেমন কোনো আলোচনাই হলো না’- বঙ্গবন্ধুর এই পর্যবেক্ষণ সঠিক ছিল। এরপর বঙ্গবন্ধুর মনোভাব, তিনি কি চান বুঝতে পেরে নজরুলের চিকিৎসার পাশাপাশি তাঁর সাহিত্যগবেষণা ও তাঁকে সম্মাননার ব্যাপারটিতে জোর দেয় সরকার। সরকারি অর্থায়নে বাংলা একাডেমি থেকে নজরুল-রচনাবলি প্রকাশ হতে থাকে। ১৯৭৪ সালের শহিদ দিবস স্মরণে ১৯ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত বাংলা একাডেমির সভায় নজরুল প্রধান অতিথির আসনে মঞ্চে বসেন। বাংলা একাডেমিতে নজরুলের কোনো অনুষ্ঠানে আগমন ও অংশগ্রহণ এটিই প্রথম এবং একমাত্র দৃষ্টান্ত। ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর সমাবর্তনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নজরুলকে সম্মানসূচক ডি. লিট. ডিগ্রি প্রদান করে। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বঙ্গভবনে বিশেষ সম্মাননা অনুষ্ঠান করে নজরুলের হাতে সেই ডিগ্রি তুলে দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য রাষ্ট্রপতি মাহমুদ উল্লাহ। এই সিদ্ধান্ত যে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অনুমোদিত, তা বলাই অপেক্ষা রাখে না। ধানমন্ডির ‘কবি ভবন’ নামের বাড়িটিই পরে ‘নজরুল ইন্সটিটিউট’, আরো পরে ‘কবি নজরুল ইন্সটিটিউট’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানে নজরুল বিষয়ক গবেষণা হয়ে থাকে।
বয়সে বঙ্গবন্ধু নজরুলের চেয়ে একুশ বছরের ছোট ছিলেন। বয়সের এই ব্যবধান সত্ত্বেও দুই বাঙালির চিন্তায় ছিল আশ্চর্যরকম মিল। দুজনেরই আকাঙ্ক্ষা ছিল বাঙালির স্বাধীনতা এবং সর্বস্তরের মানুষের মুক্তি । বলা চলে, বয়সের কারণে নজরুল ইসলাম আগে যা চিন্তা করেছিলেন, বঙ্গবন্ধু সে চিন্তার ধারাবাহিকতা এনেছেন, বাঙালিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তারই ফলশ্রুতি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ এবং ১৯৭২ সালের ঐতিহাসিক সংবিধান। বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টিতে নজরুল ছিলেন আদর্শ মানুষ, ধ্রুবতারার মতো।
কাজী নজরুলের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর কবে প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল, জানা যায়নি। নজরুল ফরিদপুরে প্রথম যান ১৯২৫ সালের ১ মে। এরপর ১৯২৬, ১৯৩৬, ১৯৩৮ সালে নজরুল ফরিদপুরে গিয়েছেন। এর অন্যান্য কারণের সাথে ছিল রাজেন্দ্র কলেজের ছাত্রদের নজরুল-সংবর্ধনায় যোগদান। শেখ মুজিব এ সময় রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে যোগদান করেননি। ১৯৪০ সালে বঙ্গবন্ধু নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগদান করেন। বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ‘সওগাত’, ‘ মোহাম্মদী’, ‘আজাদ’ পত্রিকা রাখা হতো। কাজী নজরুলের রচনা ও তাঁর সম্পর্কে নানা তথ্য ও পরিচয় কিশোর বয়স থেকেই বঙ্গবন্ধু পেয়ে থাকবেন এসব পত্রিকার মাধ্যমে। ১৯৪১ সালের কোনো একদিন কাজী নজরুলের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাতের প্রামাণিক তথ্য পাওয়া যায় ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে। সে সাক্ষাৎটি হয়েছিল ফরিদপুরে; ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলন উপলক্ষ্যে। ঐ সম্মেলনে কাজী নজরুল ইসলাম, হুমায়ুন কবির, ইব্রাহিম খাঁর মতো সাহিত্যিক ব্যক্তিত্ব উপস্থিত ছিলেন। সরকারের ১৪৪ ধারা জারির কারণে প্রকাশ্যসভা হতে পারেনি সেদিন। কিন্তু ঘরোয়া সভায় কাজী নজরুল ইসলাম গান শুনিয়েছিলেন; শিক্ষা ও ছাত্রদের কর্তব্য সম্পর্কে বক্তব্যও দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন: ‘একটা ঘটনার দিন-তারিখ আমার মনে নাই, ১৯৪১ সালের মধ্যে হবে, ফরিদপুর ছাত্রলীগের জেলা কনফারেন্স, শিক্ষাবিদের আমন্ত্রণ জানান হয়েছে। তাঁরা হলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম, হুমায়ুন কবির, ইব্রাহিম খাঁ সাহেব। সে সভা আমাদের করতে দিল না, ১৪৪ ধারা জারি করল। কনফারেন্স করলাম হুমায়ুন কবির সাহেবের বাড়িতে। কাজী নজরুল ইসলাম সাহেব গান শোনালেন। আমরা বললাম, এই কনফারেন্সে রাজনীতি আলোচনা হবে না। শিক্ষা ও ছাত্রদের কর্তব্য সম্বন্ধে বক্তৃতা হবে।’
কাজী নজরুলের সেই বক্তৃতা ও গানে বঙ্গবন্ধুও ছাত্রাবস্থায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তাই তাঁর আত্মজীবনীতে আমরা পাই নজরুলকে। এর আগেই পূর্ব বাংলার তরুণদের কাছে তাঁর কবিতা আর আপসহীন বক্তব্যে নজরুল আদর্শ ও কর্মনিষ্ঠতার প্রতীকে পরিণত হয়েছেন। যে কারণে তিনি আমন্ত্রিত হয়ে বারবার পূর্ব বাংলায় এসেছেন।
১৯১৪ সালে, পনেরো বছর বয়সে নজরুল এসেছিলেন ময়মনসিংহের দরিরামপুরে। এরপর তিনি ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, কুমিল্লা, ফরিদপুর, পাবনা, কুষ্টিয়া, বগুড়া, সিলেট, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুরসহ আরো কিছু জায়গায় একাধিকবার এসেছেন। এসব জায়গায় তিনি লিখিত ও তাৎক্ষণিক অনেক বক্তৃতা দিয়েছেন এবং যুবসমাজকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। এই বক্তৃতার অনেকগুলোই এখন পাওয়া যায় না। সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে গেছে। এর মধ্যে কিছু পাওয়া যায়। ১৯২৯ সালে নজরুল চট্টগ্রামের বুলবুল সোসাইটিকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘ভয়ে-নির্ভীক, আনন্দে-শান্ত তারুণ্যই তিনি কামনা করেন।’
তিনি ছিলেন মানবতার কবি, সাম্যের কবি, অসাম্প্রদায়িক চেতনার কবি, জগরণের কবি। বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি বিনির্মাণে তাঁর সৃষ্টিকর্ম সবসময় আমাদের প্রেরণার উৎস।
সদা প্রাণোচ্ছল কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলার সব জায়গা একসময় চষে বেড়িয়েছেন। তিনি বিদ্রোহের গান গেয়ে মানুষের মুখে ভাষা ফুঁটিয়ে জাগিয়ে তুলেছেন ঘুমন্ত বাঙালিকে।
১৯৩২ সালে সিরাজগঞ্জে বঙ্গীয় মুসলিম তরুণ সম্মেলনে নজরুল বলেছিলেন, ‘ধর্মের পরিচয়ে নয়, কর্মে পরিচয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, যৌবশক্তিতে বলীয়ান হয়ে এগিয়ে যেতে হবে।’ ১৯৩৩ সালে ফরিদপুর মুসলিম ছাত্র সম্মিলনীতে বলেন, ‘শত বিধি-নিষেধের অনাচারের শিকলে বন্দিনী এই পৃথিবী মুক্তির আশায় ফরিয়াদ করছে যুবকদের প্রাণের দরবারে। মুক্তিকামী পৃথিবীর সেই আর্জি কি বিফল হবে?’
এভাবেই প্রতি বক্তৃতায় যুবশক্তিকে, বিশেষ করে মুসলিম যুবসমাজকে কাজী নজরুল ইসলাম ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বাধীনতার জন্য আত্মোৎসর্গে আহ্বান জানিয়েছেন। পূর্ব বাংলা ছাড়াও, কলকাতা বা পশ্চিম বাংলার নানা সভাতে নজরুল ইসলাম যে বক্তৃতা দিতেন তা তরুণদের কাছে ছিল আকর্ষণীয়।
নজরুল বঙ্গবন্ধু দুজনই দেশমুক্তির কথা ভাবতেন, মানব কল্যাণের কথা ভাবতেন অথচ অত্যন্ত পরিতাপের কথা এটাই যে, একই সঙ্গে একই সভায় দুজনের অংশগ্রহণ করা সম্ভবপর হয়নি। কারণ, ১৯৪২ সালের মাঝামাঝি গোপালগঞ্জ থেকে এন্ট্রান্স পাস করে কলকাতার ওয়েলেসলি পাড়ার ‘ইসলামিয়া কলেজে’ যুবক শেখ মুজিবুর রহমান যখন ভর্তি হন, তার কিছু দিনের মধ্যেই অর্থাৎ ১৯৪২ সালের জুলাই মাসে নজরুল দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। নজরুল যদি সে সময় ব্যাধিগ্রস্ত না হয়ে পড়তেন, তাহলে নজরুল ও শেখ মুজিব একসাথে কাজ করার সুযোগ পেতেন। দুজনের কাজের একটি চমৎকার যুগলবন্দি হয়তো বাঙালির সামনে ইতিহাস হয়ে থাকতো।
নজরুলের সাহিত্য বিষয়ে বরাবরই অত্যন্ত উচ্চধারণা পোষণ করতেন বঙ্গবন্ধু। তাই নিজের বুকের মাঝে লালন করতেন সে কবিতা। ১৯৫৩ সালের একটি ঘটনার উল্লেখ আছে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে । যেখানে তিনি লিখেছেন নজরুলের একাধিক কবিতা তাঁর মুখস্থ থাকার কথা। হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দির সঙ্গে করাচিমুখো যাত্রাকালে মোটরগাড়িতে কয়েকজন পাকিস্তানি আইনজীবীকে বঙ্গবন্ধু নজরুলের ‘ চোর-ডাকাত’, ‘নারী’, ‘সাম্য’ কবিতা মুখস্থ শুনিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘আমার কাছে তাঁরা (পাকিস্তানি আইনজীবীরা) নজরুল ইসলামের কবিতা শুনতে চাইলেন। আমি তাঁদের ‘কে বলে তোমায় ডাকাত বন্ধু’, ‘নারী’, ‘সাম্য’- আরও কয়েকটা কবিতার কিছু কিছু অংশ শুনালাম।’
নজরুল সেদিন যে কবিতাগুলো মুখস্থ আবৃত্তি শুনিয়েছিলেন সেগুলোতে চোর-ডাকাতসহ মেহনতি মানুষের স্বার্থ ও অধিকারের কথা বলা হয়েছে। নারীর সমানাধিকারের উল্লেখ আছে। সাম্য প্রতিষ্ঠার কথা আছে। অর্থাৎ নজরুলের বিদ্রোহীসত্তা, সাধারণ মানুষের স্বার্থের প্রতি পক্ষপাতহীন মনোভাব, নারী-অধিকারের প্রশ্নে সোচ্চার অবস্থান বঙ্গবন্ধুকে আকৃষ্ট করেছিল। এটি তিনি মনে মনে ধারণ করেছিলেন। তাই, স্বাধীন বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধানের মূলনীতিতেই উল্লিখিত বিষয়গুলোকে তিনি স্থান দিয়েছিলেন।
১৯৫৩ সালে বঙ্গবন্ধু যখন করাচিতে, তখন ঢাকায় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় দপ্তরে (১৫০ মোগলটুলি) ২৩শে মে ‘নজরুল দিবস’ পালনের আয়োজন করে। এই আয়োজনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি প্রবন্ধ উপস্থাপনের কথা ছিল। তিনি করাচিতে থাকায় তা পাঠ করেন ছাত্রনেতা মোশাররফ হোসেন চৌধুরী। ‘ইত্তেফাক’-এ সংবাদ বের হয়েছিল এভাবে: ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমান করাচিতে থাকায় তাঁর প্রেরিত প্রবন্ধ পাঠ করেন মোশাররফ হোসেন চৌধুরী। এ প্রবন্ধের উপসংহারে বর্তমান শোণিতলোলুপ জগতের অত্যাচার ও অবিচারের বন্যা রোধের জন্য কবির বৈপ্লবিক জীবনাদর্শ ছাত্র, যুবক ও জনগণের কতখানি প্রয়োজন আছে তা অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় ব্যাখ্যা করা হয়।’
বঙ্গবন্ধুর এই প্রবন্ধটি আজ আর পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলে কাজী নজরুল সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশটি স্পষ্টতর হতো। ১৯৫৪ সালে একবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নজরুলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। এই সাক্ষাৎ একেবারেই হৃদয়ের টানে। নজরুলকে তিনি মন দিয়ে উপলব্ধি করতেন বলেই এই সাক্ষাৎ করেছিলেন। কলকাতার তৎকালীন পাকিস্তান ডেপুটি হাই কমিশন অফিসের কর্মকর্তা আসাদুল হক লিখেছেন, যুক্তফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান সরকারি কাজে কলকাতায় গিয়ে কাজী নজরুলের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে ডেপুটি হাইকমিশনার তাঁর প্রেস-এটাচির সঙ্গে আসাদুল হককেও পাঠিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুকে কাজী নজরুলের বাড়িতে নিয়ে যাবার জন্য। তখন কাজী নজরুল ইসলাম থাকতেন টালা পার্কের পাশে মন্মথ দত্ত রোডের দোতলা ফ্ল্যাটে। একগুচ্ছ রজনীগন্ধা ও মিষ্টির প্যাকেটসহ বঙ্গবন্ধু সেবার কবির ফ্ল্যাটে গিয়েছিলেন। বোঝাই যাচ্ছে, নজরুলের প্রতি বঙ্গবন্ধু ছিলেন বিশেষভাবে অনুরক্ত।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন ভয়হীন । তিনি পাকিস্তানিদের উদ্দেশে দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন, ‘ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলবো, ‘আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা।’ মৃত্যুর ভয় তিনি করেন না। বাঙালি বলে গর্ব কাজী নজরুলের মধ্যেও ছিল। ১৯৪২ সালে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ ‘বাঙালির বাঙলা’য় ব্রিটিশশাসিত অবিভক্ত ভারতের মাটিতে নজরুল গর্ব প্রকাশ করেছেন নিজে বাঙালি বলে; বলেছেন: ‘বাঙালিকে, বাঙালির ছেলেমেয়েকে ছেলেবেলা থেকে শুধু এই এক মন্ত্র শেখাও: এই পবিত্র বাংলাদেশ বাঙালির- আমাদের।’ সব শেষে তিনি উচ্চারণ করেছেন: ‘বাঙলা বাঙালির হোক! বাঙলার জয় হোক! বাঙালির জয় হোক!’
তখনো মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হয়নি- ১৯৭১ সালের ৪ জানুয়ারিতে ছাত্রলীগের ২৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। এই সভায় পাকিস্তান সরকারের বঙ্গবন্ধু কাজী নজরুল ইসলামকে খন্ডিত করে উপস্থাপনের অপপ্রয়াসের সমালোচনা ও প্রতিবাদ করেন। তিনি তাঁর বক্তৃতায় উল্লেখ করেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ও কাজী নজরুলকে বাদ দিয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের কথা ভাবা যায় না। কিন্তু এর উপর বারবার হামলা এসেছে। ভেবে অবাক হতে হয় কাজী নজরুলের কবিতার শব্দ পরিবর্তন করা হয়েছে। গানের শব্দ বদল করে রেডিওতে গাওয়া হয়েছে। তারা মুসলমানী করিয়েছেন। এ অধিকার তাদের কে দিলো?’
স্মর্তব্য. কাজী নজরুল ইসলামের রচনায় ইসলামি শব্দ অনুপ্রবেশ করিয়ে তাঁকে ‘খাঁটি মুসলমান’ কবি বানাবার একটি অপচেষ্টা পাকিস্তান আমলে চালানো হয়েছিল। এই বক্তৃতার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু তারই প্রতিবাদ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কারাগারে অন্তরীণ রেখে পাকিস্তানিরা ভেবেছিল যুদ্ধের পরিসমাপ্তি করা যাবে। কিন্তু যে জাদুকরী নেতৃত্ব ছিল বঙ্গবন্ধুর, কারান্তরালে থাকলেও তাঁর অপ্রত্যক্ষ নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। তাই বঙ্গবন্ধুর প্রিয় কবি নজরুলের কবিতা ও গান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির সহায় হয়।
পাকিস্তান সরকার মুক্তিযুদ্ধকালে কাজী নজরুল ইসলামের নামে ভাতা বন্ধ করে দেয়। এটা ছিল চরম অমানবিক। সে সময় প্রবাসী সরকারের পক্ষ থেকে নজরুল ইসলামকে সমহারে ভাতা প্রদান করা অব্যাহত রাখা হয়- যা ছিল বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক শিক্ষার প্রতিফল। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। কবি নজরুল ইসলাম বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যবিভাগের তৎকালীন মহাপরিচালক ডা. মেজর এ চৌধুরী নজরুলকে কবি ভবনে দেখতে যান। তাঁরই পরামর্শে সার্বক্ষণিক চিকিৎসা তত্ত্বাবধানের জন্য তৎকালীন পিজি হাসপাতাল, আজকের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের ১১৭ নম্বর কেবিনে কবি নজরুলকে ভর্তি করা হয়। প্রফেসর ডা. নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে গঠিত মেডিক্যাল বোর্ডের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা চলতে থাকে- বঙ্গবন্ধু চিকিৎসার খোঁজখবর নেন।
এরই মধ্যে ঘটে ১৯৭৫-এর সর্বনাশা ১৫ আগস্ট! জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আত্মীয়-পরিজনসহ শাহদাত বরণ করেন। এ কারণে নজরুলের চিকিৎসায় পড়ে ঘাটতি আর অমনোযোগ। যে কারণে হাসপাতাল থেকে কবিভবনে আর ফেরা হয়নি নজরুলের। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট (১২ ভাদ্র, ১৩৮৩) তিনি লোকান্তরিত হন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরে এবং নজরুলের মৃত্যুর আগে অসুস্থ নজরুলের উপর চলে বেশ জবরদস্তি। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী এ প্রসঙ্গে লেখেন: ‘আমার (গাফ্ফার চৌধুরী) মনে পড়ে, জিয়াউর রহমানের আমলে কবি নজরুল ইসলামের (তখনো তিনি বেঁচে ছিলেন) জন্মদিনের অনুষ্ঠানের ছবিতে দেখানো হয়েছিল, অপ্রকৃতিস্থ কবির মাথায় টুপি পরানো হচ্ছে। তথাকথিত ধর্মীয় কালচারের এই প্রহসনটি এখন আমাদের জাতীয় জীবনের সর্বত্র ব্যাপ্তিলাভ করেছে।’
১৯৭৫-এর আগস্টে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আর বেশিদিন বাঁচেননি নজরুল। পরের বছর ওই আগস্টেই যেন অভিমান করে চিরতরে দূরে চলে যান চির অভিমানী কবি কাজী নজরুল ইসলাম! তাঁদের আপাত মৃত্যু ঘটেছে, তবে কর্ম অম্লান।

সহায়ক গ্রন্থ:
১. অশোক কুমার মিত্র : নজরুল প্রতিভা পরিচিতি, ১৯৬৯, ঢাকা। ২. আবদুল কাদির : নজরুল প্রতিভার স্বরূপ, (শাহাবুদ্দীন আহমদ সম্পাদিত), ১৯৮৯।
৩. শেখ দরবার আলম : অজানা নজরুল, ১৯৮৯, ঢাকা।

 

আফরোজা পারভীন
কথাসাহিত্যিক, প্রবন্ধকার, গবেষক,  কলামলেখক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top