সিডনী শনিবার, ২৭শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১

নারী কি শুধুই রমণী? : ড. শাহনাজ পারভীন


প্রকাশিত:
৬ অক্টোবর ২০২০ ২১:৩০

আপডেট:
২৭ এপ্রিল ২০২৪ ১৪:২৬

ছবিঃ শাহনাজ পারভীন

 

একজন নারী আসলে কি? এ নিয়ে সমাজে ব্যাপক মতদ্বন্দ্বিতা আছে। নারী, রমণী নাকি মহিলা? নাকি একই সাথে আরো কিছু? আরো কিছু বলতে জীবনের প্রতিটি ধাপে ধাপে নিজস্ব নাম এবং দায়িত্বে তার রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।‘রমণ‘ এবং ‘মহল’ছেড়ে তারা আজ দিনে দিনে মানবের পরিপূর্ণ সত্ত্বায় পরিস্ফুটিত ‘নারী’ হয়ে উঠেছেন অর্থাৎ ‘রমণী’ ও ‘মহিলা’র আদি অর্থ ছাড়াও দিনে দিনে তারা পৃথিবীর অনিবার্য বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন পরিপূর্ণ মানবসত্তাসম্পন্ন ‘নারী’ হয়ে উঠেছেনআমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ পৃথিবীর অগণিত পনিস্ফুটিত মানবীই তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এতকিছু সত্ত্বেও প্রথমেই আমি যদি তাদেরকে মানুষ হিসেবে দেখতে চাই তো দেখি, সেখানে একজন মানুষের যে যে বৈশিষ্ট্য আছে একজন নারীরও তাই। তারও দুটো হাত, দুটো পা, এক জোড়া চোখ একটি হৃদয় এবং মানবিক অনুভূতি তারও আছে। যতটা না আছে একজন পুরুষের তার চেয়ে বেশি কিছু নারীর। নারীর মেধা, মনন পুরুষেরই মতো। কখনো কখনো তারও চেয়ে কিছু বেশি। কিন্তু প্রেক্ষাপট কি পাল্টে গেল? কথায় কথায় মেয়েদের ধর্ষণ, অবমাননা, অবহেলা, অসম্মান, বঞ্চনা সব মিলিয়ে আজ এক অসহায় দিন যাপন করছে। সংখ্যালঘু, সংখ্যাগুরু, শিক্ষিত অশিক্ষত, ধনী, গরীব, ছাত্রী, শিক্ষিকা সবাই আজ এর শিকার। দিনে, রাতে, ঘরে, বাইরে, একা, স্বামীর সঙ্গে কোথাও সে যেন আজ নিরাপদ নয়। সিলেটের এমসি কলেজের ঘটনায় আমরা খুবই মুষড়ে পড়েছি। স্বামীর সঙ্গে নবপরিণীতারও নিরাপত্তার এতটা অভাব?
অথচ এতদিন আমরা জেনে এসেছি 
’রাজা করিছে রাজ্য শাসন, রাজারে শাসিছে নারী’
এ থেকেই বুঝতে পারি। অবশ্যই রাজার চেয়ে রানীর মনন ক্ষমতা বেশি। তা না হলে তো সে রাজাকে শাসন করতে পারতেন না। শুধু রাজা আর রাজ্য কেন, প্রতিটি ঘরের হিসেব থেকেই বুঝতে পারি, সংসারের দায় দায়িত্ব নারীই বহন করেন নিপুণ হাতে। সংসারের দায়িত্ব কাঁধে নেবার আগে সে বাবা মায়ের বড় আদরের সন্তান হিসেবেই বেড়ে ওঠেন। একজন ছেলে সন্তানের মতোই আদর আর স্নেহে, অনেক গোছানো অনেক মানবিক হয়ে বেড়ে ওঠেন একজন মেয়ে সন্তান।
তারপর সে যখন বিয়ের পর শ্বশুর বাড়িতে যায়, তখন সে দশভূজা হয়ে নতুন সংসারের সবাইকে আপন করতে প্রাণপন চেষ্টা করে, যেখানে একজন ছেলে সন্তান মাঝে মাঝে শ্বশুর বাড়িতে জামাই আদরে থেকে আসে কয়েক দিন। তাকে কিছুই ছাড়তে হয় না। না নিজের ঘর, নিজের পরিবেশ নিজের বাড়ির আঙিনা। একজন মেয়েকে সব ছেড়ে আসতে হয়। তার নিজস্ব সব, সবকিছু। মা, বাবা, ভাই, বোন, ঘর-দোর, বিছানা-বালিশ, গোলাপ-বাগান, চায়ের-কাপ, আঙিনা, নিজস্ব আকাশ। পুরো শেকড় উপড়িয়ে নতুন শেকড় গজাতে হয় প্লেটের বনসাইয়ের মতো। ঝুরি নামাতে হয় সাবধানে। তাকে আহত হতে হয়, রক্ত ঝরাতে হয় হৃদয়ে অহর্নিশ। তারপর সার্বক্ষনিক উত্তরণের মাধ্যমে একজন হয়ে উঠতে হয়।
এই হচ্ছে নারী। পারিবারিক যাবতীয় চাহিদা মিটিয়ে, স্বামী, সন্তান, সংসার গুছিয়ে বাইরের জগতে সে যখন পা রাখেন, তখন মেধা, মননে সে নিশ্চিতই অনন্য সেটা প্রমাণ করেন। কিন্তু এতকিছুর পরও তাকে সর্বক্ষেত্রেই অবদমিত রাখা হয়। অফিসের বস যদিও তার থেকে কোনও ভাবেই মেধাবী কিংবা বেশি মননশীল নন, তবুও একমাত্র মেয়েমানুষ বলে তাকে দমিয়ে রাখতে সারাক্ষণই বদ্ধ পরিকর থাকেন। যখন তার সাথে মেধায় মননে হেরে যান তখন তার শাড়ির আঁচল টানতে চান। কারণ এই একটি জায়গায় রয়েছে মেয়েদের অবদমন করবার সমূহ অপকৌশল।

বাড়ির নিজস্ব চৌহদ্দি, অফিস প্রাঙ্গন ছাড়াও ইদানীং আমরা চলন্ত বাসেও নারীদের নিরাপত্তার অভাব দেখতে পাচ্ছি। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত বার মাসে একুশ নারীকে চলন্ত বাসে শ্লীলতাহানিসহ ধর্ষণ করা হয়েছে। চলন্ত বাস থেকে ধর্ষণ শেষে হত্যা করে ফেলে দেয়া হয়েছে। কী জঘণ্য সংবাদ! ৮ জুলাই, ২০১৯ খ্রি.এর নারী সংগঠনের তথ্যমতে, গত ছয়মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৭৩১ নারী, শিশু এবং ২৬ নারী ও শিশু হত্যা হয়েছে।

বর্তমান অবস্থায় আমাদের বাইরে বের হতে আতংকিত করে তোলে। শিক্ষিত এক একজন নারী। রূপা। এনজিওতে চাকুরিরত। তানিয়া ইবনে সীনায় নার্সের চাকুরির মাধ্যমে সমাজকে সেবা দিয়ে এসেছে দীর্ঘদিন। নুসরাত জাহান রাফি মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী। তনু ছাত্রী, সাংস্কৃতিক কর্মী। মিতু গৃহিনী। তৃষা বাচ্চা একটি মেয়ে। পরী দুধের শিশু। সাইমার মুখে এখনও দুধের গন্ধ। তবুও সে নারী! অর্থাৎ সব বয়সী মেয়ে, শিশুদেরকে অপহরণ, হেনস্তা, ধর্ষণ, হত্যার মাধ্যমে অসময়ে তাদের জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দেয়া হচ্ছে। এভাবে চলতে পারে না। এর একটা বিহিত দরকার। দরকার কঠোর আইনের। শুধু আইন হলেই হবে না। চাই বাস্তবায়ন। আর একটি মেয়েরও অসময়ে জীবন প্রদীপ যেন না নেভে তার নিশ্চয়তা চাই।
অথচ এই সমাজে একজন মাতাই পারেন তার সন্তানের জন্য দীর্ঘ ৪৪ বছর রোজা রাখতে। ঝিনাইদহের একজন মা তার হারিয়ে যাওয়া সন্তানের ফিরে আসার জন্য মানত করে দীর্ঘ বছর রোজা রাখছেন। কতটা মানবিক, কতটা মায়া থাকলে একজন মা তার সন্তানের প্রতি এইভাবে তার ভালবাসা প্রকাশ করতে পারেন। অথচ সেই মায়েদের, সেই মেয়েদের এই মৃত্যূ এই অবহেলা, এই অসম্মান চাই না। এ ব্যপারে ব্যক্তির পক্ষ থেকে, সমাজের পক্ষ থেকে, সর্বোপরি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কঠোর হস্তক্ষেপ আশা করছি।

একটি মহিলা কলেজে চাকুরির সুবাদে প্রতিদিনই আমি এমন কোন মায়ের দেখা পাই, যার স্বামী তাকে ছেড়ে সুখের আশায় চলে গেছে অন্য কোনও গৃহে। ফেলে গেছে তারই ঐরশজাত অবুঝ সন্তানদের। সেই সন্তানদের লেখাপড়া, ভরণপোষণের জন্য অন্যের বাড়ি পরিচারিকার কাজ থেকে শুরু করে সবজি বিক্রি পর্যন্ত করছেন তারা। তারপরও বুকে হেঁটে সন্তানদের মানুষ করছেন একা একা। প্রতিনিয়ত তাদের কথা শুনতে শুনতে মন গলে যায়, চোখ ভিজে ওঠে অজান্তে। শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে।

আমার সাধ্যের মধ্যে যতটুকু পারি, তাদের সাহায্য সহযোগিতা করি। স্বপ্ন দেখাই মেয়েদেরকে। মায়েদেরকে নিজের জীবনের কালো অধ্যায় সম্পর্কে সচেতন করে সন্তানদেরকে পড়াশুনা চালিয়ে নেবার পরামর্শ দেই, ব্যবস্থা করি। উপবৃত্তিসহ নানান রকম বৃত্তির ব্যবস্থা, বই যোগাড় করে দেয়া, কখনও কখনও কিনে দেওয়া থেকে শুরু করে বিনা মূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে টিউটরের ব্যবস্থা করি। তাদেরকে শেখাই সামনে অগাধ সমুদ্র। পাড়ি দিতে হবে। তাই শুধু রমণী নয়, নারী হয়ে ওঠো।

আজ দাপ্তরিক ব্যস্ত সময়ে প্রাক্তন ছাত্রী ঝরনা এলো ঝলমল করতে করতে। সে খুশি হয়ে শোনালো তার জিতে যাবার সংবাদ। তার ছাত্রী জীবনের নানান বঞ্চনার পুরো সময়টাতে পাশেই ছিলাম। সে এখন শিক্ষক। রমণী থেকে নারী হয়ে উঠেছে। কথাশেষে বললো- আমারই শেখানো কথা- আপনিই আমার জীবনের ম্যাজিক ছিলেন ম্যাডাম। তাই আমি আজ শুধু রমণী নই, একজন নারী। এভাবে প্রতিনিয়ত এইসব জিতে যাবার গল্প শুনতে শুনতে মনটা ভাল হয়ে যায়। শত বক্ষিুব্ধতার মধ্যওে ভাবতে থাকি এখন সময় শুধু ঘুরে দাঁড়াবার।

 

ড. শাহনাজ পারভীন
কবি, কথাসাহিত্যিক, উপাধ্যক্ষ, উপশহর মহিলা কলেজ, যশোর।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top