সিডনী শনিবার, ২৭শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১

ভোট অংক : ছন্দা বিশ্বাস


প্রকাশিত:
১৫ অক্টোবর ২০২০ ২১:৪২

আপডেট:
২৭ এপ্রিল ২০২৪ ০০:১১

 

নবীন নায়েক মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, ”ঠিক মনে করতে পারছি না।“

আমি মনে মনে বলি, সেটাই তো স্বাভাবিক। প্রতি বছর মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকে এতো এতো স্টুডেন্ট বের হয় কতজনাকে আর মনে রাখা যায়। তার উপর আমার মত লাস্ট বেঞ্চের বাপে ক্যালানো, মায়ে খ্যাদানো উচ্চিংড়ের কথা কেইই বা মনে রাখে।

তবু স্যারকে মনে করানোর চেষ্টা করে বলি, ”মনে আছে  স্যার, সেই নাইন্টি নাইনের ব্যাচ? মাধ্যমিকে ওয়েস্ট বেঙ্গল টপার হয়েছিল দীপক?”

বাকীটা আমাকে আর বলতে হল না, স্যার দেখলাম নিজে থেকেই মাথা নেড়ে বললেন, ”তুমি তো দীপকদের ইয়ারে ছিলে, তাই না?”

আমি ঠোটে ঝোলা হাসি এনে বিনীত সুরে বলি, “ঠিক ধরেছেন স্যার। দীপক গুহ আমাদের ক্লাশের ফার্স্ট বয় ছিল। সেবার  ফাইনালের টেস্ট পরীক্ষা, ফিজিক্যাল সায়েন্সের দিন আমি পিছনের বেঞ্চে বসে টুকলি করছিলাম। সেদিন পণ্ডিত স্যার গার্ড দিচ্ছিলেন। আর পড়বি তো পর সেদিন পন্ডিত স্যারের চোখে পড়ে গেলাম। স্যার মনে হয় অনেকক্ষণ ধরে আমায় লক্ষ্য করেছিলেন। তারপর হাতেনাতে ধরে আমার খাতা ধরে টান মেরে তাতে কিসব লিখে আমাকে স্কুল মাঠের মাঝে কান ধরে দাড় করিয়ে দিলেন। তারপর আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বললেন,"দাঁড়াও তোমার এবার হবে", বলে কী একটা আনতে যেন ছুটে গেলেন টিচার্স রুমের দিকে।

সেকেন্ড হাফে পরীক্ষা দিতে আসা নিচের ক্লাসের ছাত্ররা তখন চিড়িয়াখানার জন্তুর মতো আমাকে দেখছে। আমি তো ভয়ে এবং লজ্জায় কাঁপছি তখন। পণ্ডিত স্যার অফিস রুম থেকে তেল মাখানো বেত হাতে নিয়ে এগিয়ে আসছেন। সবাই জানে পণ্ডিত স্যার একবার শুরু করলে ‘উনত্রিশ ঘা’ এর নীচে থামতে পারেন না।

তো বেতখানা এনে সবে তিন ঘা মেরেছেন তখন আপনি এসে আমাকে পণ্ডিত স্যারের হাত থেকে উদ্ধার করলেন। তারপর আপনার ঘরে নিয়ে গিয়ে অন্য একটা খাতা  আমার সামনে দিয়ে বলেন,”লেখো, যা পারো তাই লেখো। দেখো, এক এক নম্বরের অনেক কোয়েশ্চেন আছে, সেগুলোর আনসার দিত পারলেই পাশ মার্কস উঠে যাবে। পাশ করতে গেলে খুব বেশি পড়াশুনার দরকার হয় না,  বাবা। ”

 

এক

আমি গনেশ চন্দ্র গলুই ওরফে গনা। তিনতিনবার নাধ্যমিকে ফেল করার পরে ঘর ছেড়ে তে’ রাস্তার মোড়ে এসে দাড়ালাম। পাঠ্য বইএর কবিতার ছন্দের চাইতে তখন ভাল লাগতে শুরু করেছে পথের লোকেরদের চলার ছন্দ। অন্ধকারের ভিতরেও দূর থেকে কেউ একজন হেটে  আসছে দেখে বলে দিতে পারতাম কোনটা ন্যাটা নকুল, কোনটা কানকাটা কেষ্ট (পরের বউকে নিয়ে ফষ্টিনষ্টি করতে গিয়ে পাড়ার ছেলেরা ধরে কান কেটে দেয়), পাড়ার মেয়ে ভাগানো কার্তিক, পকেটে ব্লেড চালানো ধুন্দুল, শিক্ষক ঠ্যাঙ্গানো রুস্তম আর ডাক্তার ক্যালানো মকবুল। এই নিয়ে বেশ কয়েকবার বন্ধুদের সাথে বেটিং হয়েছে এবং প্রতিবারেই আমি জিতে গেছি।

বিকেল হলেই সাইকেল নিয়ে টইটই করে ঘুরে বেড়াতাম। যাকে বলে রাস্তা মেপে বেড়ানো। তারপর ফিরে এসে পটার চায়ের দোকানে ঠেক নিতাম। ওটাই আমাদের আড্ডা মারার ঠিকানা হয়ে গেল। বসে বসে পরের পয়সায় চা-সিগারেট খাই আর গোফে তা দেই।

বাড়ী ফিরলেই মায়ের সেই এক গজর গজর,”কিছু একটা কর গনা। আমি চোখ বুজলে তোর কি হবে বুঝতে পারছিস? কি করে বাচবি তুই? কিছু একটা কাজকম্ম করে নিজের পায়ে দাড়া, আমি তাহলে মরেও শান্তি পাবো।”

বকবক করতে করতে একেবারে কানের পোকা নড়িয়ে দিল। অবশেষে একদিন বাধ্য ছেলের মতো কাজ শুরু করে দিলাম। ফুচকা বেচা।

ঠেলা গাড়িটা ঠেলতে ঠেলতে কালী মন্দিরের সামনে আমারই বাল্যবন্ধু কেলে পটার চায়ের দোকানের পাশে রাখলাম।পটাই আমাকে এই বুদ্ধিটা বাতলে ছিল। বলেছিল, "দ্যাখ গনা, এই তল্লাটে কিন্তু কোনও ফুচকার দোকান নেই। আর প্রতিদিন দ্যাখ মাইরি, কত সুন্দরী সুন্দরী সব মেয়েরা লাইন দিয়ে এই কালী মন্দিরে আসে পুজো দিতে, প্রতিমা দর্শন করতে। বিকেল হলেই এখানে সুন্দরীদের ঢল নামে। ওই যে সামনে একটা ছোটমোটো  মিনি মার্কেট না শপিং মল কি একটা  হয়েছে না, ওখানেই সবাই ঘুরতে আসে। তখন তোর ফুচকার দোকানে একবার না একবার ঢু দেবেই।”

পটার কথাটা সত্যি হল।

ভাগ্য কাকে বলে। দেখতে দেখতে কয়েক দিনের ভিতরে আমার নাম সরি আমার দোকানের নাম ফাটল-“গনার ফুচকা।“

বিকেল হতে না হতেই সুন্দরীদের লাইন পড়ে যেত। আমি শাদা পাজামা-পাঞ্জাবী পরে, একেবারে ফুল্টুস জামাই সেজে সুন্দরীদের হাতে ফুচকা তুলে দিতে দিতে মনে মনে বলতাম, ভাগ্য ফিরতে কতদিন।

বাড়ী ফিরে লাভের হিসাব কষতাম। এক থেকে দুই অংক, তারপর তিন অংক ছাড়িয়ে গেলে ব্যাংকে একটা বই করলাম। মা বলল,”গনা এবারে একটা বিয়ে কর।“

কিন্তু কিছুদিন যেতেই একদিন ঘটে গেল চরম দুর্ঘটনা। আগের দিন পটার বাড়িতে পাট্টি ছিল। গলা পর্যন্ত মাল গিলে পরদিন দুপুর পর্যন্ত বিছানায় পড়েছিলাম। মা বাবুদের বাসা থেকে কাজকর্ম সেরে ফিরে এসে দেখে আমি সেই ভাবে লটকে পড়ে আছি। মা ঘেটি ধরে খানিক নেড়ে আমাকে জাগিয়ে দেয়।

বেলা পড়ে আসছে দেখে আমিও তাড়াতাড়ি চান টান করে গুছিয়ে নেই। সেদিন কি একটা উপলক্ষে মেলা বসেছিল। লোকে লোকারণ্য। ভীড়ে রাস্তা দিয়ে চলা দায়। দেখতে দেখতে আমার বাক্সের ফুচকা প্রায় শেষের দিকে। হঠাৎ কে একজন আবিষ্কার করল, তেতুল গোলা জলের হাড়ির ভিতরে নাকি একটা ইয়া বড়ো টিকটিকি ভাসছে।

সর্বনাশ! হঠাৎ আমার মনে পড়ল গতকালের তেতুল গোলা জলটা তো ফেলে দিতে ভুলে গেছি। মাটির হাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি বেশ বড়ো সাইজের  টিকটিকি মরে পেটটা ফুলে ঢোল হয়ে জলের উপরে ভাসছে।

আমার সামনে তখন চারটে লাইনে মেয়েরা এবং ছেলেরাও ফুচকার শাল দোনা হাতে অপেক্ষা করছে। আমার বুকের ভেতরে তখন  দুম দুম করে হাজার হাতুড়ির ঘা পড়ছে। কথাটা বাতাসের সাথে সাথে মুহূর্ত্যের ভিতরে ছড়িয়ে গেল।

উপস্থিত যারা খাচ্ছিল, তারা ত সঙ্গে সঙ্গে হড় হড়  করে বমি করে ভাসাল। আর যারা একটু আগে খেয়েদেয়ে মেলায় ঘুরছিল, ফিরছিল, ছেলেদের সাথে মস্তি করছিল, কথাটা কানে যাওয়া মাত্র তাদেরও সেই একই দশা।

অবস্থা বেগতিক দেখে পটা চায়ের দোকান ফেলে আমার কাছে ছুটে আসে। তারপর আমার কান ধরে হিড় হিড় করে টেনে একপাশে সরিয়ে কানে কানে বলল, “এক্ষুণি পালা, নইলে পাবলিকের প্যাঁদানিতে তোর লাশ আজ রাস্তায় পড়ে থাকবে।“

জনতার পিট্টির ভয়ে আমি তখন ফুচকার গাড়ি রেখে পগার পাড়।

বহুদিন পালিয়ে ছিলাম বাদুড়িয়ায় আমার এক পিসির বাড়িতে। মা সবকথা জানত। মনে মনে বলত, ”আমার ছেলেটাকে ভাল রেখো ঠাকুর।“

দুই

অনেক বছর বাদে এই শহরে পা রাখলাম। চেহারার সাথে সাথে আমার নামেরও পরিবর্তন হয়েছে। আমি গনা থেকে এখন গনা মস্তান। আমার সেই প্যাঁকাটির মতো ল্যাগবেগে চেহারাতে মেদ জমেছে খনিককটা। রংচটা শার্ট প্যান্টের পরিবর্তে এখন আমার পরনে সাগরনীল জিন্স আর ফুলকারি টি শার্ট। চোখে সান গ্লাশ, হাতে স্টীলের বালা, চুল ঘাড় পর্যন্ত নামানো। বুকের উপরের দুটো বোতাম খুলে আমি এখন পুরো দস্তুর ‘দাদা’ বনে গেছি।

ইনকাম একাটা জুটিয়ে নিয়েছিলাম- সিনেমা হলে টিকিট ব্ল্যাক করা। সঙ্গে জমির দালালী। তাতে রোজগারপাতি মন্দ হতো না।কোত্থেকে সেদিন বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিড়ে গেল। ‘জয় বাবা লোকনাথ’ বলে কপাল ঠুকে একটা সিকিম বাম্পার লটারির টিকিট কেটে বসলাম।

দেখি এক টিকিটেই কেল্লা ফতে। একেবারে প্রথম প্রাইজটা জুটে গেল। এক টিকিটে পাচ লাখ! ভাগ্য সহায় থাকলে যা হয়। এরপর জড়িয়ে গেলাম প্রোমোটারি ব্যবসায়। আমার মনে হল আমার মত অপগন্ডের কাছে এই মুহুর্ত্যে এটাই সব চাইতে লাভজনক পেশা। ঠিক ঠাক চালাতে পারলে বাড়ি-গাড়ি করতে খুব বেশিদিন লাগবে না।

সত্যি সত্যি লক্ষ্মী বাধা পড়ে গেল আমার কাছে। আমি এখন গনা মস্তান থেকে গনাদা, গনেশদা কিম্বা গনেশবাবু। লোকাল পঞ্চায়েত, বিডিও অফিস, মিউনিসিপ্যালিটি-সব এখন আমার হাতের মুঠোয়। বেশ কিছু রোড কন্সট্রাকশাণ, কিছু স্কুল এবং অফিস বিল্ডিঙের কাজ, কিছু শহরের ঝা চকচকে আবাসন তৈরী করার পরে আমার বেশ সুনাম হয়েছে।

তো সেদিন শাসক দলের একজন নেতা আমার অফিসে এসে বললেন,”গনেশ, এবারে কিন্তু তোমায় ভোটে দাড়াতে হবে। উপর ওয়ালার নির্দেশে এবারে তুমি কিন্তু তুমি নোমিনেশাণ পাচ্ছ। প্রস্তুত থেক মানসিকভাবে।“

আমি তো আকাশ ছুতে চলেছি মনে হল। আরে এই দিনটার অপেক্ষাতেই তো এতদিন বসেছিলাম। হাজার হাজার মানুষের মিছিলের সামনে আমি হাটছি, রাস্তার দুই পাশে জনতার ঢল, সকলে মাথা উচু করে আমাকে দেখছে। আমার ভিতরে স্বপ্নের পাখিটা তখন ডিমে তা দিতে শুরু করেছে। আর কদিন বাদেই ছানা ফুটে বের হবে।

 সেদিন স্কুলের সামনের রাস্তায় হঠাৎ হেড স্যারের সাথে দেখা হয়ে গেল। কত যুগ বাদে আজ স্যারের মুখোমুখি হলাম।

'স্যার?’ বলে জোরে একটা ডাক দিয়ে আমি বাইক থেকে নেমে স্যারের পায়ে ঢপ করে একটা প্রণাম ঠুকে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে পড়লাম। তারপর স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি হেসে বললাম,”আমাকে চিনতে পেরেছেন স্যার?”

স্যার দেখলাম হঠাৎ বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। আমার মুখের দিকে খানিকটা সময় তাকিয়ে থেকে তারপর মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, "ঠিক মনে করতে পারছি নাতো বাবা।”

মনে না থাকারই তো কথা। নবীন স্যারের এতো সব প্রতিভাবান  ছাত্রছাত্রী থাকতে স্যার আমার কথা কেনই বা মনে রাখতে যাবেন।

তবে ছোটবেলার কিছু কিছু স্মৃতি  মানুষের মনে গভীর একটা দাগ রেখে যায়। হাজার কসরত করেও সেই দাগ কিন্তু মোছা যায় না। আমার জীবিনেও সেইরকম গভীর একটা দাগ আছে। সেটা স্কুল জীবনের স্মৃতি।

আমি সেবার অয়ানুয়াল পরীক্ষায় টুকলি করতে গিয়ে পণ্ডিত স্যারের কাছে ধরা পরে যাওয়া এবং অপ্রস্তুত হওয়ার ঘটনাটা হেড স্যারকে বলি।

হেড স্যার মাথার ভিতরে আঙ্গুল চালিয়ে ঘাড় নেড়ে বললেন, "ওহ, তুমিই সেই বাদর ছেলেটা? সে কত দিনের কথা। আর সেদিনের সেই ছোকরা যে এত বড়ো হয়ে গেছে , সত্যি আমি তোমায় চিনতে পারি নি।”

আমি আস্তে আস্তে বলি,"সেদিন স্যার আপনাকে ভগবানের মতো মনে হয়েছিল। আপনি শুধু আমায় পণ্ডিত স্যারের মারের হাত থেকেই বাঁচাননি, আমায় অনেক অপমানের হাত থেকেও মুক্তি দিয়েছিলেন। আপনার কথা স্যার আমি কোনোদিন ভুলতে পারবো না। আজ শুধু একটা কথা ভেবে খারাপ লাগে, সেদিন স্যার আপনি আমাকে পড়াশুনাটা চালিয়ে যেতে বলেছিলেন। বলেছিলেন সন্ধ্যে হলে বই পত্তর নিয়ে চলে আসিস আমার বাড়ী। আমি স্যার আপনার কথা রাখতে পারিনি। আসলে সেই বয়সে লেখাপড়ার গুরুত্বটা যে কি, তখন বুঝতাম না। এখন মর্মে মর্মে টের পাচ্ছি।”

কথাটা বলতে বলতে আমার গলার স্বর কিছুটা আর্দ্র হয়ে পড়ে।

স্যার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,”তোমার তো দেখছি পুরানো দিনের কথা সব পরিষ্কার মনে আছে। তা এদিকে আজ কি মনে করে?”

“আপনিই তো আমায় ডেকেছেন, তাই এলাম।”

আমি ঠোটে মৃদু হাসি এনে বলি।

"আমি তোমায় ডেকেছি? কীজন্যে বলতে পারো? আমি না ঠিক বুঝতে পারছি না।”

স্যার কথা বলতে বলতে ধীর গতিতে স্কুলের দিকে যাচ্ছিলেন। আমিও বাইকটাকে ঠেলতে ঠেলতে স্যারের সাথে পা মিলিয়ে হাটতে থাকি।

আমি স্যারের সাথে হাটতে হাটতে স্কুলের দিকে যেতে যেতে বলি, “এই তো সেদিন স্যার স্কুল বিল্ডিং তৈরীর ব্যাপারে আপনি কথা বলবেন বলেছিলেন না? রাতে ফোনে আপনার সাথে কথা হল। আপনি আমাকে স্কুলে আসার কথা বললেন,তাই।”

স্যার খুব খুশি হলেন যখন শুনলেন স্কুলের নতুন ভবন নির্মাণের দায়ীত্ব আমি নিয়েছি।

স্যার ওনার ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালেন। ওনার ঘর থেকে বিশাল স্কূল মাঠ, মাঠ পেরিয়ে মেইন গেট, বড়ো রাস্তা- সব দেখা যায়। এই কয় বছরে কত পাল্টে গেছে আমাদের স্কুলটা। দোতলার জায়গায় তিনতলা হয়েছে। আগে মাঠের এক দিক বরাবর লম্বা বিল্ডিং ছিল এখন দুইদিকেই বিল্ডিং উঠে গেছে। আগেও স্কুল ভবন শাদা রঙের ছিল, এখনও নানান মতবিরোধ সত্বেও সেই শাদা রঙের ট্রাডিশাণ বজায় আছে। বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখি গেটের মুখ সেই কৃষ্ণ চূড়া গাছটা আরও শাখায় শাখায় পল্লবিত হয়ে আছে। গ্রীষ্মকে আহবান জানানোর জন্যে সে রক্তিম সাজে সেজেছে। মাঠের একদিকে ছোট্ট একটা গার্ডেন করা হয়েছে। আর মাঠটার চারিদিকে বেশ কিছু গাছ লাগানো হয়েছে। এটা আমাদের সময়ে ছিল না।

হেড স্যারের ঘরে রবীন্দ্রনাথ, কাজি নজরুলের পাশে স্যার জগদীশ্চন্দ্র বসু, সত্যেন্দ্র নাথ বসু এবং মহা বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের ছবিটাও সেই আগের মতো অবিকল একই রয়েছে। আলমারির সংখ্যা বেড়েছে। বেড়েছে বইয়ের সংখ্যায়ও। সামনের দেওয়ালে রাখা আছে প্রচুর মেমেন্টো। এগুলো সবই আমাদের স্কুলের কৃতী  ছাত্রদের অবদান। স্যারের ঘরে ঢোকার মুখেই দেওয়ালের গায়ে শ্বেত পাথরের উপর খোদাই করে পর পর মাধ্যমিক আর উচ্চ মাধ্যমিকের প্রথম স্থানাধিকারীদের নাম লেখা আছে।

স্যার আমাকে বসিয়ে রেখে পাশের ঘরে একটু গেলেন। আমি সেই অবসরে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। খুব গর্ব হচ্ছে, আমার স্কুলের জন্যে কিছু কাজ করতে পারব ভেবে। এই প্রতিষ্ঠান আমার মায়ের মতো। কিছুই তো দিতে পারিনি স্কুলকে, তাই এই কাজটা করতে পারবো জেনে মনে মনে কৃতার্থ বোধ করছি।

হেড স্যার নবীন নায়েক ছিলেন পন্ডিত ব্যাক্তি। আমরা তাকে আড়ালে ‘নায়ক স্যার’ বলতাম। তার পয়ত্রিশ বছরের শিক্ষকতা জীবনে  এই শহরে কত কৃতী ছাত্র আছে। বিদেশেও অনেকে সম্মান এবং সাফল্যের সাথে কাজ করছে। স্যার যখন রাস্তায় বের হন তখন তিনি মাথা নীচু করে হাটেন। একবার তার এক বিচ্ছু ছাত্র এর কারন জিজ্ঞেস করায় তিনি বলেছিলেন, রোজ রাস্তায় যাদের দেখি তাদের অধিকাংশই আমার ছাত্র। এমন অনেক বাড়ি আছে যাদের তিন পুরুষ আমার হাতে বড়ো হয়েছে। রাস্তায় বের হলে তাদের সাথে দেখা হয়ে গেলে  তারা প্রনাম করবে, দুই একটা কথা না বলে তো আর যাওয়া যায় না। তার উপর এখন যারা পড়ুয়া, তারা বাইকে যেভাবে বান্ধবীদের নিয়ে চলাফেরা করে আমাদের সামনে পড়ে গেলে তারাই বিব্রত বোধ করে।”

স্কুল থেকে ফিরেও দেখেছি অনেক রাত পর্যন্ত ছাত্রদের পড়াতেন। কিন্তু কারো কাছ থেকে সামান্যতম বেতন নিতেন না। কেউ জোর করলে বলতেন,”শিক্ষাকে আমি বেচতে পারবো না। সরকার ত আমাকে পারিশ্রমিক দেয়। তাতেই আমার কোনোমতে চলে যাবে।“

নানান শিক্ষামূলক কাজের সাথে তিনি জড়িত ছিলেন। কথায় কথায় সেদিন যখন জানতে পারলাম স্যার তার আজীবনের সঞ্চয়- রিটায়ারমেন্টের পরে যাবতীয় টাকা পয়সা স্কুলকে দান করেছেন, তখন তার প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে এলো। তিনি সত্যি আমাদের শহরের গর্ব।

তিন

না না করেও কাটাতে পারলাম না। সামনের মিউনিসিপ্যালিটির ভোটে আমাকে দাড়াতে হচ্ছে। আমার হাতে এখন বলতে গেলে সেরকম কোনো কাজ নেই। ভোটের পরে শ্রী নদীর ব্রিজটাতে হাত দেবার কথা আছে। অবশ্য সেটার জন্যে আমাকে এই মুহূর্ত্যে ভোটে জেতাটা খুব দরকার। এখানেও আমার প্রতিদ্বন্দ্বী পরেশ নন্দী আছে। সে তো দশ কোটী টাকার এই প্রজেক্টার জন্যে মুখিয়ে আছে। লোকমুখে শোনা যাচ্ছে, এগজিকিউটিভ এঞ্জিনীয়রকে এর ভিতরেই নাকি সপরিবারে ইউরোপ ঘোরার প্রস্তাব দিয়ে এসেছে বাড়ীতে গিয়ে।

আমার এই মুহূর্ত্যে ইলেকশানের জন্যে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। রাজনীতিতে সদ্য হাতে খড়ি, দাদাদের কথা বার্তা বুঝতে তাই মাঝে মাঝে হোঁচট খেতে হচ্ছে।  শুধু ভোটের আগে বাড়ি বাড়ী গিয়ে মুখ দেখানো ছাড়া বাকি যা কাজ আমার হয়ে পার্টির ক্যাডাররাই করছে। বড়দা তো সেদিন বলেই দিল,“কোনও চাপ নিসনা, গনা। আমাদের ছেলেরা এক একটা দুঃশাসন। গালি, নিন্দা, অভিসম্পাত দিয়ে পাঁচ বছর বিরোধীদের তারা বসিয়ে রাখার ক্ষমতা রাখে। আর তার সাথে ধৃতরাষ্ট্রের আরও শ খানেক ছেলে তো আছেই। তারা কিল, চড়, চপার, গুলি, প্রয়োজনে বাড়ি থেকে মেয়েদের তুলে নিয়ে আসা- কোনটাতেই পিছুপা হবে না।“

আমি শুধু কয়েকটা মিছিলে হাটব, কিছু রাজনৈতিক সভায় গরম গরম বক্তব্য রাখবো, আমার বিপক্ষের জনকে কথার আচড়ে ক্ষত-বিক্ষত করব-এই আর কি।

ইতিমধ্যে আমার নামে শহরের বিভিন্ন জায়গায় ব্যানার, পোস্টার, হোর্ডিং লাগানো হয়ে গেছে। নানান লিফ্লেট, পুস্তিকা, রাস্তায়, গাড়ীতে, অফিস, দোকান বাড়ীর দেওয়ালে, গাছের গুড়ির গায়ে, লোকেদের বাথ্রুমের দেওয়ালে আমার নাম- ‘সাইকেল চিহ্নে গনেশ চন্দ্র গলুই ওরফে গনাকে ভোট দিন।’

আমি সত্যি একটা কেউকেটা বনে গেছি। কিন্তু আমার বিপক্ষে দাড়াচ্ছে কে?সেটাই তো এখনও জানা যাচ্ছে না। বিরোধী পার্টি এখনও পর্যন্ত তাদের দলের কারুর নাম ঘোষণা করেনি। একটা চাপা উত্তেজনা হচ্ছে। সেদিন পার্টি অফিসে কথাটা বলতেই বড়দা বললেন,”নো চিন্তা গনা, ওদের দলে আছেটা কে যে দাঁড়াবে? সব কটাকে সাফ করেছি, পয়সা দিয়ে মুখ মেরেছি, একেবারে তুড়ি মেরে সব ভোট আমাদের ব্যালট বক্সে একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়বে। বিপক্ষের কাউকে ভোট দিতেই দেবো না। এবারে সব ভোট আমাদের।”

তবু কেন জানি আমার অস্বস্তিটা যেন কিছুতেই যাচ্ছে না। আমার বিপক্ষে কে দাঁড়াচ্ছে? নামটা জানা খুবই দরকার। যুদ্ধ করবো, অথচ প্রতিপক্ষকে চিনব না, জানব না, তা কি করে হয়।

উত্তেজনার পারদ চড়ছে। সামনের সপ্তাহের ভিতরে সব কিছু জানা যাবে। ওইদিনই নমিনেশান জমা দেবার শেষ তারিখ।

সেদিন বিপক্ষের নাম ঘোষণা শুনে আমি চমকে উঠলাম। আমার বিপক্ষে নবীন নায়েক মানে আমাদের হেডস্যার দাড়াচ্ছেন।

আমি মুহূর্ত্যের ভিতরে ফুটো হয়ে যাওয়া বেলুনের মত চুপসে যেতে থাকি। নিজেকে অবাঞ্ছিত, মরা মানুষের মতো মনে হচ্ছে। কী বলার আছে ওনার বিপক্ষে? আমি তো ওনার নখেরও যোগ্য নই। এই শহরের প্রতিটা ইট, কাঠ, পাথর, প্রতি ইঞ্চি জমি জানে নবীন নায়েককে। বাতাসের প্রতিটা অনু-পরমানু তাকে চেনে। তার বিরুদ্ধে আমি কি প্রচার করবো। যে কটা কথা বলবো সব মিথ্যে বলা হবে। কিন্তু কিছু তো বলতে হবে, নইলে আমার পার্টির লোক আমায় ছেড়ে দেবে না।

বড়দা এর ভিতরে আমার মনের কথা পড়তে পেরে শ্রী কৃষ্ণের ভূমিকা নিয়ে রাজনীতির ভাগবৎ ব্যাখ্যায় নেমে পড়েছেন। এটাও একটা যুদ্ধ। তাই এখানে কে তোমার বাবা, ভাই, বোন, মা- কে তোমার নিকতাত্মিয়- সব তুচ্ছ। পার্টির নীতি, আদর্শ, পার্টির প্রতি বশংবদ থাকাটাই দস্তুর। সবার উপরে পার্টি সত্য তাহার উপরে নাই-এটাই মুলমন্ত্র।

আমার মাথাটা এই মুহূর্ত্যে ঘেটে ‘ ঘ’  হয়ে গেছে। কি করবো বুঝতে পারছি  না। আগে যদি ঘূণাক্ষরেও টের পেতাম কিছুতেই এ পথে পা বাড়াতাম না। হেড স্যারের বিপক্ষে দাঁড়ানোর মতো ধৃষ্টতা সত্যি এই মুহূর্ত্যে আমার নেই। তাছাড়া রাজনীতিতে আমি একেবারেই আনকোরা। এদের চলনবলন, মুখে এক আর পেটে  আর এক, আমি সত্যি এই কয়দিনে ধন্দে পড়ে গেছি। যাদের দূর থেকে আদর্শবাদী, বিবেকবান, সৎ এবং চরিত্রবান বলে মনে করতাম, এদের অন্দরে ঢুকে সামান্য যা কিছু জানতে বা দেখতে পেরেছি, তাতেই আমার অন্তরাত্মা ভিতরে ভিতরে প্রচণ্ড একটা ধাক্কা খেল। এখন আমার সাপের ছুঁচো গেলার মতো অবস্থা। বেশ কয়েকদিন আমার চোখ থেকে ঘুম উধাও হয়ে গেছে। দিব্যি ভাল ছিলাম। কেন যে খামকা এই রাস্তায় পা বাড়ালাম। নিজেই নিজের হাত কামড়াতে ইচ্ছা করছে। মা মারা যাওয়ার আগে একটা কথা বলে গিয়েছিল, ”গনা, মনে রাখিস, লোভে পাপ, আর পাপে মৃত্যু। তাই বেশি লোভ করতে যাস না।”

 পাঁচ

সেদিন রাতের বেলায় নিস্তব্ধ শহরে মোটামুটি সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়েছে তখন চুপিচুপি হাটতে হাটতে স্যারের বাড়ির দিকে পা বাড়াই। বর্তমানে স্যারের ছেলে বিদেশে থাকেন। স্ত্রী গত হয়েছেন বছর দুই হল। একটু আধটু পার্টি আগেও করতেন, রিটায়ারমেন্টের পরে পার্টির চাপে পড়ে অনিচ্ছা সত্বেও এবারে ভোটে দাড়ালেন। বাড়ীতে এখান স্যার একাই থাকেন।

স্যারের বাড়ীটা আমার বহুদিনের চেনা। কিছুদিন আগে পর্যন্ত এই বাড়ীটার সামনে সকাল এবং বিকেলের পর থেকে সারি সারি সাইকেল রাখা থাকত। দূর দূরান্ত থেকে কত ছাত্ররা এখানে পড়তে আসতো। ইদানীং স্যারের বৌ মারা যাবার পরে স্যার এখন আর কাউকে সেভাবে পড়ান না।

অলি গলি পার হয়ে এ পাড়া সে পাড়া ঘুরে পলেস্তারা খসা জীর্ণ দোতলা বাড়ীটার সামনে এসে দাড়াই। কাছেই একটা লাইট পোস্ট থেকে মৃদু আলো জ্বলছে। গাছের ডালপালা থাকায় আলোটা স্তিমিত এবং মন্থর হয়ে আছে। একেবারে নিস্তব্ধ চারিদিক।

সামনের সেই মাধবীলতার মন্ডপ করা লোহার গেটটা বন্ধ দেখে ভাবি  কীভাবে স্যারের বাড়ীর ভিতরে যাওয়া যায়। একবার ভাবলাম ফোন করলে কেমন হয়। পরক্ষনেই ভাবি, না থাক, যদি উনি এত রাতে দেখা না করতে চান।

অথচ আজ ওনার সাথে দেখা করাটা আমার ভীষণ দরকার। কি করি, কি করি, ভাবতে ভাবতে নিঃশব্দে পাচিল টপকাই। খুব বেশি উঁচু ছিল না পাচিলটা। অথচ এই পাচিলটাকেই ছোটবেলায় মনে হতো কত না উঁচু।

পাচিলের একটা দিকে বেশ কিছু ইট খসে যাওয়ায় সেদিকটা আরো নিচু হয়ে গেছে। আমি সেই দিকটা বেছে নেই। প্যান্ট গুটিয়ে পাচিল টপকে ওপাশে যাই। হঠাৎ মনে পড়ল অনেকদিন আগে স্যারের পোষা একটা ইয়াবড়ো কালো রঙের ডোবারম্যান ছিল। কথাটা মনে পড়তেই গায়ের সমস্ত রক্ত যেন জমে গেল। সর্বনাশ! একবার যদি সে টের পায়, আমাকে ছিড়ে খাবে। তাহলে এখন কি আমাকে ফিরে যেতে হবে? কুকুরের দৃষ্টি শক্তি আর ঘ্রাণ শক্তি প্রবল। এতক্ষণে নিশ্চয়ই তার টের পাওয়ার কথা।

আমি পাচিলের এককোণে ঘাপটি মেরে এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখতে থাকি। হাতের কাছে ছোট্ট একটা ইটের টুকরো দেখে ছুড়ে মারি। ভাবখানা এমন, যদি কুকুরটা থাকে, তাহলে নিশ্চয়ই বেরিয়ে আসবে। আর আমি সেই সুযোগে পাচিল ডিঙ্গিয়ে ওপারে লাফিয়ে পড়তে পারব।

আমার পাটা একপ্রকার পাচিলের কাছেই রেডি করা ছিল।

কিন্তু নাহ, ইটের শব্দে কেউই বেরিয়ে আসেনি বা কাউকে কোনোরকম আওয়াজ করতে শুনলাম না। আগে স্যারের গেটে  'কুকুর হইতে সাবধান', কথাটা লেখা থাকত। বেশ কিছুদিন সেই প্লেটটা আর দেখি না। কথাটা মনে পড়ে যাওয়ায় বেশ খানিকটা স্বস্তি বোধ করি। নিঃশব্দে ফুলের বাগান পেরিয়ে একেবারে স্যারের ঘরের সামনে এসে দাড়াই। উপরের তলা একেবারে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। নীচের তলার একটা ঘর থেকে নীল রঙের একটা মৃদু আলো জ্বলছিল।

আমার মন বলছিল স্যার নিশ্চয়ই ওই ঘরেই ঘুমিয়ে আছেন। আমি পা টিপে টিপে এগিয়ে গেলাম সেই ঘরের দিকে। একবার ভাবলাম, কলিং বেল বাজাই। কিন্তু বারান্দায় রেলিঙ দিয়ে ঘেরা  অংশে হাতড়ে কোনো কলিং বেল খুঁজে পেলাম না। সত্যি বলতে গেলে  স্যারের বাড়ীতে এই প্রথম আমি ঢুকলাম। এদিক সেদিক তাকিয়ে কিছু খুঁজে না পেয়ে  জানালার কাছে এসে উকি মেরে দেখি নিচের ঘরে স্যার ঘুমাচ্ছেন। খটাং খটাং শব্দে পুরানো দিনের একটা ঊষা কোম্পানির ফ্যান মাথার উপরে ঘুরছে। ফ্যানের হাওয়ায় জানালার পর্দাটা উড়ছে।

উড়ন্ত পর্দার ফাকা দিয়ে দেখলাম, ঘরের ভিতরে একটা নীল আলো জ্বলছে। আর বিছানা উপরে পরম নিশ্চিন্তে স্যার ঘুমাচ্ছেন।

ঘুমন্ত মানুষকে যে এতো সুন্দর দেখায়, আমি সেই প্রথম দেখলাম। মনে হচ্ছে কোনও দেবদূত ঘুমিয়ে আছেন। জাগাতে মন চাইছিল না। তবু আমি আস্তে আস্তে স্যারের জানালায় টোকা দেই, এক, দুই, তিন-

স্যার দেখলাম, ঘুমিয়ে থাকলেও ভীষণ সজাগ। এইটুকু শব্দেই জেগে গেলেন। ঘাড় ঘুরিয়ে ভাবছেন বুঝি,“এত রাত্রে দরজায় শব্দ? নাহ, তবে কি জানালায়? গেট বন্ধ, তাহলে কে এল?”

স্যার দেখি বিছানার উপরে  ধড়পড় করে উঠে বসলেন। তারপর টর্চ জ্বেলে এদিক সেদিক দেখতে লাগলেন। 

আমি জানালা দিয়ে আস্তে আস্তে ডাক দেই,”স্যার, ও স্যার? দরজাটা একটু খুলবেন? আমি গনা বলছি, গনেশ গলুই।”

স্যার হঠাৎ কি যেন একটু ভেবে নিলেন। ঘাড় ঘুরিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে কান খাড়া করে আমার কথাটা শুনলেন। তারপর  টর্চটা নিয়ে মশারি থেকে বেরিয়ে এলেন। আলতা জ্বালতেই বাগানটা আলোকিত হয়ে গেল।

জানালার কাছে এসে পর্দাটা উঁচু করে দেখে নিলেন সত্যি আমি কিনা।

 

“এতো রাতে গনা তুমি?”
স্যার ঘুম জাড়ানো গলায় জিজ্ঞাসা করলেন।
“একটু দরজাটা খুলুন না স্যার?”
আমি বিনীত ভাবে বলি।
স্যার বাইরে এসে কোলাপসিবল গেটের তালা খুলে আমায় ভিতরে আসতে বললেন।
 আমি ঘরে ঢুকেই স্যারের পা দুখানা জড়িয়ে ধরলাম।
“ছাড়, ছাড়, কি ছেলেমানুষি করছ, কি হয়েছে বল?”

আমি হঠাৎ আবেগ প্রবণ হয়ে বলি,”স্যার, আপনার বিরুদ্ধে আমি কিভাবে প্রচারে নামবো? আগে জানলে আমি সত্যি দাড়াতাম না। স্যার, আপনার বিপক্ষে যে কটা কথা বলতে হবে, অভিযোগ আনতে হবে- সবই যে মিথ্যে বলতে হবে, সেটা স্যার আমি কিছুতেই বলতে পারবো না। এতোবড় অন্যায় কাজ আমি করতে পারবো না স্যার।

তারপর ঢোক গিলে বললাম, স্যার, এবারে ইলেকশানটা জেতা আমার জীবনে একটা টার্নিং পয়েন্ট। এর সাথে শ্রী নদীর ব্রিজের দশ  কোটি টাকার প্রজেক্টের ব্যাপার জড়িয়ে আছে। ইলেকশান পারপাস আমার নিজের লাখ দুয়েক টাকা অলরেডী খরচ হয়ে গেছে।”

স্যার দেখলাম মাথা নীচু করে চুপচাপ কথাগুলো শুনলেন। তারপর আস্তে আস্তে কি যেন ভেবে বললেন, “অনেক রাত হয়েছে এখন বাড়ী যাও। তাছাড়া আমার শরীরটাও বিশেষ ভাল নেই। কদিন থেকে জ্বরে ভুগছি।“

স্যারের আদেশ আমি কখনো অমান্য করিনি। তাই আজও করলাম না। ধীর পায়ে বেরিয়ে এলাম। শুনশান পথ ঘাট। গোটা শহরটা গভীর সুষুপ্তিতে মগ্ন হয়ে আছে। পথ বাতিগুলো হঠাৎ নিভে গেল কেন কে জানে। চারিদিক ঘন অন্ধকার। কৃষ্ণা দ্বাদশীর ক্ষীন ম্রীয়মান চাঁদ আমাকে পথ দেখাতে দেখাতে নিয়ে এল। 

দিন যতই এগিয়ে আসছে আমাদের প্রচার ততই তুঙ্গে। খোজ নিয়ে দেখি স্যার প্রচারে বের হননি। তবে বিপক্ষের প্রচার, মিটিং, মিছিল, জন সংযোগ ভালই চলছে। এদিকে ইলেকশানের দিন যত এগিয়ে আসছে আমার ভিতরে উত্তেজনার পারদ ততই বাড়ছে। বড়দা কিছু কিছু টিপস দিয়েছেন আমার কানে কানে। ভোটে জেতার মন্ত্রগুপ্তি যাকে বলে। আমি অবশ্য এসব ব্যাপারে একেবারেই আনকোরা। তবে এ লাইনে কিছুদিন থাকলে অনেক বাজে অভ্যাসও রপ্ত হয়ে যাবে। যেভাবে দশচক্রে পড়ে ভগবান ভূত হন। আর আমি ত কোন ছাড়। রাজনীতি করতে এলে অনেক সেন্টিমেন্ট বিসর্জন দিতে হয়। সে আমরা আমাদের পুরান- মহাকাব্যেও দেখেছি। বড়দা এক’দিনে আমাকে ভালই মগজ ধোলাই করেছে।  

ছয়

সেদিন ঘুম ভাঙ্গল বড়দার ফোনে। ভোরবেলা সংবাদটা বড়দার মুখ থেকেই জানতে পারি। সত্যিই নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। সংবাদটা শোনা মাত্র আমার পা দুটো কেপে উঠল। ফোনটা রেখে দ্রুত বাইকটা বের করে লাইফ নার্সিং হোমের দিকে ছুটে যাই।

এই সকালে নার্সিং হোমের সামনে পৌছে দেখি লোকের ঢল নেমেছে। আমি জনতাকে সরিয়ে আস্তে আস্তে নার্সিং হোমের ভিতরে যাই। দেখি শাদা চাদরে সর্বাংগ ঢাকা আমাদের হেড স্যার চীর নিদ্রায় শায়িত আছেন।

আমার বুকের ভিতরটা কেপে কেপে উঠল। চোখের কোণ বেয়ে এক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল সকলের অজান্তে। আমি মাথা নত করে মনে মনে বললাম, এবারেও আপনি আমায় পাশ করিয়ে দিলেন স্যার। তবে আপনার এই মৃত্যু আমি কামনা করি নি, স্যার। আমি শুধু আপনার রাজনৈতিক হার চেয়েছিলাম।

হঠাৎ প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইলটা বেজে উঠল। দ্রুত মোবাইলটা বের করে দেখি বড়দার ফোন। কানে দিতেই জোর ধাতানি,“ চোখের জল ফেলে আর ন্যাকামি করতে হবে না। মিডিয়া কিন্তু সব নজর রাখছে।”

খুব মৃদু গলায় ‘সরি’ বলে ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে আসি।

বাইরে বেরিয়ে আসার সময়ে নানারকম গুঞ্জন কানে এলো। সকলে বলাবলি করছে, দিব্যি ভালো মানুষ কোনো রোগ ভোগ নেই, কি করে যে এমনটা ঘটল কে জানে। খবর পেয়ে ছুটে এলেন স্যারের বহু পুরানো ছাত্ররা। ছাত্রদের কাঁধে চেপে নবীন নায়েক চললেন অচিনপুরের দিকে।

শ্রী নদীর পাড়ে ইলেকট্রিক চুল্লিতে দাহ করা হল স্যারকে। দুইদিন ঠাণ্ডা ঘরে স্যারের ছেলের অপেক্ষায় রাখা হয়েছিল। স্যার শ্রাদ্ধ্য, মুখাগ্নি- এইস রিচুয়ালে বিশ্বাস করতেন না। তার ধ্যান জ্ঞান ছিল তার স্কুল এবং তার ছাত্র ছাত্রী। তবু স্যারের ছেলে এসে বাবার মুখাগ্নি করলেন। তারপর উকিল ডেকে স্যারের বাড়ি এবং সংলগ্ন জমি, বাগান সব স্কুলকে দান করে গেলেন। স্যার নাকি একটা ইচ্ছাপত্র লিখে রেখে গিয়েছিলেন ।         

 

সাত

একেবারে বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় বিজয়ী হলাম। তবে অনুভব করলাম, এই জয়ের ভিতরে কোনও আনন্দ নেই। চেয়ারম্যান হিসেবে প্রথমেই যে কাজটা করলাম, চেন্নাই থেকে একজন স্কাল্পচারিস্টকে দিয়ে স্যারের একটা আবক্ষ মূর্তি বানালাম। স্কুলে ঢোকার মুখে মূর্তিটা বসান হবে ঠিক হল।

এদিনটা ছিল স্কুলের প্রতিষ্ঠা দিবস। একশ বছর পূর্তি উপলক্ষে শহরের বহু গণ্যমান্য লোককে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। মূর্তিটা উন্মোচন করার দায়িত্ব পড়েছে আমার উপরে। স্কুল প্রাঙ্গণে বেশ বড়সড় প্যান্ডেল বাধা হয়েছে। বেশ কিছুদিন ধরে চলবে নানান কর্মকান্ড। মাইকে ঘোষণা শোনা যাচ্ছে। ঘোষক একসময় আমার নাম ঘোষণা করলেন।

স্কুলের বর্তমান হেড স্যার, স্কুল পরিচালন সমিতির সেক্রেটারি এবং আরো কয়েকজন গণ্যমান্য লোকের সাথে আমি ধীর পায়ে এগিয়ে আসেন।

মূর্তিটার আবরণ সরিয়ে দেখি একেবারে নিখুঁত অবয়ব। সেই চোখ, চোখে কালোফ্রেমের চশমা, গোল গলা শাদা পাঞ্জাবি পরা আমাদের হেড স্যার।

পাশেই দাঁড়ানো একজন সিনিয়র ছাত্র একশটা গোলাপ দিয়ে বানানো মালাটা আমার হাতে দিয়ে বলল, স্যারের গলায় পরিয়ে দিতে।  আমি স্যারের মূর্তিটার দিকে একবার তাকালাম। দেখি স্যার আগের মতোই ব্যক্তিত্বপূর্ণ চাহনিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমার শরীরের ভিতরে কেমন একটা শিহরণ খেলে গেল।

 স্যারের গলায় মালা পড়ানোর সময়ে মুর্তিটার গায়ের স্পর্শে আমি কেপে উঠলাম। আমি মনে মনে বললাম, আমায় ক্ষমা করবেন, স্যার। সেদিন আপনার মৃত্যুতে সত্যি আমার কোনো হাত ছিল না। জ্বর এবং শ্বাসকষ্ট নিয়ে সেদিন আপনি নার্সিং হোমে ভর্তি হলেন এবং শ্বাস কষ্টের সমস্যার জন্যে আপনাকে অক্সিজেন দেওয়া হল। পরে সি সি ইউ তে নিয়ে যাওয়া হল এবং ভেন্টিলেশানে রাখার  ব্যবস্থা হল। পরে জানতে পারি সেই রাতেই নাকি আপনার সিলিন্ডার থেকে অক্সিজেন শেষ হয়ে যায়। কথাটা জানাজানি হতেই সেই রাতে যার ডিউটি ছিল তাকে সাময়িক ভাবে সাসপেন্ড করা হল।

পরে অবশ্য সত্যিটা জানতে পারি । এই কাজটা করার জন্যে পার্টির কাছ থেকে সে দুই লাখ টাকা পেয়েছে। নবীন স্যারের জীবনের দাম!

আমি বুঝতে পারিনি স্যার ভোটের অঙ্কটা যে সত্যিই এতটা জটিল!

 

ছন্দা বিশ্বাস
দার্জিলিং, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top