সিডনী শনিবার, ২৭শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১

ইন্টারভিউ জীবন অতঃপর : ড. শাহনাজ পারভীন


প্রকাশিত:
৯ নভেম্বর ২০২০ ২১:৩৭

আপডেট:
২৭ এপ্রিল ২০২৪ ১৫:০৮

 

ইফাজ ইন্টারপ্রাইজের উত্তেজনাকর ভাইভা বোর্ডের সকল সদস্যই সক্রিয়। বোর্ডের সভাপতিসহ প্রতিটি সদস্যেরই রয়েছে ব্যক্তিগত পছন্দের ক্যাণ্ডিডেট। তুলকালাম কাণ্ড চলছে একেকজন প্রার্থীর ভাইভাতে। কে কার ক্যান্ডিডেটকে পেছনে ফেলে নিজের পছন্দের প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে পারেন তার প্রতিযোগিতায় ভিতরে ভিতরে কন্টকাকীর্ণ। ইফাজ ইন্টারপ্রাইজের ইঞ্জিনিয়র থেকে শুরু করে প্রাইভেট সেক্রেটারী এবং ইফাজ ব্রিক্স এর ম্যানেজার, ড্রাইভার, কেয়ারটেকার থেকে ক্লিনারসহ প্রায় পঞ্চাশজনের নিয়োগদানের জন্য তিনটি বোর্ড বসেছে নিজস্ব হলরুমে। দেশের বাঘা বাঘা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে একেবারে স্বশিক্ষিত মধ্যবয়সী নারী-পুরুষ পোর খাওয়া জীবনকে পেছনে ফেলে এতে অংশ নিচ্ছে।
ইফাজ ইন্টারপ্রাইজের প্রধান উপদেষ্টা এই তিনটি বোর্ডের প্রধান কেমব্রীজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ. ডি ডিগ্রিধারী অত্যন্ত সুন্দরী স্মার্ট ড. আবেদা সুলতানা বোর্ডগুলো ঘুরে ঘুরে দেখছেন। তীক্ষè দৃষ্টিতে ভিডিও করছেন ভাইভা বোর্ডের চলচ্চিত্র। তিনি প্রথমেই প্রথম বোর্ডটাতে ঢু মারেন। ওখানে একজন প্রতিযোগীকে প্রথম প্রশ্নটা করছেন বোর্ডের একজন কর্মকর্তা-
: আপনি তো সাহিত্য নিয়ে পড়েছেন। বলুন তো, নাইপলের ‘জেসমিন ফুল’ আর ‘ জেসমিন’ শব্দটির মধ্যে মূল পার্থক্যটি কোথায়?
: ধন্যবাদ, এটা এমন একটা উপমা যেমন ‘ডেফোডিল’ না দেখে উডস্ওয়ার্থ পড়ার মত। বিষয়টি আমি আর একটু ক্লিয়ার করার চেষ্টা করছি। যেমন সাঈদ লিখেছেন নাইপলের একটি প্রবন্ধে আছে- লেখক ব্রিটিশ গায়ানার একটি বাগানে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করছে একটি ফুলের নাম। যেই ফুলটির গন্ধ তার চেনা। একজন বয়স্ক মহিলা বললেন-আমরা একে জেসমিন বলি; নাইপল বলছেন-তার মানে আমি এই ফুলটিকে অনেক বছর ধরে চিনি। আমার কাছে এতদিন এই নামটি বইয়ের শুধু একটি শব্দ যা আমি চিনতাম...। কিন্তু ফুল আর শব্দটি আমার মন থেকে দীর্ঘদিন বিচ্যুত থাকার ফলে আমি এই ফুল এবং তার গন্ধকে এক সঙ্গে করতে পারি নি।
আমাদের জীবনে এর সাদামাঠা ব্যাখ্যা আছে। জেসমিন- শেফালি যেটাই বলি না কেন মূলত আমাদের ঐতিহ্যের শেকড় থেকে আস্তে আস্তে সরে আসা।
: চমৎকার! আপনি মূল জায়গা ধরে টান দিয়েছেন। এবার পহেলা বৈশাখ সম্পর্কে কিছু বলুন। বিশেষ করে এর চেতনা...
: ধন্যবাদ। পহেলা বৈশাখের শেকড় ঠিক কবে আমাদের চেতনার সাথে মিশেছিল তার সঠিক ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ষোড়শ শতাব্দিরও পরে অষ্টাদশ শতাব্দিতে আমরা ভারত চন্দ্রের কাব্যে বৈশাখের বন্দনা পাই। ষোড়শ শতাব্দিতে মুকুন্দরাম লেখেন-
‘ধন্য অগ্রহায়ন মাস
ধন্য অগ্রহায়ন মাস’ অগ্রহায়নকে কেন্দ্র করেই। আর ভারতচন্দ্র লেখেন- ‘ বৈশাখ এদেশে বড় সুখের সময়’ সেই থেকেই বাঙালির প্রাণের উৎসব এটি। বিশেষ করে এদেশের সবচাইতে ধর্মনিরুপেক্ষ সর্বপ্রধান অনুষ্ঠানের পরিধি লাভ করেছে বৈশাখ।
ভাইভা বোর্ডের অন্য সদস্যরা বুঝতে পারছিলেন না ইফাজ ইন্টারপ্রাইজের প্রাইভেট সেক্রেটারিয়েট পদটার জন্য এ প্রশ্নগুলো কী খুবই প্রাসঙ্গিক কিনা? অন্য একজন কর্মকর্তা সুযোগ বুঝে অন্য প্রশ্নটি মেলে ধরেন।
: আচ্ছা, আপনার রেজাল্ট তো খুব ভালো। আপনি অন্য কোন প্রফেসনে না যেয়ে প্রাইভেট ফার্মের দিকে ঝুঁকলেন কেন?
: এই রকম একটা প্রাণোস্পর্শী প্রশ্নের জন্য ধন্যবাদ। আগাগোড়াই শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছা ছিল আমার। এজন্য সাহিত্য নিয়ে পড়াশুনা করলাম। লেখক হয়ে উঠারও চেষ্টা রয়েছে। লেখক হওয়ার জন্য শিক্ষক পদটা বড় প্রয়োজন। কিন্তু মায়ের যা সম্বল ছিল তা বিক্রি বাট্টা করে ইউনিভার্সিটির শেষ ধাপটা পার করিয়েছেন। পড়ানোর চাকুরিটার জন্য লক্ষ লক্ষ টাকার যোগান দিতে সে অপরাগ। তাই ইচ্ছের বিরুদ্ধেই এখানে আসা।
: তার মানে আপনি এর চেয়ে কোন ভাল চাকুরি পেলে এটাতে ইস্তফা দিতে পিছপা হবেন না?
: বিষয়টা ঠিক ঐ রকম নয়, তবে... তাছাড়া এখানে আমার যোগ্যতার মূল্যায়ণ হবে বলে আমার বিশ^াস।
মেয়েটির সপ্রতিভ উত্তর আবেদা বেগমের বেশ ভাল লাগলো । এখানকার সদস্যরাও বেশ অভিজ্ঞ বলে মনে হচ্ছে তার। উনি পায়ে পায়ে এগিয়ে যান দ্বিতীয় বোর্ডটাতে।
দ্বিতীয় বোর্ডের ক্যান্ডিডেটদের মৌখিক পরীক্ষা শেষে প্র্যাকটিকাল পরীক্ষার জন্য আনা হয়েছে ইফাজ ইন্টারপ্রাইজ মালিকের বাসা ঝিঙেফুল’ এ। এখানে পাঁচতলা মুল বিল্ডিং এর দোতলা বেশ খানিকটা বাড়ানো। পদ্মা ইঞ্জিনিয়ারিং এর এক্স এন ইঞ্জিনিয়র নিজে হাতে করেছিল এর প্লান। ম্যানেজার, সুপারভাইজার, টিউটর, ড্রাইভারের জন্য এ্যাটাচ্ড বাথ, বারান্দাসহ চারটে রুম। নীচের অংশে গাড়ি রাখবার ব্যবস্থা। বেশ ঘোরানো, পেঁচানো। ওখানেই মালিকের নিজস্ব সসার জীপ, ওয়াইফ- বাচ্চাদের জন্য দুটো মার্সিডিজ।ওখান থেকে যে একটা গাড়ি কোন ঝামেলা ছাড়াই সুন্দর ভাবে একবারে বের করে আনতে পারবে তাকেই মনোনয়ন দেয়া হবে। এজন্য সকলেই তাদের শ্রেষ্ট কৌশলের আশ্রয়ে নিজেদের মেধার পরীক্ষা দিতে প্রস্তুত।
অন্য আর একটা বোর্ডের দিকে পা বাড়ান ড. আবেদা সুলতানা। তৃতীয় বোর্ডটাতেও ইন্টারভিউ নিতে সকলে মহা ব্যস্ত।
: আপনার নাম?
: আমেনা বেগম। তয় আমারে সবাই আমিরন কয়।
: পিতার নাম?
: ইমান আলী বিশ্বাস।
: আপনি দরখাস্তে উল্লেখ করেছেন আপনার বয়স ত্রিশ। এটা কী ঠিক? আমার তো মনে হয়...
: ছার এডাই ঠিক। আমার বয়েস ত্রিশ অইবেই। হ, ছার যুদ্ধু তো আমি দেকছি।
: যুদ্ধ দেখছেন মানে ’৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধ?
: হ ছার, তহন তো আমার বিয়ে অইচে।
: বিয়ে হয়েছে মানে? তার কতদিন আগে আপনার বিয়ে হয়েছে?
: তহন আমার ছেলেডা আর মেয়েডা অইচে। আর যেই ছেলেডা বুবুক্কে মরলো হেইডা ছিল প্যাডে।
: তার মানে যুদ্ধের বছর দশেক আগে আপনার বিয়ে হইছে?
: না, না, অত অবে না ছার। যুদ্ধুর সাত বছর আগে আমার বিয়ে অইছে। বিয়ের তিন বছর পর আমার প্রথম ছাওয়ালডা, তার দুই বছর পর মেয়েডা।
: কত বছর বয়সে আপনার বিয়ে হয়েছে?
: অত কি আর মনে আছে ছার? কম বয়সেই বিয়ে অইচে। এখনকার মায়েগের মত গরে বেছন রাকতো না ছার। সাবালক অইছি বার তের বছরে তার তিন চার বছর পরই বিয়ে অইছে।
: বুঝেছি, আপনার বয়স তো পঞ্চান্ন ষাটের মাঝামাঝি কিন্তু চুল তো পাকি নি একটাও...
: কী যে কন ছার, আমার মার তাই পাকিনি। আমার নানীরও পাকিনি। আমার তো তাও একটা দু’একটা পাকছে। পাকপেই বা না ক্যান। নানান চিন্তাই আমার মাথা গরম।
: মাথা গরম হবে না। আপনার বয়স ষাট, লিখেছেন ত্রিশ।
খেই হারিয়ে ফেলেন যেন ইন্টারভিই নিতে এসে। সামান্য একটা পোষ্ট, এখানেও কত ক্যান্ডিডেটের ছড়াছড়ি, যোগাযোগের দৌঁড়াদৌঁড়ি...
: আমি কি আর অত কিছু জানি ছার? আমারে যা জিগালেন আমি তার উত্তর দিলাম। এইবার আমি আপনাগেরে এট্টা প্রশ্ন জিগাই ছার-
অন্যপক্ষকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই শুরু করে আমেনা -
: আমারে কইছে রানতে অইবো, ঘর অপিস দেখে রাকতে অইবো। অফিসের লোকজন সব খাবে, থাকপে। তা আমার বয়সখান নিয়া অত টানাহ্যাচড়া করতেছেন ক্যান ছার? আমারে জিগান আমি রানবার পারি কিনা? আমি ছার ভালোই গোস -পুলাও- সব পারি। সোয়ামির হোটেল ছিল। আমিই তো সব করতাম। সে সব না, কনে আমার বয়স কত?
আমেনা বেগমের মেজাজখানা চড়ে গেল ওদের কৌশল দেখে। ও তো ভাবছে উনারা ওর জীবন নিয়া গল্প শুনতাছে। তা না, অহন দেহি, গল্পে গল্পে বয়সের হিসাব কষতাছে। তাইলে কী আর ঐসব গল্প করতাম। মনে মনে বলে আমার কী এমন বয়স। বয়স যদি দেখবার চান তো মওলানা সাহেবের বউয়ের বয়স দেহন লাগে। কত যে বয়স...। তার ছেলের বয়স চল্লিশ...তার বয়স পয়ত্রিশ। বোঝো ঠেলা? আমি কি আর তাই নাকি? ঐ যে যুদ্ধু ও তো সবারই জানা। কারো বয়স কেউ ঢাকপার পারবি না। আমেনার নিজের চুল নিজেরই ছিঁড়তে ইচ্ছে করে। চাকরি অবে না, তা না অবে। ঢেকি স্বর্গে গেলিও লাতি খাতি অয়। তো কাম-কামই। বাসা বাড়ির কামও কাম, অফিসির কামও কাম। ঐ অলো। আইছি কম ঠিক করতি আর ঊনরা বয়েস নিয়ে করছে টানাটানি। কি যে দ্যাশটা অইলো? এই বুড়ো বয়সে আমি বয়েস দিয়ে কি আর করবো? আমার এক পা তো রইচে গোরে।
: এইবার কন দেহি ছার, আমার চাকরিডা কী অইবো?
আমেনা শান্ত হয়। ভেতরে ভেতরে খানিকটা আশাবাদীও। যা হোক, মুকির উপর দুটো কতা তো কইছে সে।
: আপনার বয়স যদি ত্রিশ হতো, আমরা চেষ্টা করতাম, কিন্তু আপনার বয়স তো দ্বিগুন।
: আবার ঐ একই কতা? আমার বয়েস দিয়ে কী করবেন ছার? একি আর সরকারী চাকরি যে বয়েস লগবি?
: ওসব আপনি বুঝবেন না, এই চাকুরির জন্য আপনি কাকে ধরেছেন?
আমিরণ বিপাকে পড়ে যায়। এইটাতো কওন মানা। কিন্তু উনারা শুনলো কোন জাগাত্তে। মনে অয় উনারা সবই জানেন। মিত্তে কতা কয়েও কোন লাব নেই। এমনিতেও আমিরণ মিত্তে কতা কয় না। এই সৎগুন আছে তার। মনে মনে সাত পাঁচ ভাবে আমেনা। সে স্পষ্ট বলল-
: কমিশনাররে দরছি ছার। মহিলা কমিশনার গুলজার বেগম আফারে-উনারে কইছি। বোজেন তো বয়েস অইচে। চাওয়ালডা দেহে না। মেয়েডাও গরীর। মা রইচে আমার কাছে। নানী রইচে। কী করব ছার। হঠাৎই হতাশায় আটকে যায় আমিরনের গলা।
: ঐ তো ঝামেলা। কিন্তু আপনার শরীরটাও বেশ ভারি। এত মোটাসোটা যে বয়সটাও লুকানো যাচ্ছে না। আমরাই বা কি করব বলুন?
গুলজার বেগমের সুহৃদ তরুণ ছেলেটা আমিনা বেগমের মুখে যেন মায়ের আদল খুঁজে পায়।
: একদিকে মালিকের চাপ, অন্যদিকে...। এদিকে আপনাদের চাপ। চাপে চাপে আমরা তো কাহিল।
নেক্সট...
আমেনা ভাইভা বোর্ড থেকে বেরোতে বেরোতে নিজের বয়সটাকে যেন অভিসম্পাৎ করে-
: হায় আল্লাহ, টাকা, পয়সা, রূপ, যৌবন না বাড়াইয়া শুধু বয়েসটাই বাড়াইলা...
ড. আবেদা বেগম আমেনা বেগমের কথায় হুঁচোট খায়। চোখ যায় নিজের শরীরের দিকে। তার বয়সও আমেনা বেগমের মতই। কিন্তু টাকা- পয়সা, রূপ- সৌন্দর্য সবই বেড়েছে শুধু বয়সটাই যেন বাড়েনি তার!

 

ড. শাহনাজ পারভীন
কবি, গবেষক, কথাসাহিত্যিক, উপশহর মহিলা কলেজ, যশোর

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top