সিডনী শুক্রবার, ৩রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

দার্শনিক, সমাজ-সংস্কারক রাজা রামমোহন রায় : আহমেদ জহুর


প্রকাশিত:
৮ অক্টোবর ২০২০ ২০:৪৯

আপডেট:
৩ মে ২০২৪ ০২:৩২

ছবিঃ রাজা রামমোহন রায় 

 

ব্রাহ্ম-সমাজের প্রতিষ্ঠাতা রাজা রামমোহন রাজনীতি, জনপ্রশাসন, ধর্মীয় ও শিক্ষাক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ও অবদান রেখেছিলেন। তিনি সব চেয়ে বেশি বিখ্যাত হয়েছেন যুগ-যুগান্তরের অভিশাপ সতীদাহ প্রথা বিলুপ্ত করার প্রচেষ্টায় কার্যকর ভূমিকা রেখে। হিন্দু বিধবা নারীদের তখন স্বামীর চিতায় সহমরণে যেতে বা আত্মাহুতি দিতে বাধ্য করা হতো।

রামমোহন রায় হুগলী জেলার রাধানগর গ্রামে জন্মগ্রহণ ১৭৭২ সালের ২২ মে সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে। প্রপিতামহ কৃষ্ণকান্ত ফারুখশিয়ারের আমলে বাংলার সুবেদারের আমিনের দায়িত্ব পালন করতেন। সে সূত্রেই 'রায়' পদবীর ব্যবহার বলে অনুমান করা হয়। কৃষ্ণকান্তের কনিষ্ঠ পুত্র ব্রজবিনোদ রামমোহনের পিতামহ এবং রামকান্ত হচ্ছেন তাঁর পিতা। রামকান্তের তিন বিবাহ। মধ্যমা পত্নী তারিণীর এক কন্যা ও দুই পুত্র : জগমোহন ও রামমোহন। এঁদের বংশ ছিল বৈষ্ণব, কিন্তু রামমোহনের মাতা ছিলেন ঘোর তান্ত্রিক ঘরের কন্যা। রামকান্ত পৈতৃক এজমালি ভদ্রাসন ছেড়ে পার্শ্ববর্তী লাঙ্গুলপাড়া গ্রামে সপরিবারে উঠে যান। তাঁর পিতা রামকান্ত রায় ছিলেন বৈষ্ণবী ও মাতা তারিণী দেবী ছিলেন শাক্ত। পনেরো-ষোলো বছর বয়সে তিনি গৃহত্যাগ করে নানা স্থানে ঘোরাঘুরি করেন। কাশী ও পাটনায় কিছুকাল ছিলেন এবং পরে নেপালে গিয়েছিলেন। এর আগে তাঁর সঙ্গে তন্ত্রশাস্ত্রবেত্তা সুপণ্ডিত নন্দকুমার বিদ্যালঙ্কারের যোগাযোগ হয়। রামমোহনের সংস্কৃতে বুৎপত্তি, তাঁর বেদান্তে অনুরাগ নন্দকুমারের সহযোগিতায় হয়েছিল। ব্রাহ্ম উপাসনালয় প্রতিষ্ঠায় মূলত  হরিহরানন্দই তাঁর দক্ষিণহস্ত ছিলেন। বারানসী থেকে প্রথাগত সংস্কৃত শিক্ষার পর তিনি পাটনা থেকে আরবি ও পারসি ভাষা শেখেন। পরে তিনি ইংরেজি, গ্রিক ও হিব্রু ভাষাও শেখেন।

তরুণ বয়সে রামমোহন কলকাতায় মহাজনের কাজ করতেন। ১৭৯৬ সালে তিনি অর্থোপার্জন শুরু করেন। ১৮০৩ থেকে ১৮১৪ সাল পর্যন্ত বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী ছিলেন। কলকাতায় প্রায়ই আসতেন এবং কোম্পানির নবাগত অসামরিক কর্মচারীদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে তাদেরকে নানা ভাবে সাহায্য করতেন। এই সুযোগে তিনি ভালো করে ইংরেজি শিখে নেন। বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাজে সিভিলিয়ান কর্মচারীদের মধ্যে জন ডিগবির সঙ্গে তখন তাঁর অন্তরঙ্গ ঘনিষ্ঠতা হয়। কোম্পানির কাজে ডিগবির অধীনে তিনি দেওয়ানরূপে বাংলাদেশের রংপুরে কাজ করেন ১৮০৩ থেকে ১৮১৪ সাল পর্যন্ত। ১৮১৫ সাল থেকে রামমোহন কলকাতার স্থায়ী বাসিন্দা হন এবং সেখান থেকেই প্রকাশ্যে তাঁর সংস্কার-প্রচেষ্টার শুরু।

রামমোহন রায়ের প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ফারসি ভাষায় লেখা (ভূমিকা অংশ আরবিতে) তুহফাতুল মুহাহহিদিন। গ্রন্থে একেশ্বরবাদের জোর সমর্থন আছে। এরপর একেশ্বরবাদ (বা ব্রাহ্মবাদ) প্রতিষ্ঠা করার জন্য বেদান্ত-সূত্র এবং উপনিষদগুলি বাংলায় অনুবাদ করে তিনি প্রচার করতে থাকেন। ১৮১৫ থেকে ১৮১৯ সালের মধ্যে প্রকাশিত হয় বেদান্তগ্রন্থ, বেদান্তসার, কেনোপনিষদ, ঈশোপনিষদ, কঠোপনিষদ, মাণ্ডূক্যোপনিষদ ও মুণ্ডকোপনিষদ। রক্ষণশীল ব্যক্তিরা ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁর লেখার প্রতিবাদ করতে থাকেন। এসব প্রতিবাদ কটূক্তিপূর্ণ এবং বিদ্বেষ ভাবাপন্ন। রামমোহনও প্রতিবাদের প্রতিবাদ করেছিলেন যুক্তি দিয়ে এবং ভদ্রভাষায়। ফলে প্রতিবাদ-কর্তারা অবিলম্বে থেমে গিয়েছিলেন। বেদান্ত গ্রন্থ প্রকাশের সঙ্গে রামমোহন রায় ব্রহ্মনিষ্ঠ একেশ্বর উপাসনার পথ দেখান আত্মীয় সভা প্রতিষ্ঠা করে। এই আত্মীয় সভাকেই পরে তিনি ব্রাহ্মসমাজ নামে নতুন রূপ দান করেন।

বেদান্ত-উপনিষদগুলো বের করার সময়ই তিনি সতীদাহ অশাস্ত্রীয় এবং নীতিবিগর্হিত প্রমাণ করে পুস্তিকা লিখলেন- 'প্রবর্তক ও নিবর্তকের সম্বাদ'। প্রতিবাদে পুস্তিকা বের হল 'বিধায়ক নিষেধকের সম্বাদ'। তার প্রতিবাদে দ্বিতীয় ও তৃতীয় পুস্তিকা বের হয়। ওই বছরেই ডিসেম্বর মাসে আইন করে সহমরণ-রীতি নিষিদ্ধ করা হয়। তবুও গোঁড়ারা চেষ্টা করতে থাকে যাতে পার্লামেন্টে বিষয়টি পুনর্বিবেচিত হয়। এ চেষ্টায় বাধা দেওয়ার জন্য রামমোহন বিলেত যেতে প্রস্তুত হন। এ ব্যাপারে তাঁকে আর্থিক সহায়তা দান করেছিলেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। মোঘল সম্রাট ২য় আকবর তাঁর দাবি বৃটিশ সরকারের কাছে পেশ করার জন্য ১৮৩০ সালে রামমোহনকে বিলেত পাঠান, তিনিই রামমোহনকে 'রাজা' উপাধি দিয়েছিলেন।

১৮৩০ সালের ১৯ নভেম্বর রাজা রাম মোহন রায় কলকাতা থেকে বিলেতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।  তিনি ছিলেন আধুনিক ভারতের সমাজ সংস্কারের অন্যতম পথিকৃৎ। রামমোহন একেশ্বরবাদে বিশ্বাস করতেন। তিনি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মূর্তি পূজার ঘোর বিরোধী ছিলেন। এই বিশ্বাস থেকেই তিনি ব্রাহ্মসমাজ ও ব্রাহ্মধর্ম প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের আচরণীয় ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান মানতেন না এবং প্রকাশ্যে এর প্রতিবাদ করতেন। তিনি মনে করতেন সকল ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান কূ-সংস্কার ছাড়া কিছু নয়। রামমোহন রায় বেদের বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করে তাঁর বক্তব্যের প্রমাণ দিয়েছিলেন।

রামমোহন রায় ১৮৩১ সালে মুঘল সাম্রাজ্যের দূত হিসেবে যুক্তরাজ্য ভ্রমণ করেন এবং ওই সময়ে তিনি ফ্রান্সও সফর করেছিলেন। ১৮৩৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর মেনিনজাইটিসে আক্রান্ত হয়ে তিনি ব্রিস্টলের স্টেপল্টনে মৃত্যুবরণ করেন। ব্রিস্টলে আর্নস ভ্যাল সমাধিস্থলে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। ১৯৯৭ সালে মধ্য ব্রিস্টলে তাঁর একটি আবহ মূর্তি স্থাপন করা হয়।

 

আহমেদ জহুর
কবি, সংবাদিক ও প্রাবন্ধিক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top