সিডনী শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১

ভালো থেকো : ডঃ গৌতম সরকার


প্রকাশিত:
১৫ অক্টোবর ২০২০ ২১:৫৬

আপডেট:
১০ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৭:২৬

 

হোটেল ছেড়ে বাইরে আসতেই মুখে -চোখে ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা লাগলো। আকাশ এখন নীল, উপত্যকার মাথায় মুকুটের মত সাজানো পাহাড়চূড়াগুলো আরো বেশি সাদা, আরো বেশি উজ্জ্বল। তবে নদীর দিক থেকে বয়ে আসা বরফ ঠান্ডা হাওয়া সত্তরের মানুষটার অস্থিমজ্জায় কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছে। আজ সকালে যখন সাংলা ছেড়ে ভারতবর্ষের এই প্রান্ত গ্রামে এসে পৌছেছিল তখন কোথাও রোদের ছোঁয়া ছিলোনা। হোটেলে ঢোকার পরেই ঝিরঝির বৃষ্টি শুরু হয়েছিলো। ফলে তখন বাইরে বেরোনোর ইচ্ছে বিসর্জন দিয়ে হোটেলের ঘরেই আটকে থাকতে হয়েছিলো। এই হোটেলটা ছিটকুল গ্রামের একদম উত্তর প্রান্তে, এখান থেকে একটু এগিয়ে গেলেই নদীখাত শুরু হয়েছে। দুপুরে হোটেলের বাঙালি ম্যানেজারের আতিথেয়তায় গরম গরম ভাত, মুগের ডাল, পোস্ত, আলুভাজা আর মাছের ঝোল খেয়ে মনপ্রাণ ভরে গেছে। এতদিন এখানকার বিজাতীয় মশলাদার খাবার খেয়ে প্রাণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। হোটেল থেকে বেরিয়ে নদীর দিকে হাঁটা লাগালেন প্রিয়ব্রত। প্রীতিকণা খাওয়ার পর একটু বিশ্রাম নিতে চাইলো। তাই ওকে ওর মতো বিশ্রাম নিতে দিয়ে একলাই বেরিয়ে পড়েছেন।

বেড়াতে এসে অকারণে হোটেলের ঘরে আটকে থাকা 'না পসন্দ' প্রিয়ব্রতর। রাস্তার পিচ উঠে এবরোখেবরো পাথর বেরিয়ে আছে; দেখে শুনে পা ফেলতে হচ্ছে। কিছুটা এগোতেই বসপা নদীর মন ভালো করে দেওয়া কলতান কানে এলো। অজান্তেই হাঁটার গতি বেড়ে গেলো। হঠাৎ দূরে চোখে পড়লো নদীখাতের ওপর একজন শাড়ি পরা মহিলা বসে আছেন, কিন্তু বসার ভঙ্গিটা কিরকম যেন! আরেকটু এগোতে ব্যাপারটা স্পষ্ট হলো। জামাকাপড় দেখে আগেই বুঝেছিলেন উনিও তার মতো একজন ট্যুরিষ্ট, মাটিতে হামাগুড়ি দিয়ে হাতের আন্দাজে কিছু একটা খুঁজছেন। ধীরে ধীরে পাশে পৌঁছে গেলেন প্রিয়ব্রত। ভদ্রমহিলার কোনো দিকে খেয়াল নেই, বিড়বিড় করতে করতে খুঁজেই চলেছেন। হাতে , শাড়িতে লাল মাটির ছাপ, মাথার সাদা চুলগুলো নদীর অবাধ্য হাওয়ায় আর ঝুঁকে থাকার কারণে সারা মুখ ঢেকে দিয়েছে। প্রিয়ব্রতর চোখদুটো এবার ভদ্রমহিলাকে ছেড়ে আশপাশে সন্ধিৎসু দৃষ্টি চালালো। সঙ্গে সঙ্গেই চোখে পড়লো একটু দুরে একটা পাথরের খাঁজে চশমাটি পড়ে আছে। প্রিয়ব্রত তাড়াতাড়ি এগিয়ে চশমাটি কুড়িয়ে ভদ্রমহিলার হাতে দিলেন। ভদ্রমহিলা উঠে দাঁড়িয়েছেন , আঁচলে হাতের ধুলো ঝেড়ে চশমা পরে প্রথম কথা বললেন, "ধন্যবাদ, আসলে একটা উঁচু পাথরে হোঁচট খেয়ে ....." কথা শেষ না করে উনি প্রিয়ব্রতর দিকে তাকিয়ে রইলেন। প্রিয়ব্রতর মনে হলো এইমাত্র সমগ্র ছিটকুল উপত্যকায় কয়েক সেকেন্ডের জন্য ভূমিকম্প হয়ে গেলো। আশপাশের পৃথিবী থেকে কয়েকটা মুহূর্ত চুরি হয়ে গেল! তবে সেই চুরির কথা তিনি ছাড়া বোধহয় আর কেউ টের পাননি। ওই তো দূরে রঙিন জামাকাপড় পড়া কয়েকটি অল্প বয়সের ছেলে-মেয়ে নদীর বুকে বসপার উচ্ছলতার সাথে তাল মিলিয়ে খুশির ফোয়ারা ছোটাচ্ছে; সামনের ভদ্রমহিলাও সাময়িক অস্বস্তি কাটিয়ে স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, "আপনি! আপনিও কি এখানে ঘুরতে এসেছেন?" প্রিয়ব্রত মুখে কোনো উত্তর না দিয়ে ম্লান হেঁসে ঘাড় নাড়লেন। তারপর একই প্রশ্ন মুখেচোখে ফুটিয়ে ভদ্রমহিলার দিকে গভীর চোখে তাকালেন। অব্যক্ত প্রশ্নটি বুঝে নিয়ে উনি উত্তর দিলেন, " আমরা আজ কল্পা যাওয়ার পথে জায়গাটি ঘুরে যাচ্ছি। কিন্তু এখানে এসে মনে হচ্ছে একটা দিন থাকতে পারলে ভালো হতো।" প্রিয়ব্রত বাবুর মনে একশোটা প্রশ্ন পরস্পরের সাথে কুস্তি লড়তে ব্যস্ত, কোনোটাই ঠিকঠাক মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসতে পারছেনা। কোনো ভদ্রমহিলার সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকাটা চূড়ান্ত অশোভন। নিজেকে একটু প্রস্তুত করে নিলেন। কিন্তু মুখ খোলার আগেই খেলতে থাকা সেই বাচ্ছাগুলোর ঝাঁক চিৎকার করতে করতে নদীখাত থেকে উঠে এলো। একসাথে 'দিম্মা' ' 'ঠাম্মা' ডাকে এবং কলবল করতে করতে নদীর গল্প বলতে বলতে ভদ্রমহিলাকে টানতে টানতে নিয়ে চলে গেল। আর ভদ্রমহিলাও সব ভুলে নাতি-নাতনি পরিবৃত হয়ে, পাথরেখোদা উঁচুনিচু রাস্তার কথা ভুলে, রাজ-রাজেন্দ্রানীর মতো ওদের হাত ধরে এগিয়ে চললেন। প্রিয়ব্রতকে কিছু বলে যাওয়ার কথাও মনে এলোনা। এই পাহাড়, নদী, উত্তুরে হাওয়া, অজানা পাখির ডাক আর পাহাড়ি ফুলের গন্ধ , মহান কোনো শিল্পীর হাতে আঁকা অপার্থিব এক রঙ্গদৃশ্যে সমস্ত কুশীলবরা গ্রীন রুমে ফিরে গেছে, সংলাপ ভুলে বিশাল এই মঞ্চে প্রিয়ব্রত নিস্পন্দ, একাকী দাঁড়িয়ে রইলেন।

বাবার বেশি বয়সের সন্তান হওয়ায় মাধ্যমিক পরীক্ষার আগেই বাবা চাকরি থেকে অবসর নেন। ফলে ছোটবেলাটা একটা হিসেবে মধ্যে দিয়ে কাটাতে হয়েছে। স্কুল ডিঙিয়ে কলেজে ভর্তি হয়ে খরচ বাড়লো। তখন একটা টিউশন যোগাড় হলো, বড়লোক বাড়ির একমাত্র মেয়েকে পড়াতে হবে। টিউশন ফিসটাও লোভনীয়। নিজের পড়ার ক্ষতি না করার শর্তে বাবা রাজি হলেন। তারপর চললো পড়াশোনা আর পড়ানো। মেয়েটির বাবা-মা খুব ভালো মানুষ, বড়লোক মানেই অহংকারী হয় সেই ভুল ধারণা ওনাদের দেখেই কেটে গিয়েছিলো। ধীরে ধীরে একটা বিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি হলো। প্রিয়ব্রতবাবুও মন দিয়ে পড়াতে লাগলেন, পরীক্ষার সময় নিয়ম মেনে নয়, প্রায় প্রতিদিনই পড়াতে লাগলেন। মেয়েটির বুদ্ধিশুদ্ধি মন্দ ছিলোনা, তবে বড়লোকের আদুরে মেয়ে হওয়ার জন্য পড়াশোনায় প্রচুর ফাঁকি মারতো। সেই মেয়েকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে উচ্চ মাধ্যমিকে প্রথম ডিভিশনে পাশ করালেন প্রিয়ব্রত। মেয়েটি এবং তার পরিবার যত আনন্দ পেলেন তার থেকেও উনি নিজে বেশি তৃপ্ত হলেন। এটাকে উনি নিজের জয় হিসাবেই দেখেছিলেন। তারপর দুজনের পথ দুটি দিকে বাঁক নিলো। প্রিয়ব্রত উচ্চ শিক্ষার জন্য কলকাতাগামী হলেন আর মেয়েটি পছন্দের বিষয় নিয়ে স্থানীয় কলেজে ভর্তি হলো। শেষের দিন ওদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময় মেয়েটি কামিনী গাছের তলায় হাপুস নয়নে কেঁদেছিল। প্রিয়ব্রত এই ভয়টিই করছিলেন। শেষের দিকে উনি বুঝতে পারছিলেন, কোনো কোনো মুহূর্তে অকারণেই বাইরের কোনো গাছে বসন্তবউরি পাখিটা ডেকে উঠছে, মধ্যরাতের দরবারি কানাড়া দিন নেই রাত নেই মনের ভিতর মাতন তুলছে , রাতে হঠাৎ হঠাৎ ঘুম ভেঙে কি এক সুখস্বপ্নর মাদক আনন্দে সারারাত আর ঘুমই আসতোনা। কিন্তু বাস্তবের রুক্ষ মাটিতে দাঁড়িয়ে উনি সবসময়ই সব সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করে আগামী দিনের জীবনযুদ্ধের জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করতেন। তাই অতি সচেতনতার সঙ্গে মন থেকে সেই সব টুকরো টুকরো রঙিন স্বপ্নকে নিষ্ঠুর হাতে মুছে দিতেন। কিন্তু কামিনী গাছের ডাল ধরে কাঁদতে থাকা মেয়েটির চোখে উনি ধরা পড়ে গিয়েছিলেন।

পরের একটা বছর কলকাতা একদম ভালো লাগতোনা, প্রতি সপ্তাহেই বাড়ি ফিরতেন। ফলে দেখা সাক্ষাৎ হতো, কখনো হাত ধরাধরি করে নদীর বালুচরে , আবার কোনো কোনোদিন আরেকটু সাহসী হয়ে কামারপুকুর, জয়রামবাটি ঘুরে বেড়িয়েছেন; তারপর ছিল অজস্র চিঠির ঝাঁপি। তখন মোবাইল ফোন ছিলোনা আর ল্যান্ডফোনে কথা বলতে দুজনের কেউই সাহস করতোনা। পরের বছর দুজনেরই ফাইনাল পরীক্ষা, যোগাযোগ কমে এলো , তবে চিঠির সংখ্যা বাড়লো। ঠিক তার একবছর পর প্রিয়ব্রত শেষ চিঠিটি পেলেন। অনার্স পরীক্ষার পরই ওর বাড়ি থেকে প্রবাসী এক ইঞ্জিনিয়ার পাত্রের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হলো। গোটা চিঠির ছত্রে ছত্রে আকুল জিজ্ঞাসা ফুটে উঠেছিল-ও এখন কি করবে! প্রিয়ব্রত কোনো উত্তর দিতে পারেনি। নিজের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, বাবার পেনশনের ওই কটা টাকা, অবিবাহিত দিদি সবকিছু তাকে এক কলমও লিখতে দেয়নি। ভীরুর মতো, কাপুরুষের মতো নিজেকে একেবারে গুটিয়ে নিয়েছিল। বিয়ের রাত্রে অলক্ষ্যে দুফোঁটা জল ফেলা ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনি। তারপর দীর্ঘ ৫০ বছর পর দেখা! প্রিয়ব্রত বাস্তবে ফিরলেন- স্বাতী কি চিনতে পারলো! তবে চেনার কথা নয়, সময়ের কারিগর এই অর্ধ শতাব্দীতে কত আঁকিবুকি, কাটাছেঁড়াই না চালিয়েছে এই শরীরের ওপর! অজান্তে প্রলম্বিত দীর্ঘশ্বাস বসপার শীতল হাওয়ার সাথে মিশে কোনদিকে যে হারিয়ে গেল তাল খুঁজে পেলেননা। হোটেলে ফিরে আসাই মনস্থ করলেন। হঠাৎ চোখে পড়লো স্বাতী যেখানে বসে ছিল সেখানে কি একটা রোদে চিকচিক করছে। কাছে গিয়ে দেখলেন, একটা কানের দুল!

কল্পা মানে কিন্নর-কৈলাশ ! হোটেলের অবস্থানটিও অনবদ্য। একদম ওপর তলায় ঘর পেয়েছে। পরিষ্কার আকাশে ঘর-বারান্দা থেকে কিন্নর-কৈলাসের রজত ছটায় চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। প্রীতিকণা এখানে এসে খুব খুশি , ও তো ঘর থেকে আর কোথাও বেরোতেই চাইছেনা। বলছে, "ঘর থেকে এত ভালো দৃশ্যপট, সারা আকাশ জুড়ে কিরিট ধারিণী তাদের শুভ্রতায় মুগ্ধ করে দিচ্ছে, আর কি চাই!" সত্যি কথা! তাছাড়া কল্পায় আর পাঁচটা ট্যুরিষ্ট স্পটের মতো সাইট সিয়িংয়ের চাপ নেই। এই হোটেল ছেড়ে কিছুটা উৎরাইয়ে গেলে দেখে নেওয়া যায় হু বু লাংকার মনাস্ট্রি আর নারায়ণ নাগিনী মন্দির আর পরের দিন যাওয়ার ইচ্ছে কয়েক কিলোমিটার দূরে রোঘি গ্রাম-কিন্নরী স্থাপত্যে তৈরি বাড়িগুলোর শৈলী দেখার মতো। তারপর পড়ে থাকে কালো- মসৃন পাহাড়ি পথ ধরে নিজের খেয়াল হেঁটে যাওয়া। প্রিয়ব্রতকে যদিও একটু খেয়াল রেখেই হাঁটতে হবে। কানের দুলটি সন্তর্পণে রাখা আছে পার্সের গোপন পকেটে। এই দুলের মালকিন আজ যদি কল্পায় থাকে , এত হোটেলের মধ্যে খুঁজে বের করা সম্ভব নাকি! তবু মনে একটি দুরাশা পোষণ করে বিকেলের দিকে একলা ভ্রমণে বেরিয়ে পড়লেন।

এই জায়গায় খুব উচ্চমানের আপেল চাষ হয়, তার বেশিরভাগটাই ইউরোপে আর এশিয়ার বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়। এখন যদিও মরশুম নয়, তাই পাতা খসিয়ে গাছগুলির কঙ্কাল দাঁড়িয়ে আছে। প্রিয়ব্রতর খুব ইচ্ছে একবার আপেলের ভরা মরশুমে আসার। গাছভরা কমলালেবু অনেক জায়গায় দেখেছে, কিন্তু পাকা আপেলে গাছ ছেয়ে আছে- এ দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য হয়নি। ঘন জঙ্গলের বুক চিরে সর্পিল রাস্তা এগিয়ে চলেছে; হালকা চড়াই তাই চলতে কষ্ট হচ্ছেনা। মূল রাস্তার দুপাশে ইতস্ততঃ হোটেলগুলো। বেশ কয়েকটা বিলাসবহুল হোটেলও চোখে পড়লো। সন্ধানী দৃষ্টিতে রাস্তা আর হোটেলের অন্দর আর বাহির মহল দেখতে দেখতে অনেকটা পথ পেরিয়ে এলেন। এতটা রাস্তায় কোনো ট্যুরিষ্টের সাথে দেখা হলোনা। হোটেলের মধ্যে একাধিক ট্যুরিষ্ট দেখেছেন , কিন্তু তার মধ্যে তাঁর কাঙ্খিত জন ছিলোনা। হাঁটতে হাঁটতে রেকং পিও যাওয়ার মূল রাস্তায় পৌঁছে গেলেন। সকালে এই পথেই এসেছেন। এখান থেকেই আসল কল্পার শুরু। মনে মনে ভাবলেন, আর এগোনো ঠিক হবেনা। হোটেল থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার পথ হেঁটে এসেছেন। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলেন সূর্য্য এখন দিনের কাজ সেরে আজকের মতো ফিরে যাবার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। এককাপ চা খেয়ে, কাঠের বেঞ্চে বসে একটু বিশ্রাম নিয়ে উঠে পড়লেন।

আলো কমে যাওয়াতে ফেরার জঙ্গলপথ আরেকটু ঘন হয়ে উঠেছে। তবে রাস্তায় গাড়ির উপদ্রব কম বলে হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছেনা। ধীরে ধীরে আপনমনে হেঁটে চললেন। তাঁর সারা চিন্তা জুড়ে কালকের ছিটকুল। ভাগ্যের কি অদ্ভুত পরিহাস! একই শহরে পাশাপাশি থেকেও গত পঞ্চাশ বছরে একবারও সাক্ষাৎ ঘটলোনা, আর এই হাজার হাজার মাইল দূরে আচম্বিতে ঘটে যাওয়া কালকের ঘটনাটা অস্থির করে তুলেছে। তার ওপর ওই কানের দুলটি! তার মালকিনকে ফেরত না দিতে পারলে মনে শান্তি পাবেননা। কিন্তু কোথায় খুঁজবেন তাকে! এই বিস্তীর্ণ পাহাড়ের কোন বাঁকে সে অপেক্ষা করে থাকবে! এই পাথর, জঙ্গল, কালো পিচের রাস্তা, ঘরে ফেরা পাখির দল কেউই তাঁর জিজ্ঞাসার হদিশ জানেনা। টলমল টলমল করতে করতে এগিয়ে চললেন। অন্ধকার একটু গাঢ় হয়েছে, আবার এত গাঢ় হয়নি যে রাস্তার আলো জ্বলে উঠবে।

কিছু ছেঁড়া ছেঁড়া খবর পেয়েছিলেন প্রিয়ব্রত। পাত্র যাদবপুরের ইঞ্জিনিয়ার, বিয়ের সময় আমেরিকাতে কর্মরত ছিল। তবে কলকাতায় যৌথ পরিবার, পরে নিশ্চয়ই কলকাতাতেই কাটিয়েছে। ভাবতে অবাক লাগে, একই রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেছে, একই আকাশের নিচে একই এলাকার বাতাস থেকে দুজনে শ্বাস নিয়েছে, একই বৃষ্টিতে ভিজেছেন, একই রোড গায়ে মেখেছেন কিন্তু কখনো দেখা হয়নি! তারপর দিদির বিয়ে হয়েছে, অনেক সংগ্রামের পর একটা ভদ্রস্থ চাকরি জুটেছে। চাকরি পাওয়ার পরেও বিয়ে করতে বেশ কয়েকবছর কেটে গেছে। বাবা-মা আস্তে আস্তে চোখ বুজেছে , সেও বহু বছর হলো। হঠাৎ করে প্রিয়ব্রতর চমক ভাঙলো কতকগুলো শিশুর আনন্দ- উচ্ছাস- কলরোলে। চোখ তুলে দেখলেন, একটা বেশ বড় হোটেল। ভিতরে প্রশস্ত পার্কে দোলনা, সি-স, স্লিপ ইত্যাদিতে বাচ্ছাগুলো মেতে উঠেছে, আর রাস্তার দিকে পিছন ফিরে একটা চেয়ারে বসে কি যেন করে চলেছেন এক ভদ্রমহিলা। পিছন দিক থেকে ঠিক বোঝা যাচ্ছেনা, তবে মন দিয়ে কিছু একটা করছেন, কারণ বাচ্ছাগুলোর এত চিৎকার-চেঁচামেচি ওনার মনোযোগে কোনো ব্যাঘাত ঘটাচ্ছেনা। প্রিয়ব্রত দাঁড়িয়ে গেলেন। যদিও এভাবে বাইরে থেকে হোটেলের অন্দরমহলে উঁকিঝুকি মারা কোনো ভদ্রলোকের উচিত নয়, কিন্তু এক প্রতিবর্ত টানে উনি আস্তে আস্তে হোটেলের গেটের দিকে এগিয়ে গেলেন। গেট দিয়ে ঢুকেই ওনার প্রত্যয় হলো, ইনিই তিনি, কোনো পরিশ্রম ছাড়াই অপ্রত্যাশিত এই খুঁজে পাওয়া। কিন্তু ভিতরে ঢুকতেই এক সুবেশ তরুণ হাঁসি হাঁসি মুখে এগিয়ে এলো, " নমস্কার সাব, বলিয়ে, ম্যায় আপকা কোঈ মদত কর সকতা হুঁ ?" প্রিয়ব্রতবাবুকেও বাধ্য হয়ে একটু অভিনয় করতে হলো, " ইয়ে হোটেল কে বারে মে থোড়া জনকারি লেনা হ্যায়।"

"ও বহত খুব, আইয়ে!"

ছেলেটি খুব যত্ন করে রিসেপশনে নিয়ে গেল। নিজের পরিচয় দিলো। ও এই হোটেলের ম্যানেজার। নাম সতীশ, সিমলার কাছাকাছি এক গ্রামে বাড়ি।

প্রিয়ব্রতবাবু একটু লেখালেখি করেন শুনে ওর আগ্রহ বেড়ে গেলো। হোটেলের এক কর্মীকে কফি দিতে বলে ওনাকে নিয়ে বাইরে বাগানে চললেন। আশেপাশে বেশ কয়েকটা বসার জায়গা, মাথায় ছাতা লাগানো। দিনের বেলায় সূর্য্যের তাপ আর সন্ধ্যেবেলা শিশিরের হাত থেকে মাথাকে রক্ষা করবে। কিন্তু সব ছাতার তলাতেই মানুষজন বসে আছে। প্রিয়ব্রত লক্ষ্য করলেন একমাত্র স্বাতী যেখানে বসে সেখানে ও একাই আছে। আশপাশে কয়েকটি চেয়ার খালি। সতীশেরও সেটা চোখে পড়েছে, ও হেঁসে চোখের ইশারায় আমন্ত্রণ জানিয়ে এগিয়ে গেলো, পিছন পিছন প্রিয়ব্রত চললেন। সামনে গিয়ে দেখলেন উনি মন দিয়ে সোয়েটার বুনছেন। সতীশ স্মার্ট ছেলে, কাছে গিয়ে একটু ঝুঁকে বলে উঠলো, "গুড ইভনিং মিসেস সেন, ক্যান উই সিট হিয়ার ফর এ মিনিট, ইফ য়্যূ ডোন্ট মাইন্ড!"

"সার্টেনলি! মাই প্লেজার!" বলে চোখ তুলে একবার সতীশকে আর গভীর চোখে প্রিয়ব্রতকে দেখলেন। কিন্তু মুখ-চোখের রেখায় কোথাও কোনো পূর্ব পরিচয়ের বিশ্বাস ধরা পড়লো বলে মনে হলোনা। সতীশ পাশে বসে এই হোটেলের ইতিহাস- ভূগোল, বর্তমান, ভবিষ্যতের পরিকল্পনা বলে যেতে লাগলো, আর প্রিয়ব্রত কয়েক হাত তফাতে বসে থাকা একদা ভালোবাসার মানুষটির শরীর থেকে ভেসে আসা অদ্ভুত মিষ্টি পারফিউমের গন্ধে ভাসতে ভাসতে অতিতচারী হয়ে উঠলেন.......

নদীর বালির বুকে রেখে যাওয়া জেলেদের নৌকোর খোলে অপরিসর জায়গায় পাশাপাশি বসে আছে ছেলেমেয়ে দুটি। মাথা নিচু করে আধা শোওয়া যাতে কারোর চোখে না পড়ে যায়। মেয়েটির মাথা আলতো করে ছেলেটির বুকে লেগে আছে। তখনও ওর শরীর ছুঁয়ে এরকম সুবাস ভেসে আসতো। সরাসরি না তাকিয়েও প্রিয়ব্রত বুঝতে পারে সতীশের বকবকানি , তাঁর উপস্থিতি কোনোকিছুই ভদ্রমহিলার অখন্ড মনোযোগে ভাগ বসাতে পারছেনা। কিছুক্ষণ পর ভিতর থেকে কেউ একজন সতীশকে ডাকলো। সতীশ 'এক্সকিউজ মি' বলে উঠে যেতে দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে ঘিরে সন্ধ্যের কল্পায় অখন্ড নৈশব্দ নেমে এলো। আশপাশের বাচ্ছাগুলোও কখন যেন খেলা ছেড়ে উঠে গেছে। প্রিয়ব্রত একটু সরে বসলেন। মানুষটি মুখ নিচু করে কৃত্রিম আলোয় অসম্ভব দ্রুততায় স্বপ্ন বুনেই চলেছে, এই স্বপ্নখেলায় একটা সময় তিনিও অন্যতম সঙ্গী ছিলেন। ভাবতেই চোখটা জ্বালাজ্বালা করে উঠলো। এবার পকেট থেকে পার্সটা বের করলো, সন্তর্পণে দুই আঙুলে সোনার দুলটি ধরে হাতটা বাড়িয়ে দিলো। এতক্ষন ভদ্রমহিলার মনোযোগ ভঙ্গ হলো। একটু চমকে গেলেন যেন, এই বয়সেও চোখের আকাশে বিদ্যুৎ খেলে গেলো। আবার সেই গভীর অন্তর্ভেদী দৃষ্টি।

"এটা আমি কাল ছিটকুলের রাস্তায় খুঁজে পেয়েছি।"

কিন্তু ওই কয়েক মুহূর্ত ! আবার সংহিত ভঙ্গিমায় হাত পেতে দুলটি নিয়ে মুখে বললেন, "ধন্যবাদ।" চারদিকে আবার অচেনা- অনাত্মীয় শীতল নীরবতা নেমে এলো। কয়েকমুহূর্ত বসে থেকে উঠে দাঁড়ালেন প্রিয়ব্রত, একটা ভারী দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বললেন, "আসি, ভালো থেকো।" কয়েকপা এগোতেই এতক্ষন ধরে যে কথা শোনার জন্য কান মন প্রাণ উৎকর্ণ হয়ে ছিল, শীতের কুয়াশার মতো নরম, ধোঁয়া ওঠা বায়বীয় সেই কন্ঠ ভেসে এলো, "তুমিও ভালো থেকো, প্রিয়তু!"

 

ডঃ গৌতম সরকার
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top