সিডনী শনিবার, ২৭শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১

মহর্ষি বাল্মিকী রবীন্দ্রনাথ ও ঠাকুরবাড়ির মেয়ে প্রতিভা : ড. আফরোজা পারভীন


প্রকাশিত:
১২ অক্টোবর ২০২০ ২৩:৩৬

আপডেট:
১২ অক্টোবর ২০২০ ২৩:৪৪

ছবিঃ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 

দস্যু রত্নাকরের কথা আমরা অনেকেরই জানি। জানি দস্যুত্ব ছেড়ে বল্মিকী হয়ে যাওয়ার কথাও। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ মহর্ষি বাল্মিকীর কাহিনি অবলম্বনে ‘বাল্মিকী প্রতিভা’ নাটক রচনা করেছেন সেটাও আমাদের জানা। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না বাল্মিকীর কাহিনির নামকরণ কি করে বাল্মিকীপ্রতিভা হলো!
দস্যু রত্নাকরের গল্পটি আমরা মনে করতে পারি। রত্নাকর মহাদেবী কালীর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে একটি বালিকাকে উৎসর্গের জন্য তাঁর অনুসারীদের নির্দেশ দেন। ওই বালিকার হৃদয়ছোঁয়া আকুতি দস্যু রত্নাকরের মনকে আমূল পরিবর্তন করে। সে বালিকাকে বলির মঞ্চ থেকে মুক্তি দেয়। এ ঘটনা দস্যুর অনুসারীরা মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু মানুষের প্রতি দয়াবোধের কারণে দেবী সরস্বতী তাকে আশীর্বাদ করেন, আর রত্নাকর দস্যু থেকে মহর্ষি বাল্মীকির উদ্ভব ঘটে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মাত্র ২০ বছর বয়সে লিখেছিলেন গীতিনাট্য বাল্মীকি প্রতিভা। তিনি মহর্ষি বাল্মীকির রামায়ণ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে দুর্ধর্ষ দস্যু রত্নাকরের কথা এ নাট্যে তুলে ধরেন। গীতিনাট্য বাল্মীকি প্রতিভার প্রথম মঞ্চায়ন হয় ১৮৮১ সালে কলকাতার বিদ্যাভাজন সমাগম সম্মিলনী মঞ্চে। রবীন্দ্রনাথ নিজেই সেখানে বাল্মীকির চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। সংগীত ও নাটকের মেলবন্ধনে রচিত এ গীতিনাট্য সম্পর্কে কবির ব্যাখ্যা হলো, ‘বাল্মীকি প্রতিভা হলো গানের সুরে নাট্যের মালা।’ আর এ গানগুলোকে ভর করে রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় বেশ কয়েকবার নৃত্য আয়োজন করা হয়েছিল। তবে এটি কখনো পূর্ণাঙ্গ নৃত্যনাট্য হিসেবে মঞ্চস্থ হয়নি।
বাল্মীকির চরিত্র দস্যু রত্নাকর ও অন্যান্য দস্যুর নৃত্যের ধরন এক রকমের; দ্বিতীয়ত, বনদেবীদের নৃত্য একেবারে ভিন্ন। সরস্বতীর নৃত্য পরিবেশনার সুযোগ নিতান্ত কম। কারণ, তিনি একটি রূপক চরিত্র হিসেবে মঞ্চে আসেন এবং রত্নাকরকে আশীর্বাদ করেন। নৃত্য পরিবেশনা, আবেগ, চরিত্র রূপান্তরের পরিমিতিবোধ প্রশংসনীয়।
প্রতিভাসুন্দরী দেবী রবীন্দ্রনাথের চেয়ে মাত্র ৫ বছরের ছোট ছিলেন ।মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তৃতীয় পুত্র হেমেন্দ্রনাথের প্রথম সন্তান প্রতিভা। তিনি ছিলেন সত্যই প্রতিভাময়ী । হেমেন্দ্র নাথ ঠাকুর তাঁকে সর্বগুণে গুণান্বিত করে তোলার জন্য একেবারে উঠে পড়ে লেগেছিলেন। বাড়ির অন্যান্য শিশুদের সঙ্গে প্রতিভা ও তাঁর বোনদের কোন যোগাযোগ ছিল না। তাদের মহলের দরজা বন্ধ থাকত। বন্ধ দুয়ারের ওপারে চলত বিদ্যার সাধনা।
লোরেটোতে প্রতিভাই ছিলেন প্রথম হিন্দু ( ব্রাহ্ম) ছাত্রী । মতান্তরে তিনি ভর্তি হয়েছিলেন বেথুন স্কুলে। তখনো মেয়েদের পরীক্ষা দেবার ব্যবস্থা ছিল না । তাই হয়তো তিনি পরীক্ষা দিতে পারেননি । তবে ওপরের ক্লাস পর্যন্ত উঠেছিলেন । সবথেকে আশ্চর্যের বিষয় ছিল এই যে, প্রতিভা বা তাঁর বিদ্বান পিতা হেমেন্দ্রনাথ কেউই এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার কথা ভাবেন নি। কিন্তু তখনই বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধ দরজা খোলার চেষ্টা করেছিলেন চন্দ্রমুখী বসু।
যাই হোক, সংগীত জগতে বাঙালি মেয়েদের একটি পথ খুলে দিয়েছিলেন এই প্রতিভা। পুরনো প্রথা না মেনে হেমেন্দ্রনাথ তার স্ত্রী কন্যাকে গান শিখিয়েছিলেন । প্রতিভা চর্চা করেছিলেন দেশি-বিদেশি সংগীতের। শুধু তাই নয় চিরকালের প্রথা ভেঙে প্রতিভা তাঁর ভাইদের ব্রহ্মসংগীত গিয়েছিলেন মাঘোৎসব এর প্রকাশ্য জনসভায় ।
মেয়েকে গান শেখানোর ব্যাপারে কোন কার্পণ্য করেননি হেমেন্দ্রনাথ । নতুন নতুন নক্ষত্রের আত্মপ্রকাশ হচ্ছিল ঠাকুরবাড়ি থেকে সুধী সমাজে । বাড়ির ওস্তাদ বিষ্ণু চক্রবর্তীর কাছে তালিম নেওয়া ছাড়াও বিদেশি গান শিখতেন প্রতিভা । আরো বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র শিখেছিলেন । ১৮৮২ সালের প্রাপ্ত একটি পত্রে দেখা যায় পিতা তাঁর কন্যাকে গান সম্পর্কে উপদেশ দিচ্ছেন।
প্রতিভা তাঁর পিতার ইচ্ছা পূরণ করার জন্য মেয়েদের মধ্যে গানের ব্যাপারে অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছিলেন। চন্দ্রমুখী ও কাদম্বিনী যেমন বাঙালি মেয়েদের লেখাপড়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন, তেমনি প্রতিভা সুযোগ করে দিয়েছিলেন গান ও অভিনয় করার। এই দুঃসাহসিক নজির তার কাকিমাদের ঘোড়ায় চড়া বা বিলেতে যাওয়ার চেয়ে খুব কম সাহসের কথা নয়। তার কাকিমা পিসিমারা অভিনয় করেছিলেন ঘরোয়া আসরে । দর্শক হিসেবে যারা ছিলেন তারা সবাই আপন জন, চেনা শোনার মানুষ, লজ্জা বলতে তেমন কিছু ছিল না । সমালোচনার আশঙ্কা তো ছিলই না। সাধারণ মানুষ যারা অর্থাৎ সাধারণ মানুষের সমাজে সর্বপ্রথম এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন প্রতিভা।
ঠাকুর বাড়ির যেকোনো উৎসবে মানুষ ভেঙে পড়তো আর শুনত বাঙালি মেয়েদের গান । অবাক হয়ে যেত সম্ভ্রান্ত ভদ্রঘরের মেয়েরা আসরে বসে গান গাইছেন দেখে!
এমন সময় রবীন্দ্রনাথ ফিরলেন বিলেত থেকে। ঠাকুর বাড়িতে তখন শুরু হয়েছে গীতিনাট্য স্বর্ণযুগ । স্বর্ণকুমারী দেবী ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথের লেখা “বসন্ত উৎসব ” ও “মানময়ী” র ঘরোয়া অভিনয় হয়ে গেছে কয়েক বার । এমন সময় রবীন্দ্রনাথ দেশি বিলিতি সুর ভেঙে লিখলেন এক নতুন অপেরাধর্মী গীতিনাট্য ।
রামায়ণের সুপরিচিত রত্নাকর দস্যুর বাল্মিকীতে রূপান্তরের কাহিনীটি তিনি বেছে নিলেন । এই নাটকের তিনটি নারী চরিত্র ছিল । বালিকা, লক্ষ্মী ও সরস্বতী । নাটক লেখার পরেই যখন রিহার্সেল শুরু হল তখন রবীন্দ্রনাথ সরস্বতী ভূমিকায় প্রতিভার অপূর্ব অভিনয় দেখে নাটকের সঙ্গে প্রতিভার নামটি জুড়ে নাম দিলেন বাল্মিকীপ্রতিভা ।
এরপর স্থির হল বিদ্বজ্জন সমাগম সভায় বাল্মিকী প্রতিভা অভিনয় হবে । সে দিনটা ছিল শনিবার , ১৬ ই ফাল্গুন বাংলার ১২৮৭ সাল , বসন্ত সন্ধ্যা। বসন্তের মৃদুমন্দ দখিনা বাতাস বইছে । দর্শকরা উপস্থিত শুরু হলেন। এমন সময় শুরু হল বাল্মিকীপ্রতিভা। ডাকাতের আনাগোনা, গুরুগম্ভীর পরিবেশ । দর্শকরা মুগ্ধ । ক্রৌঞ্চমিথুনাদের জায়গায় সত্যিকারের দুটি বক। এদুটি অবশ্য জোগাড় করে এনেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর । ছোট ভাইয়ের নাটক মঞ্চস্থ হবে তাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাউৎসাহে পাখি শিকারে বেরোলেন। কিন্তু কোথায় পাখি ? সারাদিন ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে খালি হাতে ফিরছেন । এমন সময় একজনকে দেখলেন কাঁধে করে অনেকগুলো মৃত বক বাজারে বিক্রি করতে নিয়ে যেতে। তার কাছ থেকে দুটো কিনে নিয়ে এলেন।
সেকালে অনেকেই স্টেজের মধ্যে বাস্তব জগতকে টেনে আনতে চেষ্টা করতেন। কালমৃগয়া অভিনয়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর স্টেজে একটা পোষা হরিণ ছেড়ে দিয়েছিলেন । এজাতীয় মঞ্চসজ্জার সূচনা হয় বেঙ্গল থিয়েটারের পুরুবিক্রম নাটকে। ছাতুবাবুদের বাড়িতে শরচ্চন্দ্র ঘোষ পুরু সেজেছিলেন । তিনি একটা সত্যিকারের সাদা ঘোড়ার পিঠে চেপে স্টেজে আসতেন।
বাল্মীকিপ্রতিভার অভিনবত্ব হল অভিনেত্রীদের আবির্ভাব। হাত বাঁধা বালিকার ভূমিকায় সত্যিই এক অনন্য সুন্দরী বালিকা এসে বসলো। প্রতিভাকে চিনতে পারলেন অনেকেই । এই মেয়েটির মুগ্ধ করেছিলেন গান শুনিয়ে। এবারও মুগ্ধ করলেন সরস্বতীর সাজে ও অভিনয়ে। বাল্মিকীপ্রতিভা দেখে সকলে সাধু সাধু করে শেষে এক অনির্বচনীয় তৃপ্তির রেশ নিয়ে ফিরে গেলেন।
“আর্যদর্শন” কাগজে যখন এই অভিনয় সংবাদ ছাপা হলো তখন দেখা গেল সমালোচক প্রতিভার অভিনয় প্রশংসা করতে গিয়ে লিখেছেন, ” শ্রীযুক্ত বাবু হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিভা নাম্নী কন্যা প্রথমে বালিকা ও পরে সরস্বতী মূর্তিতে অপূর্ব অভিনয় করিয়াছিলেন । ” প্রতিভা বুঝি সৌভাগ্যবতী । তাই প্রথম মঞ্চ অবতরণ এর পর তাঁকে সহ্য করতে হয় নি অপমানের গ্লানি । বরং তাকে সশ্রদ্ধ স্বীকৃতির জানিয়েছিলেন কলারসিকগন। রাজকৃষ্ণ রায় “আর্যদর্শনে” লিখেছিলেন কবিতা “বালিকা প্রতিভা” নামে।
সাধারণী পত্রিকাতেও সমালোচকরা বিশেষভাবে প্রতিভার অভিনয়ের কথা লেখেন , “বঙ্গ কুল কুমারী কতৃক রঙ্গবেদী এই প্রথম উজ্জ্বলীকৃত হইল। বঙ্গ রঙ্গ ভূমির নবকলেবর এই অভিষেক ক্রিয়ার প্রতিভা উপযুক্ত অধিষ্ঠাত্রী দেবী বটেন। তিনি সুকণ্ঠা, সতেজ নয়ন এবং ধীরপদ বিক্ষেপ কারিণী। তাঁর গীতাভিনয়ে দর্শকবৃন্দের অনেকে বিস্মিত এবং প্রীত হইয়াছিলেন।
একবার ঠাকুরবাড়িতে বেশ বড় মাপের বাল্মিকীপ্রতিভা অভিনয়ের আয়োজন করা হলো ১৮৯৩ সালে, লেডি ল্যান্সডাউনের সংবর্ধনা উপলক্ষে । এর আগে এক যুগ ধরে বাল্মিকীপ্রতিভা মঞ্চাভিনয় হয়ে গিয়েছে। প্রতিবারই সরস্বতী সেজেছেন প্রতিভা এবং বাল্মিকী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । এবার আমন্ত্রণ জানানো হলো বহু গণ্যমান্য দর্শককে । মঞ্চসজ্জার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল দ্বিজেন্দ্রনাথ-এর অন্যতম পুত্র নীতিন্দ্রনাথকে। তিনি স্টেজের মধ্যে প্রাণপণ চেষ্টা করলেন ” ন্যাচারাল এফেক্ট” আনার। বারান্দা থেকে টিনের নল লাগিয়ে বৃষ্টির জল পড়ার ব্যবস্থা করলেন । দর্শকরা বড় খুশি হলেন।
এবার হাত বাধা বালিকা সাজলেন প্রতিভার সেজোবোন অভিজ্ঞা, লক্ষীর ভূমিকায় সত্যেন্দ্র দুহিতা ইন্দিরা, সরস্বতী ভূমিকায় প্রতিভা। সাদা শোলার পদ্ম ফুলের সাজে প্রতিভা যখন অস্ট্রিচ পাখির ডিমের খোলা দিয়ে তৈরি বীণা হাতে নিয়ে বসে ছিলেন তখন প্রথমে সবাই বুঝি ভাবল মাটির প্রতিমা । তাই শেষে প্রতিভা যখন উঠে এসে বীণাটি কবির হাতে তুলে দিয়ে মধুর কন্ঠে বললেন,– ” এই নে, আমার বীণা দিনু তোরে উপহার । যে গান গাহিতে সাধ ধ্বনিবে ইহার তার,’.
মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেলেন সকলে। এই অভিনয় শিল্পীর সুচিতা ও মাধুর্য নাটকে ঠাকুর বাড়ির রুচির পরিচয় দিল। অভিনয় বলেই পৌরাণিক কাহিনী বেছে নিয়ে তাকে দুমড়ে মুচড়ে দেখানোর দরকার নেই সে কথা কিন্তু সেদিন সকলেরই উপলব্ধি হয়েছিল ।
পরবর্তী জীবনের গানের জন্য প্রতিভা অনেক সাধনা করেছেন। সৌভাগ্যক্রমে তাঁকে বাঁধা পেতে হয়নি। তাঁর স্বামী ছিলেন বিখ্যাত ব্যক্তি এবং রবীন্দ্র সুহৃদ আশুতোষ চৌধুরী। ইনিই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “কড়ি ও কোমল” যথোচিতভাবে সাজিয়ে প্রকাশ করেন।
সঙ্গীতের ক্ষেত্রে প্রতিভার প্রকৃত অবদান হলো স্বরলিপি রচনার সহজতম পন্থাটি আবিষ্কার করা । তিনি দ্বিজেন্দ্রনাথ, যতীন্দ্রনাথের স্বরলিপির পদ্ধতি এবং স্বরসন্ধি প্রয়োগপদ্ধতিতে যেমন নতুনত্ব এনেছিলেন , তেমন তাকে নতুন করে তুলেছিলেন সকলের ব্যবহারের উপযোগী। প্রতিভার আগে কোন মহিলা স্বরলিপি নির্মাণের ব্যাপারে এগিয়ে আসেননি। জ্ঞানদানন্দিনীর “বালক” পত্রিকায় প্রতিভার স্বরলিপি পদ্ধতির প্রকাশ হতে থাকে। বাল্মিকী প্রতিভা ও কালমৃগয়ার গানগুলির প্রথম স্বরলিপিকার ছিলেন প্রতিভা। শোনা যায়, একসময় তিনি হেমেন্দ্রনাথের নির্দেশে বহু ব্রহ্ম সংগীত ও হিন্দুস্থানী সঙ্গীতের স্বরলিপি তৈরি করেছিলেন।
কিন্তু স্বরলিপি নির্মাণ করলেই তো হবে না। গাইবে কে? নিত্যনতুন রসসিঞ্চন করবে কে ? সে ভার নিলেন প্রতিভা । স্বরলিপি নির্মাণের সঙ্গে চলল গান শেখাবার কাজ । তারও হাতেখড়ি হল বালক-এ। সেখানে তিনি কাগজ-কলম খুললেন একটি গানের ক্লাস “সহজ -গানশিক্ষা”। বালক ছোটদের কাগজ । ছোটদের দিয়ে শুরু করা ভালো । তাই তিনি প্রথমে তাদের বলে নিলেন গান কাকে বলে? “গান মানুষের স্বাভাবিক। হাসি কান্নার সময় মানুষের কন্ঠস্বর পরিবর্তন হয় । তাই বোঝা যায়, নানাভাবে নানা সুর আছে। সেই সুরের চর্চা করেই সংগীতের উৎপত্তি হয়েছে।” সংগীতের প্রতিভার এরূপ সংজ্ঞা নির্ণয় একান্ত তাঁর নিজস্ব। পরিণত বয়সে তিনি আরো মৌলিক সংগীত চিন্তার পরিচয় দিয়েছিলেন।
সংগীত এমন একটা জিনিস যার জন্য শুধু জ্ঞান নয় । রীতিমতো চর্চার প্রয়োজন। প্রতিভা সেই চেষ্টায় নিজেদের বাড়িতে প্রথমে “আনন্দসভা” ও পরে “সংগীত সংঘ” স্থাপন করেন। তা গান শেখানোর জন্য ‘সংগীত স্কুল’ বিশেষ খ্যাতি লাভ করে। এখানে প্রতিভা শেখাতেন খাঁটি ওস্তাদি হিন্দুস্থানী গান। যদিও বিদেশি সঙ্গীতেও ছিল তার অবাধ অধিকার । ঘরপড়ষরহর র নিকট তিনি শিক্ষা নিয়েছিলেন। মহর্ষি প্রতিভার পাশ্চাত্য সংগীতের দক্ষতা দেখে তাঁকে পিয়ানো কিনে দিয়েছিলেন । মহর্ষি খুব ভালবাসতেন প্রতিভার পিয়ানো শুনতে। বাঙালি মেয়েরা এবার ভাল করে গান শেখার সুযোগ পেল। প্রতিভা তখন লেডি চৌধুরী হিসেবে পরিচিত। বিচারপতি স্যার আশুতোষ এর স্ত্রীর স্কুলে উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়েরা গান শিখতে আসার সাহস পেয়েছিলেন। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের সঙ্গে যন্ত্রসংগীত শেখানো হতো । বিশেষ করে সেতার ও এসরাজ।
ইন্দিরা এসে যোগ দিয়েছিলেন স্কুলের দায়িত্বে। ঘটনা সূত্রে তিনি এসেছিলেন চৌধুরী বাড়ির বউ হয়ে । প্রতিভা একটি সংগীত বিষয়ক পত্রিকার কথা ভেবেছিলেন । জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গীত প্রকাশিকা অনেকদিন আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল । সংগীত চর্চার জন্য ওরকম একটি পত্রিকা থাকার দরকার । সেই জন্য প্রতিভা ‘আনন্দ সভা’ নামে আনন্দ সংগীত পত্রিকার প্রচলন শুরু করলেন এবং তার সঙ্গিনী হয়েছিলেন ইন্দিরা দেবী। যুগ্ম সম্পাদনায় আনন্দ সংগীত আট বছর সগৌরবে প্রকাশিত হয় । পত্রিকায় প্রতিভা শুধু নিয়মিতভাবে স্বরলিপি প্রকাশ করতেন তা নয় সেই সঙ্গে লুপ্ত সংগীত পুনরুদ্ধারের কাজ শুধু সংগীত ও যন্ত্র সঙ্গীতের পুনরুদ্ধারের চেষ্টা শুরু করেছিলেন।
শোনা যায় বাংলার ১২৯২ সালে বালকের জৈষ্ঠ পত্রিকায় বন্দেমাতরম গানের সাত পংক্তির স্বরলিপি প্রকাশ করেন তিনি। এবং তিনি বিশেষ কারণে গানটির পুরো দিতে পারেন নি। অবশ্য সেখানে কারুর নাম ছিল না। (বিষয়টি বিতর্কিত)
প্রতিভা প্রাচীন সঙ্গীত শিল্পীদের ইতিহাস অন্তরাল থেকে উদ্ধার করে এনেছিলেন । যেমন – তানসেন ঠাকুর, বৈজু বাওড়া নায়ক, মহারাজা সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর আরো অনেকের সংগীত স্রষ্টার জীবনী রচনা ও তাঁদের সংগীত সম্পর্কিত চিন্তার বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরেছিলেন । শিল্প ও শিল্পী উভয়কে না জানলে সাধনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তাঁর চেষ্টায় বহু সঙ্গীতজ্ঞের জীবনসাধনার লুপ্ত ইতিহাস সংগৃহীত হয়েছে । গানের ক্ষেত্রে প্রতিভা তাঁর কাকাদের মত খ্যাতি পান নি। কিন্তু সংগীত জগতে তিনি তাঁর গুরুজনদের মতই সমান কর্তৃত্বের অধিকারী।
প্রতিভার মৃত্যুর পর সংগীত সংঘের পুরস্কার বিতরণী সভায় কাকা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে কথা বলেছিলেন তার মধ্যেই প্রতিভার প্রকৃত পরিচয় লুকিয়ে রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ” সংগীত শুধু তাঁর কন্ঠে আশ্রয় নিয়েছিল, তা নয়। এ তাঁর প্রাণকে পরিপূর্ণ করেছিল । এরই মাধুর্য প্রবাহ তাঁর জীবনের সমস্ত কর্মকে পল্লবিত করেছে।”
রবীন্দ্রসংগীতের ক্ষেত্রে প্রতিভার প্রধান কৃতিত্ব ছিল স্বরসন্ধিসহ কয়েকটি রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্বরলিপি রচনা করা। এর সার্থক উদাহরণ হল – “ কোন আলোতে প্রাণের প্রদীপ “গানের স্বরলিপি । সংস্কৃত স্তত্রে সুর দিয়ে গাওয়ার পরিকল্পনা রবীন্দ্রনাথের একান্ত নিজস্ব । তাঁর বেদ গানের স্বরলিপিও তৈরি করেন প্রতিভা।
মাঘৎসবের সূচনা হত একটি বেদগানের ভাবগম্ভীর পরিবেশ দিয়ে। কখনো ” যদেমি প্রস্ফুরনিনব ” , কখনো ” গীতা স্তত্র, .প্রতিবারই প্রতিভা স্বরলিপি তৈরি করে অন্যদের গান শেখাতেন । প্রতিভার নিজের লেখা গানও দুর্লভ নয় । বিশেষ করে “সাঁঝের প্রদীপ দিনু জ্বালায়” ইত্যাদি ব্রম্ভ সংগীত হিসাবে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।
প্রতিভা জীবনের সঙ্গে মিশে ছিল আরও দুটি জিনিস। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আধ্যাত্বসাধনা এবং হেমেন্দ্র নাথ ঠাকুরের ধর্মানুরাগ। নববর্ষের উপদেশে তিনি বলেছিলেন, “পৃথিবীতে সকল স্থানে অর্থের মান, অর্থের আদর, অর্থের জয়। কিন্তু ধর্মের কাঙালকে চিরদিনই সহ্য করিতে হয় । ধর্মের জয় তোমার নিকট।”
সাহিত্যচর্চা না করলেও বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উপর প্রতিভার ছিল অবাধ দখল। এছাড়াও নানা ভাষা , ইংরেজি ফরাসি ,ল্যাটিন, সংস্কৃত প্রভৃতি যেমন শিখেছিলেন তেমনি ইতিহাস-ভূগোল অন্যান্য বিদ্যাচর্চায় আগ্রহী ছিলেন ।
ঠাকুর বাড়ির অন্যান্য মেয়েদের দু-চারটে লেখা যেমন ইতস্তত চোখে পড়ে, প্রতিভার লেখা তেমন দেখা যায় না। তাঁর একটি বক্তৃতা সংগ্রহ ‘আলোক’ ছাপা হয়েছিল অনেক দিন আগে বলে জানা যায় । সেখানে তিনি লিখেছেন , “ভালো চিন্তা হৃদয়কে অধিকার না করিলে ভালো হইবার দিকে অগ্রসর হওয়া যায় না । চিন্তার ভালো-মন্দ কোটি আমাদের আচার-ব্যবহার এর গতি নিয়মিত করে, চিন্তা সংযত না হইলে আমাদের স্বভাব যথেচ্ছাচারী ও শিথিল হইয়া পড়ে। কিন্তু কাহার চালনায় এই চিন্তাকে আমরা সংযত করিতে পারি? সে কে? সে আর কেহ নয়। সে জ্ঞান। চিন্তাকে সুপথে চালনা করিবার জন্য আমাদের জ্ঞানের শরণাপন্ন হইতে হইবে।”

 

ড. আফরোজা পারভীন
কথাশিল্পী, গবেষক, কলামলেখক
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top